শুভ জন্মদিন – জয় গোস্বামী

পৌলোমী সেনগুপ্ত

শুভ জন্মদিন – জয় গোস্বামী

সুবীরবাবুর ঘুম ভাঙল পেটে একটা খোঁচা খেয়ে। ঘুম চোখে দেখলেন, সামনে বসে আছে বিনি। আকাশে আলো ফুটেছে সবে। পাখি ডাকছে। জানলার দিকে তাকালেন সুবীরবাবু। জানলায় রোদ আসেনি। এত সকালে বিনি তাঁর ঘুম ভাঙাচ্ছে কেন?

সুবীরবাবু বললেন, “কী রে, কী হয়েছে?”

বিনি বলল, “কই, বলো!”

সুবীরবাবু বললেন, “কী বলব!”

বিনি ধৈর্য হারিয়ে বলে, “কী বলবে আমি বলে দেব কেন? আজ কী!”

সুবীরবাবুর মনে পড়ল, “তাই তো। ওহ! হ্যাঁ, শুভ জন্মদিন। মানে হ্যাপি বার্থডে।”

বিনি রাগ করে, “এত দেরি করলে কেন!”

সুবীরবাবু একটা হাই তোলেন, “আরে, দেরি কোথায়। এই তো বললাম। তাই বলে এত সকালে ঘুম ভাঙিয়ে দিলি।”

বিনি বলে, “কখন ভোর হয়ে গেছে। কতগুলো চড়াই এসে ঘরে ঢুকল। আবার উড়ে গেল। জানলা দিয়ে দেখলাম, রাস্তায় একটা লোক হাফপ্যান্ট পরে দৌড়তে দৌড়তে চলে গেল। সামনের ছাদে বসে কাকটা কতক্ষণ ধরে ঠোঁট দিয়ে ডানা চুলকোল। তুমি তখনও ঘুমোচ্ছ! তাই ডাকলাম।”

“বেশ করেছিস।” সুবীরবাবুর বেশ রাগ হল। কিন্তু আজ জন্মদিনের দিন তো আর বকতে পারেন না। সুবীরবাবু উঠে চশমাটা পরলেন। ঘড়ির দিকে তাকালেন, সাড়ে পাঁচটা। সুবীরবাবু সাড়ে সাতটা পৌনে আটটায় ওঠেন। যাক গে, আর কী করা যাবে।

পেটে আবার খোঁচা।

“কী রে। আবার কী হল?”

“ওপরে চলো।”

“ওপরে মানে?”

“ওই লোকটার কাছে।”

“ওই লোকটা? ওপরে তো শ্যাম ব্যানার্জি থাকেন।”

“কী নাম কী জানি! ওই যে, দাড়ি আছে।”

বলতে বলতে বিনির চোখমুখ চকচক করে ওঠে।

সুবীরবাবু বলেন, “খবরদার বিনি, দাড়ির দিকে নজর দিবি না।”

বিনি ফিক করে হাসে, “আচ্ছা। এখন ওপরে চলো।”

“দ্যাখো কাণ্ড। শ্যাম ব্যানার্জি তো এখন ঘুমোচ্ছন।”

“আমরা তুলে দেব। চলো। চলো না।”

“কিন্তু, খামোখা ভদ্রলোকের ঘুম ভাঙানো কি উচিত হবে?”

বিনি সুবীরবাবুর হাত ধরে টানে, “আঃ তুমি যাবে!” অগত্যা, সুবীরবাবু বলেন, “চল। তুই যখন ছাড়বি না।”

শ্যাম ব্যানার্জি সুবীরবাবুদের ওপরের ফ্ল্যাটে থাকেন। তিনি আবার কবি। রাত জেগে লেখেন। আর বেলা অবধি বিছানায় পড়ে থাকেন। তাঁর দরজায় কোনও কলিং বেল নেই। কয়েকবার ধাক্কা দিতে শ্যাম ব্যানার্জি দরজা খুললেন।

সিড়িঙ্গে ধরনের রোগা লোকটি। সর্বদা, সাদা রঙের পায়জামা পাঞ্জাবি পরে থাকেন। একমুখ দাড়ি। মাথার পেছনে ইন্দ্রলুপ্ত। ভদ্রলোককে দেখিয়ে বিনির দাদা মোমো বলেছিল, “মাথার পেছনে টাকটা দেখছিস, কীরকম ঢেউ খেলানো!”

বিনি বলেছিল, “তাই তো! কেন রে দাদা?”

ওরা দু’জনে সুবীরবাবুর দোতলার বারান্দা থেকে দেখছিল শ্যাম ব্যানার্জি অফিসে বেরোচ্ছেন। শ্যাম ব্যানার্জির অফিস যাওয়াটাও অন্যরকম। তিনি কাঁধে একটা ঝোলা আর হাতে একটা ফোল্ডিং ছাতা নিয়ে বেরোন। ছাতাটা অত্যন্ত বেয়াড়া ধরনের, কিছুতেই ঠিকমতো খোলে না। খুললে বন্ধ হতে চায় না। ভদ্রলোক মোড় পর্যন্ত গিয়ে রিকশায় ওঠেন। এই বারান্দা থেকে দেখা যায় মোড়ের মাথায় রিকশায় উঠে তিনি প্রাণপণ চেষ্টাতেও ছাতা বন্ধ করতে পারছেন না। গরমের ছুটির সময়, এ বাড়িতে এলে, বিনি এটা রোজ খেয়াল করে দেখে। তা ছাড়া শ্যাম ব্যানার্জির আর একটা স্বভাব হল, অধিকাংশ দিনই, বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাত্র দশ পা গিয়েই তিনি হঠাৎ “এই যাঃ”বলে উলটো মুখে ফিরতে থাকেন। সবাই জানে, তিনি রোজই কিছু-না-কিছু নিতে ভুলে যান। মানিব্যাগ, নয় চশমা, নয়তো কোনও দরকারি চাবি। মোমা বিনি এ-বাড়িতে এলে, বারান্দায় বসে অপেক্ষা করে কখন উনি ঘুরে বাড়ির দিকে ফিরবেন।

সুবীরবাবুদের ঠিক পাশের দোতলায় মোমোর বয়সি আরেকটি ছেলে থাকে। ভুলচু। গরমের ছুটির সময় একেক দিন তাকেও দেখা যায় তাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে। ওই শ্যাম ব্যানার্জির অফিস যাওয়ার সময়টায়। কী একটা ফেলে গিয়ে, একদিন ওইরকম ঘুরে আবার ফিরতে ফিরতে শ্যাম ব্যানার্জি শুনলেন একটা হইহই। তিনি মুখ তুলে দেখলেন, ওপরের দুটি বারান্দার একটিতে দাঁড়িয়ে একটি বালক চেঁচাচ্ছে, “আমি জিতেছি, আমি জিতেছি।” অন্য বারান্দায় অপর একটি বালক কিছুটা ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে বলছে, “তাতে কী, কাল তো তুই হেরেছিলি!” বললেন, তিনি হাত তুলে বেশ খুশি হয়ে, “জিতেছ, বাঃ, জীবনে তো হারজিত আছেই,” বলতে বলতে নিজের বাড়িতে ঢুকে গেলেন। জানলেনও না, বালক দুটি বাজি ধরেছিল তাঁরই ওপর। অর্থাৎ ভুলচু বলছিল, “বল তো, আজ ফিরবে কি না!” মোমো, শ্যাম ব্যানার্জির যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, বলেছে, “উঁহুঁ আজ ফিরবে না। হাঁটাটা বেশ কনফিডেন্ট। আজ কিছু ভুলে গেলে, হাঁটাটা ওরকম হত না।”

ভুলচু বলেছে, “উঁহুঁ শিওর ভুলে গেছে। তুই দেখ। এখনই ফিরবে।”

“ফিরবে না।”

“বাজি?”

“বাজি।”

“দশ টাকা।”

“উঁহুঁ । পাঁচ টাকা।”

“আচ্ছা। পাঁচ টাকা। ঠিক তো!”

“হ্যাঁ ঠিক।”

তারপরই ঘুরে গেছেন শ্যাম ব্যানার্জি। আর ভুলচু চেঁচিয়ে উঠেছে জিতেছি। জিতেছি।

সেই হেরে যাওয়াটা মোমো-র একটা তিক্ত স্মৃতি। তাই সে বিনিকে বলেছিল, “বলতে পারলি না তো, টাক ঢেউখেলানো হয় কেন?”

বিনি লাফায়, “কেন রে দাদা?”

“কবিতা লেখে তো। সারাক্ষণ ব্রেনের মধ্যে চিন্তা ঘুরছে। একেবারে ঢেউ খেলছে চিন্তার। বুঝলি, তাই বাইরের টাকেও সে রকম ঢেউ ঢেউ ব্যাপার…।”

সত্যি, শ্যাম ব্যানার্জির মাথার পেছনে ইন্দ্রলুপ্তটি বেশ একজায়গায় উঁচু, একজায়গায় নিচু।

এই মুহূর্তে অবশ্য ভদ্রলোক দরজা খুলে বেশ হকচকিয়ে গেছেন। যাওয়ারই কথা।

“এত সকালে! সুবীরবাবু।”

সুবীরবাবু, খানিক বিরক্ত মুখে বললেন, “এই যে, এ একটু এল।” বলে তিনি বিনির দিকে আঙুল দেখালেন।

শ্যাম ব্যানার্জি বললেন, “এ মানে? ও, এ-ই মিনি? এসো মিনি, এসো। এসো৷”

বিনি ক্রুদ্ধ মুখে বলল, “মিনি নয়। বিনি। আমার নাম। ঠিক করে বলবে।”

শ্যাম ব্যানার্জি ভয়ে ভয়ে বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। ঠিক করে বলাই তো উচিত। মানে বিধেয়। মানে যাকে বলে শোভন! তাই না?”

শ্যামবাবুর ভয় পাওয়ার কারণ আছে। বিনির সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম অভিজ্ঞতাই তিনি ভোলেননি। প্রথমবার যেদিন তিনি বিনিকে দেখেন, সেদিন তিনি সুবীরবাবুর আলমারি থেকে বই নিয়ে ঘাঁটছিলেন। এটা শ্যাম ব্যানার্জির স্বভাব। সুবীরবাবু তাঁকে কিছু বলতে পারেন না। কবি মানুষ। একটু বই-ই তো দেখছে। তাকে কি কিছু বলা যায়। কিন্তু পরে সুবীরবাবু, তাঁর গবেষণার কাজে বা ছাত্রদের প্রয়োজনে কোনও দরকারি বই খুঁজতে গেলে দেখেন, বিষয় অনুযায়ী সযত্নে রাখা তাঁর বইগুলি, ঘেঁটে, একাকার করে দিয়ে গেছেন ভদ্রলোক। সেইরকম, শ্যাম ব্যানার্জি একদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যথেচ্ছ বই ঘাঁটছেন। একটা করে বই দেখছেন, আর এদিক-ওদিক গুঁজে দিচ্ছেন, তখন, বিনি এসে ও-বাড়িতে রয়েছে।

বলা দরকার, এটা হল, মোমো বিনির জ্যাঠার বাড়ি। সুবীরবাবু এদের দূর সম্পর্কের জ্যাঠামশাই। যদিও সুবীরবাবুকে এরা কখনওই জ্যাঠামশাই বলে না। বলে, সুবীরদা। তাদের বাবা-মা’র অনুকরণে। তারা মাঝে মাঝেই ছলছুতোয় এ-বাড়িতে এসে থাকে। আর বুচু, সুবীরবাবুর মেয়ে উচ্চশিক্ষার্থে দিল্লি চলে যাওয়ার পর এটা বেড়েছে। সেদিনও বিনি এসেছে। এসে দেখে কিনা দাড়িওয়ালা একটা লোক, আপনমনে একটার পর একটা বই নামাচ্ছে। আপন মনে বিড়বিড় করছে। দু’-চার পাতা পড়ছে। হাসছে। একটা নোটবই নিয়ে তাতে পেনসিল দিয়ে কীসব টুকছে। আবার বইগুলো যেমন তেমন করে রেখে দিচ্ছে।

বিনি তো কবি টবি বলে জানে না। সে গিয়ে বলল, “সুবীরদার বইয়ে হাত দিয়েছ কেন?”

শ্যাম ব্যানার্জি ঘোরে ছিলেন, চমকে তাকালেন। “অ্যাঁ। হ্যাঁ। হ্যাঁ। হ্যাঁ হাত দিয়েছি কেন। তুমি কে মণি?”

বিনি ভুরু কুঁচকে বলল, “মণি নয়। বিনি। আমার নাম। ঠিক করে বলবে।”

শ্যাম ব্যানার্জি বলেন, “অ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ। ঠিক করেই তো বলব। ঠিকই তো। নাম তো ভুল বলা অনুচিত। মানে অন্যায়। মানে যাকে বলে অসৌজন্যমূলক। তাই না? অ্যাঁ।” বলে তিনি, পরবর্তীকালে সেসব ভুলের জন্য অনুতাপ করেছেন, তেমন একটি ভুল করে বসলেন। শ্যাম ব্যানার্জি, কী সোনামণি বাচ্চা এটা? এটা কার মেয়ে? বলে, বিনির গাল টিপে আদর করলেন। ঝুন্টুচুন্টু, ঢুচুচুচ্চু।”

সেদিন সুবীরবাবুর স্ত্রী সুপ্রিয়া বাড়িতে ছিলেন।

একটু পরে তিনি দেখলেন সারা বাড়ি শ্যাম ব্যানার্জি দৌড়ে বেড়াচ্ছেন, আর তাঁকে তাড়া করে চলেছে বিনি।

ব্যাপারটা এইরকম: শ্যাম ব্যানার্জি কী সোনামণি বাচ্চা এটা বলে গাল টিপে আদর তো করেছেন, কিন্তু তিনি দুটো জিনিস জানতেন না। এক, বিনি গাল টিপে আদর করা একদম পছন্দ করে না। দুই, শ্যাম ব্যানার্জির রোগা রোগা হাড় বের করা আঙুলে গাল টিপলে প্রচণ্ড লাগে। ফলে, তিনি দেখলেন, কোথা থেকে একটা প্লাস্টিকের টুল নিয়ে এসে বিনি তার পাশে রাখল। তিনি আপন মনে বলে উঠলেন, “কী বিনি, তুমিও বই দেখবে? কী বই!” তারপরে তিনি দেখলেন, বিনি টুলের ওপর দাঁড়িয়ে তাঁর প্রায় সমান সমান লম্বা হয়ে বলছে, “না, বই দেখব না। গাল টিপলে কেন! কেন-ন অ অ অ!” বলে, প্রচণ্ড জোরে শ্যাম ব্যানার্জির গাল খামচে ধরেছে। আর, দাড়ি ধরে হ্যাঁচকাচ্ছে। শ্যাম ব্যানার্জি “আঁ আঁ” করে দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরের অন্যপ্রান্তে চলে গেছেন। খেয়াল করেননি, তাঁর পাশেই ছিল একটি ছোট ডিভান। তড়াক করে সেই ডিভানে লাফিয়ে উঠে বিনি আবার সমান করে নিয়েছে নিজের সঙ্গে তাঁর উচ্চতা। এবার এমন জোরে তাঁর থুতনি ধরে মাথা ঠুকে দিয়েছে দেওয়ালে, তিনি অন্ধকার দেখেছেন। শ্যাম ব্যানার্জি “সুপ্রিয়াদি, সুপ্রিয়াদি” ডাকতে ডাকতে প্রাণপণে পৌঁছেছেন সুবীরবাবুদের বেডরুমে। খেয়াল করেননি, বেডরুমে খাট থাকে। মুহূর্তে সেই খাটের ওপর উঠে পড়েছে বিনি। আর আবারও তাঁর গালের দিকে হাত বাড়িয়েছে। কিন্তু এবার, মাথাটা একটু সরিয়ে নেওয়ায় সে হাতের মুঠোয় পেয়েছে শ্যাম ব্যানার্জির দাড়ি। সুপ্রিয়া এসে যখন তাঁকে মুক্ত করলেন, শ্যাম ব্যানার্জি তখন পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছেন।

সেই স্মৃতি শ্যাম ব্যানার্জি ভোলেননি। সাদরে সসম্ভ্রমে তিনি বিনিকে বললেন, “বিনি। বিনি। ঠিক। এসো।”

সুবীরবাবু পেটে একটা খোঁচা খেলেন। আবার। “আবার কী।”

বিনি বলে, “আজকে কী—সেটা বলে দাও।”

সুবীরবাবু বলেন, “ও হ্যাঁ, শ্যামবাবু, আজ বিনির জন্মদিন।”

“তাই নাকি, তাই নাকি।” শ্যাম ব্যানার্জি উচ্ছ্বসিতভাবে বললেন, “সেই জন্যই কি ন্যাড়া হয়েছে।”

এটা ঠিকই, বিনি গত রবিবারে ন্যাড়া হয়েছে। যেটা তার একদম পছন্দ ছিল না। কিন্তু মাথার তালুতে একটা ছোট ফুসকুড়ি চিরুনির খোঁচায় বিষিয়ে গিয়েছিল। জ্বর এসে গিয়েছিল বেচারির। তারপর ডাক্তারের পরামর্শে ন্যাড়া করে দেওয়ার পর তিন-চার দিনেই উপশম হয়েছে। বিনি ভুরুটুরু কুঁচকে শ্যাম ব্যানার্জির দিকে তাকাল। বলল, “তোমার জন্মদিনে তুমি ন্যাড়া হও বুঝি?”

শ্যাম ব্যানার্জি বললেন, “এ অ্যা না মানে, আমার আর জন্মদিন মানে—ন্যাড়া না হই না।”

“সুবীরদা ন্যাড়া হয় জন্মদিনে?”

শ্যাম ব্যানার্জি একটু ভেবে বললেন, “সুবীরবাবু? জন্মদিনে? ন্যাড়া? না, কই, মনে তো হয় না!”

গম্ভীরভাবে বলে বিনি, “তবে আমি ন্যাড়া হব কেন? আমি বাচ্চা বলে?”

শ্যাম ব্যানার্জি এ-কথা শুনে প্রথমটা বিস্ফারিত চোখে বিনির দিকে তাকিয়ে রইলেন। অবশ্য তাঁর ওই ছোট্ট চশমার গুল্লিগুল্লি এতটুকু কাচের ভেতর দিয়ে যতটা বিস্ফারিত চোখে তাকানো যায়, তার বেশি নয়। তারপরই লাফিয়ে উঠলেন, “দেখলেন, সুবীরবাবু, দেখলেন, কী বুদ্ধির দীপ্তি। এখনকার বাচ্চাদের কী প্রতিভা। নিজেই নিজেকে বাচ্চা বলে আইডেন্টিফাই করতে পারছে। আমরা আমাদের এই বয়সে—হুঁ ফুঁ। ভাবতেও পারতাম না।”

হঠাৎ সুবীরবাবু ধমকে ওঠেন, “এ কী রে বারবার চমকে দিচ্ছিস কেন! যা বলবি মুখে বল না কেন। আমার পেটে লাগে না?”

বিনি আবার একটা খোঁচা মেরেছে সুবীরবাবুকে। সকাল থেকে এই নিয়ে বারচারেক হল। এখনও এককাপ চা খাওয়া হয়নি। তিনিই বা কত সইবেন। কিন্তু বিনি তাতে একটু লজ্জিত নয়। যে সমানতালে, উলটো ধমক দিয়ে বলে, “এখনও কিছু বলছে না যে।”

সুবীরবাবু শ্যাম ব্যানার্জিকে বলেন, “ইয়ে শ্যামবাবু, আজ তো বিনির জন্মদিন, ওকে একটু শুভেচ্ছা জানিয়ে দিন তো! সেই থেকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে।”

শ্যামবাবু লাফিয়ে উঠলেন, “আরে হ্যাঁ। ঠিকই তো! নিশ্চয়ই। জানাবই তো। শুভেচ্ছা মানে, শুভকামনা। মানে, যাকে বলে, শুভৈষণা, শুভায়ু ভব…”

“য্যাঃ। কীসব শক্ত শক্ত কথা বলে যাচ্ছে! ও সুবীরদা? দ্যাখো না।”

“আচ্ছা আচ্ছা!” শ্যাম ব্যানার্জি সংযত হন। তারপর, তাঁর প্রশস্ত কপালে হাত বোলান। বলেন, “ঠিকই তো। বিনি। তোমার শুভ জন্মদিন। শুভ জন্মদিন। তুমি বড় হও। বড় হবে। আমি জানি।”

“সে আমিও জানি। সবাই বড় হয়।”

“সে তো বটেই। কিন্তু বিনি, আমি বলছি, তুমি অনেক বড় হবে। তার জন্য তার জন্য…”

এবার শ্যাম ব্যানার্জির মনে হল কিছু উপদেশ তাঁর দেওয়া উচিত।

জন্মদিন উপলক্ষে শ্যাম ব্যানার্জি বলে চলেন, “তুমি কিন্তু মন দিয়ে পড়াশুনো করবে। মায়ের কথা, বাবার কথা শুনবে। বুঝেছ! সারাক্ষণ খেলে বেড়াবে না।”

বিনি বলে, “দেখা যাক। দেখা যাক।”

শ্যাম ব্যানার্জি কথাটা কান করেন না। বলেন, “আজ শুভ জন্মদিন, আজ শপথ নাও, গুরুজনদের মান্য করবে। কারও কথার অবাধ্য হবে না। বড়দের দাড়ি ধরে টানবে না। ঠিক তো?”

বিনি আবারও বলে, “দেখা যাক। দেখা যাক। কী হয়।”

শ্যাম ব্যানার্জি ঘাবড়ে যান। বলেন, “ও সুবীরবাবু, এ কী বলতে চাইছে। বারবার দেখা যাক বলছে কেন!”

সুবীরবাবু হতাশ গলায় বলেন, “এটি ওর বাবার স্বভাব। মুদ্রাদোষও বলা যায়। ওর বাবা, মানে আমার পিসতুতো ভাইটিকে কেউ কোনও কথা বললে, সে, ‘দেখা যাক, দেখা যাক,’ বলে থাকে। তারপর বলে, ‘কী হয়।’ ইনি বাবার কাছে শুনে শুনে সেটি রপ্ত করে ফেলেছেন। এর টনসিলের ধাত, যখন আরও ছোট ছিল, একদিন ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা দই খেতে গিয়ে ভাঁড় ভেঙে ফেলেছিল। তাই ওর মা কান ধরে বলেছেন, ‘ঠান্ডা খেতে বারণ করেছি না, আর কখনও খাবে না তো? খাবে? কী, খাবে না তো?’ তখনও বিনি চোখ ভর্তি জল নিয়ে বলে যাচ্ছিল, ‘দেখা যাক, দেখা যাক।’ ”

এবার বিনি শ্যাম ব্যানার্জিকে বলে, “দই খাব। নিয়ে এসে তো। দই।”

সুবীরবাবু বলেন, “অ্যাই বিনি। কী লাগিয়েছিস। চল তো।”

শ্যাম ব্যানার্জি বলেন, “দই? হ্যাঁ? তা মানে? স্নেহমায়া? স্নেহমায়া?” ডাকতে ডাকতে ভেতরে চলে যান।

সুবীরবাবু, বিনিকে, “চল শিগগির, ছি ছি। বেচারা ভদ্রলোককে এভাবে বিরক্ত করা।”

বিনি আপন মনে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। বলে, “এই টিভিটা কী করে চালায়।”

শ্যাম ব্যানার্জিদের টেবিলে একটা সাদা কালো ছোট সাইজের টিভি। বিনি এদিক ওদিক তাকায় তারপর একটা টুলে উঠে পড়ে। শ্যাম ব্যানার্জি ঘরে ঢুকেই বিনিকে টুলের ওপর উঠতে দেখে আঁতকে ওঠেন। “কেন মা। কেন। মানে টুলের ওপর কেন?”

“টিভিটা চালাব। চালিয়ে দাও তো।”

বলে পটাপট সুইচ টিপতে থাকে। হঠাৎ টিভিটা সচল হয়ে খুব জোরে বেজে ওঠে। সুবীরবাবু লাফিয়ে উঠে টিভির সুইচ নিভিয়ে দেন। তারপর বিনির হাত ধরে বলেন, “বাঁদরামি বন্ধ কর। নাম। নাম টুল থেকে।”

বিনা বাক্যে শান্তভাবে বিনি টুল থেকে নেমে আসে, বলে, “নিউজ হচ্ছে। আমি নিউজ শুনি না।”

ইতিমধ্যে শ্যাম ব্যানার্জির গৃহিণী স্নেহমায়া দেবী ঘরে ঢোকেন।

এত সকালেই তাঁর স্নান হয়ে গেছে।

স্নানঘরে ছিলেন বলেই এতক্ষণ তাঁকে দেখা যায়নি। তাঁর চেহারাটি শ্যাম ব্যানার্জির বিপরীত। তাঁর স্বামী যেমন রোগা প্যাকাটি টাইপ, তিনি তেমনই গোলগাল ফরসাটরসা। লালপাড় শাড়ি আর বড় সিঁদুরের টিপ। স্নেহমায়া দেবী বলেন, “এই যে, বিনি দই তো নেই। মালপো করেছি। খাবি?”

বিনি বলল, “হ্যাঁ অ্যা। দাও।”

শ্যাম ব্যানার্জি খুবই হিংসুক দৃষ্টিতে তাকালেন তাঁর গৃহিণীর দিকে। কী করে যে ছোটরা স্নেহমায়া দেবীর কাছে এত বশ মানে। স্নেহমায়া কোনও অচেনা বাচ্চাকে রাস্তায় দেখলেও, “উফ, কী ছুন্দল। ছোনামণি ছু টু চু টু করে কোলে নিয়ে নেন। প্রচণ্ড পাজি বাচ্চারাও ঠান্ডা হয়ে যায়। তার দেখাদেখি শ্যাম ব্যানার্জিও বাচ্চা দেখলেই তেমন করে সোহাগ দেখাতে যেতেন। কিন্তু কেন জানি না, তাঁর ওই বদখত কাঠ কাঠ চেহারার জন্যই হয়তো সবসময়ই, বাচ্চাদের কাছে হয় তিনি থাবড়া খেয়েছেন, নয়তো তারা খিমচে কামড়ে রক্ত বের করে দিয়েছে তাঁর। স্নেহমায়া দেবী মালপোয়ার প্লেট সামনে নামিয়ে রেখে বিনিকে প্রশ্ন করেন, “আজ জন্মদিনে বিনির বাড়িতে খাওয়াদাওয়া। জোর; তাই না?”

বিনি আঙুল দেখিয়ে বলল, “সুবীরদা খাওয়াবে।”

স্নেহমায়া দেবী বলেন, “তাই নাকি! সুবীববাবু…”

সুবীরবাবু বলেন, “বিনি তো নিজের জন্মদিনে নিজেই আমার কাছে নেমন্তন্ন নিয়েছে। আজ সকাল থেকে ওর সব খাওয়াদাওয়ার ভার আমার। তাই কাল রাতেই ওকে আনতে হয়েছে। আমার একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে, উনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কোলে চেপে উঠেছেন।”

বিনি মালপো থেকে মুখ তুলে প্রতিবাদ করে, “মোটেই না, আমি জেগে জেগে চোখ বুজে ছিলাম, দেখছিলাম, তুমি আমাকে দোতলায় তুলতে পারো কি না।”

স্নেহমায়া দেবী এইসব কথার মধ্যে কখন যেন চা বানিয়ে ফেলেছেন। কাপ এগিয়ে দিয়ে বলেন, “তা হলে ভাই সুবীরবাবু, ওকে কী খাওয়াবেন? রান্না করবেন নাকি? আপনি তো ভালই রাঁধেন।”

সুবীরবাবু সত্যিই ভাল রান্না করতে পারেন। কিন্তু বিনি নাকি সুবীরবাবুর রান্না খেতে চায় না। তাই সুবীরবাবু বলেন, “দেখি, ভেবেছি, ভাল একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাব। বিরিয়ানি খেতে চেয়েছে।”

বিনি চেঁচাল, “ইঃ। দহিবড়া?”

“হ্যাঁ। আর দহিবড়া।”

হঠাৎ শ্যাম ব্যানার্জি “পেপার এসেছে, পেপার এসেছে” বলে নেচে ওঠেন। তাঁরা দুটো কাগজ রাখেন, একটা ইংরেজি। একটা বাংলা।

শ্যাম ব্যানার্জি ইংরেজিটা সুবীরবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজে বাংলাটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। শ্যাম ব্যানার্জির কাগজ পড়ার একটা বিশেষত্ব আছে। তিনি প্রথম পাতা বা হেডলাইন পড়েন না। তিনি পড়েন ভেতরের পাতার ছোট ছোট খবর। যেমন ‘হাওড়ায় দু’বস্তা চিনি উদ্ধার,’ ‘চিড়িয়াখানায় ভালুক অসুস্থ’ কিংবা ‘গাঁজা চোর ধৃত’, অথবা ‘বনগাঁয় দু’মাস বিচারক নেই’—এ ধরনের খবর পড়ে তিনি বেশ চিন্তিত হয়ে ওঠেন। এ ছাড়া তিনি দৈনিক রাশিফল পড়েন। যেমন, সুবীরবাবুর মনে আছে শ্যাম ব্যানার্জি তাঁকে বলেছিলেন, “আজ আমার রাশিফলে দেখলাম চর্মপীড়ায় ক্লেশ। তারপরই সকাল দশটা নাগাদ একটা কাঠপিঁপড়ে কামড়াল আমাকে। দেখুন একেবারে ডান হাতেই। কতটা ফুলে গেছে দেখুন তো। এখন কবিতা লিখব কী করে! একেই বলে চর্মপীড়ায়⋯”

সুবীরবাবু বললেন, “কিন্তু এটাকে তো দুর্ঘটনাও বলা যায়। আপনি অত শিওর হচ্ছেন কী করে। তা ছাড়া, যদি লেখা থাকত দংশক প্রাণী বিষয়ে সাবধান, তা হলেও হত,” কিন্তু শ্যাম ব্যানার্জি বাধা দিয়েছিলেন, “না, না, দেখুন, চর্ম মানে ব্যাপারটা চর্মে, চামড়ায়। চর্মই তো ফুলে গেছে। চর্মেই তো কামড়েছে—ফলে এক রকম চর্মপীড়া⋯”

সুবীরবাবু বলেছিলেন, “যাক গে যাক। এখন একটু চুন লাগিয়ে দিন।”

আজ অবশ্য শ্যাম ব্যানার্জি রাশিফল পড়েছেন কি না বোঝা গেল না। কিন্তু খুব চিন্তিত ভাবে তিনি কাগজটা নিয়ে এসে বললেন, “দেখেছেন সুবীরবাবু, কী দিনকাল পড়েছে।”

সুবীরবাবু বলেন, “হ্যাঁ। দিনকাল তো ভাল নয় ঠিকই। কিন্তু আপনি কী দেখলেন!”

“এই দেখুন না, কাগজে লিখেছে, ‘নস্য নিয়ে অজ্ঞান।’ এর পর তো মানুষ শান্তিতে একটু নস্যিও নিতে পারবে না! ভেজাল ছিল নিশ্চয়ই!”

বিনি জিজ্ঞেস করে, “নস্যি কী?” বিনির নস্য বিষয়ে জ্ঞান হয়নি এখনও।

শ্যাম ব্যানার্জি উৎসাহভরে বলে ওঠেন, “এই তো। এই তো। নস্যি। এই যে।” বলে তাক থেকে চকচকে নস্যির কৌটো তুলে দেখান।

বিনি বলে, “কী এটা দেখি! খোলো। এটা দিয়ে কী হয়?”

“না, না, বাবা। তুমি দূরে দূরে থাকো। এটা দিয়ে কী হয় দেখাচ্ছি।”

স্নেহমায়া দেবী রাগত ভাবে বলেন, “ম্যাগো, কী বিচ্ছিরি অভ্যেস।”

শ্যাম ব্যানার্জি জীবনে এই প্রথম কাউকে নস্যি নেওয়া দেখাচ্ছেন। সুতরাং, বিরাট কৃতিত্বের কাজ করছেন এইভাবে, কৌটো খুলে দু’ টিপ নস্যি নাকে দিয়ে টানেন। তবে অতি উৎসাহের জন্য, বোধহয় পরিমাণ বেশি হয়ে থাকবে— তাই ঝড়ং ঝড়ং ঝড়ং করে দু’-তিনবার বাজখাই হাঁচলেন।

স্নেহমায়া দেবী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে উঁহু বলে আওয়াজ করলেন।

বিনি হাততালি দিয়ে উঠল, “কী মজা কী মজা। আমি নস্যি নেব।”

সুবীরবাবু চোখ পাকালেন, “খবরদার। অ্যাই বিনি। তা হলে বিরিয়ানি বন্ধ।”

ইতিমধ্যে নস্যির ঠেলায় শ্যাম ব্যানার্জির দু’চোখ থেকে জল নেমেছে। তাই দেখে বিনি অবাক হয়ে বলে, “তুমি কাঁদছ কেন?”

শ্যাম ব্যানার্জি কোনওমতে বলেন, “আনন্দে। নস্যি নেওয়ার আনন্দে।”

স্নেহমায়া দেবী হঠাৎ খেপে যান। “তোমার আনন্দ বের করছি,” বলে, কৌটোটা নিয়ে কোনও কিছু বোঝার আগেই তিনতলার জানলা দিয়ে পেছনের রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেন। বিনি আবার আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে, “কী মজা! কী মজা!”

শ্যাম ব্যানার্জি হাহাকার করেন, “অ্যা-অ্যা- হ্যা-হ্যা—ফেলে দিলে!”

স্নেহমায়া দেবী বলেন, “দিলাম। সারাক্ষণ হাঁচছে আর নাক ঝাড়ছে। ওই রুমালগুলো সর্দিতে সর্দিতে কাদা। কে কাচবে ওগুলো?”

সুবীরবাবু সামলে দেন, “যাকগে যাকগে। একেবারে ফেলে দিলেন।”

“দিলাম। ও আবার আনবে। এই নিয়ে কতবার ফেলে দিলাম জিজ্ঞেস করুন ওকে।”

সুবীরবাবু বলেন, “কতবার?”

শ্যাম ব্যানার্জি মুখ নিচু করে বলেন, “তেরোবার। আর কিনব না। আর নয়। তা ছাড়া মানুষ নস্যি নিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে।” বলে শ্যাম ব্যানার্জি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

বিনির হঠাৎ কী মনে হয়। বলে, “সুবীরদা, ওর নাম কী?”

“ওর নাম মানে? ঠিকভাবে কথা বলো। উনি তোমার জেঠু হন। ওঁর নাম শ্যাম ব্যানার্জি। কেন?”

বিনি বলে, “আমি ওকে নেমন্তন্ন করব তো, তাই। শ্যাম ব্যানার্জি, আমি তোমাকে নেমন্তন্ন করছি। তুমি আমার সঙ্গে আজ বিরিয়ানি খাবে। আর দহিবড়া খাবে।”

হঠাৎ তাঁর প্রতি এত সদয় হল কী করে বিনি। আসলে তিনি জানেন না, তাঁকে নস্যি নিতে দেখার পর থেকে বিনি তাঁকে পছন্দ করে ফেলেছে। তারপরে স্নেহমায়া দেবী কৌটো ফেলে দেওয়ার পর তিনি যে করুণ মুখে বসেছিলেন। তা দেখে মায়াও হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ সে খেয়াল করেছিল, লোকটার নাম সে মনে করতে পারছে না। কিন্তু এবার তিনি বেশ খুশি ও অবাক হয়ে বলেন, “অ্যাঁ। যাব! মানে যাবই তো। সুবীরবাবু!”

সুবীরবাবু বলেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলুন, চলুন। খুব ভাল হবে।”

স্নেহমায়া দেবী বলেন, “দ্যাখো তোমার কী কপাল, সকালে উঠেই বিরিয়ানির নেমন্তন্ন।”

বিনি স্নেহমায়া দেবীর গা ঘেঁষে দাড়িয়ে বলে, “তুমিও চলো না জেঠিমা।”

স্নেহমায়া বলেন, “আমার কি যাওয়ার জো আছে। আমি যাব এখন, নারকেলডাঙা, আমার বোনের বাড়ি।”

শ্যাম ব্যানার্জি বলেন, “সুবীরবাবু, আমি তা হলে চানটানগুলো সেরে নিই। একটা ভাল পাঞ্জাবি পরতে হবে। দ্যাখো তো গো একটা খুব সাদা মানে, পরিচ্ছন্ন, মানে যাকে বলে শ্বেতশুভ্র, হ্যাঁ, এই গোছের একটা পাঞ্জাবি আছে কি না!”

স্নেহমায়া আলমারি খুলতে খুলতে বলেন, “নস্যির দাগ নেই এমন পাঞ্জাবি তো পাওয়া দুষ্কর।”

শ্যাম ব্যানার্জি উৎফুল্ল হয়ে বলেন, “জানেন তো সুবীরবাবু, আজ কাগজে কী লিখেছে, রাশিফলে!”

সুবীরবাবু বলেন, “কী?”

“লিখেছে, সাহিত্যিকের শুভ। দেখলেন তো মেলে কি না।”

হঠাৎ বিনি বলে, “শ্যাম ব্যানার্জি, তোমার জন্মদিন কবে?”

“আমার? সে তো নভেম্বর মাসে! দশ তারিখে।”

বিনি ঠোঁট ওলটায়, “সে তো অনেক দেরি। শ্যাম ব্যানার্জি, তুমি কিন্তু তোমার জন্মদিনে আমাকে নেমন্তন্ন করবে। প্রমিস!”

“নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। ইয়ে, প্রমিস। তা হলে আমি চানটা করে নিই।”

এই সময় সুবীরবাবু পেটে ফের একটা খোঁচা, খান। “উঃ, আবার কী হল!”

বিনি বলে, “জেঠি কিন্তু আমাকে এখনও উইশ করেনি!”

স্নেহমায়া বলেন, “সত্যিই তো খুব অন্যায় হয়েছে আমার।” বলে, তাকে কাছে টেনে এনে বলতে থাকেন, “আজ শুভ জন্মদিনে আমি তোকে আশীর্বাদ করছি, তুই আরও পাজি হ। আরও পাজি হ।”

ওদিকে, এই আশীর্বচন শুনে, কলঘরের দরজায় ঢুকতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন শ্যাম ব্যানার্জি। কারণ, তিনি সবেমাত্র ভাবছিলেন যে, এর পর আর বিনি তাঁর দাড়ি ধরে টানবে না নিশ্চয়ই!

১৪০৬

অলংকরণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

সকল অধ্যায়

১. প্রোফেসর হিজিবিজ্‌বিজ্ – সত্যজিৎ রায়
২. বাহাদুর – আশাপূর্ণা দেবী
৩. কুমির – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
৪. ননীদা – মতি নন্দী
৫. হর্ষবর্ধনের ভাগনে ভাগ্য – শিবরাম চক্রবর্তী
৬. কর্ভাস – সত্যজিৎ রায়
৭. বেণী লস্করের মুণ্ডু – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৮. টুম্পুর গল্প – সুকুমার দে সরকার
৯. বারীন ভৌমিকের ব্যারাম – সত্যজিৎ রায়
১০. বীর হওয়ার বিড়ম্বনা – শিবরাম চক্রবর্তী
১১. নন্দগুপি – লীলা মজুমদার
১২. পালোয়ান ভূত – মনোজ বসু
১৩. হিসাব – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৪. গান – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৫. জ্যান্ত খেলনা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৬. মুড়ি – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
১৭. কর্নেল মিত্র – বিমল মিত্র
১৮. গুল-ই ঘনাদা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৯. ভয়ঙ্কর মুখোশ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
২০. দিনে ডাকাতি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
২১. গন্ধটা খুব সন্দেহজনক – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২২. মেজকর্তার খেরোখাতা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২৩. গোয়েন্দা বরদাচরণ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৪. সাধু কালাচাঁদের ফলাও কারবার – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
২৫. একটি ভুতুড়ে ঘড়ি – বিমল কর
২৬. বুনো হাতির বন্ধুত্ব – সমরেশ বসু
২৭. গোয়ায় গোগোলের প্রথম কীর্তি – সমরেশ বসু
২৮. ইঁদারায় গণ্ডগোল – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৯. চোর সাধু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৩০. টোরি জঙ্গলের ভক্ত-বাঘ – সুবোধ ঘোষ
৩১. জোনাকি-ভূতের বাড়ি – সমরেশ বসু
৩২. বনবিড়াল – বিমল কর
৩৩. ভয় ও ভূত – সুকুমার সেন
৩৪. সুপারমেন – সমরেশ মজুমদার
৩৫. রাত যখন বারোটা – অশোক বসু
৩৬. প্রেতাত্মার উপত্যকা – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৭. আলুর চপ – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
৩৮. হাবুলমামার ভূতের ব্যবসা এবং… – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৯. অশোকের কাণ্ড – হর্ষ দত্ত
৪০. হারাধন – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪১. হয়তো এইরকমই – আশাপূর্ণা দেবী
৪২. মহারাজা তারিণীখুড়ো – সত্যজিৎ রায়
৪৩. খুড়ো-ভাইপো – বাণী বসু
৪৪. সহযাত্রী – সত্যজিৎ রায়
৪৫. দারিৎসু – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৪৬. চার বুড়োর আড্ডা – আশাপূর্ণা দেবী
৪৭. রামপলের অন্তর্ধান রহস্য – রূপক সাহা
৪৮. দেয়ালা – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪৯. শুভ জন্মদিন – জয় গোস্বামী
৫০. ইন্দ্রনাথ সামন্তের বাড়ি – সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন