রামপলের অন্তর্ধান রহস্য – রূপক সাহা

পৌলোমী সেনগুপ্ত

দিল্লি থেকে জয়দীপ এসেছে ইডেনের ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ওয়ান ডে ম্যাচ কভার করতে। ওকে ডিনার খাওয়াব বলে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম। জয়দীপ হিন্দুস্থান টাইমস-এর রিপোর্টার। অনেকদিনের বন্ধু। আমি কোনও কাজে দিল্লিতে গেলে রোজই দেখা করতে আসে। মাঝেমধ্যে রেস্তরাঁয় টেনে নিয়ে যায়। ওকে একদিন না খাওয়ালে খুব বাজে ব্যাপার হবে। হোটেল থেকে জয়দীপকে তুলে নিয়ে, রোয়িং ক্লাবে যাব, এই আমার প্ল্যান।

সারাটা দিন খুব ধকল গেছে। সকালের দিকে ইডেনে প্র্যাকটিস করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ব্রায়ান লারার ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য ইডেনে গিয়েছিলাম। ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমের লোকাল ম্যানেজার অম্বিকাদা। তিনি ব্যবস্থা করে দিলেন। টানা পঁয়তাল্লিশ মিনিট কথা বলেছি লারার সঙ্গে। দুপুরে অফিসে বসে সেই ইন্টারভিউ লিখেছি। শচীন সম্পর্কে কয়েকটা ভাল মন্তব্য করেছেন লারা। অন্য কোনও রিপোর্টার সে-সব পায়নি। মনটা তাই খুশি।

সকালে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় ফুল্লরা বলেছিল, “আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরো।” ফুল্লরা আমার স্ত্রী। আমাদের পেশার ঝকমারির কথা ও জানে। অন্যদিন বলে, “আজ একটু তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা কোরো।” সাংবাদিকদের কাজের সময়ের কোনও মা-বাপ নেই। কোনওদিন সন্ধে সাতটায় কাজ শেষ হয়ে যায়। কোনওদিন হয়তো রাত একটা পর্যন্ত অফিসে পড়ে থাকতে হয়। সেইজন্য সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার অনুরোধ এলেই বলি, “যাওয়ার চেষ্টা করব।” সেই চেষ্টা বেশিরভাগ দিন ফলবতী হয় না। এমন ভাগ্য, যেদিন কোনও অনুষ্ঠান থাকে, সেদিনই অফিসে বেশি কাজ পড়ে যায়। হয়তো অফিস থেকে বেরোতে যাচ্ছি, এমন সময় বড় কোনও খবর হয়ে যায়। তখন বেরোতে পারা যায় না। তাই আজও ফুল্লরাকে বলে এসেছি, “চেষ্টা করব।”

জয়দীপ রয়েছে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে। সেখানে গিয়ে খোঁজ করতেই রিসেপশনিস্ট ভদ্রমহিলা বললেন, “মি. বাসু ওঁর রিপোর্ট ফ্যাক্স করার জন্য সি টি ও গেছেন। আপনি কি কোনও মেসেজ রেখে যাবেন?”

একটু হতাশ হয়েই বললাম, “এক টুকরো কাগজ দিন তা হলে?”

একটা বোকামি করেছি। দুপুরে জয়দীপের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ইডেনে। তখনই ডিনারের কথা ওকে বলে দেওয়া উচিত ছিল। তখন খোলসা করে কিছু বলিনি। শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম, “সন্ধের দিকে তুই কখন ফ্রি হবি জয়দীপ?” ও বলেছিল, “মনে হচ্ছে সাতটা নাগাদ।” তখন আমি বলেছিলাম, “আমি একবার তোর হোটেলে যাব।” ও বলেছিল, “চেষ্টা করব, থাকতে।” চেষ্টা কথাটা শুনে আমি মনে মনে হেসেছিলাম।

দিল্লিতে রিপোর্ট পাঠিয়ে জয়দীপ কখন হোটেলে ফিরবে, রিসেপশনিস্টের পক্ষে সেটা বলা সম্ভব না। তাই চিরকুটে লিখে দিলাম, “তোর খোঁজে এসেছিলাম, আজ রাতে একসঙ্গে ডিনার করব বলে। আমি অফিসে ফিরে যাচ্ছি। তুই ফিরেই আমাকে একবার ফোন করবি—কালকেতু নন্দী।”

গ্রেট ইস্টার্ন থেকে আমাদের অফিস হাঁটাপথ। পাঁচ মিনিটও লাগে না। ওয়াটারলু স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে আসার সময় হঠাৎ পকেটে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল।

“হ্যালো, কালকেতুদা, সব্যসাচী বলছি।”

“বলো।”

“অম্বিকাদা, আপনাকে ফোন করেছিল। খুব আর্জেন্ট ব্যাপার। এখনই রিং ব্যাক করতে বলেছে আপনাকে।”

“ঠিক আছে শোনো, সব কপি প্রেসে পাঠিয়ে দিয়েছ?”

“হ্যাঁ। আপনি কি ফিববেন?”

“এক্ষুনি আসছি।”

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অফিসে পৌঁছে গেলাম। হাতঘড়িতে দেখি, সওয়া সাতটা বাজে। স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টে বসে রয়েছে কৌশিক। ওর নাইট ডিউটি। বাকিরা সারাদিন খুব খাটাখাটনি করেছে। তাই বাড়ি চলে গেছে। কৌশিককে বললাম, “তাজ বেঙ্গলে অম্বিকা ব্যানার্জিকে ফোনে একটু ধরো। আমি নেটওয়ার্ক থেকে আসছি। দেখি, ভাল কোনও ছবি পাওয়া যায় কি না।”

কৌশিক বলল, “কালকেতুদা, একটু আগে আপনার বাড়ি থেকে ফুল্লরাদি ফোন করেছিল। আপনাকে একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলেছে।”

শুনে বললাম, “ঠিক আছে।” তেমন আর্জেন্ট নিশ্চয়ই নয়। তা হলে ফুল্লরা আমাকে মোবাইলে ধরে নিত। বাড়িতে পরে ফোন করা যাবে, ভেবে নেটওয়ার্কে গেলাম। বুয়েনস আইরেসে কাল রাতে খেলা ছিল আর্জেন্তিনার সঙ্গে ইকুয়েডরের। প্রি-ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবলের খুব গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। জিতে আর্জেন্তিনা মূলপর্বে চলে গেছে। সেই ম্যাচের ছবি আসবে নেটওয়ার্কে। আমার দরকার। ওই ডিপার্টমেন্টে কাজ করে গোপাল বলে একটা ছেলে। আমাকে দেখামাত্রই বলে উঠল, “কালকেতুদা, কলম্বিয়া ম্যাচের একটা ভাল ছবি এসেছে। ফাউস্তিনো আসপ্রিয়ার। নেবেন?”

“আর্জেন্তিনার কোনও ছবি আসেনি?”

“না। এ এফ পি ওই একটা ছবিই আজ পাঠিয়েছে।”

“ঠিক আছে, তা হলে আসপ্রিয়ার ছবিটাই তিন কলাম পাঠিয়ে দাও।”

“কালকেতুদা, একটা রিকোয়েস্ট করব। যদি কিছু মনে না করেন।”

শুনে মনে মনে হাসলাম। আমি জানি, গোপাল কী অনুরোধ করতে পারে। নিশ্চয়ই কালকের ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচের একটা টিকিট। চাইবার আগেই পকেট থেকে একটা টিকিট বের করে ওকে দিয়ে দিলাম। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল গোপালের।

ডিপার্টমেন্টে ফিরে আসতেই কৌশিক বলল, “অম্বিকাদা লাইনে রয়েছেন। কথা বলুন।”

তাড়াতাড়ি ওর হাত থেকে রিসিভারটা নিয়ে বললাম, “কী ব্যাপার অম্বিকাদা? কোনও খবর আছে নাকি?”

ও-প্রান্তে গলায় উদ্বেগ। অম্বিকাদা বললেন, “আর খবর! কালকেতুভাই, এতদিন অন্যদের খবর তোমাকে দিতাম। এবার বোধহয় নিজেই খবর হতে হবে।”

“কী হল অম্বিকাদা?”

“লয়েড আমার ওপর প্রচণ্ড চটে গেছে।”

লয়েড মানে ক্লাইভ লয়েড। ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমের ম্যানেজার হয়ে এসেছেন। অম্বিকাদার সঙ্গে লয়েডের খুব খাতির। অনেক বছর ধরেই। একবার নাকি লয়েড অম্বিকাদার হাওড়ার বাড়িতেও নেমন্তন্ন খেতে গেছিলেন। সেই গল্প উনি খুব করেন। যার সঙ্গে এত দহরম-মহরম, হঠাৎ তিনি খেপে গেলেন কেন, বুঝতে পারলাম না। তাই জিজ্ঞেস করলাম, “খুলে বলুন তো কী হয়েছে।”

“কী আর হবে? অ্যাদ্দিন ধরে যে সুনামটা ছিল, এক্কেবারে নষ্ট হয়ে গেল ভাই। লয়েড বলছে, আমার নামে কমপ্লেন করবে। আরে বাবা, তোর টিমের প্লেয়ার। সামলাবি তুই। কখন বেরিয়ে, কোথায় গেল—সে-খবরও আমাকে রাখতে হবে?”

“কার কথা বলছেন অম্বিকাদা?”

“আবার কে? কিষাণ নারায়ণ রামপল। দুপুরে প্র্যাকটিস সেরে এসে আমাকে বলল, একটা গাড়ি দিতে হবে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফিরে আসবে। লাঞ্চের পর এদের কেউ শপিংয়ে যায়। কেউ বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতে। তখন ভাবিনি, ছোঁড়া আমাকে এমন বিপদে ফেলে দেবে। বেলা দুটোর সময় সেই যে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে, এখনও পাত্তা নেই। লয়েড এখন আমাকেই দুষছে। কেন ওকে জিজ্ঞেস না করে রামপলকে গাড়ি দিয়েছি।”

কিষাণ নারায়ণ রামপল ছেলেটা ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমে সর্বকনিষ্ঠ। বয়স মাত্র বোলো বছর সাত মাস। এত কম বয়সে ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমে আর কেউ ঢোকেনি। অলরাউন্ডার। বাঁ হাতে ব্যাট করে। ডান হাতে বল। ইয়র্কশায়ার আর ল্যাঙ্কাশায়ার ওকে নিয়ে টানাটানি করছে কাউন্টি লিগে খেলাবার জন্য। ছেলেটার আর একটা পরিচয়ও আছে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ওর বাবা বার্বাডোজ সরকারের অর্থমন্ত্রী। রামপল টিমে ঢোকার পর থেকেই ভারতের কাগজে ওকে নিয়ে প্রচুর লেখালেখি চলছে। অম্বিকাদার চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। ছেলেটার যদি কিছু হয়, তা হলে হইচই পড়ে যাবে। গেল কোথায় রামপল?

প্রথম যে প্রশ্নটা মনে এল, জিজ্ঞেস করলাম, “ছেলেটা যে গাড়িতে গিয়েছিল, সেটা এখন কোথায়?”

“ফিরে এসেছে। ব্যাটা ড্রাইভার এখন যা বলছে, তাতে তো আমার প্যালপিটিশন আরও বেড়ে গেছে। শাড়ি কেনার জন্য রামপল বড়বাজার গিয়েছিল। রাজা কাটরার কাছে একটা দোকানে। ওখানে গাড়ি পার্ক করা যায় না। তাই ড্রাইভার বলেছিল, ঘোরাঘুরি করে আধ ঘণ্টা পর ও দোকানের সামনে এসে দাঁড়াবে। ঠিক টাইমে দোকানের সামনে গিয়ে ও দেখে, রামপল নেই। তাই ফিরে এসেছে। কী করা যায়, বলো তো ভাই। কাল খেলা। লয়েড এই প্রথম ওকে নামাবে। এখন বলছে, যেখান থেকে পারো, ওকে খুঁজে আনা চাই।”

“পুলিশকে খবর দিয়েছেন?”

“আই বি’র লোকদের এইমাত্র বললাম। ওরা যা বলল, তাতে তো আমার গা হিম হয়ে যাচ্ছে ভাই। বড়বাজার মানে বেটিংয়ের জায়গা। যদি কোনও বুকমেকারের পাল্লায় পড়ে, তা হলে আমি গেলাম। কালকেতুভাই, তুমি কেসটা নেবে? পারলে তুমিই পারবে। এর আগে অনেক কেস তুমি সল্‌ভ করে দিয়েছ। লয়েড আলটিমেটাম দিয়েছে, রাত বারোটার মধ্যে রামপল যদি না ফেরে, তা হলে এমব্যাসিতে জানিয়ে দেবে। এখনও কেউ খবরটা জানে না। ভাই, তুমি আমাকে বাঁচাও।”

গলা শুনে মনে হল, অম্বিকাদা ভেঙে পড়েছেন। সত্যিই উনি এখন বিপদের মধ্যে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সাড়ে সাতটা। অর্থাৎ আর সাড়ে চার ঘণ্টার মতো সময় হাতে। এত বড় শহর কলকাতা। রামপল কোথায়, এইটুকু সময়ের মধ্যে বের করা সম্ভব? অম্বিকাদার সন্দেহটাও অমূলক নয়। রামপলকে নিয়ে আমরা কলকাতার সব কাগজই, দিন কয়েক ধরে প্রচুর লেখালেখি করেছি। ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত বলেই নয়, প্রতিভাবানও। ইংল্যান্ডে গ্রেম হিককে নিয়ে যেরকম নাচানাচি হয়েছিল একসময়, রামপলকে নিয়েও সেরকম প্রচার হয়েছে। ক্রিকেটের সামান্য খবর রাখে, এরকম লোক রাস্তাঘাটে ওকে দেখে চিনতে বাধ্য।

অম্বিকাদাকে বললাম, “আপনি এত উতলা হবেন না। দেখি, কী করতে পারি। একটা ইনফর্মেশন দিন তো। রামপল বড়বাজারের ঠিক কোন দোকানে শাড়ি কিনতে ঢুকেছিল? ড্রাইভারটা কি বলেছে?”

“বলেছে। রূপসী নামে একটা দোকানে। রাজা কাটরার কাছাকাছি কোথাও হবে।”

“ঠিক আছে। আপনি হোটেলেই থাকুন। অন্য কোথাও যাবেন না। আমার একটা মুশকিল হয়ে গেল। জয়দীপ বাসুকে তো চেনেন। হিন্দুস্থান টাইমসের। ওকে ডিনার খাওয়াব বলে হোটেলে থাকতে বলেছি। বেচারা না খেয়ে বসে থাকবে। আপনি ওকে ফোন করে একটু বলে দেবেন, আমার জন্য যেন অপেক্ষা না করে। এখন ওকে হোটেলে পাব না। যদি পারি, পরে মোবাইলেও আমি ওকে ধরার চেষ্টা করব।”

“ও-সব তুমি ভেবো না ভাই। ওকে আমি গ্র্যান্ডে ডিনার খাওয়াবার ব্যবস্থা করছি। তুমি এ-দিকটা দ্যাখো। আমাকে বাঁচাও।”

ফোন রেখে দিয়েই নীচে নেমে এলাম। বড়বাজারে ‘রূপসী’ নামে সেই দোকানটায় একবার যাওয়া দরকার। দোকানের কর্মীদের সঙ্গে কথা বললে হয়তো কোনও ক্লু পাওয়া গেলেও যেতে পারে। আমাদের অফিস থেকে বড়বাজার এমন কিছু দূরে নয়। মারুতিতে গেলে মিনিট দশেকও লাগবে না। রাত পৌনে আটটায় রাস্তায় লোকজন কম। সময় আরও কম লাগবে। তবে দোকানটা খোলা পেলে হয়!

নীচে নেমে মারুতি বের করে বেরোতেই দেখি, অমিতাভ। ‘দৈনিক প্রভাত’ কাগজের রিপোর্টার। হনহন করে হাঁটছে। হঠাৎ চোখাচোখি হয়ে গেল। আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর নিচু হয়ে বলল, “কোথায় যাচ্ছিস রে কালকেতু? বাড়ির দিকে নাকি?”

মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, বড়বাজার। সামনে নিলাম। এত রাতে বড়বাজার বললে অমিতাভর সন্দেহ হতে পারে। পরক্ষণেই হয়তো বলে বসবে, ‘বেটিং নিয়ে কোনও স্টোরি করতে যাচ্ছিস বুঝি! আমিও যাচ্ছিলাম। চল, একসঙ্গে যাই।’ ছেলেটা যেমন ধূর্ত, তেমনই অসৎ। বছর তিনেক আগে একটা ইন্টারভিউ ছাপিয়েছিল ভিভিয়ান রিচার্ডসের। যা কিনা আদৌ ও নেয়নি। ক্রিকেট রিপোর্টাররা একটু চালিয়াত ধরনের হয়। ক্রিকেটারদের সঙ্গে ওঠা-বসা করে বলে মনে করে, ক্রিকেটারদের মতোই ওরা খুব গ্ল্যামারাস। শচীন-আজহারদের নিয়ে কত গল্প? সত্যি-মিথ্যে যা বলে, লোকে হাঁ করে শোনে। কয়েকজন ক্রিকেট রিপোর্টারকে তো আমি নিজের চোখে ক্রিকেটারদের সুটকেস বইতে দেখেছি।

অমিতাভও এই ধরনের রিপোর্টার। ওকে কাটাবার জন্য বললাম, “না রে, আমি বেহালার দিকে যাচ্ছি। তা, আজ কী এক্সকুসিভ খবর করলি?”

“কাগজে কাল দেখিস। তোকে বলতে তো বাধা নেই। জানি, তুই লিখে দিবি না। দারুণ একটা ইন্টারভিউ পেয়েছি রে! রামপলের। আমরা বড় করে ছাপছি।”

“তাই নাকি! বাঃ। কী বলেছে রামপল?”

“বলেছে, ও ইন্ডিয়াতে চলে আসতে চায়। বার্বাডোজে নাকি ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা ঠিক সম্মান পায় না। ওর বাবা ফাইনান্স মিনিস্টার বলে ওদের কোনও অসুবিধে হয় না। তবে অন্যদের কাহিল অবস্থা…”

অমিতাভ আরও কীসব বলে যাচ্ছে। শুনে রাগ হয়ে গেল আমার। এই ইন্টারভিউটাও ভিভিয়ান রিচার্ডসের মতো নেওয়া। তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য বললাম, “বাঃ, চমৎকার। কাল নিশ্চয়ই তোদর কাগজ দেখব। কখন নিলি তুই রামপলের ইন্টারভিউটা?”

“বিকেল পাঁচটায়। আর কেউ ছিল না, বুঝলি। গ্র্যান্ডের সুইমিং পুলের ধারে তখন একা বসেছিল রামপল। প্রায় ঘণ্টাখানেক কথা বলল আমার সঙ্গে। জানি না, এত কথা বলার পর, কাল হইচই হলে, রামপল অস্বীকার করবে কি না।”

এবার সত্যিই রাগ বাড়ছে অমিতাভর ওপর। অম্বিকাদার কথামতো রামপল দুপুরের পর থেকেই উধাও। অমিতাভ ওকে হোটেলে পেল কী করে? তবুও মুখে হাসি এনে বললাম, “ইন্টারভিউটা টেপ করিসনি?”

“না রে। সেটাই ভুল করেছি। টেপ রেকর্ডারটা সঙ্গে নিয়ে রাখলে ভাল করতাম।”

পেছন থেকে অন্য একটা গাড়ি অধৈর্য হয়ে হর্ন দিচ্ছে। তাই অমিতাভকে বললাম, “চলি রে। কাল মাঠে দেখা হবে।” বলেই গাড়িতে স্টার্ট দিলাম। পাঁচ-সাতটা মিনিট নষ্ট হয়ে গেল। অমিতাভর মতো রিপোর্টারদের জন্যই আজ এত বদনাম আমাদের। একদিন একটা মিথ্যে কথা লিখে, আস্থা নষ্ট করার কী দরকার, আমি বুঝি না। পাঠকরা ঠিক মনে রাখে। কোন সাংবাদিক মতলববাজ। যাকগে, অমিতাভকে নিয়ে ভাবার সময় নেই। রামপলকে খুঁজে বের করতে হবে। ব্র্যাবোর্ন রোডের দিকে গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম। ক্রীড়াসাংবাদিকতা করার মাঝে আমাকে আজকাল গোয়েন্দাগিরিও করতে হচ্ছে। ছোটবেলায় ইচ্ছে ছিল, গোয়েন্দা হব। হলাম সাংবাদিক। এই পেশাটাও অবশ্য খানিকটা গোয়েন্দাদের মতো। গোপন খবর বের করার মধ্যে যে আনন্দ আছে, তা আমরাই শুধু টের পাই।

মিনিট সাতেকের মধ্যেই বড়বাজারে গিয়ে খুঁজে বের করলাম রূপসী দোকানটা। সবে বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন দোকানের এক কর্মচারী। সেই সময়, বলতে গেলে, একটু ধমক দিয়েই ভেতরে ঢুকলাম। বেশ বড় দোকান। বারো-চোদ্দোজন কর্মচারী তখন শাড়ি পাট করে শো-কেসে তুলে তুলে রাখছেন। সারাদিন খদ্দেররা পাঁচটা শাড়ি দেখেন, একটা কেনেন। এ-সব ব্যবসায় অসম্ভব ধৈর্য দরকার।

আমাকে দেখেই পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সি একটা ছেলে ক্যাশ কাউন্টার থেকে উঠে এল। তারপর বলল, “আপনি কালকেতু নন্দী, না?”

বললাম, “হ্যাঁ। আমাকে চেনেন?”

“চিনি। আপনি একবার আমার ভাইয়ের ইন্টারভিউ নিতে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন।”

শুনে একটু অবাক হয়ে গেলাম। সারাদিনে কত লোকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। সবাইকে মনে রাখা সম্ভব হয় না। লোকে কিন্তু আমাদের ঠিক মনে রাখে। ছেলেটা বলল, “আমার ভাই প্রসেনজিৎ বিষয়ী গত বছর গুডরিক দাবায় খুব ভাল খেলেছিল। আপনি ছবি দিয়ে ওর সম্পর্কে একটা লেখা বের করেছিলেন। বলুন, কী সাহায্য করতে পারি আপনাকে। কিছু কিনবেন? এটা আমাদেরই দোকান।”

“না ভাই। অন্য একটা ব্যাপারে এসেছি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমের ক্রিকেটার রামপল আজ দুপুরে আপনাদের দোকানে শাড়ি কিনতে এসেছিল?”

“হ্যাঁ। তখন আমি ছিলাম না। বাড়িতে লাঞ্চ করতে গেছিলাম। কেন বলুন তো?”

“সে-ব্যাপারেই একটু জানতে এসেছিলাম।’

দোকানের অন্য কর্মচারীরা সবাই আমার দিকে তাকিয়ে। একজন বলল, “ফরেনার লোকটা পাঁচটা শাড়ি কিনে নিয়ে গেছে।”

ঘুরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “সঙ্গে কেউ ছিল?’

“না। ফরেনার লোকটা এসেই শো-কেসে টাঙানো শাড়িগুলো দেখিয়ে নামাতে বলল। দামও জানতে চাইল না।”

এবার দোকানের মালিক সেই ছেলেটা বলল, “অত জিজ্ঞেস করার দরকার নেই কালকেতুবাবু। আমাদের দোকানে স্পেশ্যাল একটা ব্যবস্থা আছে। সারাদিন কারা এল গেল, আমরা ভিডিওতে মনিটর করি। আপনি ক্যাসেট নিয়ে যান। কথাবার্তাও পেয়ে যাবেন।”

কলকাতার কয়েকটা বড় বড় শো-রুমে ইদানীং এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে। চুরি-ডাকাতি রোধের জন্য দোকানের কয়েকটা গোপন জায়গায় ক্যামেরা লুকনো থাকে। দূরে, অন্য কোথাও একজন টিভি পর্দার সামনে বসে সব লক্ষ রাখে। ছেলেটা ক্যাসেট দিতে চাইছে। কিন্তু এখন নিয়ে লাভ নেই। দেখব কোথায়? সময় চলে যাচ্ছে হু হু করে। ক্যাসেট দোকানে বসেই দেখে নিলে সময় বাঁচানো যাবে। তাই বললাম, “এক্ষুনি দেখা যাবে ক্যাসেট?”

“দেখতে পারেন।” বলেই ছেলেটা ইশারা করল একজনকে, “আপনি এর সঙ্গে যান। আমি হিসেবপত্র করে আসছি।”

লোকটার সঙ্গে, পাশের দরজা দিয়ে অন্য একটা ঘরে ঢুকলাম। একটা টেবলের ওপর টিভি সেট। তার সামনে রিভলভিং চেয়ার। লোকটা আমাকে বসতে বলে, পাশের তাক থেকে একটা ক্যাসেট নিয়ে রিওয়াইন্ড করতে লাগল। মিনিটদশেক পর বলল, “এই যে, দেখুন।”

টিভির পর্দায় রামপলের ছবি। ছেলেটা বাঙালিদের মতো দেখতে। তবে চুল কোঁকড়ানো। দোকানে ঢোকার পরই ছেলেটা ঘুরে ঘুরে শো-কেসে ঝোলানো শাড়ি দেখতে লাগল। আশপাশে কয়েকটা মেয়ে শাড়ি পছন্দে ব্যস্ত। হঠাৎ একটা মেয়ে চিনতে পারল রামপলকে। সে পাশের মেয়েটাকে কী যেন বলল ফিসফিস করে। প্রথম মেয়েটা এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে শুরু করল। অন্য মেয়েটা সাইড ব্যাগ থেকে একটা খাতা বের করে অটোগ্রাফ চাইছে। ঠোঁট নড়ছে। কিন্তু কথা শুনতে পাচ্ছি না। রামপলের চারপাশে ভিড় জমে গেছে। ক্যাশ কাউন্টার থেকে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বয়স্ক এক ভদ্রলোক উঠে এলেন। একটা চেয়ার এগিয়ে দেওয়া হল রামপলের দিকে।

পর্দার দিকে তাকিয়ে খুঁটিনাটি দেখছি। মেয়ে দুটো আঠার মতো লেগে রয়েছে রামপলের সঙ্গে। বোধহয় কলেজে পড়ে। একজন কর্মচারী সফ্‌ট ড্রিঙ্কসের একটা বোতল এগিয়ে দিলেন। রামপল সেটা নিল না। ও ব্যস্ত ভাবে শাড়িগুলো দিতে বলল। পকেট থেকে পার্স বের করে টাকা গুনে দিচ্ছে। তারপর পাশ ফিরে কী যেন জিজ্ঞেস করল প্রথম মেয়েটাকে। সেই মেয়েটা হাত নেড়ে নির্দেশ দিচ্ছে। বোধহয় কোথাও যেতে চাইছে রামপল। মেয়েটা রাস্তা বলে দিচ্ছে।

দোকানের যে কর্মচারীটা ক্যাসেট চালিয়েছিল, তাকে বললাম, “সাউন্ডটা বাড়িয়ে দেবেন? কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি না। তার আগে একটু রিওয়াইন্ড করে দিন।”

লোকটা সাউন্ড বাড়িয়ে দিতেই শুনলাম, রামপল ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করছে, “বলতে পারো, এখানে সুতান আটি বলে জায়গাটা কোথায়? কীভাবে যেতে হবে?”

“সুতান আটি বলে কোনও জায়গা নেই। সুতাপট্টি আছে। এখান থেকে কাছেই। হেঁটেও যেতে পারেন। আপনি কি কিছু কিনবেন?”

“না, আমি একজনের সঙ্গে দেখা করতে চাই।”

“চলুন, আমরাই নিয়ে যাচ্ছি। আমার নাম শ্রীময়ী। এ আমার বন্ধু সুভদ্রা। আমরা আপনার ফ্যান।”

“থ্যাঙ্কস।”

একটু পরেই হাতে শাড়ির প্যাকেট নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল রামপল। তার পেছনে সেই দুটি মেয়ে।

ক্যাসেটে আর কিছু দেখার নেই। কিন্তু হঠাৎই চোখে পড়ল, ষণ্ডামতো একটা লোক ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে কার সঙ্গে নে কথা বলছে। কথা বলতে বলতেই লোকটা দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। ঠিক বুঝলাম না, লোকটা রামপলদের পিছু নিল কি না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। নাহ, বড়বাজারে এসে আমার কোনও লাভ হল না।

দোকানের কর্মচারীটি এইসময় বলল, “ক্যাসেটটা কি বের করে নেব সার? না, আর একবার দেখবেন?”

“দরকার নেই।”

হঠাৎই কী মনে হল, জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, ওই ক্রিকেট প্লেয়ারটার সঙ্গে যে দুটো মেয়ে কথা বলছিল, তারা কি আপনাদের রেগুলার কাস্টমার?”

“হ্যাঁ সার। ওদের চিনি। রতনলাল বসাক স্ট্রিটে থাকে।”

“বাড়ি চেনেন?”

“চিনি সার। তারাসুন্দরী পার্কের কাছে ওদের বিরাট বাড়ি। একজনের বাবা হাইকোর্টের বড় উকিল। পুতান মল্লিক।”

“আমাকে নিয়ে যেতে পারবেন?”

“আপনি একবার ছোটবাবুর সঙ্গে কথা বলুন!”

ছোটবাবু মানে, দোকানের সেই মালিক ছেলেটি। একবার অনুরোধ করতেই সে রাজি হয়ে গেল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই, মারুতি করে হাজির হলাম তারাসুন্দরী পার্কের কাছে। ছেলেবেলায় এই অঞ্চলটায় বহু বছর কাটিয়েছি। আমরা তখন থাকতাম ১৩ নম্বর বসাক স্ট্রিটে। পড়তাম সিটি জুবিলি স্কুলে। ছুটির পর পার্কের মাঠে রোজ খেলতাম। হাতের তালুর মতো চেনা প্রতিটি বাড়ি। দোকানের কর্মচারীটার সঙ্গে যে-বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, মনে পড়ে গেল, সেটা সুকুমার মল্লিকদের বাড়ি। সুকুমার আমার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ত সিটি জুবিলিতে। এখন হাইকোর্টের নামী ল’ইয়ার।

বাড়ির একতলায় ল’ইয়ারের চেম্বার। সেখানে বসে রয়েছেন ফরসা, মোটাসোটা একজন মাঝবয়সি ভদ্রলোক। ঘরে ঢুকে নিজের পরিচয় দিতেই ভদ্রলোক বলে উঠলেন, “আরে, কী সৌভাগ্য। আপনার লেখার খুব ভক্ত আমরা। বসুন। বলুন কী করতে পারি আপনার জন্য? আমারই নাম পুতান মল্লিক।”

শ্রীময়ীর কথা তুলে, রামপলের অন্তর্ধানের খবরটা দিতে পুতান মল্লিক বললেন, “এ তো সিরিয়াস ব্যাপার। দাঁড়ান, শ্রীময়ীকে ডাকছি। আমারই মেয়ে। ক্রিকেটপাগল। আশ্চর্য, আমাকে কিছু বলেনি!”

বলেই উনি বেল টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে হাজির হল পনেরো-ষোলো বছর বয়সি একটি ছেলে। পুতান মল্লিক বললেন, “অ্যাই, ছোট দিদিমণিকে ডেকে আন তো।”

ছেলেটা বলল, “সে তো ফেরেনি। দুকুরে বেইরেচে। মামণিকে ফোন কইরে বলেছে, ফিরতি দেরি হবে।”

“গেচে কোথায়?”

“মামণিকে জিজ্ঞেস কইরব?”

“শিগগির যা। এ কী! রাত ন’টা বাজতে চলল, এখনও বাড়ি ফিরবে না? আজ খুব বকুনি খাবে আমার কাছে।”

রাগে গজগজ করছেন পুতান মল্লিক। আমি একটু হতাশ। মেয়েটাকে পাওয়া গেলে রামপলের হদিশ পাওয়া যেত। সময় চলে যাচ্ছে। কী করব, ভাবতে লাগলাম। বরাবরই চাপে পড়লে মাথাটা কাজ করতে শুরু করে। একটা-না-একটা রাস্তা ঠিক বেরিয়ে যায়। পঙ্কজ রায়ের বিশ্বরেকর্ড করা সেই ব্যাটটা যেবার স্মাগলাররা হংকংয়ে পাচার করছিল, সেবারও বেশ চাপের মধ্যে পড়ে গেছিলাম। পরে ব্যাটটা উদ্ধার করি শেষ মুহূর্তে। সে যাক, পুরনো কথা ভেবে আর লাভ কী? এখন উদ্ধার করতে হবে রামপলকে। না হলে বদনাম হয়ে যাবে কলকাতার। শ্রীময়ী মেয়েটা কখন ফিরবে, তার ঠিক নেই। ওর জন্য অপেক্ষা করাটা যুক্তিযুক্ত হবে কি না, বুঝে উঠতে পারলাম না।

কলকাতায় টেস্ট ক্রিকেটাররা খেলতে এলেই একদল ছেলে-মেয়ে হঠাৎ যেন পাগল হয়ে যায়। ক্রিকেটারদের সামান্য একটু দেখার জন্য এরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইডেনের ক্লাবহাউসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। অথবা গ্র্যান্ডের ফুটপাথে। ভাল ভাল পরিবারের সব ছেলেমেয়ে। অফিসেও আমরা প্রচুর ফোন পাই। “আঙ্কল, অনিল কুম্বলের ফোন নম্বরটা দেবেন?” “আঙ্কল, রাহুল দ্রাবিড়ের অ্যাড্রেসটা পাওয়া যাবে? একটা গ্রিটিংস কার্ড পাঠাব।” প্রায়ই এরকম অনুরোধ আসে। বিশেষ করে, স্কুল-কলেজের মেয়েদের কাছ থেকে। শ্রীময়ী বলে মেয়েটাও বোধহয় এইরকম ক্রিকেট ফ্যান। আজ যেমন বাড়ির বকুনির কথা ভুলে, লেগে রয়েছে রামপলের সঙ্গে।

এ-সব কথা ভাবার সময়ই, পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকলেন এক ভদ্রমহিলা। হাতে রেকাবিতে বড় বড় তিনটে সন্দেশ আর অমৃতি। টেবলের ওপর রেকাবিটা রেখে ভদ্রমহিলা হাত তুলে নমস্কার করে বললেন, “আমি শ্রীময়ীর মা। আপনার সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি, আমার দেওর সুকুমারের কাছ থেকে। টিভি-তে আপনাকে এতবার দেখেছি, আপনি ঢোকামাত্রই চিনতে অসুবিধে হয়নি।”

এতক্ষণ ইচ্ছে করেই সুকুমারের কথা জিজ্ঞেস করিনি। পুতান মল্লিক অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। এক পলকেই বুঝতে পারলাম, ভদ্রলোক আইন ব্যবসা নিয়ে এমন ব্যস্ত, চারপাশের অনেক কিছুরই খবর রাখেন না। ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, “সুকুমার এখন নেই?”

“না। একটা মামলার ব্যাপারে দিন তিনেক হল দিল্লিতে গেছে। ও থাকলে খুব খুশি হত আপনাকে দেখে।”

ভদ্রমহিলা আরও কী বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় বাইরে রাস্তার দিকে চোখ পড়তেই বলে উঠলেন, “এই তো শ্রীময়ী এসে গেছে। যাক, নিশ্চিন্ত।’

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সতেরো-আঠারো বছর বয়সি একটা মেয়ে ঘরে ঢুকল। টিভি-তে একটু আগে দেখেছি। চিনতে পারলাম। পুতান মল্লিক বেশ রেগে রয়েছেন দেখে মেয়েটা আদুরে গলায় বলল, “বাপি, আজ রামপলের অটোগ্রাফ পেয়ে গেছি। দুপুরে আমি আর সুভদ্রা শাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম রূপসীতে…।”

পুতান মল্লিক তাকে থামিয়ে কড়া গলায় জানতে চাইলেন, “এত রাত হল?”

“পিসিমণির বাড়ি গিয়েছিলাম। মা-কে তো ফোন করে দিয়েছিলাম।”

এই সময়ই আমি জিজ্ঞেস করলাম, “রূপসী থেকে বেরিয়ে রামপল কোথায় গিয়েছিল, জানো?”

মেয়েটা এতক্ষণে লক্ষ করল আমাকে। চোখে বিস্ময়। কিন্তু বলল, “সুতাপট্টিতে। ওকে আমরাই একটা রিকশাতে তুলে দিই।”

“তারপর?”

“জানি না।”

উত্তরটা শুনে আমি ঠিক করে নিলাম, আর সময় নষ্ট করব না। পুতান মল্লিককে বললাম, “চলি মি. মল্লিক। সুকুমারকে বলবেন, পরে একদিন আড্ডা মারতে আসব।”

ভদ্রমহিলা মিষ্টি মুখে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করে বেরিয়ে এলাম। একটা লাইন ধরে এগোচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, রামপলের হদিশ পেয়ে যাব। পেলাম না। সামনে ফের অন্ধকার। নাহ্, অম্বিকাদার কাছে মানসম্মান বোধহয় আর রাখা সম্ভব হল না। অফিসের দিকে গাড়ি চালানোর সময় হঠাৎ মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। পকেট থেকে বের করে কানে নিতেই জয়দীপের গলা, “কী রে, কখন আসবি। তোর জন্য বসে আছি।”

বিব্রত মুখে বললাম, “জয়দীপ, আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি। একটা কাজে ব্যস্ত রে। আজ বোধহয় যাওয়া হবে না। তুই ডিনার সেরে নে। পরে সব বলব।”

জয়দীপ বলল, “এটা কী ধরনের ভদ্রতা হল?”

“প্লিজ, কিছু মনে করিস না। কখন ফ্রি হব, বুঝতে পারছি না।”

“ও কে।” বলেই জয়দীপ লাইনটা কেটে দিল। বুঝলাম, ও বেশ অসন্তুষ্ট। খুব খারাপ লাগল। দিল্লিতে ও যদি আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করত, তা হলে আমিও মনঃক্ষুন্ন হতাম। এটাই স্বাভাবিক। পরে ম্যানেজ করতে হবে। ভেবে মনটা সরিয়ে আনলাম রামপলের দিকে। প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে। হাতে বিশেষ সময় নেই। ঘণ্টাদেড়েক হল, বেরিয়ে এসেছি অফিস থেকে। এর মধ্যে রামপল আবার ফিরে যায়নি তো হোটেলে? একবার খোঁজ নেওয়া দরকার। মোবাইলে তাই ধরলাম অম্বিকাদাকে।

“ফিরেছে?”

“না। আমার খুব টেনশন হচ্ছে কালকেতুভাই। ছেলেটা যদি কোনও বিপদে পড়ে, তা হলে আমি দায়ী হয়ে থাকব।”

“চিন্তা করবেন না। ঘণ্টাখানেক পর আবার ফোন করছি।”

অম্বিকাদাকে তো আশ্বাস দিলাম। কিন্তু নিজে বুঝতে পারছি, ঘণ্টাখানেক পরে ফোন করলেও, রামপলের খোঁজ দেওয়া সম্ভব না আমার পক্ষে। ওকে শেষ দেখা গেছে বড়বাজার অঞ্চলে। কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে নিশ্চয়ই পুলিশের কাছে খবর চলে যেত। সেরকম কিছু হয়নি। হয় ও পরিচিত কোনও লোকের বাড়ি গেছে, না হয় কিডন্যাপড হয়েছে। পরিচিত লোকের বাড়ি গেলে, হোটেলে নিশ্চয়ই ফোন করে একটা খবর দিত। দেয়নি। তার মানে, এমন কোথাও আছে, যেখান থেকে ওর পক্ষে খবর দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। এত বড় শহর। ইচ্ছেয় হোক, অথবা অনিচ্ছায়— যেখানেই রামপল থাকুক, ওকে এই অল্প সময়ের মধ্যে খুঁজে বের করা সহজ ব্যাপার নয়। গাড়ি চালাতে চালাতে নানারকম ভাবছি। একবার মনে হল, ছেলেটা কোনও ডিসকো ফ্লোরে যায়নি তো? ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা নাচগান ভালবাসে। পার্ক স্ট্রিটের ডিসকো ক্লাবগুলোয় খোঁজ নিলে ভাল হত।

হঠাৎই বীভৎস সাহু-র একটা কথা মনে পড়ে গেল। লালবাজারের রেকর্ড সেকশনের অফিসার বীভৎস সাহু আমার বন্ধুস্থানীয়। অপরাধ জগতের খুঁটিনাটি ব্যাপার ভদ্রলোকের কণ্ঠস্থ। যখনই কোনও দরকার হয়, ভদ্রলোকের সাহায্য নিই। এর আগে দু’-তিনবার বীভৎস সাহু রহস্য উদঘাটনে আমাকে রাস্তা বাতলে দিয়েছেন। কথায় কথায় একবার ভদ্রলোক বলেছিলেন, “ইনফর্মেশন। বুঝলেন কালকেতুবাবু, ইনফর্মেশনটাই আসল। তথ্য যদি আপনার হাতে থাকে, তা হলে কোনও রহস্যই আর রহস্য থাকে না।” কথাটা মনে হতেই, ঠিক করলাম রামপল সম্পর্কে সব তথ্য আগে জানতে হবে। ছেলেটা ভারতীয় বংশোদ্ভূত। রূপসী দোকানে শ্রীময়ী বলে মেয়েটার কাছে ও জিজ্ঞেস করেছিল সুতান আটি বা সুতাপট্টি বলে জায়গাটা কোথায়? ওখানে কি ওর কোনও আত্মীয় থাকে? থাকতেও পারে।

বিডন স্ট্রিটের কাছে পৌঁছে জ্যামে আটকে গেলাম। ব্যান্ডপার্টি সঙ্গে নিয়ে বিয়েবাড়ির লোকজন যাচ্ছে রবীন্দ্রকাননের দিকে। উত্তর কলকাতায় এ এক পরিচিত দৃশ্য। ঘোড়ায় চেপে বর। পড়ে যাওয়ার ভয়ে কেমন যেন জুবুথুবু হয়ে বসে। দেখেই হাসি পেল। সঙ্গে সঙ্গে উলটো দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। আর তখনই মনে পড়ল নিরঞ্জন ঘোষালের কথা। উলটো দিকে, রাস্তার ওপরই নিরঞ্জনের বাড়ি। একসঙ্গে আমরা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তাম। বিরাট ধনী পরিবারের ছেলে। এম এ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিল হিস্ট্রিতে। মাঝে কিছুদিন আগে দেখা হয়েছিল বইমেলায়। বলেছিল, বই লিখছে। গত দু’শো বছরে ভারত থেকে যে-সব পরিবার আফ্রিকায় বা আরও পশ্চিমের কোনও দেশে গিয়ে বসবাস শুরু করেছে, তাদের নিয়ে। প্রচণ্ড খাটছে বই লেখার জন্য। আগে চিঠিপত্র লিখে তথ্য সংগ্রহ করত। এখন বাড়িতে ইন্টারনেট বসিয়েছে। ফলে তথ্য পাওয়ার খুব সুবিধে হয়ে গেছে। বাড়িতে বসেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে নিরঞ্জন।

কথাটা মনে হতেই গাড়ি রাস্তার ধারে পার্ক করলাম। নিরঞ্জন পারবে। রামপল সম্পর্কে তথ্য দিতে। সত্যি বলতে কী, আরও কিছু আগে আমার ওর সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত ছিল। রামপল সম্পর্কে অনেক তথ্য ও দিতে পারত। কলেজে পড়ার সময় নিরঞ্জনদের বাড়ি খুব আসতাম। খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের লুচি খাওয়াতেন ওর মা। সেই দিনগুলো খুব সুন্দর ছিল।

ডোর বেল টিপতেই বেরিয়ে এল নিরঞ্জন। আমাকে দেখে অবাক। বলেই ফেলল, “এত রাতে তুই হঠাৎ? আয়, ভেতরে আয়।”

ভেতরে ঢুকে সংক্ষেপে সব কথা গুছিয়ে বলতে নিরঞ্জন বলল, “কয়েকদিন ধরে রামপল ছেলেটার খবর কাগজে পড়ছি। তোরা লিখছিস, ছেলেটার পূর্বপুরুষ বার্বাডোজে গিয়েছিল বিহারের জামালপুর থেকে। কথাটা কিন্তু ঠিক নয়।”

বললাম, “তুই কি খোঁজখবর নিয়েছিস?”

“হ্যাঁ। বার্বাডোজে আমার এক বন্ধু আছেন, ফ্রান্সিস কোজিয়ার। উনি রিসার্চ করছেন ভারত থেকে ওখানে গিয়ে যাঁরা বসবাস করছেন তাঁদের নিয়ে। উনি একবার ভারতে এসেছিলেন মাস ছয়েকের জন্য। কোজিয়ারের কাছেই রামপল সম্পর্কে সব তথ্য পেয়েছি। তোকে একটা প্রিন্ট আউট দিতে পারি।”

“কী আছে তাতে?”

“ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। শুনে চমকে উঠবি। রামপলের ঠাকুরদার ঠাকুরদার ঠাকুরদা—অভয়পদ পাল কলকাতার লোক। তখন অবশ্য সুতানুটি অঞ্চল। একটা ঠিকাদার কোম্পানির হয়ে কাজ করার জন্য অভয়পদ কিনিয়ায় যান। সেখান থেকে বার্বাডোজে। সেখানে গিয়ে সেটল করেন। রামপলের ঠাকুরদার ঠাকুরদা কৃষ্ণচন্দরপল আঠারোশো তিরানব্বই সালে পিতৃভূমির টানে একবার কলকাতায় আসেন। এখানে বছর দুয়েক ছিলেন। বিয়েও করেন। কিন্তু হঠাৎই ফের বার্বাডোজে ফিরে যান। তাঁর নামে খুনের অভিযোগ উঠেছিল। কৃষ্ণচন্দরপলই শোভাবাজারে বিরাট একটা বাড়ি তৈরি করেন। সেই বাড়ি এখনও রয়েছে।”

নিরঞ্জন এই পর্যন্ত বলে তাক থেকে একটা ফাইল বের করল। তারপর কয়েকটা পাতা উলটে বলল, “এই দেখ, রামপলের বংশতালিকা। সাত পুরুষের ঠিকুজি রয়েছে। তোর কাজে লাগবে। ফাইলটা নিয়ে যেতে পারিস। আমার কম্পিউটারে সব ফিড করা আছে। পরে প্রিন্ট আউট বের করে নেব।”

নিরঞ্জনের কথা শুনে হঠাৎ মনে পড়ল, রূপসী দোকানে রামপল সুতান আটি বলে একটা জায়গার খোঁজ করেছিল। শ্রীময়ীরা ভুল করে ভেবেছিল, সুতাপট্টি। আসলে ওটা সুতানুটি। শোভাবাজারে ওদের বাড়িটা এখনও আছে। রামপল কি সেখানে গেছে? হয়তো ওর স্বজনদের খুঁজে পেয়েছে।

ফাইল উলটে দেখছি। কোজিয়ার লিখেছেন, “কৃষ্ণচন্দরপল প্রচুর অর্থ নিয়ে কলকাতায় যান। সেটাই তাঁর বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর জ্ঞাতিদের দুই তরফ টানাটানি করতে থাকে। এ-নিয়ে দুই তরফের কলহ শেষ পর্যন্ত খুনখারাপিতে গড়ায়। জ্ঞাতিরাই পরে মিলেমিশে খুনের দায় চাপিয়ে দেন কৃষ্ণচন্দরপলের ওপর। কিন্তু প্রতিবেশী এক ভদ্রলোকের সাহায্যে তিনি পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। সেই সময় তাঁর স্ত্রীকে সঙ্গে আনতে পারেননি। কৃষ্ণচন্দরপল দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করেন। তাঁর একমাত্র পুত্র শোভারামপাল।”

এই পর্যন্ত পড়ে নিরঞ্জনকে জিজ্ঞেস করলাম, “রামপলদের শোভাবাজারের বাড়িটা ঠিক কোথায়?”

“ট্রামলাইনের গায়ে। সতেরোর বি। এখন ভাগাভাগি হয়ে গেছে। কয়েকটা অংশ বিক্রি করে দিয়েছেন কেউ কেউ। এই ফাইলটা তৈরি করার সময় একবার ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম। কৃষ্ণচন্দরপল এখানে যে বিয়ে করেন, সেই স্ত্রীর একটিই পুত্রসন্তান। তার তরফে এখন দুই ভাগ। সৌমেন্দু পাল আর অর্ধেন্দু পাল। এদের মধ্যে মুখ দেখাদেখি নেই। দু’জন দু’রকম রাজনীতি করেন। বাড়ির মাঝে একটা পাঁচিল। জানিস, রামপলের বাবা ধরমপল বার্বাডোজের অর্থমন্ত্রী হওয়ার পরই একবার পিতৃভূমিতে আসতে চেয়েছিলেন। এখান থেকে আমিই রিপোর্ট পাঠাই, আসবেন না। আপনাকে নিয়ে টানাটানি হবে। আপনাকে নিয়ে বোমাবাজি হয়ে যাবে। কী অবস্থা বল ভাই। এ-কথা শুনে ধরমপল পিছিয়ে যান।”

জিজ্ঞেস করলাম, “রামপল তোর সঙ্গে যোগাযোগ করেনি?”

“না। ওর বাবা করেছিলেন। আমি গাঁটের পয়সা খরচা করে ওর পেছনে একজন গোয়েন্দা লাগিয়ে রেখেছি। সে খবর দিয়েছে, রামপল এখন শোভাবাজারে ওর জ্ঞাতিদের বাড়িতে রয়েছে।”

কথাটা শুনে উঠে পড়লাম। হাতঘড়িতে দেখি দশটা বাজে। এখনই শোভাবাজারে যাওয়া দরকার। ভাগ্যিস, নিরঞ্জনের কথা মনে পড়েছিল। তাই রামপলের একটা হদিশ পাওয়া গেল। বরাবর দেখেছি, যখনই জট খুলতে পারছি না, ঈশ্বর যেন সহায় হন। হঠাৎ কোনও রাস্তা বের করে দেন। নিরঞ্জনকে বললাম, “চলি রে। পরে দেখা হবে।”

“এই, তোর কাছে কালকের খেলার একটা টিকিট আছে?”

একটা কেন, নিরঞ্জনকে পাঁচটাও দিতে আমি রাজি। পকেট থেকে গোটা তিনেক টিকিট বের করে এগিয়ে দিলাম। তারপর বেরিয়ে এসে গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম শোভাবাজারের দিকে। খুঁজে খুঁজে সতেরোর বি বাড়িটায় পৌঁছে আমি অবাক হয়ে গেলাম। এ কী! এটা তো আমার চেনা বাড়ি। আগেও একবার এসেছি। এই বাড়ির একটা ছেলে—শোভনদেব পাল এ-বছরই সি এ বি-র বর্ষসেরা জুনিয়ার ক্রিকেটারের পুরস্কার পেয়েছে। খুব প্রতিশ্রুতিমান অলরাউন্ডার। বাঁ হাতে ব্যাট করে। ডান হাতে বল। রামপলের মতোই। বয়স ষোলো বছর সাত মাস। প্রায় একই সময়ে একই পরিবারের দুটি ছেলে, বিশ্বের দুই প্রান্তে জন্মেছে। তাদের মধ্যে কী আশ্চর্য মিল! ভারতের আন্ডার সেভেনটিন একটা টিম আর এক সপ্তাহ পরেই ওয়েস্ট ইন্ডিজে কয়েকটা ম্যাচ খেলতে যাচ্ছে। সেই দলে বাংলা থেকে নির্বাচিত হয়েছে এই শোভনদেব। বেচারা হয়তো গতকাল পর্যন্তও জানত না, রামপল ওর জ্ঞাতিভাই।

বাড়িটার খুবই জরাজীর্ণ অবস্থা। দেওয়ালে শ্যাওলা জমে গেছে। প্রায় একশো বছর বয়স। হওয়ারই কথা। কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দিলেন মাঝবয়সি এক ভদ্রমহিলা। দেখেই চিনতে পারলাম শোভনদেবের মা। তখনই মনে পড়ল, ছেলেটার বাবার নাম অর্ধেন্দু পাল। আগেরবার ভদ্রমহিলার পরনে ছিল সস্তা শাড়ি। আজ দেখলাম, দামি তাঁতের শাড়ি পরে রয়েছেন। ভদ্রমহিলা কিছু বলার আগেই পেছনে এসে দাঁড়াল শোভনদেব। আমাকে দেখে বলল, “সার, আপনি?”

“রামপল কি এখনও আছে?”

“হ্যাঁ, সার। অদ্ভুত ব্যাপার। আজ বিকেলে আমাদের বাড়িতে এসে বলে কিনা, আমাদের জ্ঞাতিভাই।”

“ঠিকই বলেছে।” বলে ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরে বড় একটা উঠোন। সেখানে একটা কাঠের টুলের ওপর বসে রামপল। আশপাশে আরও কয়েকজন মহিলা ও পুরুষ। মহিলাদের প্রত্যেকের পরনে নতুন শাড়ি। দেখেই বুঝতে পারলাম, রূপসী থেকে রামপল শাড়িগুলো এঁদের জন্যই কিনেছে। সবাই খুব আগ্রহভরে দেখছেন রামপলকে। আমাকে দেখে রামপল শোভনদেবকে জিজ্ঞেস করল, “ইনি কে? আমাদের আত্মীয়?”

শুনে আমিই উত্তরটা দিলাম, “না। আমি একজন রিপোর্টার। তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। মি. লয়েড তোমার জন্য খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। তোমাকে এক্ষুনি আমার সঙ্গে যেতে হবে।”

উঠোনে ষাট ওয়াটের একটা আলো। তাতেও স্পষ্ট দেখলাম, লয়েডের নাম শুনে ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়াল রামপল। তারপর বলল, “আপনি আমাকে শিগগির হোটেলে নিয়ে চলুন। সত্যিই অনেক রাত্তির হয়ে গেছে। আসলে কী জানেন, এখানে আসার আগে, দেশে, বাবা আমাকে বলে দিয়েছিলেন, যে করেই হোক, এঁদের সঙ্গে একবার দেখা করে যেতে। উনি আমাকে একটা ঠিকানাও দিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা হারিয়ে ফেলেছি। শুধু মনে ছিল, আমার পূর্বপুরুষরা থাকেন সুতান আটি বলে একটা জায়গায়। এটা পড়েছিলাম ফ্রান্সিস কোজিয়ারের একটা লেখায়…”

“কী করে তুমি এঁদের খুঁজে বের করলে?”

“সন্ধেবেলায়, বাধ্য হয়ে বাবাকে একটা ফোন করলাম। তখন উনি ঠিকানাটা দিলেন। আমার জীবনে আজ একটা স্মরণীয় দিন। এঁদের কথা সেই ছোটবেলা থেকে শুনছি। আপনি কি কয়েকটা ছবি তোলার ব্যবস্থা করে দিতে পাবেন? তা হলে দেশে ফিরে বাবাকে দেখাতে পারতাম।”

মারুতিতে একটা ক্যামেরা সবসময়ই রেখে দিই। অনেক সময় কাজে লেগে যায়। অফিস থেকে ফোটোগ্রাফার ডেকে আনার সময় নেই। তাই নিজেই বেরিয়ে গিয়ে নিকন ক্যামেরাটা নিয়ে এলাম। রামপল ছেলেটা এত ভাল, প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা করে ছবি তুলল। পরিবারের সবচেয়ে বয়স্কা মহিলা অর্ধেন্দুবাবুর ঠাকুমা। বয়স আশির কাছাকাছি। তাঁর সঙ্গে ছবি তোলার সময় রামপল হঠাৎই ভদ্রমহিলাকে কোলে তুলে নিল। ফোকলা মুখে সেই মহিলার কী হাসি। মনে মনে ঠিক করে নিলাম, কালকের কাগজে এই ছবিটাই ছাপব। অর্ধেন্দুবাবুর জ্ঞাতিভাই সৌমেন্দুবাবু একবার বলেই ফেললেন, “এই ছেলেটার জন্যই দশ বছর পর এ-বাড়িতে পা দিলাম। এত অল্প সময়ের মধ্যে সবাইকে আপন করে নিয়েছে যে, মনে হচ্ছে জাদু জানে।”

মিনিট পনেরোর মধ্যেই দু’জনে বেরিয়ে এলাম শোভাবাজার থেকে। রাত ঠিক পৌনে এগারোটায় গ্র্যান্ড হোটেলে রামপলকে অম্বিকাদার হাতে তুলে দেওয়ার সময় বললাম, “এবার নিশ্চিন্তি হলেন তো?”

আনন্দে কেঁদে ফেললেন অম্বিকাদা, “নিশ্চিন্ত হলাম মানে? প্রাণ ফিরে পেলাম। বাঁচালে ভাই। অসাধ্য সাধন করলে আজ। এই নাক-কান মুলছি। আর কখনও লোকাল ম্যানেজারের দায়িত্ব নেব না। কাল খেলা হয়ে যাওয়ার পরই রিটায়ার করব। উফ, আর একটু দেরি হলে আজ হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত।”

হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলাম। প্রায় এগারোটা বাজে। জয়দীপের হোটেলে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। বেচারি হয়তো খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়েছে। রেড রোড ধরে গাড়ি চালাতে চালাতে মনটা খারাপ হয়ে গেল। রিপোর্টারের চাকরিটাই বাজে। কাউকে কথা দিয়ে, কথা রাখা যায় না। জয়দীপ কী ভাবল আজ, কে জানে?

সিটের ওপর রামপলদের বংশলতিকার ফাইল পড়ে রয়েছে। কাল চমৎকার একটা স্টোরি লিখতে হবে। রামপল আর শোভনদেবদের নিয়ে। কয়েক পুরুষ এঁদের মধ্যে যোগাযোগ নেই। ক্রিকেটই মেলবন্ধন হয়ে দাঁড়াল। শোভাবাজার থেকে বিদায় নেওয়ার সময় রামপল কেঁদে ফেলেছিল। ওর একদিকে অর্ধেন্দুবাবুর স্ত্রী, অন্যদিকে সৌমেন্দুবাবুর স্ত্রী। দুই কাকিমা ভাষা বুঝতে পারছেন না। কিন্তু আবেগ তো চাপা থাকে না। রামপলের গাল ছুঁয়ে ওঁরা আদর করছেন। দু’জনেরই চোখে জল। পাড়া-প্রতিবেশীরা ওই দৃশ্য দেখে অবাক! দুই পরিবারের মধ্যে এমন মিল আগে কখনও কেউ দেখেনি। কে এই ছেলেটা? যাকে নিয়ে সব ঝগড়াঝাঁটি উধাও?

শোভাবাজার থেকে চলে আসার আগে রামপল একবার বলেছিল, “শোভন, তুমি আমাদের দেশে গেলে নিশ্চয়ই দেখা হবে। বাবাকে সব কথা জানাব। তুমি ইচ্ছে করলে আমাদের বার্বাডোজে ট্রেনিং-ও নিতে পারো। সে-ব্যবস্থা বাবা করে দেবেন।” শুনে শোভনদেব ঘাড় নেড়েছিল। তখন স্পষ্ট দেখলাম, ওর চোখে ঘোর লেগে রয়েছে। রামপল ওর আত্মীয়—এই কথাটা কলকাতার ক্রিকেটমহলে যদি কাল কাউকে ও বলে, সবাই হেসেই উড়িয়ে দেবে। কাগজে দেখার পর অবশ্য বিশ্বাস করবে। দুনিয়াটা কী অদ্ভুত, তাই না?

বাড়িতে ফিরে এলাম রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ। রোজ এ-সময়েই ফিরি। আগে মা জেগে থাকতেন। ফুল্লরাকে বিয়ে করার পর, এখন আর মাকে কষ্ট করতে হয় না। দরজা খুলে দিয়ে ফুল্লরা বলল, “তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবলে এসো। এতক্ষণ কোথায় ছিলে? অফিসে পেলাম না!”

রামপলের অন্তর্ধানের খবর এককথায় বলা যাবে না। তাই বললাম, “পরে বলছি।”

হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকতেই আমি অবাক! মুখ থেকে ছিটকে বেরল, “আরে জয়দীপ, তুই?”

নির্লিপ্ত গলায় জয়দীপ বলল, “হ্যাঁ, আমি। সাংবাদিকরা অভদ্র হলে কী হবে, তাদের বউরা কিন্তু এখনও ভদ্রতাবোধ হারায়নি। ফুল্লরা তোর আগেই, আজ সকালে আমাকে ডিনারের নেমন্তন্ন করে রেখেছিল।”

কী বলব? চুপ করে রইলাম।

১৪০৪

অলংকরণ: অনুপ রায়

সকল অধ্যায়

১. প্রোফেসর হিজিবিজ্‌বিজ্ – সত্যজিৎ রায়
২. বাহাদুর – আশাপূর্ণা দেবী
৩. কুমির – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
৪. ননীদা – মতি নন্দী
৫. হর্ষবর্ধনের ভাগনে ভাগ্য – শিবরাম চক্রবর্তী
৬. কর্ভাস – সত্যজিৎ রায়
৭. বেণী লস্করের মুণ্ডু – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৮. টুম্পুর গল্প – সুকুমার দে সরকার
৯. বারীন ভৌমিকের ব্যারাম – সত্যজিৎ রায়
১০. বীর হওয়ার বিড়ম্বনা – শিবরাম চক্রবর্তী
১১. নন্দগুপি – লীলা মজুমদার
১২. পালোয়ান ভূত – মনোজ বসু
১৩. হিসাব – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৪. গান – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৫. জ্যান্ত খেলনা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৬. মুড়ি – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
১৭. কর্নেল মিত্র – বিমল মিত্র
১৮. গুল-ই ঘনাদা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৯. ভয়ঙ্কর মুখোশ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
২০. দিনে ডাকাতি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
২১. গন্ধটা খুব সন্দেহজনক – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২২. মেজকর্তার খেরোখাতা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২৩. গোয়েন্দা বরদাচরণ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৪. সাধু কালাচাঁদের ফলাও কারবার – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
২৫. একটি ভুতুড়ে ঘড়ি – বিমল কর
২৬. বুনো হাতির বন্ধুত্ব – সমরেশ বসু
২৭. গোয়ায় গোগোলের প্রথম কীর্তি – সমরেশ বসু
২৮. ইঁদারায় গণ্ডগোল – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৯. চোর সাধু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৩০. টোরি জঙ্গলের ভক্ত-বাঘ – সুবোধ ঘোষ
৩১. জোনাকি-ভূতের বাড়ি – সমরেশ বসু
৩২. বনবিড়াল – বিমল কর
৩৩. ভয় ও ভূত – সুকুমার সেন
৩৪. সুপারমেন – সমরেশ মজুমদার
৩৫. রাত যখন বারোটা – অশোক বসু
৩৬. প্রেতাত্মার উপত্যকা – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৭. আলুর চপ – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
৩৮. হাবুলমামার ভূতের ব্যবসা এবং… – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৯. অশোকের কাণ্ড – হর্ষ দত্ত
৪০. হারাধন – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪১. হয়তো এইরকমই – আশাপূর্ণা দেবী
৪২. মহারাজা তারিণীখুড়ো – সত্যজিৎ রায়
৪৩. খুড়ো-ভাইপো – বাণী বসু
৪৪. সহযাত্রী – সত্যজিৎ রায়
৪৫. দারিৎসু – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৪৬. চার বুড়োর আড্ডা – আশাপূর্ণা দেবী
৪৭. রামপলের অন্তর্ধান রহস্য – রূপক সাহা
৪৮. দেয়ালা – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪৯. শুভ জন্মদিন – জয় গোস্বামী
৫০. ইন্দ্রনাথ সামন্তের বাড়ি – সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন