হর্ষবর্ধনের ভাগনে ভাগ্য – শিবরাম চক্রবর্তী

পৌলোমী সেনগুপ্ত

ভাগনে যে সব সময় মামার সব বিষয়ে ভাগ দখল পায়, তা হয় না। বরং, বেশির ভাগ তার উলটোটাই দেখা যায়।

সব ভাগনেই কিছু মাতুলভাগ্য নিয়ে জন্মায় না।

মামা, কোনও পরীক্ষা-টরিক্ষা না দিয়েই, ডবোল পাশ করলেও দেখা গেছে যে তাঁর ভাগনে ডবোল ফেল মেরে বসেছে—রীতিমতন পরীক্ষা দিয়েই, এমন কী!

এর মানে কী তা কে জানে, তবে সেটাই সেবার হাতে হাতে প্রমাণে পেলাম!

‘আমার ভাগনের বিষয়ে কিছু বলতে চাই’, হর্ষবর্ধনই কথাটা পাড়লেন গোড়ায়: ‘আপনি যদি তার সম্বন্ধে একটু চেষ্টা করেন—’

‘আবার সম্বন্ধ?’ শুনেই না আমার দম বন্ধ হবার মতো প্রায়: ‘মাপ করবেন আমায়, আর না! আপনার সেই গুরুঠাকুরের মেয়ের সম্বন্ধ করতে গিয়েই যথেষ্ট শিক্ষা পেয়েছি। অমন গুরুতর ঝঞ্ঝাটে পড়তে চাই না আর।’

‘শিক্ষা পেয়েছেন, না, শিক্ষা দিয়েছেন। হাড়ে হাড়ে শিক্ষা দিয়েছেন। আমার-ও কি শিক্ষা হয়নি নাকি? যা পেঁয়াজ-খাওয়া পাত্র এনেছিলেন মশাই!’

বলতে গিয়ে পয়জার-খাওয়ার মতোই যেন মুখখানা হয়ে যায় তাঁর।

তাঁর সেই লপেটাহত মুখের দিকে তাকিয়ে ঘটনাটা মনে পড়ে আমার…

সংক্ষেপে ব্যাপারটা বলা যায় এখানে…

গুরুদেব তাঁর কন্যার একটি সৎপাত্রের জন্য উপরোধ করেছিলেন তাঁকে। আর সেই উপরোধের ঢেঁকি গিলতে হয়েছিল এই আমাকেই।

এদিকে আমার মা পই পই করে মানা করেছিলেন কারও কোনও সম্বন্ধের ব্যাপারে যাবিনে তুই কক্ষনও। কদাচ না।

মা’র সেই পই পই করে মানা কখনও আমি অমান্য করিনি। এমনকী, নিজের সম্বন্ধেও যাইনি আমি একেবারে। বিয়েও দিইনি নিজের পৈতেও না, এমন কী! তাঁর সেই পই পই মানা মেনে এসেছি। অথচ, এদিকে, হর্ষবর্ধনের কথাটাও ঠেলা দায়!

শেষটায়, দু’কুল বজায় রাখতে মন গড়া এক সম্বন্ধ এনে খাড়া করলাম…

‘একটি ভাল ছেলে আমার সন্ধানে আছে,’ পাড়া গেল কথাটা—সব দিক থেকেই সংপাত্র কিন্তু দোষের মধ্যে একটি মাত্র খুঁত—তবে সে কথাও কই মশাই, একেবারে নিখুঁত কেউ কি এই দুনিয়ায় আছে কোনওখানে কোথাও? এমনকী আপনার ওই চাঁদের মধ্যেও তো খুঁত। তবে কিনা, চাঁদ এই পৃথিবীর নয়। তবে এই পাত্রটির বিষয়ে বলতে হয় যে সে একেবারে সোনার চাঁদ—শুধু একটুখানি যা খুঁত!’

‘খুঁতটা কী শুনি?’

‘এমন কিছু খুঁত-খুঁত করার মতন নয়। ছেলেটি পেঁয়াজ খায়।’

‘পেঁয়াজ খায়?’ শুনেই চমকে ওঠেন হর্ষবর্ধন: কী বললেন, পেঁয়াজ খায় পাত্তর?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। সেই কথাই বলছি। এই সামান্য একটুখানি যা খুঁত তার।’

‘গোঁসাই-ঠাকুরদের কুলে পেঁয়াজখোর জামাই! এটাকে আপনি সামান্য বলছেন! এই পেঁয়াজ খাওয়াকে?’

‘না, সামান্য বলছিনে। পেঁয়াজ সামান্য নয়। ঠাকুর বলতেন পেঁয়াজের খোসা ছাড়িয়ে গেলে শেষ পর্যন্ত যেমন তার কিছুই থাকে না, তেমনি নেতি নেতি করতে করতে এগিয়ে গেলে এই ব্রহ্মাণ্ডমায়া বিলকুল গায়েব। এমনকী স্বয়ং পরমব্রহ্মের পাত্তাও মেলে না তখন।’

‘বলতেন নাকি ঠাকুর? তার মানেটা?’

‘মানেটা যে কী, তা আমিও ঠিক বুঝিনি। মনে হচ্ছে পেঁয়াজ হল গে ব্ৰহ্মাণ্ড কিংবা ব্রহ্মাণ্ড একটা পেঁয়াজি। অর্থাৎ কিনা, ব্রহ্মাণ্ডের মতন পেঁয়াজও আসলে মায়াই৷’

‘মায়াই হোক বা যাই হোক, মায়া বলে পেঁয়াজকে উড়িয়ে দিলে তো চলবে না মশাই! পেঁয়াজ বেজায় গন্ধ ছাড়ে যে! ঠাকুর বংশে তো ও-জিনিসের আমদানি হতে পারে না।’ তার কাতর কণ্ঠ শুনতে পাই।

‘সে কথা আপনি বুঝুন। তবে আমি বলছিলাম কি পাত্রটি ভালই। তবে ওই যা খুঁত—একটু পেঁয়াজ খায়। তাই বলে কি রোজই খায়? তা নয়। মাঝে মাঝে খেয়ে থাকে। ওই মাংস-টাংস হলেই—’

‘মাংস খায়!’ তিনি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন— ‘আমাদের ঠাকুরমশায়ের নিরিমিষ বোষ্টম বংশে এসে শেষে মাংস খাবে! পাঁঠার মাংস কি অপাঠ্য মাংস কে জানে! নিষিদ্ধ মাংস কি না তাই বা কে বলবে।’

‘না না, নিষিদ্ধ নয়, সুসিদ্ধ করেই খায়। নিষিদ্ধ হজম করতে পারবে কেন?’

‘নিষিদ্ধই হোক আর সুসিদ্ধই হোক…’ হর্ষবর্ধনের গলায় যেন হায় হায় বাজে—’গোঁসাই বাড়িতে এসে শেষে মাংস খাবে নাকি!’

‘খাব বলে কি আর অ্যাতো অ্যাতো? পাচ্ছে কোথায়! একটু আধটু কখনও কখনও খায়। আর, সে-ও ওই চাটের মুখেই’। হবু জামাইয়ের মুখ রাখতে গিয়ে আমার রোখ চেপে যায়।

‘চাট!’ সদ্য যেন ঘোড়ার চাট খেলেন এমনি ঘোরালো হয় তাঁর মুখখানা—’এরপর আবার চাটও আছে? চাট তো জানি…চাট তো জানি…’

‘হ্যাঁ, যা ধরেছেন!’ তাঁর বোধশক্তির বহর দেখে আমি উৎফুল্ল হই— ‘খালি খালি কি আর চাট মারে? অকারণে খায় না মশাই!’

‘এর মধ্যে কারণও আছে আবার!’ তার আর্তনাদ শুনি: ‘বৈষ্ণব বংশে শেষটায় ঘোর শাক্তের আমদানি!’

‘শাক্ত বলে শাক্ত! ঘোরতর শাক্ত। শাক্ত বা শক্ত যাই বলুন, শুধু ও-ই নয়। ওদের দলটাই বেশ শক্তিধর। বেজায় শক্তি ধরে। ওয়াগন ভাঙাই কি সোজা নাকি? ওই তো কাজ ওদের। শক্তি না থাকলে কি পারা যায় ওসব? আর সেই কারণেই— ওই সব কাজকর্মের গোড়ায় একটুখানি কারণ বারি পান করে নিতে হয়। তবে ওই একটুখানিই। বেশি খাবার মুরোদ কই ওদের? পয়সা কোথায়? তা ছাড়া—’

‘থামুন! থামুন!…ওয়াগন ভাঙা, মালগাড়ি লুঠ! কী বলছেন আপনি? অ্যাঁ? আর এই কারণেই থামে কি না কে জানে। গাঁজা গুলি ভাং টাং চণ্ডু চরস—’

‘গাঁজা চণ্ডু চরসের কথা বলতে পারি না, তবে গুলি খায় বটে মাঝে মাঝে। আর ওই ভাঙের কথা যা বললেন… ভাঙচুরের কাজ তো! ভাঙবার মুখে চুর হয়ে থাকলে, খেয়াল না রাখলে আচমকা ওইগুলিও…’

‘গুলিও খায়?’ আবার তাঁর হায় হায় শোনা যায়।

‘খায়, মানে, খেতে বাধ্য হয় আর কী! পুলিশের গুলি এসে পড়ে যে আটপকা। না খেয়ে কি উপায় আছে!’

‘পুলিশের গুলিও খায়। ওয়াগন ভাঙে, নেশা করে, মাংস খায়, চুরি ডাকাতিও করে,’ পাত্রের গুণাবলীর ফিরিস্তি দিতে গিয়ে ক্রমেই তিনি যেন মিইয়ে পড়েন—‘এর ওপরেও আরও কোনও ইতরবিশেষ আছে কি না কে জানে!’ হর্ষবর্ধন মুহ্যমান হন।

‘হ্যাঁ, আছে ইতর বিশেষ’—আমার আশ্বাস দান: ‘আছে বই কী। ওর বন্ধুরাই সেই ইতরবিশেষ। বিশেষ ইতর বলেই বোধ হয় তাদের আমার। সত্যি বলতে কী, ছেলেটি ভালই, পাত্র হিসেবে নেহাত অপাত্র নয়, কিন্তু ওই যে বলে সঙ্গদোষে লোহা ভাসে। সঙ্গীদের পাল্লায় পড়েই আমাদের ভাবী দুলোহা ভেসে গেল!’

‘দুলোহা! দুলোহা নাম? বাঙালিও নয় বুঝি?’

‘না না, দুলোহা ওর নাম নয়। খাঁটি বাঙালিও বটে। আমাদের বেহারের দেহাতি ভাষায় জামাইকে দুলোহা না দুলাহা কী যেন বলে থাকে। তাই বলছিলাম। চেহারাটা একটু কাঠখোট্টা হলেও তাই বলে খোট্টা নয়—বাঙালিই আলবাৎ।’

‘রাখুন আপনার দেহাতি বাত! উনি চিৎকার ছাড়েন—’ আপনার কথায় আমার দেহ জ্বলে যাচ্ছে! এমন পাত্র এনেছেন যে…শ্বশুরবাড়িতে আমাদের মেয়ের সুখের অন্ত থাকবে না। জামাই যতক্ষণ বাড়ি থাকবে…বউকে ধরে ঠেঙাবে কি না কে জানে…’

‘ক’দিন বাড়ি থাকবে মশাই!’ আমি ভরসা দিই ওনাকে— ‘ক’দিন আর থাকতে পাবে? থাকতে দেবে নাকি পুলিশ? বছরের মধ্যে এগারো মাস তো তার জেলখানাতেই কাটে। বছর ভোরই শান্তি-স্বস্তিতে থাকবে আপনাদের মেয়ে। সত্যি, ছেলেটি ভারী নির্ঝঞ্ঝাটে। জেল থেকে বেরিয়ে তিন-চার দিন বাইরে থাকতে না থাকতেই আবার তাকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। আবার সেই জেলেতেই কাটে। আপনার ভয় নেই কোনও…’

তারপর আর অভয়বাণী শোনানো যায়নি ওঁকে। চোখে মুখে জলের ঝাপটা মারতে হয়েছে ওঁর। মূৰ্ছিত হয়ে আছাড় খেয়েছেন উনি।

‘তারপর আবার আপনি একটা ছেলের সম্বন্ধে বলতে এসেছেন আমাকে!’ গোড়ার কথায় ফিরে গিয়ে এবারের ফাঁড়াটা কথার গোড়াতেই আমি কাটাতে চাই।

‘না না! এটা কোনও বিয়ের সম্বন্ধ নয়, বি এ পাশের সম্বন্ধেও নয়কো, নিতান্তই এস এফের ব্যাপার!’

‘এস এফ? এস এফের ব্যাপার!’ আমি ঠাওর করতে পারি না ঠিক।

‘হ্যাঁ। আমার ভাগনে স্কুল ফাইনাল দিয়েছিল এবার। ফেল করে বসেছে। কর্তাদের কাউকে ধরে টরে পাশ করিয়ে দিতে হবে তাকে। আমার বোন কান্নাকাটি করছে। বেজায়। অতএব আপনাকে…আপনিই একাজ পারবেন। তাই আপনার কাছেই…’

‘আমি কাকে ধরব? কাউকেই তো আমি জানি না। এসব বিষয়ে কাকে যে ধরতে হয় তাই আমার জানা নেই।’

‘সেই ভদ্রলোককে পেলে আসতুম না আপনার কাছে, মশাই! তিনি সব রকম পাশ করিয়ে দিতে পারতেন—পরীক্ষা-টরিক্ষা কিছু না দিলেও। এমনকী বি এ, এম এ, ডাক্তার মোক্তার—যা চান। কিন্তু দেখাই তো মিলছে না তাঁর।’

‘কে সেই ভদ্রলোক?’

‘আমাদের বিদ্যাসাগর মশাই! কোথায় যে তিনি বর্তমানে আছেন জানি না।’

‘বিদ্যাসাগর মশাই!’ আকাশ থেকে পড়ি আমি—সোজা একেবারে ভূমধ্য সাগরেই—‘তিনি কি এখনও বর্তমান আছেন?’

‘থাকবেন না কেন? ক’বছর আগেও তো দেখেছি আমি তাঁকে।’

‘বলেন কী! অনেকদিন আগে তিনি দেহরক্ষা করেছেন এই রকম একটা সন্দেহ ছিল আমার। সেদিন তাঁর দেড়শো বছরের স্মৃতি বার্ষিকী হয়ে গেল না?’

‘আহা, তিনি তো আমাদের সাবেক বিদ্যাসাগর—প্রথম ভাগের। অ আ ক খ-র। ইনি হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যাসাগর…নানা ভাগের বলা যায় এনাকে।’

‘নানা ভাগের বিশ্ববিদ্যাসাগরটা কী রকমের আবার?’

‘বলি তা হলে খুলে আপনাকে—শুনুন। দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে সেবার একটা টাট্টু নিয়ে ফিরেছিলাম তো! রোজ সকালে ময়দানে সেই ঘোড়াটায় চেপে হাওয়া খেতাম। সেই সময়ে আলাপ হয়েছিল সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে। কথায় কথায় তিনি জানতে চেয়েছিলেন কী পাশ করেছি আমি? আমি বলেছিলাম—এপাশ-ওপাশ। তাতে একটু অবাক হয়ে তিনি শুধিয়েছেন—ওই A-0 পাশটা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের মশাই? আমি বলেছি—কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, বিছানার ওপর। এপাশ আর ওপাশ। ‘তা আপনি কি কোনও পাশ টাশ করতে চান, বি এ কি এম এ?’ তিনি জানতে চেয়েছেন—তা হলে আমি তার ব্যবস্থা করতে পারি।’ আর কি মশাই এই বয়সে কেঁচে গণ্ডূষ করা যায়? সেই ইনফ্যান্ট ক্লাসের থেকেই? ‘না না, পড়াশোনা করতে হবে না, কোনও পরীক্ষা-টরিক্ষা না দিয়ে যদি…?’ দুনিয়ার যে-কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের যে-কোনও ডিগ্রি উনি আনিয়ে দিতে পারেন বললেন। শুনে আমি বলি—‘দিন তা হলে পাশ করিয়ে আমায়। সবচেয়ে বড় পাশের ডিগ্রি পেতে চাই। তখন তিনি বিলেতের দুই নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার সেরা দু’খানা ডিগ্রি আনিয়ে দিলেন আমায়। পাঁচশো পাঁচশো হাজার টাকা দিয়ে দু’-দুটো পাশ আমি। তা জানেন?’

‘তাই নাকি?’ জানার কৌতূহল জাগে আমার। ‘কী কী পাশ শুনি?’

‘ডঃ আর ডাঃ।’ তিনি জানান। ‘এর চেয়ে বড় ডিগ্রি আর নেই নাকি। ওই ডঃ আর ডাঃ।

‘ডঃ আর ডাঃ?’ শুনে তো আমি হাঁ।

‘হ্যাঁ, একটা মেডিক্যাল কলেজ থেকে আসে। আরেকটা কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস না থাইসিস তাই দিয়ে পেতে হয়। ওই ডঃ আর ডাঃ। দুটোর উচ্চারণই ওই ডাক্তার।’

ডাক্তার হর্ষবর্ধন ব্যক্ত করেন আমার কাছে— ‘লেখার সময় ওইভাবে লিখতে হয় কেবল। একটার বেলায় ডঃ আরেকটার বেলায় ডাঃ।’ উনি নিজের ডাহা বিদ্যাবত্তা জাহির করেন।

শুনে পুলকিত হই—‘তা, সেই ভদ্রলোকই তো পাশ করিয়ে দিতে পারেন ডিগ্রি দিয়ে আপনার ভাগনেকেও। কাউকে ধরাধরি করতে হয় না আর তা হলে।’

‘পারেনই তো! কিন্তু দেখাই যে পাচ্ছি না তাঁর। সকালে ওঁকে ময়দানে দেখতাম, আর বিকেলে গোলদিঘিতে বিদ্যাসাগরমশায়ের স্ট্যাচুর নীচে বসে থাকতেন সেই বিশ্ববিদ্যাসাগর। কিন্তু আজকাল আর তাঁকে দেখতে পাই না। আমি আরও ক্যান্ডিডেট নিয়ে গেছলাম তার পরে—পাছে আরও আরও নিয়ে যাই—সেই কারণেই কিনা কে জানে, ভয় খেয়ে হয়তো পালিয়েছেন এখান থেকে।’

‘আরও পাশার্থী ক্যান্ডিডেট নিয়ে গেছলেন নাকি আপনি?’

‘হ্যাঁ। আমার সেই টাট্টুটাকেই নিয়ে গেছলাম তার পরে। বলেছিলাম এটাকে পাশ করাতে পারেন? ডঃ, ডাঃ যা আপনার অভিরুচি।’ তিনি ঘাড় নাড়লেন—না, তা হয় না। আমি বললাম, আমার দুটো ডিগ্রির জন্য আমি পাঁচশো পাঁচশো এক হাজার দিয়েছি—কিন্তু এই ঘোড়াটার জন্যে এক হাজার দু’হাজার পাঁচ হাজার যা লাগে দেব। এটা আমার ভারী প্রিয়—এর পিঠে চড়ে বেড়াই তো! এটাকেও তাই পাশ করাতে চাই আমি।’

‘উত্তম প্রস্তাব দিয়েছিলেন মশাই! ডাক্তারের পিঠে ডাক্তার। এমনটা আর হয় না।’ সহানুভূতিওয়ালা মহানুভব ব্যক্তি বলে মনে হয় আমার হর্ষবর্ধনকে।

‘তাতে তিনি কী বললেন, জানেন? বললেন যে শুধু গাধাদের ডিগ্রি দেওয়ারই তাঁর এখতিয়ার আছে কেবল। ঘোড়াদের পাশ করতে হলে সামনের ওই বাড়িটায় যেতে হবে—আমাকে উনি বিশ্ববিদ্যালয় বিলডিংটা দেখালেন—ঘোড়াদের ডিগ্রি ওখানেই দিয়ে থাকে। ওটাই হচ্ছে অশ্বমেধের জায়গা। ঘোড়া পিটে ওঁরা গাধা বানিয়ে ছেড়ে দেবার পর আমার কাছে তারা এলে তখনই আমি শুধু পাশ করাতে পারি। তার আগে নয়। এই কথাই বললেন উনি।’

‘এই বললেন নাকি?’ আমি বলি—‘তা হলে তো আপনার ভাগনের বেলাতেও উনি পারতেন। আপনার ভাগনেকে—যদ্দুর আমার মনে হচ্ছে— মানে, নরাণাং মাতুলক্রম হয় তো? সে-ও একটা গাধাই।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু তারপর যে তিনি কোথায় উধাও হয়ে গেলেন কে জানে। গড়ের মাঠে সকালে হাওয়া খেতে যেতেন। সেখান থেকেও হাওয়া। দেখতেই পাই না আর। তাই তো আসতে হল আপনার কাছে। এখন, কী করতে হবে বলুন?’

‘এগজামিন পাশ করাতে হলে—’ আমার সর্বজ্ঞতা প্রকাশ পায়—‘যদ্দুর জানি, সববের গোড়ায় ধরতে হয় গিয়ে এগজামিনারকে, তারপর ট্যাবুলেটর, তারপরে কন্ট্রোলার, তারপরে বোধ হয় সেই উপাচার্যমশাইকেই—’

‘সে-সব স্টেজ পেরিয়ে গেছে। ধরে করে দেখা গেছে সবাইকে—কিসসু হয়নি। গেজেটে ফল বেরিয়ে যাবার পর আর নাকি কিছুই করার থাকে না।’

‘এখন কোনও মন্ত্রীই একমাত্র ভরসাস্থল। তিনিই যদি পারেন কেবল।’ আমি বলি—‘যদি ইচ্ছা করেন তবেই।’

‘আপনি একটু বললেই হবে। আপনাদের সাংবাদিকদের ভক্তি না করলেও ভয় করে সবাই। আপনি যদি গিয়ে অনুরোধ করেন—’

‘দেখা যাক চেষ্টা করে। হবেই যে, তা বলা যায় না। আমার মুন্সিয়ানা আর মন্ত্রীমশায়ের মর্জি। তবে আমি যাব একবার…আপনি আমার জন্য এত করে থাকেন, আপনার জন্যে কিছু করতে পেলে আমি কৃতার্থ হব। তা, কী কী বিষয়ে ফেল গেছে ছেলেটা? ’

‘অঙ্কে। কেবল ওই একটা বিষয়েই।’

অঙ্ক! শুনে আমার আতঙ্ক হয়। সেই সঙ্গে ফেলোফিলিংও জাগে বোধ হয় একটুখানি। আহা, ওই সাবজেকটে আমিও যে ফেল গিয়েছি বরাবর।

গেলাম মন্ত্রীবরের কাছে। তাঁর সদর দপ্তরে সটাং।

বললাম, ‘দেখুন, আমার ভাগনেটা—’ নিজের বলেই চালিয়ে দিলুম হর্ষবর্ধনের ভাগনেকে। পরস্মৈপদীকে আত্মনেপদী করতে কোনওদিনই আমার দ্বিধা হয় না—‘আপনারই নির্বাচনী এলাকার ছেলে। এ বছর আপনার ইলেকশনে খাটাখাটনিতে একেবারে পড়াশুনা করতে পারেনি। সারারাত আপনার পোস্টার মেরেছে আর দিনভর ভোট ফর ভোট ফর করে চেঁচিয়েছে খালি। ফলে এ বছর ফেল মেরেছে এবারকার ফাইনালে। তাই আপনার কাছে এলাম। আপনি যদি অনুগ্রহ করে এখন…’

‘আমার জন্যে খেটেছিল বলছেন? কী কী বিষয়ে ফেল গেছে শুনি? ’

‘অঙ্কে। ওই অঙ্কেই কেবল।’

‘একটা বিষয়েই? তা হলে হয়ে যাবে। করে দেব আমি। একটা বিষয়েই তো! পাঠিয়ে দেবেন আমার কাছে কাল এমন সময়ে।’

ছেলেটি পরদিন যথাসময়ে গিয়েছে তাঁর কাছে।

‘কী বিষয়ে ফেল করেছ শুনি?’ শুধালেন তাকে মন্ত্রীমশাই।

‘ম্যাথামেটিকসে।’

ম্যাথামেটিকসে? ম্যাথামেটিকসেও ফেল গেছ আবার?’ শুনে যেন মাথা খারাপ হয়ে যায় তাঁর— ‘তোমার মামা যে বলে গেলেন মোটে একটি বিষয়ে ফেল গেছ। ওই অঙ্কেই কেবল। ম্যাথামেটিকসেও আবার ফেল করেছ তার ওপর? না, দু’-দুটো সাবজেক্টে ফেল! যাও। কিচ্ছু হবে না। যাঃও! পালাও। ভাগো হিঁয়াসে।’

তারপর আর কী! ভাগতে হল আমাদের ভাগনে বেচারাকে।

১৩৭৮

অলংকরণ: শৈল চক্রবর্তী

সকল অধ্যায়

১. প্রোফেসর হিজিবিজ্‌বিজ্ – সত্যজিৎ রায়
২. বাহাদুর – আশাপূর্ণা দেবী
৩. কুমির – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
৪. ননীদা – মতি নন্দী
৫. হর্ষবর্ধনের ভাগনে ভাগ্য – শিবরাম চক্রবর্তী
৬. কর্ভাস – সত্যজিৎ রায়
৭. বেণী লস্করের মুণ্ডু – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৮. টুম্পুর গল্প – সুকুমার দে সরকার
৯. বারীন ভৌমিকের ব্যারাম – সত্যজিৎ রায়
১০. বীর হওয়ার বিড়ম্বনা – শিবরাম চক্রবর্তী
১১. নন্দগুপি – লীলা মজুমদার
১২. পালোয়ান ভূত – মনোজ বসু
১৩. হিসাব – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৪. গান – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৫. জ্যান্ত খেলনা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৬. মুড়ি – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
১৭. কর্নেল মিত্র – বিমল মিত্র
১৮. গুল-ই ঘনাদা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৯. ভয়ঙ্কর মুখোশ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
২০. দিনে ডাকাতি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
২১. গন্ধটা খুব সন্দেহজনক – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২২. মেজকর্তার খেরোখাতা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২৩. গোয়েন্দা বরদাচরণ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৪. সাধু কালাচাঁদের ফলাও কারবার – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
২৫. একটি ভুতুড়ে ঘড়ি – বিমল কর
২৬. বুনো হাতির বন্ধুত্ব – সমরেশ বসু
২৭. গোয়ায় গোগোলের প্রথম কীর্তি – সমরেশ বসু
২৮. ইঁদারায় গণ্ডগোল – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৯. চোর সাধু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৩০. টোরি জঙ্গলের ভক্ত-বাঘ – সুবোধ ঘোষ
৩১. জোনাকি-ভূতের বাড়ি – সমরেশ বসু
৩২. বনবিড়াল – বিমল কর
৩৩. ভয় ও ভূত – সুকুমার সেন
৩৪. সুপারমেন – সমরেশ মজুমদার
৩৫. রাত যখন বারোটা – অশোক বসু
৩৬. প্রেতাত্মার উপত্যকা – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৭. আলুর চপ – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
৩৮. হাবুলমামার ভূতের ব্যবসা এবং… – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৯. অশোকের কাণ্ড – হর্ষ দত্ত
৪০. হারাধন – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪১. হয়তো এইরকমই – আশাপূর্ণা দেবী
৪২. মহারাজা তারিণীখুড়ো – সত্যজিৎ রায়
৪৩. খুড়ো-ভাইপো – বাণী বসু
৪৪. সহযাত্রী – সত্যজিৎ রায়
৪৫. দারিৎসু – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৪৬. চার বুড়োর আড্ডা – আশাপূর্ণা দেবী
৪৭. রামপলের অন্তর্ধান রহস্য – রূপক সাহা
৪৮. দেয়ালা – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪৯. শুভ জন্মদিন – জয় গোস্বামী
৫০. ইন্দ্রনাথ সামন্তের বাড়ি – সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন