পৌলোমী সেনগুপ্ত
বঁড়শিমামার দেওয়া আদরের উপহার ওই রং-পেন্সিলের বাক্সটা যে টমটমের এত দুঃখের মূল হবে, তা কি আর সেদিন ভেবেছিল টমটম? পেয়ে তো একেবারে আহ্লাদে আটখানা হয়ে গিয়েছিল। টমটমের যে একটাও রং-পেন্সিলের বাক্স ছিল না তা অবশ্য নয়। ছিল তো! থাকতে তো হবেই। ইস্কুলে ড্রইং-ক্লাস নেই?
ড্রইংবুকে শুধু লাইন দিয়ে কি ফুটকি রেখা দিয়ে আঁকা সব পাখি, বল, দোয়াত, চেয়ার, ছাতা-টাতা ছবিদের গায়ে রং লাগিয়ে দেখাতে হয় না আঁকা দিদিমণিকে? তবে সে-বাক্সগুলো এত সুন্দর আর এত বড় কি? আর রংগুলো এত ঝলমলে? এটা একটা দারুণ!
তা ছাড়া? হ্যাঁ তা ছাড়াও তো একটা ব্যাপার আছে। ইস্কুলের ড্রইং পেন্সিল বাক্সটা থেকে টমটম নিজের ইচ্ছেয় কিছু আঁকতে পায়? সে তো মা’র কড়া পাহারার মধ্যে। একবারটি সেটা টেনে নিয়ে বসলেই মা কেড়ে নিয়ে তুলে রেখে বলবেন, “বাজে বাজে নষ্ট করছিস কেন? কী দাম বাবা!”
কিন্তু এটা?
এটা সম্পূর্ণ টমটমের এক্তারে। বঁড়শিমামা ওই পেন্সিল ‘পেন্টিংবক্স’ আর একটা ড্রইং-খাতা দিয়ে বলেছিলেন, “তোর যখন যা ইচ্ছে হবে আঁকবি! দেখে-দেখে আঁকার কোনও মানে হয় না। নিজের খেয়াল-খুশিমতো আঁকাটাই তো মজা! সাপ-ব্যাঙ যা আঁকবি, মজা!
তা সেই মজাটা করতে গিয়েই তো দিব্যি একটা সাজা!
আসলে ‘ইচ্ছেমতন’ আঁকতে চাইলে আর খাতার পাতারা কতক্ষণ? সে তো দু দিনেই সর্বাঙ্গ রঙিন হয়ে বসে আছে। এখন কী করা? ভাবতে-ভাবতেই—সেই প্রথম ফাঁড়া।
তবু প্রথম চোটটা একটা হাসাহাসি হইচইয়ের মধ্যেই তালগোলে কেটে গেছল। কারণ টমটমের শিল্পকৃতি দেখে মা রেগে আগুন হলেও, বাবা হেসে ফেলেছিলেন। আর কাকা তো একেবারে অট্টহাস্য।
ব্যাপারটা এই, টমটমেদের ঘরে টেবিলে মা আর বাবার বিয়ের সময়কার একটা ছবি সুন্দর একটা স্ট্যান্ড ফ্রেমে বাঁধানো সাজানো ছিল। বিয়ের সময় থেকেই ছিল। সাদা-কালোই।
টমটমের হঠাৎ মনে হল, ছবিটায় রং করা দরকার! যেমন ভাবা তেমনই কাজ! চেয়ারে উঠে টেবিলে হাত দেওয়া এমন কিছু ব্যাপার নয়। এবং ফ্রেম থেকে ফোটোটা খুলে বার করে ফেলাও টমটমের কাছে কিছুই নয়! দু’ বছর বয়স থেকেই তো টমটম বাবার রিস্টওয়াচটায় দম দেবে বলে ঝুলোঝুলি করত, নিজে জ্বর দেখবে বলে থার্মোমিটারটা নিয়ে টানাটানি করত!
ছবিটা বার করে ফেলে টমটম মায়ের শাড়িতে টুকটুকে লাল রং আর বাবার পাঞ্জাবিতে ঘোর নীল রং দিয়ে ঠিকঠাক করে ফেলে, আর কী করা যায় ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ ভেবে বসল, আচ্ছা মায়ের নাকে যদি বাবার মতো গোঁফ থাকত আর বাবার মাথায় ঘোমটা, কীরকম দেখাত?
তা ‘কীরকম’ দেখাত, সেটা দেখতে আর কতক্ষণ? ভাবতে যা দেরি! কিন্তু টমটমের কপাল, ‘কেমন দেখতে’ লাগত সেটা নিজে ভাল করে দেখবার আগেই মা ঘরে ঢুকে, মিনিবাসের সাইরেনের মতো চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওটা কী হচ্ছে? ওটা কী হচ্ছে? অ্যাঁ? পাজি ছেলে। ছবিটার দফা শেষ করে দিলি।”
তা শুধু কি চেঁচানো? টমটমের কানটা ধরে টেনে নিয়ে গেলেন না মা বাবা-কাকার কাছে। একে ‘পাজি ছেলে’ বলা, তার ওপর আবার কান ধরা! কী এত দোষ করেছিল টমটম? যখন বঁড়শিমামার দেওয়া সেই খাতাটায় টমটম ছবি এঁকে-এঁকে দেখেছিল। হাতির যদি ডানা থাকত, ঘোড়ার যদি শিং থাকত, বেড়াল, কুকুর, গোরু, গাধারা যদি দু’ পায়ে হেঁটে হাত দিয়ে খেত, কেমন দেখতে লাগত! তখন তো কই নিন্দে দেওয়া হয়নি টমটমকে? তখন তো বরং মা, হেসে-হেসে সবাইকে ডেকে-ডেকে দেখিয়েছেন, আর টমটমকে বলেছেন, “তোদের মাথায় এত উদ্ভট খেয়াল আসে বাবা!” আর এখন? ওই ছবিটাকে একটু বদলে দিতেই, একেবারে রেগে আগুন। কান ধরা।
তো এই ছবিটা দেখে বাবা একটুখানি আর কাকা অনেকখানি হাসলেন বলেই টমটমের অপমানটা কমে গেল।
কিন্তু দ্বিতীয়বার?
তখন কাকা কি হেসেছিলেন?
‘আমার কলেজের খাতায় এটা কী হয়েছে রে বাঁদর ছেলে,” বলে কাকা নিজেই টমটমের মাথাটা দেওয়ালে ঠুকে দেননি? চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে বলেননি, “বউদি, দেখে যাও তোমার আর্টিস্ট ছেলের কাণ্ড! আমার কলেজের খাতায় যত ইচ্ছে ফুল এঁকে রেখেছেন। আবার বলে কিনা, ‘আমি কি তোমার অঙ্কর ওপর এঁকেছি? সাদা জায়গায় তো এঁকেছি।’ এ ছেলেকে নদীর এপারে পুঁতলে ওপারে গাছ গজাবে!”
কথাটার ঠিক মানে বুঝতে পারেনি টমটম, তবে খুব একটা মন্দ কথা তা বুঝে গিয়েছিল। টমটমকে তো পুঁতে দেওয়ার কথা বলেছিলেন কাকা। মানুষকে পুঁতে দেওয়া যায়? তা থেকে গাছ গজায়? সে-গাছে কী হয়? ফুল, না ফল? কীরকম দেখতে সেই ফুল, কি, ফল? সেদিন তো আবার বাবাও বকেছিলেন, “কাকার খাতা নষ্ট করেছ কেন” বলে।
একটু ফুল আঁকলেই নষ্ট হয়ে যায়? ফুল কিছু খারাপ জিনিস?
তো সেদিন মা তেমন বকেনি। বলেছিলেন, “ছোট ছেলেপুলে কি আর এমন খেলা করে না? তোর কাকা যা করছে! বাবাঃ!”
তার মা’র জন্য সেদিনের দুঃখটা কমে গিয়েছিল।
কিন্তু সেদিন?
বারান্দার দেওয়ালে কাক আঁকার দিন? কে না বকেছিলেন? মা, বাবা, কাকা, এমনকী, কাজের মাসি পর্যন্ত। যত পেরেছিলেন বকেছিলেন সবাই। আর সবাই কি শুধু বকেই থেমে গিয়েছিলেন নাকি? পেন্সিলগুলোকে মটমট করে ভেঙে ছুড়ে-ছুড়ে ফেলে দেননি বাবা চারদিকে? টমটমের মাথাটাকে দেওয়ালে ঠুকে ঠুকে আলু করে দেননি? আর মা গালে ঠাস-ঠাস করে চড় বসিয়ে দেননি? বলেননি, “এই লক্ষ্মীছাড়া হনুমান ছেলের জন্য আমার কপালে অনেক দুঃখ আছে!”
বাবা বলেননি, “আর যদি কোনওদিন দেওয়ালে আঁকতে যাস তো মেরে পিঠের ছাল তুলব, হাড়মাস আলাদা করে ছাড়ব? এই সেদিন মাত্র বাড়িটায় নতুন রং করা হয়েছে দ্যাখোনি? দেখে খুব খারাপ লাগছিল বুঝি?”
তা দেখে তো ছিল, টমটম! মিস্ত্রি লাগার সময় তো আর স্ফুর্তির শেষ ছিল না। সবসময় বাড়িতে অগোছালো ভাব, আজ এখানে টেবিল এনে খাওয়া হচ্ছে, কাল ওখানে টেবিল এনে খাওয়া হচ্ছে। ঘরের মধ্যে বাঁশ দিয়ে দিয়ে সিঁড়ি বানিয়ে রাখছে, এসব কি কম মজা? তারপর রং গুলে-গুলে কী সুন্দর রং করে ফেলল দেওয়ালগুলো, ঠিক যেন আকাশের মতো। দেখে ‘খারাপ’ লাগতে যাবে কেন, অ্যাঁ? তো, তখন তো আর টমটমের এই রং-পেন্সিলের বাক্সটা আসেনি। এলে টমটমও তো কোনওখানে একটু-একটু রং করত। বঁড়শিমামা তারপরে এসেছিলেন! বঁড়শিমামা তো বলেছিলেন, “বাঃ! দেওয়ালের রংগুলো তো খুব সুন্দর হয়েছে।”
কিন্তু টমটম কি আগে ভেবেছিল বারান্দার দেওয়ালে একটা কাক আঁকবে? মোটেই না। বারান্দায় তো এসেছিল টমটম ওই রং-পেন্সিলের বাক্সটাকেই খুঁজতে। সবসময়ই তো ওটা হারিয়ে যায়, খুঁজে-খুঁজে বার করতে হয়। কে যে কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলে! তো মা বলেন কি, “কে আবার তোর জিনিস কোথায় ফেলতে যাবে? নিজেই তো যখন যেখানে ইচ্ছে বসে আঁকতে লেগে যাস। আর তারপর ফেলে চলে যাস। কখন যেন বারান্দায় বসে কী একটা আঁকছিলি? দেখগে যা। এদিকে তো ওটা প্রাণ!” অথচ—
কে জানে কী আঁকছিল! তবে শুনেই টমটম ছুটে বারান্দায় চলে এসেছিল, আর সত্যিই দেখতে পেয়েছিল বারান্দায় পাতা বেতের চেয়ারটার তলায় পড়ে রয়েছে তার ‘প্রাণটি’। কিন্তু সেটা কুড়িয়ে নিয়ে চলে আসতে গিয়ে টমটম যে একদম হাঁ! এ কী! বারান্দার দেওয়ালে ঠিক সুইচটার নীচে একটা কাক এঁকে রেখেছে কে?
বারান্দার রেলিঙে বসে থাকা একটা কাকের ছবি! ঠিক কাকের মতো।
কে এঁকেছেন? মা? বাবা? কাকা? কাজের মাসি? নাকি ওর ছেলে সেই কেষ্ট না কে?
ওঃ! এর বেলায় দোষ হয় না। আর টমটম একদিন বাবার দেওয়ালে নিজের নামটা লিখতে যাচ্ছিল বলে বাবার কী ধমক। “এই টমটম, দেওয়ালে কী হচ্ছে? খাতা নেই? স্লেট নেই? ভাগ্যিস দেখলাম! খবরদার, দেওয়ালে দাগ কাটবে না।”
অথচ—এইখানে কালো রং-তুলি দিয়ে বেশ একখানা কাক আঁকা হয়েছে।
তো কাকের ছবি তো কালোই হবে। কিন্তু টমটমের হাতে রঙের ভাঁড়ার! ওর মনে হল, আচ্ছা, কাক যদি লাল হয় কেমন দেখতে লাগে? তো একবার বই তো দু’বার ভাবে না টমটম! তাই কালোটার ওপর বেশ ঘষে-ঘষে পেন্সিল বুলিয়ে লাল করছিল, ও মা! পা দুটো আঁকবার আগেই কিনা ছবি উধাও!
কী হল? কোথায় মিলিয়ে গেল! ফস করে উড়ে গেল যে। ওঃ, তার মানে রেলিংটার ওপর একটা কাক বসে ছিল, এটা তার ছায়া। কী মজা, একটা সত্যিকার মাপের কাক আঁকা হয়ে গেল। আবার লাল রঙের কাক! কী চমৎকার। কাকেরা যদি লাল হত! কী সুন্দর দেখতে হত। দুটো পা এমনিই এঁকে ফেলে বেশ কিছুক্ষণ ধরে নিজের বাহাদুরিটি দেখতে-দেখতে দেখে, আরে কাকটাই উড়ে গেছে, বারান্দার রেলিংগুলো তো উড়ে যায়নি। ঠিক রেলিঙের মতো দেওয়ালে আঁকা হয়ে রয়েছে কাকটার পায়ের নীচে। তবে আর কী? সেই ছায়াময় রেলিংকে কায়া দিয়ে ফেলা। সবুজ পেন্সিলের সবটাই খতম করে, রেলিংকে দেওয়ালে চিরস্থায়ী করে ফেলল টমটম। মানে সুইচের নীচের সেই সরু দেওয়ালটায় যতটা ছায়া পড়েছিল।
নিজে মোহিত হয়ে দেখতে-দেখতে ভাবল, বড়রা এসে দেখে টমটমকে নিশ্চয় খুব প্রশংসা দেবে। সবুজ রেলিঙের ওপর লাল কাক! অপূর্ব!
কিন্তু বড়রা দেখার পর যা হল, তা তো আগেই বলা হয়ে গেছে! বাবা বললেন, “নিজের কান নিজে ধরে বল আর কখনও এমন করব না। দেওয়ালে রং লাগাব না! কখনও না! বল। বল শিগগির।”
তাই করতে হল টমটমকে।
কাকা অবশ্য মারধরের দিকে গেলেন না। শুধু ব্যঙ্গের গলায় বললেন, “ছেলে এই বয়সেই ‘দেওয়ালচিত্র’ আঁকায় ওস্তাদ হয়ে গেছে, তার ভাবনা কী? বাড়িখানা এবার আর্ট গ্যালারি হয়ে উঠবে। লেখাপড়া করার দরকার নেই আর।” টমটমের এতে আরও অপমান হয়। বরং বকা খাওয়া সহ্য হয়, কিন্তু ওই ঠাট্টা? অসহ্য! এই সবই তো ওই রং-পেন্সিলের বাক্সটার জন্য!
তো আরও কতক্ষণ এইসব হেনস্থা চলত কে জানে, সেদিন হঠাৎ ঘটনা ঘটে গেল অন্য! ওই বকাবকির মধ্যেই কিনা হঠাৎ বঁড়শিমামা এসে হাজির। কাজের মাসি দরজায় বেল বাজা মাত্রই তো ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছে। আর বঁড়শিমামা এক-এক লাফে তিনটে সিঁড়ি পার করে এক মিনিটে সদর থেকে দোতলার বারান্দায়।
তা বঁড়শিমামাকে দেখেই বাবা বলে উঠলেন, “এই যে নাটের গুরু এসে গেছেন। আচ্ছা একখানি বঁড়শি বিধিয়ে গিয়েছিলে ভায়া ভাগ্নেকে!”
বঁড়শিমামা বললেন, “কী ব্যাপার? জায়গাটা যেন রণক্ষেত্র মনে হচ্ছে!”
মা তাড়াতাড়ি ভাঙা পেন্সিলের টুকরোগুলো কুড়িয়ে তুলে নিতে নিতে বললেন, “হাত থেকে পড়ে গিয়ে টুকরো হয়ে গেল। সবই তো ঘষে-ঘষে শেষ করে এনেছে!”
টমটম অবাক হয়ে তাকাল। মা বললেন, “হাত থেকে পড়ে গিয়ে!” তার মানে মা বানিয়ে-বানিয়ে কথা বললেন! কেন? হতভম্ব হয়ে গেল টমটম। ইত্যবসরে বাবা বেশ জোর গলায় আর ঠাট্টা করে-করে টমটমের মামার দেওয়ার রঙের সম্ভার নিয়ে কী-কী মহৎ কাজ করা হয়েছে তার ফিরিস্তি দিলেন। যেন জিনিসটা উপহার দিয়ে বঁড়শিমামাও বেশ একটা বেয়াড়া কাজ করে বসেছে! মায়ের মুখে গোঁফ, বাবার মাথায় ঘোমটা থেকে খাতার পাতায় ‘হাতির যদি ডানা থাকত আর ঘোড়ার থাকত শিং’-এর মতো উদ্ভট খেয়ালের কথা, কিছু বাকি রাখলেন না বাবা! তা ছাড়া চোখের সামনেই তো ওই লাল কাক আর সবুজ রেলিং বিরাজিত!
কিন্তু শুনে বঁড়শিমামা কি লজ্জা পেয়েছিলেন? মোটেই না, বরং বাবাকেই লজ্জা দিয়ে বলেছিলেন, “এই ছেলেকে আপনি বকাবকি করছেন জামাইবাবু? আপনার তো ছেলেকে প্রাইজ দেওয়া উচিত। এই রেলিংগুলোর ছায়ায় কী সূক্ষ্মভাবে রং বুলিয়েছে দেখেছেন? আর উদ্ভট চিন্তা? সেটাই তো জিনিয়াসের লক্ষণ। বড় হয়ে ছেলেটা একদিন একখানা জিনিয়াস হবে দেখবেন।”
কাকা মুচকি হেসে চলে যাওয়ার সময় বলে গেলেন, “ওই আনন্দেই থাকুন!”… মা বেজার গলায়, “জিনিয়াস নিয়ে আমি ধুয়ে জল খাব। এখন তো হাড় ভাজাভাজা—” বলে বঁড়শিমামার জন্য চা আর খাবারের ব্যবস্থা করতে চলে গেলেন। আর বাবা বললেন, “সাধে আর বেয়াড়া আদরের প্রতীক হিসেবে নেওয়া হয়েছে, ‘মামার বাড়ির আদর’। যার নাম বেয়াড়া আদর! আহা মামার বাড়ির কী গুণ। তাই তাই তাই, মামার বাড়ি যাই! মামার বাড়ি ভারী মজা, কিল চড় নাই! আহাহা! হা হা হা।”
তো সেদিনও বঁড়শিমামা এসে পড়ায় তালেগোলে ফাঁড়াটা কেটে গেছল। পরে তো বেশ জোর তলবে খাওয়াদাওয়া হাসি, গল্প চলেওছিল শেষপর্যন্ত! এমনকী, বঁড়শিমামা টমটমকে চুপিচুপি আশ্বাস দিয়ে গেছলেন, “আমি তোকে তুলি-পেন্সিল আর একটা ভাল পেন্টিংবক্স দেব। ছবি আঁকায় হাত আছে তোর! ছাড়বি না!”
অবিশ্যি চুপিচুপিই বলেছিলেন। বলেছিলেন, “এক্ষুনি দেব না, তোর বাবা রেগে ফায়ার হয়ে আছে এখন!”
কিন্তু?
সেসব না আসতেই আবার আজ?
আবার বাবা সেই রেগে ফায়ার! থাপ্পড় মেরে টমটমের ফুলো-ফুলো গালটায় পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দেওয়া!
কেন? কী করেছে টমটম? দেওয়ালে কিছু করেছে? শুধু তো দরজায়! তাও কী রংছাপ? শুধু তো একটু কাদার ছাপ! ফুলগাছের টব থেকে একটু করে মাটি নিয়ে কাদা করে—তো পরে ভিজে ন্যাকড়ায় মুছে ফেলা যায় না বুঝি? তবু কিনা বাবা নিজের চোখ লাল করে টমটমের গালটা লাল করে দিলেন।
তা প্রথমটায় অবশ্য একটু লড়তে চেষ্টা করেছিল টমটম। চেষ্টা চালিয়েছিল তার সাধ্যমতোই! জোর গলাতেই বলেছিল, “ছোট ছেলে পেয়ে ভারী মজা পাওয়া হয়েছে, না? মেরে গাল ফাটিয়ে দেওয়া হল। আমি কি দেওয়ালে কিছু করেছি? রংছাপ করেছি? শুধু তো একটু পরীক্ষা করতে—’
কিন্তু তারপরও যদি আর-একটা থাপ্পড় পড়ে, আর টমটমের মা’র ওপর আদেশ জারি হয়, “এই শয়তান, পাজি, বেয়াড়া, ব্যাদড়া, বিচ্ছুটাকে সারাদিন না খেতে দিয়ে ঘরে বন্ধ করে রেখে দাও। তবে যদি শিক্ষা হয়। দোষ করে ভয় নেই, আবার মুখে-মুখে জবাব! দেখেছ দরজাটার অবস্থা। এসো, দেখে যাও! ছেলে তো নয়, শত্রু! কিছু না পারি তো নতুন রং-করা দরজার গায়ে সরি-সারি কাদা-পায়ের ছাপ দিই! ‘দেওয়াল নয়, দরজা! রং নয়, কাদা!’ আইন বাঁচিয়ে অনিষ্ট করা! বিচ্ছু নম্বর ওয়ান! খবরদার, আজ ওকে খেতে দেবে না, আর ঘরে বন্ধ করে রাখবে!… তখন আর কে লড়তে পারবে?”
দুম দুম করে হাঁটতে-হাঁটতে বাবা আবারও বলেছিলেন, “জোতিষী ঠাকুর মামা বলে গেছেন, ভাগ্নে একখানা জিনিয়াস হবে। জিনিয়াস হওয়া বার করছি! আশ্চর্য! এত দুর্মতি মাথায় আসেই বা কেন?”
তা টমটমের মাও জানেন না এমন সব খেয়াল মাথায় আসে কেন তাঁর ছেলের। কোন কারণে যে কোন কার্যটি ঘটে, তা কে বুঝতে পারে? অথচ কাজের একটা কারণ থাকেই। কিন্তু সেটা ধরতে পারাই শক্ত। তাই মা’র খেয়ালে আসে না, ক’দিন যেন আগে পুরনো আলমারি থেকে পুরনো-পুরনো জামাকাপড় এটা-সেটা বার করে রোদে দেওয়াই কাল হয়েছিল তাঁর। রোদও যে এমন কিছু হয়েছিল তা নয়, তবু টমটমের পুজোর ছুটিটা ফুরোবার আগেই মা বাক্স-আলমারি গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। তা তুলে রাখা পুরনো জিনিসপত্র ছড়িয়ে রোদে দেওয়া হয়েছে, এমন একখানা জম্পেশ দৃশ্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে না এমন ছোট ছেলে কে আছে? টমটমও পড়েছিল। আর কোনও খাঁজ থেকে বেরিয়ে পড়া লাল টুকটুকে একজোড়া পশম-বোনা ছোট্ট খুদে মোজা দেখে আহ্লাদে আত্মহারা হয়ে বলেছিল, “এই পুঁচকে মোজা দুটো কার মা? তোমার ছেলেবেলার পুতুলের?”
মা একটু হেসে বলেছিলেন, “ছেলেবেলার কেন, বড়বেলারই!”
“ধ্যাত! বড়বেলা বুঝি পুতুল খেলে?”
“কেন খেলবে না? এই তো এখনও খেলছি। তুই তো আমার একটা পুতুলই। যখন খুব ছোট্ট ছিলি, তোর তখনকার। তোর মেজো মাসি বুনে দিয়েছিল।”
টমটম অবশ্য প্রথমটা বিশ্বাস করেনি। অবিশ্বাসের হাসি হেসে বলেছিল, “ইস, আমায় বোকা পেয়ে ঠাট্টা করা হচ্ছে। এইটার মধ্যে আমার পা ঢুকত?”
“ঢুকত না? তখন কি তুই এখনকার মতো ছিলি? এইটুকখানি খুদে-খুদে হাত-পা! পুতুলের মতো মাপ! এখন সেইসব জামা-মোজা-টুপি দেখলে আমার নিজেরই হাসি পায়।”
টমটম একটু চিন্তিত আর একটু অবিশ্বাসের ভাবে বলেছিল, “তা হলে কী করে হঠাৎ এত বড় হয়ে গেলাম?”
“হঠাৎ কেন? একটু-একটু করে হলি!”
“কী করে? কখন? কোন সময়? এতটুকু পা-টা এত বড় হয়ে গেল দেখতে পেলে না? সবসময় তো বাড়িতে থাকো! যখন ছোট্ট ছিলাম কোলেও থাকতাম তো।”
“তা আবার থাকতিস না! যা দুষ্টু ছিলি, কোল থেকে একটু নামালেই অমনই চ্যাঁচানি!… আঃ, সব জিনিস হাণ্ডুল-বান্ডুল করছিস কেন? গুছিয়ে নিই বাবা!”
“না, তুমি বলো কী করে ছোট্ট থেকে বড় হয়।’
“সে কী আর দেখতে পাওয়া যায় রে বাবা?”
“কেন দেখতে পাওয়া যায় না?”
“কী মুশকিল! তুই কি একটা খ্যাপা, না পাগল? আরে ওই তো ছাদের টবের গাছগুলো, এতটুকু চারা পোঁতা হয়েছিল না? এখন কত বড় হয়ে উঠেছে। আরও বড় হবে! তেমনই।”
“ও তো গাছ।”
“গাছও যা, মানুষও তা। একটু-একটু করে বাড়ে। তোর এই পা আবার বেড়ে-বেড়ে তোর বাবার মতন হয়ে যাবে।”
“কখন বাড়ে?”
“আহা। বলছি তো—সে কি দেখতে পাওয়া যায়?”
“বাঃ। নিজের ছেলে, ছোট্টবেলায় কোলে শুয়ে থাকে, দেখতে পাওয়া যায় না? তা হলে নিশ্চয় রাত্তিরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বাড়ে!”
“তাই হবে।”
“তাই হবে! ব্যস, বলে দিলে? রোজ মেপে-মেপে দেখতে ইচ্ছে হয়নি?”
মা হেসে ফেলে বলেন, “না বাবা, তেমন ইচ্ছে হয়নি।”
“কেন হয়নি? ও-মা। কেন হয়নি? ও-মা।”
“উঃ, কী যে করিস! কাজের সময় জ্বালাসনে বাবা! সর।”
“আঃ, তোমার কেবল যত আজেবাজে কাজ! রোজ মেপে দেখলে বোঝা যাবে, কী করে পা বাড়ে?”
“টমটম, সত্যিই তুই একটা বদ্ধ পাগল। শুধুই কি পা বাড়ে? সবই বাড়ে।”
“সবটা কী করে মাপা হবে? ও-মা।”
“আঃ! এত জ্বালাতনও করতে পারিস। ওটা কী হচ্ছে? অ্যাঁ, ফের সব ছড়িয়ে ফেলছিস যে?”
“ফেলবই তো। আরও ফেলব। তুমি কেন রোজ-রোজ মাপোনি?”
“আঃ টমটম, নিজে তো একটা পাগল। তুই কি আমাকেও পাগল করবি? যা মাসির কাছে যা।”
“মাসির কাছে যেতে আমার দায় পড়েছে। কেলেবিচ্ছিরি। সবসময় কেবল মাসির কাছে যা! নিজে কিছু বলতে পারেন না। খালি যত হান্ডুল-বাণ্ডুল কাজ।”
বলে দুমদাম পা ফেলে চলে যায় টমটম।
মা অবশ্য এতে ভয় পান না। মনে-মনে একটু হাসেন। জানেন, ওই কাজের মাসিটির কাছেই যাবে। তাকে যত-ইচ্ছে উৎপাত করবে, আবার তার গায়ের সঙ্গে লেপটে বসে গল্পও শুনবে। ‘কেলেবিচ্ছিরি’ বলে তাকে ভালবাসায় কোনও ঘাটতি নেই। ডেকে-ডেকে টেনে নিয়ে গিয়ে পড়াতে বসাতে হয়।
তা তখন তো টমটমের মা ছেলে রাগ দেখিয়ে চলে যাওয়ায় কিছুমাত্র ভাবিত হননি, হাতের কাজটা সেরে ফেলে বেঁচেছিলেন। স্বপ্নেও ভাবেননি ছেলের মনের মধ্যে কীসের চারা পুঁতে বসল! তাই সেইদিনের কথাটা মনে পড়ে না টমটমের মা’র। তাই তিনিও হতাশ হয়ে ভাবেন কেন যে ছেলেটা এমন! ওর বাবারও আবার শাসনটা একটু বেশি-বেশি। ওইটুকু ছেলেকে দরজা বন্ধ করে আটকে রাখতে হবে! এটা একটা কথা হল!
কিন্তু হল আর না হল, ততক্ষণে আসামি নিজেই সামনের ঘরটায় ঢুকে পড়ে, চটপট একটা চেয়ার টেনে নিয়ে উঠে দরজার মাথার ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিয়ে তারস্বরে ঘোষণা করতে থাকে, “দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে! খেতে দেওয়া হবে না! আমার বয়েই গেছে। নিজেই তো আমি দরজা খুলব না! খেতে ডাকলেও খাব না! অনেক, অনেক বড় হয়ে গেলে বেরিয়ে রাস্তায় চলে যাব। অনেক, অনেক দূরে। ইস্কুলের পরীক্ষার জন্যে এত, আর নিজে একটু পরীক্ষা করতেই দোষ! মারা, বকা! বঁড়শিমামার কথা বিশ্বাস হল না? ঠিক আছে। যখন বড় হয়ে গিয়ে সেই ‘জিনিনিয়াস’ না কী হয়ে যাব, তখন তোমাদের সেই জিনিস-টিনিস কিছু দেব না। কথাই কইব না তোমাদের সঙ্গে। তখন বুঝবে ঠ্যালা। দেখবে মজা! তখন পড়ে পড়ে ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে কাঁদবে।” বলতে বলতে ভবিষ্যতের জিনিয়াসটি নিজেই ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে।
কে জানে, চিরকাল পৃথিবীর যতসব সত্যিকার জিনিয়াসদের জীবনের ভোরবেলাটার ইতিহাস অনেক সময় এইরকমই হয় কি না। বকুনি, পিটুনি, শাসানি, শান্তি। কেউই তাদের বুঝতে চায় না। বলে, ‘পাজি’। বলে, ‘পাগল’!
১৩১৯
অলংকরণ: বিমল দাস
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন