ভয়ঙ্কর মুখোশ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

পৌলোমী সেনগুপ্ত

ভয়ঙ্কর মুখোশ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

আগের দিন রাত্রে একটা জলসা ছিল।

জলসা ভাঙতে ভাঙতে রাত প্রায় দেড়টা হয়ে গিয়েছিল। কাজেই বিরূপাক্ষ আমাকে আর বাসায় ফিরতে দেয়নি। বলেছিল, ‘এত রাত্রে বাস ট্রাম ট্যাক্সি কিছুই পাবি না, তার চাইতে চল রাতটা আমার ওখানেই থাকবি শিশির—’

আমি আর আপত্তি করিনি। বিরূপাক্ষের তালতলার বাড়িতে এসে বিরূপাক্ষের শয়ন-ঘরে যে সোফা-কাম-বেডটা ছিল তার উপরেই একটা বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। সকালে ঘুম ভাঙতে একটু দেরিই হয়েছিল। প্রায় সোয়া সাতটা।

হাত মুখ ধুয়ে সবে দুজনে দু’ কাপ চা নিয়ে বসেছি, বিরূপাক্ষ একটা চার্মিনার ধরিয়েছে, অল্পদূরে ফোনটা বেজে উঠল।

আমিই উঠে গিয়ে ফোনটা ধরলাম, ‘হ্যালো—’

অন্য প্রান্ত থেকে প্রশ্ন ভেসে এল, ‘বিরূপাক্ষবাবু আছেন?”

সর্দি হলে যেমন গলাটা কেমন বসে যায়, তেমনি গলার স্বর। রিসিভারটা নামিয়ে রেখে বিরূপাক্ষের দিকে তাকিয়ে বললাম, তোর ফোন, বিরু—’

বিরূপাক্ষ উঠে গিয়ে ফোনটা ধরল, ‘বিরূপাক্ষ সেন—’

অন্য প্রান্তের কথাগুলো শুনতে পেলাম না, কিন্তু বিরূপাক্ষের কথাগুলো কানে আসতে লাগল। মারা গেছেন? সুইসাইড—মানে আত্মহত্যা—নয়? ও-ঘরের দরজা খোলাই ছিল—মৃত্যুটা ঠিক স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মনে হচ্ছে না—হুঁ। ঠিক আছে, আমি আসছি—না, না আধঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাব, হ্যাঁ—’

বিরূপাক্ষ রিসিভারটা নামিয়ে ফিরে এসে আবার চেয়ারটার উপরে বসল। চা-টা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। ভৃত্য কালীপদকে আর এক কাপ দিতে বলে আর একটা চার্মিনার ধরাল।

‘কে রে? কে মারা গেছে? কে ফোন করছিল?’

‘শ্যামপুকুরের সেই থানা-অফিসার রঞ্জিত চাকীকে তোর মনে আছে?’

‘সেই যে কোলা ব্যাঙের মতো মোটা, আবলুস কাঠের মতো গায়ের রং—মাথা জোড়া টাক?’

বিরূপাক্ষ আমার কথায় হেসে বললে, ‘ভদ্রলোকটিকে তোর ঠিক মনে আছে, শিশির। তা সে যাই বল, ভদ্রলোকের মাথার মধ্যে গ্রে ম্যাটারটা ভালই আছে। তা ছাড়া যতই মোটা বলিস, প্রয়োজনের সময় সাংঘাতিক অ্যাকটিভ হতে পারেন কিন্তু ভদ্রলোক। কিছু দিন হল চাকী বেলগাছিয়ায় ট্রান্সফার হয়েছেন।

‘তা তো বুঝলাম—কিন্তু এই প্রসন্ন সকালে কার মৃত্যুসংবাদটা তোকে দিচ্ছিলেন?’

‘অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় নামে এক ধনী ব্যক্তির—’

‘তুই চিনতিস নাকি ওই অঘোরনাথকে?’

‘হ্যাঁ—পরিচয় ছিল—কিন্তু ভাবছি।’

‘কী?’

‘রঞ্জিত চাকীর ধারণা অঘোরনাথের মৃত্যুর মধ্যে রীতিমতো একটা জটিল রহস্য আছে। তাই আমার সাহায্য চায়। চল একবার ঘুরে আসি। অবিশ্যি চাকী জানে না যে, তার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল।’

কালীপদ চা নিয়ে এল, বিরূপাক্ষ দ্বিতীয়বার আবার চায়ের কাপটা সবে ঠোঁটের সামনে তুলে ধরেছে, আবার ফোনটা ঝন ঝন শব্দে বেজে উঠল।

এবারও আমিই গিয়ে ফোনটা ধরলাম, এবারে ভারী পুরুষের গলায় কে একজন বললে, ‘বিরূপাক্ষ সেন—অঘোরনাথ চাটুজ্জের ব্যাপারে নাক গলাবার চেষ্টা করবেন না নিজের মঙ্গল যদি চান—’

আমাকে প্রশ্ন করবার সুযোগ না দিয়েই অপর প্রান্তের ব্যক্তি তার বক্তব্যটুকু জানিয়ে ঠক করে ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।

আমি যেন কেমন থতমত খেয়ে আস্তে আস্তে ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রাখলাম।

বিরূপাক্ষ শুধাল, ‘কে রে, কে ফোন করছিল?’

‘একটা ভারী পুরুষ কণ্ঠস্বর তোকে সাবধান করে দিল।’

‘সাবধান করে দিল মানে?’

‘হ্যাঁ—বললে তুই যেন অঘোরনাথ চাটুজ্জের মৃত্যুর ব্যাপারে নাক গলাবার না চেষ্টা করিস—অন্যথায় মৃত্যু—’

বিরূপাক্ষ মৃদু হেসে বললে, ‘তাই নাকি? তা ভারী আর কর্কশ ছাড়া কণ্ঠস্বরে আর কিছু বিশেষত্ব ছিল?’

‘কীরকম?’

‘মানে গলার স্বরটা কি চেষ্টা করে বিকৃত করা, না স্বাভাবিক?’

‘তা বলতে পারব না।’

‘তোকে এত করে বলি, শিশির, অত আলু আর মিষ্টি খাস না, ব্রেনের গ্রে সেলগুলোর চারপাশে তাতে করে চর্বি জমে জমে ক্রমশ সেগুলোকে অকেজো করে দেয়। খাস না, অত আলু খাস না, আলুভাতে-আলুভাজা আলুর দম-আলুকাবলি-আলুর বড়া-গোল আলু-শাক আলু-মিঠে আলু—’

বিরূপাক্ষ আরও যে কতক্ষণ তার আলু-সংহিতা চালাত যাবার তাড়া না থাকলে, তা আমিই জানি, এবং আলু-সংহিতা আওড়াতে আওড়াতেই সে গায়ে জামা চড়াচ্ছিল।

জামাটা গায়ে দিয়ে বললে, ‘চল—’

আমিও উঠে দাঁড়ালাম।

বিরূপাক্ষর সেই ঝরঝরে উনিশশো উনচল্লিশের মডেলের অস্টিন। চলার সময় সারা বডি থেকে যেন হাজারো আর্তনাদ বের হয়। মাথা ঝিমঝিম করে।

কতবার বলেছি, এটাকে বিদায় দে, একটা নতুন গাড়ি কেন। কিন্তু বিরূপাক্ষের সেই ভদ্রলোকের একই জবাব, ‘মাই মোস্ট অনুগত পুরাতন বাহন, এর মর্ম তুই বুঝবি না। হাজার দোষ থাকতে পারে, কিন্তু কোনও দিন আজ পর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকতা করেনি।’

গাড়ি চালাতে চালাতেই বিরূপাক্ষ অঘোরনাথ চাটুজ্জের মোটামুটি একটা পরিচয় দিল। মানুষটা রগচটা বটে, কিন্তু মনটা অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ। ছয় ফুটের বোধহয় এক-আধ ইঞ্চি বেশিই লম্বা হবে। দেহটা যেন একটা পাকানো দড়ির মতো, যাকে বলে শুষ্কং কাষ্ঠং। কদমছাঁট—কাঁচাপাকা মাথার চুল, খাড়া নাক, ছোট ছোট চোখ, গর্তে বোজা, ভাঙা তোবড়ানো গাল। গাত্রবর্ণটা টকটকে গৌর। কী শীত কী গ্রীষ্ম পরনে একটা লুঙ্গি আর গেঞ্জি। গেঞ্জির তলা থেকে মোটা পইতেটা স্পষ্ট দেখা যায়।

লেখাপড়া যথেষ্ট করেছিলেন—কিন্তু কখনও চাকরি-বাকরি করেননি। চাকরি-বাকরি করার তাঁর প্রয়োজনও ছিল না, বাবা ছিলেন হাইকোর্টের দুঁদে উকিল, প্রচুর অর্থ কামিয়েছেন।

কলকাতার উপর খানচারেক বাড়ি ও মোটা ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স।

বাপ জগদিন্দ্র চাটুজ্জে। দুটি ছেলে। অঘোরনাথ বড় ও ছোট শিবনাথ। এক মেয়ে, জাহ্নবী। মৃত্যুর সময় জগদিন্দ্র তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি অঘোরনাথকেই দিয়ে যান—শিবনাথকে বঞ্চিত করে। বাপের সঙ্গে মতের মিল না-হওয়ায় বহু বছর আগে শিবনাথ এক বস্ত্রে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। আর কখনও আসেনি। কেউ তার কোনও খবরও জানে না। মেয়ে জাহ্নবীর বিবাহ হয়েছিল। বিবাহের ষোলো-সতেরো বছর বাদে একটি সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে জাহ্নবী মারা যান। একটি পুত্রসন্তান হয়েছিল তাঁর। জাহ্নবীর স্বামী দ্বিতীয় বার বিবাহ করায় অঘোরনাথ জাহ্নবীর সন্তানটিকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। সেই থেকে তাঁরই কাছে। বর্তমানে তার বয়স আট-নয় হবে। অঘোরনাথ তার নাম দিয়েছিলেন পল্টন—ডাকতেন পন্টু বলে। সুন্দর দেখতে ছেলেটি। এক মাথা কোঁকড়া চুল—টানা টানা দুটি চোখ। মামুর অতি বাধ্য এবং মামু বলতে একেবারে যেন অজ্ঞান। ভারী চালাক-চতুর ছেলেটি।

বেলগাছিয়া রোডের একেবারে উপরেই বিরাট কম্পাউন্ডওয়ালা বাড়ি ‘ইন্দ্রধাম’। ওইখানেই থাকতেন অঘোরনাথ।

অতবড় বাড়িতে লোকজনের মধ্যে—অঘোরনাথ ও পল্টন, এবং এক ভৃত্য, এক দাসী, একটি উৎকলদেশীয় পাচক, নেপালি দরোয়ান ও ড্রাইভার—বেহারের লোক।

কেউ কানা, কেউ খোঁড়া, কেউ তোতলা, কারও পিঠে কুঁজ, কেউ কালা, বিরূপাক্ষ ওদের বর্ণনা প্রসঙ্গে বললে, ‘যেন একটি চিড়িয়াখানা।’

আমি শুধালাম, ‘কীরকম?’

‘প্রৌঢ় ভৃত্য দশরথ—অবিশ্যি ওটা অঘোরনাথেরই দেওয়া নাম—রোগা-পটকা, মাথা জুড়ে টাক, ডান চোখটা কানা, কানেও কম শোনে। তারপর দাসী মন্থরা—’

‘মন্থরা?’

‘হ্যাঁ, ওটাও অঘোরনাথের দেওয়া নাম। পিঠে বিরাট এক কুঁজ বলে নাম দিয়েছেন ওর মন্থরা। পাচক ভোজনানন্দ—ওটাও তাঁরই দেওয়া নাম— বিরাট আকারের ভুঁড়ি—মাথায় বিরাট টিকি। রান্না যা করে, চাখতে গিয়ে তার এক-চতুর্থাংশ নিজের উদবেই চালান করে দেয় নির্বিবাদে। নিরেট গর্দভ একটি, তায় আবার তোতলা। নেপালি দারোয়ান রণবাহাদুর থাপা—বাঁ হাতটা কনুই থেকে কাটা। যুদ্ধের সেপাই ছিল, যুদ্ধেই কাটা যায়। ড্রাইভার ছগনলাল রাতকানা ও খোনা সুরে কথা বলে। এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে নাকের হাড় নষ্ট হয়ে গিয়েছে।’

বললাম, ‘চমৎকার সব স্পেসিমেনগুলো তো।’

‘হ্যাঁ, অঘোরনাথের আইডিয়া’, বিরূপাক্ষ বললে, ‘ওদের তো কেউ চাকরি দেবে না, তাই অঘোরনাথ দিয়েছেন। নচেৎ ওরা নাকি নানা ধরনের ক্রাইমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ত।’

যুক্তিটাও চমৎকার।

॥ ২ ॥

যাহোক, ‘ইন্দ্রধামে’ পৌঁছে দু’জন কনস্টেবলকে নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, তারাই বললে, সাহেব, মানে থানার ও-সি উপরে—

আমরা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম। বাড়িটা এককালে কলকাতার কোনও ধনীর বাগানবাড়ি ছিল। অঘোরনাথের বাবা জলের দামে বাড়িটা কিনে নিয়েছিলেন এবং শেষ জীবনে ওইখানেই চারটে বছর কাটিয়েছেন। বিরাট লম্বা টানা বারান্দায় অঘোরনাথের ঘরের বাইরে তাঁর দাসদাসীর দল দাঁড়িয়ে ছিল। দশরথ, মন্থরা, ভোজনানন্দ, রণবাহাদুর থাপা ও ড্রাইভার ছগনলাল। সকলের প্রতিই একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলাম। বিরূপাক্ষ এতটুকু বাড়িয়ে বলেনি।

দোরগোড়ায় একজন লালপাগড়ি দাঁড়িয়ে ছিল— তাকে ও-সির কথা জিজ্ঞেস করতেই সে ঘরের মধ্যে যেতে বললে। আমরা ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। একটা বিরাট খাটের উপরে মৃতদেহটা আড়াআড়ি ভাবে পড়ে ছিল। বাঁ হাতটা ঝুলছে। ডান হাতটা বুকের তলায়। পরনে লুঙ্গি ও একটা গেঞ্জি মাত্র। মুখটা কাত হয়ে আছে এক পাশে। ফরসা মুখখানার ওপর যেন একটা কালির ছোপ পড়েছে।

শিয়রের পাশেই একটা ছোট টেবিল। একটা কাচ-ভাঙা টেবিল ক্লক। বারোটা বেজে ঘড়িটা বন্ধ হয়ে আছে। টেবিলের ওপরে একটা টেবিল ল্যাম্প কাত হয়ে পড়ে আছে।

রঞ্জিত চাকী বিরূপাক্ষের মুখের দিকে তাকালেন। ‘দেখুন আগে বিরূপাক্ষবাবু, মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে—আমার তো মনে হচ্ছে—’

‘কী?’ বিরূপাক্ষ শুধাল।

‘বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন—হাই ভোল্টেজ কারেন্টে—’

‘কী করে জানলেন?’ বিরূপাক্ষের প্রশ্ন।

‘মধ্যরাত্রে দশরথ একটা চিৎকার শুনে তার ঘর থেকে ছুটে আসে ঘুম ভেঙে—’

‘দশরথ?’

‘হ্যাঁ।’

‘তারপর—’

‘এসে দেখে ঘর অন্ধকার—’

‘ঘরের দরজা খোলা ছিল নাকি?’

‘দশরথ তো তাই বলছে।’

‘তারপর—’

‘মন্থরা দাসীও চিৎকার শুনেছিল। সে-ও ইতিমধ্যে এসে পড়ে। কিন্তু সুইচ টিপতেও আলো জ্বলল না। মেইন ফিউজ হয়ে গিয়েছিল, এখনও ফিউজ হয়ে আছে। দশরথই তখন একটা মোমবাতি ঘরে জ্বালিয়ে নিয়ে আসে—’

‘ওর ভাগনে পল্টনও তার মামার সঙ্গেই শুত, সে কোথায় ছিল ওই সময়?’

‘ওই বিছানার উপরে বসে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে ছিল—’

‘তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সে কিছু দেখেছে কি না?’

‘আপনি জানেন নাকি পল্টনকে?’

‘হ্যাঁ, অঘোরবাবু আমার পরিচিত ছিলেন।’

‘তাই নাকি?’

‘তা পল্টনকে তো দেখছি না, সে কোথায়?’

‘পাশের ঘরে বসে আছে। তাকে অনেক চেষ্টা করেছি কথা বলাবার, কিন্তু কিছুই বলছে না।’

‘বলছে না? কেন?’

‘মনে হচ্ছে কোনও প্রচণ্ড ‘শকে’ স্পিচ অর্থাৎ কথা বলার শক্তি তার লোপ পেয়েছে।’

বিরূপাক্ষ তখন মৃতদেহটা একবার ভাল করে পরীক্ষা করে দেখল, তার পর ঘর ও ঘরের সংলগ্ন বাথরুম-ঘরের মেঝেতে দেখা গেল, কিছু অস্পষ্ট কাদামাখা পায়ের ছাপ। ছাপগুলো মনে হল বাথরুম থেকে খাটের ধার পর্যন্ত এসেছে।

‘ওই পায়ের ছাপগুলো দেখেছেন মি. চাকী?’

‘কোন ছাপ—’

‘ওই যে দেখুন না—মেঝেতে রয়েছে।’ বিরূপাক্ষ বললে।

‘তাই তো—’

‘ওগুলোর ফটো নিন, আর পারেন তো প্লাস্টার কাস্ট নিয়ে নেবার ব্যবস্থা করুন। আমি দেখি একবার পল্টন কিছু বলে কি না।’

পাশের ঘরে এলাম, এটাই বোধহয় পল্টনের পড়বার ঘর। পল্টন কেমন যেন জবুথুবুর মতো একটা চেয়ারে চুপচাপ বসে ছিল।

বিরূপাক্ষ গাড়িতে আসতে আসতে পল্টনের চেহারার যেমনটি বর্ণনা দিয়েছিল, ছেলেটি দেখতে ঠিক তেমনি। পরনে একটা হাফ প্যান্ট ও গায়ে কলার দেওয়া একটি রঙিন গেঞ্জি। একমাথা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল এলোমেলো। সমগ্র মুখখানিতে যেন একটা বিষাদের করুণ ছায়া, সামনের খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে ছিল পল্টন।

আমরা দু’জনে যে ঘরে ঢুকলাম, পল্টন যেন টেরও পেল না। যেমনটি বসে ছিল, ঠিক তেমনটি বসে রইল। বিরূপাক্ষ ডাকল, ‘পল্টন—’

কোনও সাড়া নেই। বিরূপাক্ষ আরও একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে আবার ডাকল ‘পল্টনবাবু—’

পল্টন যেন এবার একটু কেঁপে উঠল মাত্র, কিন্তু কোনও সাড়া দিল না।

এবারে একেবারে সামনাসামনি গিয়ে উপবিষ্ট পল্টনের কাঁধে একখানি হাত রেখে সস্নেহে ডাকল আবার, ‘পল্টনবাবু—’

পল্টন এবার তাকাল বিরূপাক্ষর মুখের দিকে, কিন্তু কোনও কথা বলল না।

‘কী হয়েছে পল্টনবাবু? কাল রাত্রে কী হয়েছিল? বলো—’

সাড়া নেই পল্টনের।

‘কিছু দেখেছিলে, তাই না? কী দেখেছিলে বলো তো পল্টনবাবু—’

সাড়া নেই।

বুঝলাম, যে-কারণেই হোক, ও কথা বলছে না। বলতে পারছে না।

মনে পড়ল অনেক দিন আগে কোথায় যেন পড়েছিলাম বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ভিক্তর য়ুগোর মেয়ের কথা। ভদ্রমহিলা তাঁর বাপের মৃত্যুতে এমনই আঘাত পেয়েছিলেন মনে যে, বাপের মৃত্যুর পর সুদীর্ঘ কাল যে তিনি বেঁচে ছিলেন, কেউ তাঁকে একটা কথা বলতে বা একটু হাসতে দেখেনি।

বিরূপাক্ষ আরও দু’-একবার ডাকল পল্টনকে। কিন্তু কোনও সাড়াই সে দিল না। বিরূপাক্ষ কেমন যেন অসহায় করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। তারপর মৃদু গলায় বললে, ‘একেবারে নেহাত বালক—আমার মনে হয় শিশির—’

‘কী?’

‘অঘোরনাথের মৃত্যুটা ও হয় স্বচক্ষে দেখেছে কাল রাত্রে, কিংবা কোনও কারণে হঠাৎ ভয় পেয়েছে, তাই একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ওকে কথা আমাকে বলতেই হবে, কারণ বুঝতে পারছি, গতরাত্রের ব্যাপারটার এমন কিছু ও দেখেছে বা জেনেছে যা ওর কাছ থেকে আমাকে জানতেই হবে।’

‘কিন্তু ও যে কথাই বলছে না। জানবি কী করে?’

‘আরও কিছুটা সময় গেলে ও হয়তো কিছুটা সুস্থ হবে। তখন হয়তো ও বলতে পারবে।’

তারপর বিরূপাক্ষ যেন কী ভাবল, এবং পরে বললে, ‘চল ওঘরে যাই।’

খাবার ঘরে মি. চাকী তখন সকলের জবানবন্দি নিচ্ছিলেন। এক-এক করে ডেকে জবানবন্দি নিচ্ছিলেন। দশরথ ও মন্থরার জবানবন্দি নেওয়া হয়ে গিয়েছে, বাকি তখনও পাচক, দারোয়ান ও ড্রাইভার।

মি. চাকী শুধালেন, ‘এই যে মি. সেন, কিছু বলল ছেলেটা?’

‘না। তবে একটা কাজ আপনাকে করতে হবে মি. চাকী।’

‘বলুন—’

‘ওকে সর্বক্ষণ সতর্ক প্রহরায় রাখতে হবে, যতক্ষণ না ওর মুখ দিয়ে কথা বের হয়। একটা কাজ করতে পারেন?’

‘বলুন কী করতে হবে মি. সেন।’

‘ওকে এই বাড়ি থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও সতর্ক প্রহরায় রাখবার ব্যবস্থা করতে পারেন?’

‘সে আর এমন কঠিন কী? রাখা যাবে—কিন্তু কেন বলুন তো?’

‘নচেৎ, আমার ধারণা, অঘোরনাথের হত্যার পিছনে যার হাত আছে, সে নিশ্চয়ই ওর প্রাণনাশের চেষ্টা করবে।’

‘সে কী? কেন?’

‘যেহেতু ও হয়তো এমন কিছু জানে বা দেখেছে, যেটা হত্যাকারীর বিরুদ্ধে মারাত্মক প্রমাণ হয়ে দাঁড়াবে এবং যা হত্যাকারী কিছুতেই হতে দেবে না।’

‘ঠিক আছে, আমি ব্যবস্থা করছি। কিন্তু আপনি কি কিছু বুঝতে পেরেছেন মি. সেন?’

‘এইটুকু আপাতত বুঝতে পেরেছি’, বিরূপাক্ষ বলতে লাগল, ‘অঘোরবাবুকে নৃশংসভাবে হত্যাই করা হয়েছে।’

‘অ্যাঁ?’

‘হ্যাঁ—’

‘কিন্তু আমার তো মনে হয় একটা অ্যাকসিডেন্ট—’

‘না। নিষ্ঠুর হত্যা বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এবং হত্যা করা হয়েছে কৌশলে ওর দেহে হাই ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রয়োগ করে। ওই টেবিল ল্যাম্পটা আমি নিয়ে যেতে চাই—’

‘টেবিল ল্যাম্পটা?’

‘হ্যাঁ, ওটা আমাকে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। আর একটা ব্যাপার হয়তো আপনি লক্ষ করেননি মিঃ চাকী।’

॥ ৩ ॥

রঞ্জিত চাকী বিরূপাক্ষের প্রশ্নের জবাবে ওর দিকে তাকিয়ে শুধালেন, ‘কী বলুন তো?’

‘খাটটার পায়াগুলোর দিকে চেয়ে দেখুন ভাল করে। প্রত্যেকটি পায়ার নীচে লোহার ক্যাপ লাগানো।’

রঞ্জিত চাকী খাটের পায়ার দিকে তাকালেন। আমিও তাকালাম। নজরে এল, বিরূপাক্ষর কথাই ঠিক। রঞ্জিত চাকী বললেন, ‘আশ্চর্য, ঠিকই বলেছেন তো। টেবিল ইত্যাদির পায়ার সঙ্গে ওই ধরনের লোহার ক্যাপ বা চাকা ফিট করা আগে আমি দেখেছি, কিন্তু শোবার খাটের পায়ায়…’

বিরূপাক্ষ বললে, ‘খুব সম্ভব ওগুলো আগে ছিল না। পরে লাগানো হয়েছে। দেখছেন না এতটুকু মরচে ধরেনি বা ময়লা নেই ক্যাপগুলোতে। দশরথকে এ-ঘরে ডাকুন তো—’

রঞ্জিত চাকী দশরথকে ঘরের মধ্যে ডেকে আনলেন।

‘দশরথ…’

উত্তর নেই।

‘দশরথ, শুনতে পাচ্ছ?’

‘হ্যাঁ, কিছু বলছেন? একটু জোরে বলুন—’

বিরূপাক্ষ এবারে একটু উঁচু গলাতেই কথা বলে। ‘দিনের বেশির ভাগ সময়ই তো তোমার বাবু পাশের লাইব্রেরি ঘরে বসে-বসেই পড়াশুনো করতেন…’

‘আজ্ঞে—’

‘এ-ঘরে বড়-একটা বোধহয় আসতেন না?’

‘না। রাত্রে আহারের পর শুতে আসতেন। তখনও অনেক রাত জেগে শুয়ে-শুয়েই বই পড়তেন—’

‘আমি জানি। আর এও জানি, তাঁর ঘুম খুব কম ছিল। আচ্ছা তোমার বাবু তো রোজ বিকালে পল্টনবাবুকে নিয়ে বেড়াতে বেরুতেন, কখনও ময়দান কখনও গঙ্গার ধারে—’

‘হ্যাঁ—’

‘কাল যাননি বিকেলে?’

‘গিয়েছিলেন।’

‘কখন ফিরেছিলেন?’

‘রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ।’

‘আচ্ছা, এ-বাড়িতে দু’-একদিনের মধ্যে কোনও ইলেকট্রিকের মিস্ত্রি এসেছিল?’

‘না তো।’

‘বাইরের অন্য কেউ?’

‘না, বাবু তো কারু সঙ্গে মিশতেন না—’

‘জানি। আচ্ছা, দারোয়ানকে পাঠিয়ে দাও—’

দশরথ চলে গেল। বিরূপাক্ষ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বুঝলি তো শিশির, লোকটা রীতিমতো কালা—’

তখন বুঝতে পারিনি কেন বিরূপাক্ষ ওই কথাটা বলেছিল। কিন্তু দিন-দুই পরেই বুঝতে পেরেছিলাম।

দরোয়ান রণবাহাদুর থাপা ঘরে এসে ঢুকল।

‘বাহাদুর—’

‘জি সাব—’

‘কাল পরশু বা তার আগের দিন কেউ কি তোমার বাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল বা গতকাল বিকেলের দিকে তোমার বাবু বেড়াতে বেরুলে কেউ এসেছিল?’

‘এইসা তো কোই আয়া নেহি সাব, লেকিন কাল বাবুকো বাহার যানে কো বাদ এক আদমি আয়া থা—’

‘উসিকা সাথ কোই সামান উমান থা?’

‘হাঁ সাব—ছোটা একঠো ব্যাগ—’

‘উয়ো আদমি অন্দর মে আয়া থা?’

‘নেহি সাব, উসকো হাম অন্দরমে ঘুসনে নেহি দিয়া—’

‘উ কেয়া বোলা?’

‘বোলা উপরমে কোই বাত্তি খারাপ হ্যায়, বাবু কোম্পানিমে ফোন কিয়া থা। উসি লিয়ে উনকো ভেজা গিয়া—লেকিন হামারা পর কোই হুকুম নেহি থা। উস লিয়ে হাম উসকো ঘুসনে নেহি দিয়া—’

‘ঠিক হ্যায়, তুম যা শকতা। মন্থরাকো থোড়া ভেজদো—’

‘বহুৎ আচ্ছা সাব।’ থাপা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

মন্থরা এল—

মন্থরা—

মন্থরা এতক্ষণ বোধহয় অনবরত কেঁদেছে, চোখের পাতা জলসিক্ত তখনও, এবং বেশ ভারী। মন্থরা বিরূপাক্ষের মুখের দিকে তাকাল মুখটা তুলে। পিঠে কুঁজ থাকার জন্য ও বেচারি বোধহয় ঠিক সোজা হয়ে তাকাতে পারে না।

‘কাল তোমার বাবু বিকেলে বেড়াতে বেরুবার পর কেউ বাড়িতে এসেছিল জানো? কাউকে দেখেছ?’

‘হ্যাঁ বাবু, কী সব বাতির তার খারাপ হয়েছে, সারাচ্ছিল—’

‘কে সে?’

‘জানি না। তবে বলছিল—বাবুই নাকি তাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন—’

‘কোথায় তাকে দেখেছিলে?’

‘বাবুর ঘরে খুট খুট শব্দ হচ্ছিল, ঘরে ঢুকে দেখি লোকটা কী-সব তার ঠিক করছে, আমি নীচে দশরথকে ডাকতে গেলাম, দু’জনে ফিরে এসে দেখি ঘরে কেউ নেই।’

‘তারপর দশরথকে কথাটা বলেছিলে?’

‘বলেছিলাম। ও বলল, আমার চোখে নাকি ছানি পড়েছে, কী দেখতে কী দেখেছি, কিন্তু বাবু আমি কালীর দিব্যি করে বলছি, আপনাকে যা বললাম তা মিথ্যা নয়।’

‘তোমার বাবুকে কথাটা বলেছিলে, তিনি ফিরে এলে?’

‘না।’

‘আচ্ছা মন্থরা, তুমি জানো, টেবিল ল্যাম্পটা দেখছি নতুন, কবে কেনা হয়েছিল ওটা?’

‘কোনও টেবিল ল্যাম্পই তো কেনা হয়নি। ওটা তো পুরনো, অনেক দিন থেকেই ওখানে আছে।’

‘ভাল করে দ্যাখো তো আলোটা—’

মন্থরা এবার টেবিল ল্যাম্পটার সামনে গিয়ে দেখে বললে, ‘না—এটা তো সে-আলোটা নয়, সেটার ডোমটা ছিল সাদার উপর ঘষা দাগ। এটা তো একটু নীলচে, সেই দাগগুলোও দেখছি না।’

‘হুঁ। ঠিক আছে, তুমি যেতে পারো। মি. চাকী, আপনার যা করণীয় করুন। আমি ল্যাম্পটা নিয়ে যাচ্ছি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলেই আমাকে জানাবেন আর এ-বাড়ির প্রত্যেকের উপরে কড়া পাহারা রাখবেন। আর পল্টনকে কিন্তু সঙ্গে নিয়ে যাবেন—এখানে রেখে যাবেন না।’

‘ঠিক আছে—’

‘চল শিশির’, বিরূপাক্ষ আলোটা নিয়ে বের হয়ে এল। আমি তাকে অনুসরণ করলাম।

ঘটনা কতকটা অনিবার্য মোড় নিল ঠিক দিন দুই পরে। এবং পল্টনকে কেন্দ্র করেই।

ওই দুই দিন বিরূপাক্ষ কোথাও বের হয়নি। আমার মনে হচ্ছিল, সর্বক্ষণ যেন বিরূপাক্ষ কিছুর একটা প্রতীক্ষায় কান পেতে আছে।

তৃতীয় দিন রাত একটা নাগাদ রঞ্জিত চাকীর ফোন এল।

আমি ওই সময় বিরূপাক্ষের বাড়িতে ছিলাম না। পরের দিন সকালে তার ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম সব। থানা নয়, অন্য একটা বাড়ি থেকে রঞ্জিত চাকী ফোন করেছিলেন বিরূপাক্ষকে। শ্যামবাজারে রঞ্জিতবাবু তাঁর বোনের বাড়িতেই পল্টনকে রেখেছিলেন, সুনীলবাবুর ওখানে। সুনীলবাবু ও তাঁর স্ত্রী—রঞ্জিতবাবুর বোন শ্যামলী দেবী ওখানে থাকতেন, তাঁদের কোনও ছেলেপুলে নেই, শুধু স্বামী-স্ত্রী। সুনীলবাবু বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন। ওটা সুনীলবাবুর নিজের বাড়ি, দোতলায় তিনি থাকতেন, একতলাটা ভাড়া দেওয়া। ভাড়াটেরা কিছু দিনের জন্য কাশী বেড়াতে গিয়েছেন। নীচের তলায় সে সময়ে কেউই ছিল না।

‘আপনিই বোধহয় বিরূপাক্ষ সেন?’ সুনীলবাবু বলেন।

‘হ্যাঁ। মি. চাকী?’

‘হ্যাঁ, দাদা উপরে আছেন, চলুন।’

উপরে তিনটে ঘর, একটা ডাইনিং স্পেস, সামনে খানিকটা খোলা ছাদ, বাড়ির পিছনে একটা ব্লাইন্ড লেন।

ঘরে ঢুকতেই বিরূপাক্ষ দেখল, শ্যামলীদেবীকে আঁকড়ে জড়িয়ে ধরে পল্টন বসে আছে।

শ্যামলীই বললেন, ‘আসুন, হঠাৎ ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠেছিল, সঙ্গে-সঙ্গে আমার ঘুম ভেঙে যায়, দু’ দিন থেকে আমিই ওকে নিয়ে এই ঘরে শুচ্ছিলাম।’

‘পল্টনবাবু—’ বিরূপাক্ষ ডাকল।

পল্টন বিরূপাক্ষের ডাকে ওর দিকে তাকাল।

‘আমাকে চিনতে পারছ পল্টনবাবু।’

‘হ্যাঁ—’

‘কী হয়েছিল বলে তো।’

‘একটা ভয়ঙ্কর মুখ—’

‘মুখ?’

‘হ্যাঁ, ঠিক সেই রাত্রির মতো ওই জানলাটার ওদিকে দাঁড়িয়েছিল, একটা লম্বা লাঠি দিয়ে আমাকে খোঁচাতেই আমার ঘুম ভেঙে যায়—’

‘কয়েকদিন আগে রাত্রে ঠিক এমনিই দেখেছিলে, তাই না পল্টনবাবু?’

‘হ্যাঁ—’

‘তোমাদের ঘরের আলো কি সে-সময় জ্বলছিল?’

‘না। জানলা দিয়ে জোছনা এসেছিল, সেই আলোতেই দেখে চিৎকার করে উঠেছিলাম, মামু জেগে উঠে বলল, কী, কী হয়েছে পন্টু?’

‘তারপর—’

‘তারপর একটা চোখ-ঝলসানো নীল আলো—’

‘নীল আলো?’

‘হ্যাঁ, নীল আলো। আমি এখানে কেন? মামু কোথায়? আমি মামুর কাছে যাব।’

‘হ্যাঁ যাবে বই কী, কাল সকালেই যাবে। রঞ্জিতবাবু, এখনই আমাদের বেরুতে হবে—’

‘কোথায়?’

‘চলুন, যেতে যেতে বলব। তা ছাড়া চলুন, একবার গলিটা দেখতে হবে—’

‘গলিটা?’

‘হ্যাঁ, গলিটা। আসুন—’

॥ ৪ ॥

টর্চের আলো ফেলে ফেলে গলিটা দেখতে-দেখতেই একটা মুখোশ পাওয়া গেল। বীভৎস মুখোশ।

বিরূপাক্ষ মাটি থেকে মুখোশটা তুলে দেখতে দেখতে বলল, ‘হত্যাকারী জানত রঞ্জিতবাবু, অঘোরনাথ ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত ভিতু প্রকৃতির ছিলেন। সেটা জেনেই, আমার অনুমান—’

‘কী?’

‘সে রাত্রে এই মুখোশ মুখে এঁটে অঘোরনাথকে ভয় দেখাতে গিয়েছিল। ঘরে চাঁদের আলো এসে পড়েছিল জানলার পথে। টেবিল-ল্যাম্পটার মধ্যে আগে থেকেই সে মৃত্যুফাঁদ পেতে রেখেছিল। আলোর সুইচ টিপে জ্বালাতে গেলেই হাই ভোল্টের কারেন্ট তাঁর দেহে প্রবেশ করবে, যাতে মৃত্যু অবধারিত ও সঙ্গে সঙ্গে—’

‘বলেন কী?’

‘হ্যাঁ, আপনি লক্ষ করেননি, আমি পরীক্ষা করে দেখেছি, আলোর সুইচটা মেটালের তৈরি—সে রাত্রে ঘরে ঢুকে রাত্রে আলো জ্বেলে রোজকার মতো পড়াশুনো করে একসময় অঘোরনাথ আলোটা নিভিয়ে শুয়ে পড়েন। যে ভয় দেখাতে এসেছিল মুখোশ পরে, সে জানত, অঘোরনাথ রাত্রে দু’-একবার বাথরুমে যান, সেই সময় হঠাৎ ভিতু-প্রকৃতির অঘোরনাথ ওই ভয়াবহ মুখোশ-পরা কাউকে দেখলেই আলেটা জ্বালবার চেষ্টা করবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে অবধারিত মৃত্যু, কারণ আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়বার পরই আলোর সুইচের সঙ্গে হাই ভোল্টের কারেন্ট পাস করানো হয়, এবং সেইভাবেই ছিল—’

দু’জনে গাড়িতে বসে পাশাপাশি যেতে-যেতে বিরূপাক্ষ বলতে লাগল, ‘কিন্তু হত্যাকারীর দুর্ভাগ্য, তাই মুখোশধারী অঘোরনাথের চোখে না পড়ে পড়েছিল পল্টনবাবুর চোখে, সঙ্গে সঙ্গে সে চিৎকার করে ওঠে, অঘোরনাথের ঘুম ভেঙে যায়, অঘোরনাথ আলো জ্বালাতে যান, মুহূর্তে সুইচে হাত ঠেকাতেই হাই ভোল্টের কারেন্ট তাঁর দেহে পাস করে, প্রচণ্ড একটা নীল স্পার্কও দেয়, ঘটনার আকস্মিকতায়, ভয়াবহ এই মুখোশ ও নীল আলো পল্টনবাবুকে বোবা করে দেয়। হত্যাকারী দেখল ঘটনাচক্রে পল্টনবাবু ব্যাপারটা দেখে ফেলেছে, সে হয়তো সব বলে দেবে পুলিশের কাছে। কাজেই তাকে অবিলম্বে সরানো প্রয়োজন এই পৃথিবী থেকে। ব্যাপারটা অনুমান করেই আপনাকে আমি কোনও নিরাপদ জায়গায় ওকে সরিয়ে দিতে বলেছিলাম।’

গাড়ি ইতিমধ্যে ‘ইন্দ্ৰধাম’-এর কাছাকাছি আসতেই বিরূপাক্ষ গাড়ির হেডলাইট নিভিয়ে দিল। রঞ্জিত চাকী বললেন, ‘ইন্দ্রধাম-এ নাকি?’

‘হ্যাঁ।’

‘তবে ভিতরে চলুন।’

‘গাড়ি নিয়ে নয়, হেঁটে যাব, চলুন।’ বিরূপাক্ষ কথাগুলো বলে গাড়ি থেকে নামল।

গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে কয়েক পা এগুতেই অন্ধকারে কে যেন চ্যালেঞ্জ করল, ‘দাঁড়াও—’

রঞ্জিত চাকী বললেন, ‘মহাবীর সিং, আমি—কিছু খবর আছে?’

‘না সাহেব।’

‘পাণ্ডে কোথায়?’

‘পিছনে পাহারা দিচ্ছে বাড়ির।’

বিরূপাক্ষ রঞ্জিত চাকীকে নিয়ে বাড়ির পিছনের দিকে অগ্রসর হল।

‘পাণ্ডে’—রঞ্জিত চাকী ডাকলেন।

অন্ধকার থেকে জবাব এল, ‘জি সাব, এক আদমি আধাঘণ্টা হোবে, ওই স্পাইরাল সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় গেছে—’

‘ঠিক হ্যায়, তুম ইধারই ঠারো—’

সেই স্প্যাইরাল সিঁড়ি বেয়েই অতঃপর প্রথমে বিরূপাক্ষ ও তার পিছনে পা টিপে টিপে চাকী কোনওরকম শব্দ না করে দোতলায় উঠে গেল। বাথরুমের পিছনের দরজাটা খোলাই ছিল।

চাপা গলায় বিরূপাক্ষ বললে, ‘আপনার ভগ্নীপতির বাড়ি থেকে সোজা এখানেই এসেছে লোকটা এবং এই সিঁড়িই ব্যবহার করেছে। তাড়াহুড়োয় মুখোশটা যেমন গলির মধ্যে ফেলে এসেছে, তেমনি এই দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছে মনে হচ্ছে।’

দু’জনে ঘরের মধ্যে ঢুকল। ঘরটা অন্ধকার।

বিরূপাক্ষ আলো জ্বালাল না। পকেট থেকে টর্চটা বের করে প্রথমটায় বেশ ভাল করে টর্চের আলোয় ঘরের চারিদিকটা দেখে নিল। ঘরের মধ্যে কেউ নেই। ঘরের দরজাটা খোলা।

হঠাৎ দু’জনেরই কানে এল একটা অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ। কেউ যেন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।

রঞ্জিত চাকীই বললেন, ‘শুনতে পাচ্ছেন মি. সেন, কেউ মনে হচ্ছে আশেপাশে যেন যন্ত্রণায় থেকে-থেকে কাতরাচ্ছে…’

‘শুনেছি—চলুন।’

বারান্দাটাও অন্ধকার। বেশি দূর কিন্তু যেতে হল না। খানিকটা এগুতেই টর্চের আলোয় ওরা থমকে দাঁড়াল। দাসী মন্থরা মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে, পিঠে একপাশে একটা ছোরা বিদ্ধ হয়ে আছে, রক্তে বারান্দাটা একেবারে ভেসে যাচ্ছে।

ঝুঁকে মন্থরাকে পরীক্ষা করে বিরূপাক্ষ বুঝতে পারে, হাসপাতালে পাঠালেও বাঁচবার আশা আর মন্থরার নেই।

কিন্তু সেদিকে নজর দেবার মতো সময় ছিল না বিরূপাক্ষর। সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দু’খানা ঘরের পরের ঘরটার বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিল।

বার কয়েক জোরে জোরে ধাক্কা দেবার পর দরজাটা খুলে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে দশরথ চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘কে?’

বেশ একটু উঁচু গলাতেই বিরূপাক্ষ নির্দেশের ভঙ্গিতে বললে, ‘ঘরের আলোটা জ্বালো দশরথ—’

‘বাবু, আপনি?’

‘আলোটা জ্বালো—’

‘কী হয়েছে বাবু?’

‘আলোটা জ্বালো।’ এবার বিরূপাক্ষের গলার স্বর কঠিন।

দশরথ হাত বাড়িয়ে আলোটা জ্বেলে দিল।

দশরথের আপাদমস্তকে তীক্ষ দৃষ্টি বুলিয়ে বিরূপাক্ষ বললে, ‘দশরথ, ঘুমুচ্ছিলে?’

‘আজ্ঞে—’

‘দশরথ, তোমার কাপড়ে ও কীসের দাগ?’

‘কী বললেন বাবু?’

গলা তুলে এবার বিরূপাক্ষ বললে, ‘একটু আগে তুমি মন্থরাকে ছুরি মেরেছ।’

‘কী কী বলছেন বাবু?’

‘মি.চাকী. ওই দেখুন ওর কাপড়ে রক্তের দাগ। কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করলেই জানতে পারবেন যে, ওই দাগ রক্তের এবং সে-রক্ত মন্থরারই। মন্থরাকে ও-ই খুন করেছে, আর মুখোশের কীর্তিও ওরই।’

দশরথ তার একটা চোখ নিয়ে ওদের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ সে সামনে রঞ্জিত চাকীকে একটা প্রবল ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে ছুটে বের হয়ে গেল।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত দশরথ পালাতে পারেনি। বিরূপাক্ষ ধরে ফেলেছিল তাকে। সে এখন হাজতে।

সব শুনে বললাম, ‘তা হলে সবকিছু দশরথের কাণ্ড-কারখানা বিরু?’

‘হ্যাঁ, তবে দশরথ একজনের হাতের খেলার পুতুল মাত্র, সে যেমন করিয়েছে, ওই নির্বোধটা টাকার লোভে তাই করে গেছে।’

শুধালাম, ‘তা হলে আসল অপরাধী কে? কে ওকে দিয়ে অত কাণ্ড করিয়েছে বিরু?’

বিরূপাক্ষ বললে, ‘সেটা এখনও জানতে পারা যায়নি, তবে আমার অনুমান, অর্থই যত অনর্থের মূল।’

‘অর্থ? কার অর্থ? অঘোরনাথের?’

‘হ্যাঁ, তা ছাড়া আর কার? এবং যে বেশি লাভবান হবে অঘোরনাথের মৃত্যুতে, সেই নাটের গুরু।’

‘কিন্তু অঘোরনাথ কি তার সমস্ত সম্পত্তির কিছু একটা বিলি-ব্যবস্থা করেননি? তা ছাড়া তুই তো বলছিলি অঘোরনাথের তিন কুলে কেউ নেই, ওই ভাগনেটি ছাড়া, আমাদের পল্টনবাবু।’

‘কিন্তু ওই ভাগনেকে যদি কোনওমতে সরানো যায়, তা হলে হয়তো সমস্ত সম্পত্তি বর্তাবে নিকটবর্তী ওয়ারিশানে। ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে না, যতক্ষণ না দশরথ অর্থাৎ ওই মহাশয়তানটা মুখ খুলছে।”

“দশরথ কিছু বলছে না?’

‘না, একেবারে মুখে তালা দিয়েছে। তবে রঞ্জিত চাকীও জানে, কেমন করে বন্ধ তালা খুলতে হয়। তা ছাড়া—’

‘কী?’

‘মন্থরার হত্যাপরাধ দশরথের মাথার উপর ঝুলছে যখন, তখন মুখ তাকে খুলতেই হবে—’

‘কিন্তু একটা কথা বিরু, তুই কি দশরথকে গোড়া থেকেই সন্দেহ করেছিলি?’

‘ভেবে দেখ ওই একমাত্র দশরথ ছাড়া আর কার উপর সন্দেহটা পড়তে পারে। প্রথমত আগাগোড়া যদি ব্যাপারটা মনে মনে চিন্তা করিস, তা হলে একমাত্র তারই উপর সন্দেহ আসে। এক—যে বাড়ির মধ্যেই শুধু ছিল না—যে খুব ভাল করেই অঘোরনাথের সব খবর রাখত। দুই—যার ওই বাড়িতে সর্বত্র গতিবিধি ছিল। তিন—যার উপর চট করে কারওরই সন্দেহ আসবে না। চার—যার পক্ষে অতি সহজেই পুরনো টেবিল ল্যাম্পটা সরিয়ে সারাক্ষণ নতুন ল্যাম্পটা ওইখানে রাখা সম্ভব ছিল। সব কিছুই দশরথের দিকে যাচ্ছে। নির্দেশ করছে দশরথকেই।

‘দশরথ জানত অঘোরনাথ অত্যন্ত ভিতু প্রকৃতির। সে জানত, অঘোরনাথ অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশুনা করে আলো নেভান—তাই তার পক্ষে এতটুকু অসুবিধা ছিল না আলো নেভাবার পর সেই আলোতে হাই ভোল্টের কারেন্টের তারটা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিতে। তাই দিয়েছিল সে।

‘দশরথ হয়তো ভাবছিল হঠাৎ ঘুম ভেঙে ঘরের মধ্যে আবছা আলোয় ভয়ঙ্কর মুখোশ পরা দশরথকে দেখে ভির্মি খাবেন বা সঙ্গে সঙ্গে হার্টফেল করবেন ভিতু প্রকৃতির অঘোরনাথ। অনায়াসেই কার্য সিদ্ধি হবে। তারপর পল্টনকে সরানো তো অতি সহজ। কিন্তু দুর্ভাগ্য দশরথের। অঘোরনাথের চোখে পড়বার আগেই সে পল্টনের চোখে পড়ে গেল। প্ল্যানটা খানিকটা উলটে পালটে গেলেও অঘোরনাথ তাদের প্ল্যানমতো সুইচে হাত দিতেই হাই ভোল্টের কারেন্টে মারা গেলেন সঙ্গে সঙ্গে।

‘কিন্তু পল্টনবাবু মুখোশধারী দশরথকে দেখে ফেলায় দশরথ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। ব্যাপারটা অনুমান করতে পেরেছিলাম বলেই পল্টনবাবুকে সরিয়ে দিয়েছিলাম। দশরথ দেখল, মুশকিল হল, সে মুখোশ পরে সুনীলবাবুর বাড়িতে গিয়ে রাত্রে হানা দিল। তারই নির্দেশে, সম্ভবত যে প্রথম থেকেই তাকে বাঁদর-নাচান নাচাচ্ছিল।’

‘বুঝলাম। কিন্তু বুঝলি কী করে তুই যে, পিছনে কেউ আছে?’

বিরূপাক্ষ বললে, ‘এ তো অত্যন্ত সহজ। প্ল্যানটা ভাব। দেখ দশরথের মতো একটা গবেটের মাথায় অত বুদ্ধি খেলতে পারে কি?’

‘না, তা অবশ্যি ঠিক।’

‘তারপর ফোনে সেই থ্রেটনিং, সেও তারই কাজ। রঞ্জিতবাবু যখন আমাকে ফোন করেন, তখন হয়তো সেই তিনি আশেপাশেই কোথাও ছিলেন, কিংবা দশরথই তাকে সংবাদটা দিতে সেই আমাকে থ্রেটেন করে ফোনে আর তাতে করেই আমি পরে বুঝতে পারি যে কারও ব্রেন পিছনে আছে প্রথম থেকেই—”

“আচ্ছা ঘরের মধ্যে সেই পায়ের দাগ?”

‘সম্ভবত’, বিরূপাক্ষ বললে, ‘সে ওই দশরথেরই পায়ের ছাপ, এবং সেটা যে ওরই পায়ের ছাপ, তা প্রমাণ করতে অসুবিধা হবে না। অঘোরনাথ শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করেই শুতেন বরাবর, কাজেই দশরথের পক্ষে সম্ভব ছিল না সোজা পথে দরজা দিয়ে ঘরে ঢোকার। তাই বাধ্য হয়েই তাকে পিছনের স্পাইর‍্যাল সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে বাথরুম দিয়ে ঘরে ঢুকতে হয়েছিল। বাথরুমের পিছনের দরজাটা সে নিশ্চয়ই আগে থেকেই খুলে রেখেছিল, যেটা অঘোরনাথের নজরে পড়েনি। এবং ঘর থেকে বের হয়ে যায় অঘোরনাথের মৃত্যুর পর অন্ধকারে দরজা খুলে।’

‘কিন্তু তুই দশরথকেই সন্দেহ করতে গেলি কেন?’

‘প্রথম থেকেই সব দেখে শুনে ওর উপরেই আমার সন্দেহ পড়েছিল শিশির দুটো কারণে।’

‘কী কারণ?’

‘প্রথমত, দশরথই নাকি চিৎকার শুনে ছুটে যায় অঘোরনাথের ঘরে। কিন্তু দশরথ কানে বেশ কম শুনত। তার পক্ষে দু’খানা ঘরের পরের ঘর থেকে ওই চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে যাওয়া আদৌ সম্ভব ছিল না। মিথ্যা বলতে গিয়ে নিজের জালে নিজেই জড়িয়েছে। দ্বিতীয়ত রঞ্জিত চাকী ফোনে আমায় বলেছিলেন, দশরথই নাকি রণবাহাদুরকে থানায় পাঠিয়ে তাঁকে খবর দেয়। দশরথ যদি অঘোরনাথের মৃত্যু সম্পর্কে নিঃসংশয় না হত, প্রথমেই সে ডাক্তার কাউকে ডেকে পাঠাত, কিন্তু তা না করে সে সোজা থানাতেই লোক পাঠাল।’

‘কিন্তু মন্থরাকে দশরথ খুন করল কেন?’

বিরূপাক্ষ বললে, ‘সেও দশরথের নিয়তি, মন্থরাকে খুন না করলে দশরথ হাতেনাতে ধরা পড়ত না। বেচারি মন্থরা কিছু দেখেছিল বা সন্দেহ করেছিল, কাজেই তাকে এই পৃথিবী থেকে সরানোর প্রয়োজন হয়েছিল।’

‘তাই যদি হবে তো মন্থরা সেকথা পুলিশকে জানাল না কেন?’

‘দশরথের ভয়ে সম্ভবত।’

বিরূপাক্ষর অনুমান যে নির্ভুল সেটা দিন কয়েক পরেই প্রমাণিত হল দশরথের জবানবন্দি থেকে। দশরথ যা করেছে, অর্থের লোভ, একজনের নির্দেশে। প্রথমটায় ব্যাপারটার গুরুত্ব ঠিক বুঝতে উঠতে পারেনি, পরে বুঝতে পেরে পল্টনবাবুকেও সরাবার ব্যবস্থা করে ভয় দেখিয়ে।

নাটের গুরু আর কেউ নয়, অঘোরনাথেরই ছোট ভাই শিবনাথ।

বাপ তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল তার নষ্ট চরিত্রের জন্যই। বাপ বেঁচে থাকতে চিঠি দিয়ে বাপের ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল। কিন্তু বাপ তাকে ক্ষমা করেননি। পরে অঘোরনাথের সঙ্গেও কয়েকবার দেখা করে শিবনাথ, কিন্তু অঘোরনাথও ভাইকে পাত্তা দেননি, তবে মধ্যে মধ্যে অর্থ সাহায্য করতেন বিপথগামী ভাইকে।

দশরথের সঙ্গে পরিচয় শিবনাথের ওই সূত্রেই।

শিবনাথ তাকে হাত করে অর্থের লোভ দেখিয়ে। নিরেট দশরথ শিবনাথের ফাঁদে পা দিতে দেরি করে না।

শিবনাথের অবিশ্যি কোনও পাত্তাই পাওয়া গেল না।

আর তাকে পেলেও তাকে ধরা ছোঁয়া যেত না।

যে সম্পত্তির লোভে সে এত কাণ্ড করেছিল, অঘোরনাথ অনেক আগেই সেই সম্পত্তির বিরাট একটা অংশ দেশের কল্যাণে দান করে বাকিটা পল্টনবাবুকে দিয়ে গিয়েছিলেন পাকাপোক্ত উইল করে।

১৩৮২

অলংকরন: সুধীর মৈত্র

সকল অধ্যায়

১. প্রোফেসর হিজিবিজ্‌বিজ্ – সত্যজিৎ রায়
২. বাহাদুর – আশাপূর্ণা দেবী
৩. কুমির – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
৪. ননীদা – মতি নন্দী
৫. হর্ষবর্ধনের ভাগনে ভাগ্য – শিবরাম চক্রবর্তী
৬. কর্ভাস – সত্যজিৎ রায়
৭. বেণী লস্করের মুণ্ডু – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৮. টুম্পুর গল্প – সুকুমার দে সরকার
৯. বারীন ভৌমিকের ব্যারাম – সত্যজিৎ রায়
১০. বীর হওয়ার বিড়ম্বনা – শিবরাম চক্রবর্তী
১১. নন্দগুপি – লীলা মজুমদার
১২. পালোয়ান ভূত – মনোজ বসু
১৩. হিসাব – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৪. গান – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৫. জ্যান্ত খেলনা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৬. মুড়ি – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
১৭. কর্নেল মিত্র – বিমল মিত্র
১৮. গুল-ই ঘনাদা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৯. ভয়ঙ্কর মুখোশ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
২০. দিনে ডাকাতি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
২১. গন্ধটা খুব সন্দেহজনক – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২২. মেজকর্তার খেরোখাতা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২৩. গোয়েন্দা বরদাচরণ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৪. সাধু কালাচাঁদের ফলাও কারবার – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
২৫. একটি ভুতুড়ে ঘড়ি – বিমল কর
২৬. বুনো হাতির বন্ধুত্ব – সমরেশ বসু
২৭. গোয়ায় গোগোলের প্রথম কীর্তি – সমরেশ বসু
২৮. ইঁদারায় গণ্ডগোল – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৯. চোর সাধু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৩০. টোরি জঙ্গলের ভক্ত-বাঘ – সুবোধ ঘোষ
৩১. জোনাকি-ভূতের বাড়ি – সমরেশ বসু
৩২. বনবিড়াল – বিমল কর
৩৩. ভয় ও ভূত – সুকুমার সেন
৩৪. সুপারমেন – সমরেশ মজুমদার
৩৫. রাত যখন বারোটা – অশোক বসু
৩৬. প্রেতাত্মার উপত্যকা – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৭. আলুর চপ – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
৩৮. হাবুলমামার ভূতের ব্যবসা এবং… – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৯. অশোকের কাণ্ড – হর্ষ দত্ত
৪০. হারাধন – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪১. হয়তো এইরকমই – আশাপূর্ণা দেবী
৪২. মহারাজা তারিণীখুড়ো – সত্যজিৎ রায়
৪৩. খুড়ো-ভাইপো – বাণী বসু
৪৪. সহযাত্রী – সত্যজিৎ রায়
৪৫. দারিৎসু – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৪৬. চার বুড়োর আড্ডা – আশাপূর্ণা দেবী
৪৭. রামপলের অন্তর্ধান রহস্য – রূপক সাহা
৪৮. দেয়ালা – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪৯. শুভ জন্মদিন – জয় গোস্বামী
৫০. ইন্দ্রনাথ সামন্তের বাড়ি – সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন