পৌলোমী সেনগুপ্ত
চেঁচিয়ে জোরে ডাকলাম, “টুম্পু! ও টুম্পু”!
“যাই, জ্যাজা।”
খরগোশের মতো লাফাতে লাফাতে টুম্পু এল।
“কী বলছ?”
“তুমি আজ গল্প শুনতে আসোনি কেন?”
টুম্পু একটু নেচে নিল। যেন তিন পায়ে নাচ। পাক খেয়ে টুম্পু বলল, “তুমি বড্ড বাজে কথা বলো, জ্যাজা।”
এইখানে একটু বলে রাখা ভাল। টুম্পু আমার ছোট্ট ভাইঝি। ওর ভাল নাম ঐন্দ্রিলা সরকার। টুম্পু কথা বলা শেখার সময় জ্যাঠা শব্দটা উচ্চারণ করতে পারত না বলে আজও আমি জ্যাজা। আর ওর জ্যাঠাইমা— জেন্না।
টুম্পু ভীষণ হুড়ে মেয়ে। ফিঙে পাখির ল্যাজ যেমন কখনও স্থির থাকতে পারে না। নাচছে তো নাচছেই। তেমনি ছেলেবেলা থেকে টুম্পুর হাত-পা কখনও স্থির থাকে না। এই দুড় দুড় করে জানলার শিক বেয়ে উঠছে। আর পড়ে গেলেই, আমার ছোটমেয়ে— টুম্পুর ‘ছোদ্দিভাই’ সুর করে বলত—
“ঐন্দ্রিলা সরকার
গাছে ওঠা দরকার।”
টুম্পু কান্না ভুলে গিয়ে বলত, “জ্যাজা বলেছিল আমার জন্যে পেয়ারাগাছ করে দেবে। দিলই না, হুঁঃ।”
ওর ছোদ্দিভাই বলেছিল, “টবে তো করে দিয়েছিল। কিন্তু তোর জন্যে টবে পেয়ারাগাছ লাগালেই, হয় সেগুলোতে জবা ফুল ফুটবে, না হলে লঙ্কা ধরবে। তোর জ্যাজাটা কী করবে বল?”
টুম্পু একটু ভেবে বলল, “জ্যাজাটা বড় বাজে কথা বলে। না ছোদ্দিভাই?”
সন্ধে হয় হয়। এই সময়টা আমাকে টুম্পুর জন্যে ছেড়ে রাখতেই হয়। অভ্যেস হয়ে গেছে। ও রাস্তার খেলাধুলো সেরে আমার টেবিলের সামনে, কনুই ভর রেখে, দু’হাতের চেটোয় মুখখানা ভাসিয়ে দিয়ে বলবে, “জ্যাজা, গপ্পো।”
হুকুম যেন। আমিও প্রথমে আজে-বাজে তারপরে জমিয়ে জমিয়ে গল্প বলতাম। গল্প-টল্প শুনে টুম্পুর শেষ কথা ছিল “জ্যাজাটা বড় বাজে কথা বলে।”
বাজে কথার গল্পই বলতাম।
কিন্তু অনুভব করছিলাম টুম্পু বড় হচ্ছে।
“গপ্পো শুনতে আজ আসোনি কেন?”
টুম্পুর পা দুটো বড় হয়েছে। মাথায়ও একটু বেড়েছে তাই। দু’পায়ে একটু নেচে নিয়ে বলল, “তুমি বড় বাজে কথা বলো, জ্যাজা।”
বললাম, “আচ্ছা, কান মলছি। আর একটাও বাজে কথা বলব না। কীসের গপ্পো শুনবে? তাড়কা রাক্ষুসীর? খাণ্ডব বনের?”
“দুর দুর!” টুম্পু বলল, “ও সব গপ্পো তো রোজ জেন্নার কাছে শুনি। দিতেকতিভ গপ্পো বলতে পারো?”
ভাবলাম সেরেছে। বেতালের ছবির বই দেখতে শুরু করেছে মেয়ে। ভাবলাম করবে নাই বা কেন? যখন যেমন।
বললাম, “বোসো, বলছি।”
“অনেক দিনের কথা। তখন আমি বিহারে একটা খনি অঞ্চলে অ্যাকাউনটেনট হয়ে কাজ করতে গিয়েছিলাম।”
টুম্পু বলল, “আক্যাউনতেন কী, জ্যাজা?”
“এই হিসেব-টিসেব যে লেখে।”
“বারে।” টুম্পু বলল, “তুমি তো গপ্পো লেখো। হিসেব আবার কী?”
“ওই একই। গপ্পো শুনবে না বাজে কথা বলবে?”
টুম্পু ঠোঁট দুটো চেপে তার ওপর ছোট্ট বুড়ো আঙুলটা চেপে ইশারা করল যে আর একটা কথাও সে বলবে না। পরমুহুর্তেই চুপিচুপি বলল, “দিতেকতিভ গপ্পো কিন্তু।”
“শোনোই না।…ঘন জঙ্গুলে জায়গা। একটা থাবার বাড়ি অবশ্য আমাদের দিয়েছিল। বেশ ভাল পাকা বাড়ি। তিন খানা ঘর, রান্নাঘর, আর বাড়িটা ঘিরে চারদিকে টালির বারান্দা। তোমার জেন্না তখন নতুন বউ। কলকাতা থেকে এসেছে। পছন্দ হবে কেন? সব সময় বলত, কী বিচ্ছিরি, কী নোংরা! চারদিকে বিছে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
“কী বিছে, জ্যাজা?”
“আর বলো কেন? ইয়া ইয়া কাঁকড়া বিছে। জঙ্গুলে জায়গা তো। আমি তো প্রায় সারাদিন আপিসে থাকতাম। তবুও সন্ধে হয় হয় নাগাদ যখন ফিরে আসতাম, দেখতাম তোমার জেন্না টুলে বসে চুলে চিরুনি দিতে দিতে ভুলে গিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। আকাশে তখন সিনেমা লেগেছে—’।
“তেকনিকলর?” টুম্পু জিগেস করল।
“হ্যাঁ! ও রকম টেকনিকলার বোম্বাই কেন অ্যামেরিকাও পারবে না। আকাশে রং বদলাচ্ছে তো বদলাচ্ছেই। এই প্রখর নীল নীল। তার নীচে সবুজ বন ঝক ঝক করছে। হঠাৎ পশ্চিমে একটা গেরুয়া লাল আভা। নীচের বন জঙ্গলে পাতায় পাতায় একটু একটু লালচে আভা ঠিকরে যাচ্ছে। তারপর আকাশটা লিপস্টিক মেখে মিষ্টি মিষ্টি হেসে উঠল।”
টুম্পুও হাততালি দিয়ে হেসে উঠল।
“তারপর লালে লাল। আকাশ যেন কান্না কান্না চোখে রাঙা হয়ে উঠেছে। তার মাঝখান দিয়ে সবুজ এক ঝাঁক তিরের মতো টিয়া পাখির দল ঢেউ খেলিয়ে উড়ে গেল। দূর থেকে ভেসে আসছে ময়ূরের ক্যাঁ ক্যাঁয়া ডাক। তারপর বেগুনি, সবুজ আর কেমন যেন দুঃখু দুঃখু কালো।”
দেখলাম টুম্পুর মুখটাতে যেন একটা বিষাদের ছায়া।
“তোমার জেন্নাকে বললাম, চা করেছ? তোমার জেন্না বলল, যে নেহাল মালি আজ আসেনি৷”
টুম্পু জিগেস করল, “নেহাল মালি কে, জ্যাজা?”
“আমাদের বাড়িতে কাজ করত। ওদেশি লোক।
“তোমার জেন্নাকে বললাম, দুধ কে দুইল? জেন্না বলল, আমি দুয়েছি।”
টুম্পুর চোখটা গোলগোল হয়ে গেল, “জেন্না দুধ দুইতে পারে? বোতলে ক্যাপ লাগাবে কী করে?”
হেসে উঠে বললাম, “তোমার জেন্নাকে জিগেস কোরো। যাই হোক, হঠাৎ তোমার জেন্না হইহই করে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।”
“কী হল?”
“আমার নথটা হারিয়ে গেছে।”
“একটুখানি থ হয়েছিলাম। এটা সেই নথ যা আমার মা পরেছে, ঠাকুমা পরেছে, ঠাকুমার শাশুড়ি পরেছে। ওটা আমাদের পরিবারের বড়বউরা কত দিন থেকে পরে আসছে কে জানে? ভারী সোনার নথ, মুক্তো বসানো।”
টুম্পু জিগেস করল, “নথ কী, জ্যাজা?” তারপরেই হাততালি দিয়ে বলে উঠল “বুঝেছি। বুঝেছি। নথ বিচ্ছিরি।”
“নাকছাবি বুঝি ভাল?”
টুম্পু বলল, “তুমি বড্ড বাজে কথা বলো, জ্যাজা। দিতেকতিভ কোথায়?”
বললাম, “আসছে, আসবে। ওই নথটার মতো ওই রকম একটা আমার মা, মা-বাবার মা, তাঁদের মায়েদের পরা গয়না অমনি-অমনি হারিয়ে গেলেই হল নাকি? দামও খুব বেশি। কিন্তু দামের থেকেও বড় যে, নথটা আমাদের মায়েদের স্মৃতিচিহ্ন। পুলিশে খবর দিলাম। পুলিশ এসে তোমার জেন্নাকে জিগেস করল, ‘নথটা আপনার গয়নার বাক্স থেকে হারিয়েছে?’
জেন্না বলল, ‘না তো।’
‘তা হলে হারাল কী করে?’
‘বড্ড ময়লা হয়েছিল গয়নাটা। তাই তেঁতুল জলে ধুয়ে ধুয়ে সাবান জলে পরিষ্কার করে মাটিতে রোদে শুকোতে দিয়েছিলাম।’…বলতে বলতে তোমার জেন্না লাফিয়ে উঠল, ‘ও মা!’
পুলিশ ইনস্পেকটার দাঁড়িয়ে উঠল, ‘কী হল?’
জেন্না বলল, ‘ওই যে!’
মাটির ওপর দিয়ে কী বিচ্ছিরি একটা বড় কাঁকড়া হেঁটে যাচ্ছে। চব্বিশটা পা যেন হাজার পা মনে হচ্ছিল। আর দাড়া দুটো তার ডাইনে বাঁয়ে দুরন্ত, দুষ্টু, বিশ্রী, ভয়ংকরভাবে নড়ছে।”
টুম্পু, রুদ্ধশ্বাসে শুনছিল “তারপরে জ্যাজা?”
“বুট পরা পুলিশ ইনস্পেকটার সাহেব লাফিয়ে উঠে বুট দিয়ে মারলেন এক গোঁত্তা। তারপর আবার আবার। মনে হচ্ছিল কলির কেষ্ট যেন, ত্রিভঙ্গ হয়ে নাচছে।*
“সেই কাঁকড়া বিছেটা মরল?”
“দূর! সে তখন চব্বিশ পায়ে পালিয়েছে। যাই হোক, নাচানাচি থামার পর, ইনস্পেকটার সাহেব জিগেস করলেন—আচ্ছা! যখন নথটা রোদে দিলেন, তখন কে কে ছিল বাড়িতে?”
তোমার জেন্না বলল, ‘কে আবার থাকবে? আমি আর যতসব কাঁকড়া বিছে। উনি তো মজা করে আপিসে বসে আছেন!’ তোমার জেন্নার যত রাগ তখন আমার ওপর, যেন নথটা আমিই হারিয়ে ফেলেছি।
আমি থাকতে না পেরে বললাম, ‘ছিল ছিল। আকাশে টিয়ার ঝাঁক। মহুয়াগাছের মাথায় নীলকণ্ঠ পাখি। টেলিগ্রাফের তারে ল্যাজ নাড়া, সার সার ফিঙে পাখির দল আর আমাদের দেওয়ালের পেছনে দুটো ঘোঁতঘোঁতে সাদা শুয়োরের বাচ্চা।’
ইনস্পেকটার সাহেব হো হো করে হেসে বললেন, ‘না না! তা বলছি না। মানুষজন তখন কে কে ছিল? জানেন তো এ দেশের লোক বড় গরিব। সোনাদানার লোভ সামলানো বড় শক্ত৷’
তোমার জেন্না একটু ভেবে বলল, ‘তা সবাই দেখেছিল। ছিল নেহাল মালি আর আমাদের রামপিয়ারী ঝি। হ্যাঁ, সেই সময় মুনেশ্বর মুদিও চাল, ডাল, মশলা নিয়ে এসেছিল। সেই জন্যেই তো উঠে যেতে হয়েছিল।’
‘কাকে আপনার সন্দেহ হয়?’
আমি বলে উঠলাম, ‘সব ব্যাটাকেই!’
তোমার জেন্না ঝেঁঝে-মেঝে বলল, ‘অমন কথা বোলো না। মুখ খসে যাবে। ওদের মতো ভাল লোক হয় না।’
ইনস্পেকটার বললেন, “আচ্ছা আমি সব সেকরাদের ওপর নজর রাখছি। এখানে চোরাই মাল বিক্রি করলেই ধরা পড়ে যাবে।”
টুম্পু জিগেস করল, “জ্যাজা? ওই ইন্সপেকতরটা বুঝি দিতেকতিভ?”
বললাম, “না, ডিটেকটিভ আমার রসোগোল্লা-মামা।”
“তারপর জ্যাজা?”
বলতেই লাগলাম, “রাত গভীর হয়ে এল। সেই জঙ্গুলে দেশে সন্ধের পরই রাত গভীর। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে শেয়ালে খাওয়া সিকি রুটির মতো একসিকে চাঁদ আকাশে ঝুলে আছে। আকাশ তারায় তারায় ছয়লাপ। তার নীচে জঙ্গলে কী গম্ভীর জঙ্গুলে অন্ধকার। কখনও কখনও মনে হত হঠাৎ যেন জঙ্গলের পাতায় পাতায় তারারা খসে পড়েছে। তোমার জেন্না বলত—দ্যাখো! দ্যাখো! কী সুন্দর জোনাকি জ্বলছে। হঠাৎ জঙ্গলের অদৃশ্য অন্ধকারের ভেতর থেকে হুঁড়ারের অট্টহাসি হুঃ! হুঃ! ক্ষক—খঃ খঃ…গম্ভীরা পাখির সাবধানি ডাক শোনা যেত। বন যেন থম থম করছে।
“ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমের মধ্যেই কান দুটো হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল!…সিঁদ কাটছে? ক্ক-র-র, ক্রড়র শব্দ।
টুম্পু বলল, “জ্যাজা, ভাল হবে না। ভয় দেখিয়ো না বলছি।”
“তা হলে ডিটেকটিভ গল্প শুনবে কী করে?”
“তারপর জ্যাজা?”
“শব্দটা দেওয়ালের দিক থেকেই আসছিল। বালিশের পাশ থেকে টর্চটা তুলে নিয়ে শব্দটা টিপ করে আলো জ্বালতেই ঝকমকিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। দেখি কী—
একটা প্রকাণ্ড কাঁকড়া বিছে দাড়া নাড়তে নাড়তে পালাচ্ছে। সিগারেটের খালি প্যাকেটটা ছুড়ে দেওয়ালের ধারে ফেলেছিলাম। রামপিয়ারী তো সকালে ঘর ঝাঁট দেবেই। সেই খালি প্যাকেটের থেকে সিগারেট মোড়া রাংতা কাগজটা বেরিয়ে এসেছিল। তার ওপর টর্চের আলো পড়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল।
নাঃ, কিছু নয়। বাইরে উঁচু নিচু পাহাড়ি জঙ্গলে প্রহর রাতে বনকাঁপানো, মনকাঁপানো শেয়াল ডাক শুনতে পেলাম—হুয়া! হুয়া! হ্যা, হ্যায় হ্যায় হ্যায়!
‘রসোগোল্লা আছে হ্যায়?’ আমার রসোগোল্লা-মামা দোকানে দোকানি মুনেশ্বরকে প্রশ্ন করল।
আমার মামার ধারণা যে সে খুব ভাল হিন্দি বলতে পারে। বলত, ‘এই রসোগোল্লা, এত তোরা, বাজে বাজে কথা বলিস কেন বলত। হিন্দি ভাষাটা খুব সোজা। যা বলবার বলবি, শেষে একটা হ্যায় লাগিয়ে দিবি।”
টুম্পু বলল, “জ্যাজা! তুমি বড্ড বাজে কথা বলো। কী সব যে বলছ বুঝতে পারছি না।”
“ও হ্যাঁ তাই তো! তোমার রসোগোল্লা-দাদুকে মনে পড়ে?”
টুম্পু একটু ভেবে বলল, “ওঃ তুমি গোঁফদাদুর কথা বলছ?”
‘হ্যাঁ। তোমাকে কী বলে ডাকে?”
“বুঝেছি। বুঝেছি।” টুম্পু হেসে উঠল। “আমাকে ডাকে রসোগোল্লা-দিদি বলে, আর তোমাকে ডাকে রসোগোল্লা বলে। সেই, ছেই দাদুটাই তো? মুখে পাউদার পাফের মতো ঝ্যাঁটা ঝ্যাঁটা গোঁফ?”
“ঠিক বলেছ। যে সময়ের গপ্পো বলছি—তোমার ওই গোঁফদাদু ঠিক একই রকম গোঁফফিয়াল ছিল। বড্ড রসোগোল্লা খেতে ভালবাসত। তাই কিছু ভাল লাগলেই নাম দিয়ে দিত রসোগোল্লা।”
“গোঁফদাদু দিতেকতিভ?” টুম্পু অবিশ্বাসের সুরে জিগেস করল, “জ্যাজা তুমি বড় বাজে কথা বলো।”
বললাম, “বেশ তো! কিছু বিশ্বাস কোরো না। কিন্তু গপ্পো শেষ তা হলে।”
টুম্পুর মায়ের ডাক, “টুম্পু খাবে এসো।”
“আমি জ্যাজার কাছে গপ্পো শুনছি। একটু পরে যাব।”
বললাম, “শুনবে তা হলে? হ্যাঁ, আমার রসোগোল্লা-মামাকে আসতে বলেছিলাম। মানুষটি ভুঁড়িদার বেঁটেখাটো আর দেখবার মতো ঠোঁট চাপা ঝাঁপনো গোঁফ।
আমার রসোগোল্লা-মামাকে সব ঘটনা বলেছিলাম। শুনে রসোগোল্লা-মামা বলল, ‘হুঁ! বউমা কাউকেও সন্দেহ করে না। আবার তুমি সকলকেই সন্দেহ করো। ও রকম করলেও হবে না। কার কার চুরির সুবিধে ছিল? আগে ধরো রামপিয়ারী ঝি।’
তোমার জেন্না বলল, ‘রামপিয়ারীর নামে কিছু বললে আমার মুখ খসে যাবে, মামাবাবু।’
‘বাদ দাও! বাদ দাও’ রসোগোল্লা-মামা বলে উঠল, ‘তারপরে আসে নেহাল মালি—’
‘বাদ দিন! বাদ দিন।’ তোমার জেন্না বলে উঠল।
‘বলছ?’ রসোগোল্লা-মামা বলল, ‘তা হলে থাকে মুনেশ্বর মুদি। সে তো তখন ছিল?’
তোমার জেন্না ঘাড় নাড়ল।
‘তা হলে তাকে তুমি সন্দেহ করবে না কেন? সে লোকটার নথটা মাটি থেকে তুলে নেওয়ার সুবিধে ছিল। লোকটা ব্যবসাদার। চুপি চুপি বিক্রি করে দেওয়ার সুবিধেও আছে।’
তোমার জেন্না চুপ করে থেকে বলল, ‘মামাবাবু, এদেশের লোক বড় সৎ। ওরা, আমি দেখেছি কখনও চুরি করে না।’
আমি রাগ করে বলেছিলাম, ‘তা হলে তোমার মতে আমিই চুরি করেছি বলো।’
মামাবাবু ঊরু চাপড়ে বলে উঠল, ‘ঠিক ঠিক ওই রসোগোল্লা ব্যাটাই চোর।’ বলতে বলতে চেয়ার থেকে লাফিয়ে একদম খাটের ওপর, ‘ও বাব্বা, ওটা কী?’
দেখি একটা মস্ত কাঁকড়া বিছে সড় সড় করে পালাচ্ছে।
‘কী জঙ্গুলের দেশ রে বাবা!’ রসোগোল্লা-মামা বলে উঠল, ‘কাঁকড়া বিছে না?’ বলতে বলতে রসোগোল্লা-মামা চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই ব্যাটা রসোগোল্লা, হনুমান! নিয়ে আয়।’
অবাক হয়ে জিগেস করলাম, ‘কী আনব মামাবাবু?’
‘ইয়ার্কি হচ্ছে না? রসোগোল্লা আর কী! দেখতে পাচ্ছিস না? ওই-তো শালপাতার দোনা পড়ে আছে। ওতে চিনির কুচি চিকচিক করছে।’
তোমার জেন্না বলল, ‘এ মা! শালপাতার দোনাটা তো ফেলে দিয়েছিলুম।’
বললাম, ‘তোমার জন্যেই তো এনেছি মামাবাবু। কিন্তু এখানে রসোগোল্লা পাওয়া যায় না। পান্তুয়াও না। ছানার কোনও জিনিস এখানে পাওয়া যায় না।’
‘যায় না?’ রসোগোল্লা মামার চোখে যেন দুঃখু দুঃখু ভাব এসে গেল।
‘ক্ষীরের গোলাব-জামুন খেয়ে দ্যাখো না!’
রসোগোল্লা-মামা বলে উঠল, ‘হুঁ গোলাপ জাম! তাও আবার ক্ষীরের! সোনার পাথর বাটি! নিয়ে এসো তো বউমা এক দোনা।’
সেই রসোগাল্লা-মামা মুনেশ্বরের দোকানে।
‘রসোগোল্লা আছে হ্যায়?’
মুনেশ্বর বলল, ‘রসউল্লা? ইঁহা কঁহা?’
টুম্পুর ধমক খেলাম, “জ্যাজা! আবার বাজে কথা!”
“থুড়ি ভুল হয়ে গেছে। মুনেশ্বর বলেছিল— রসোগোল্লা এখানে কোথায় পাবেন? বঙ্গালিবাবুরা দুধ কাটে, মাছি খায়! দুধ কাটলে আমাদের পাপ হয়।”
টুম্পু রেগেমেগে বলল, “কখনও আমরা মাছি খাই না, আর দুধ আবার কাটা যায় নাকি?”
“শোনো না। হঠাৎ দেখলাম রসোগোল্লা-মামা যেন সোজা হয়ে আরও জোয়ান হয়ে গেল। বেশ একটু কড়া গলায় যেন জিগেস করল, ‘তোমার এখানে সোনার নথ পাওয়া যায় হ্যায়?’ সোনা আর নথ কথা দুটো মুনেশ্বর বুঝেছিল। কেমন যেন চোরের মতো করুণ সুরে বলল, ‘নহী নহী!’
রসোগোল্লা-মামা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে বলল, ‘তবে তো তোমার এখানে কিছু পাওয়া যায় না হ্যায়। আসল দুটো জিনিসই পাওয়া যায় না হ্যায়।’
ফিরে যেতে যেতে বলেছিলাম, ‘দেখলে মামাবাবু, কেমন চোরের মতো মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দিল?’
‘হুঁ! ইনস্পেকটারকে একটু নজর রাখতে বলিস।’
দু’দিন পরে।
দুপুরে আপিস থেকে খাওয়ার ছুটিতে এসে তোমার জেন্নাকে জিগেস করলাম, ‘রসোগোল্লা-মামা কোথায় গেল?’
তোমার জেন্না বলল, ‘দ্যাঁখো তো ঘুঁটের ঘরে। মাথায় পোকা ঢুকেছে। পোকার পরীক্ষা হচ্ছে।’
আমাদের বাগানে একটা ঘুঁটের ঘর ছিল। গিয়ে দেখি রসোগোল্লা-মামা একটা উঁচু টুলে বসে চকচকে সিকি একটা একটা করে বাতাসার মতো ফেলছে।
‘কী করছ মামাবাবু?’
রসোগোল্লা-মামা বলল, ‘চুপ চুপ! আয় এই টুলটায় বোস।’
বেলা দুপুর। ঘুঁটে ঘরের মেঝেময় চকচকে সিকি ছড়ানো। বাইরে ঝিমঝিম। একটা কুককুকে পাখি ডেকেই চলেছে—কুক কুক কুক!
হঠাৎ কুককুকে পাখির ডাকটা থেমে গেল। একটা চিলের চিৎকার। তারপর গম্ভীরা পাখির সাবধানি সংকেত। হুঁড়ারের ডাক ভেসে আসছে। হুড় হুড় পালানোর শব্দ। বাঘ বেরিয়েছে জঙ্গলে?
‘কী রে, দিন দুপুরে প্যাঁচার মতো গোমড়া হয়ে বসে আছিস কেন?’ রসোগোল্লা-মামা বলল।
‘বা রে! তুমিই তো কথা বলতে মানা করলে।’
কে যেন হুড় হুড় করে ছুটে গেল। পায়ের আওয়াজটা ঠিক নেহাল মালির মতো।
হঠাৎ দেখি ঘুঁটে ঘরের মেঝেয় সেই ধেড়ে কাঁকড়া বিছেটা দাড়া উঁচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রসোগোল্লা-মামা বলল, ‘চুপ করে বসে দেখ।’
আর বসে বসে অবাক হয়ে দেখলাম, বিছেটা একটা চকচকে সিকি দুই দাড়ায় তুলে খুর খুর করে নিয়ে ঘুঁটের গাদায় মিলিয়ে গেল।
চুপ করে বসে আছি। একবার রোদ মিলিয়ে গেল। আবার উঠল রোদ। চকচকে সিকিগুলো ঝকমকিয়ে উঠল। আবার এল বিছেটা। আবার একটা সিকি দাড়ায় করে নিয়ে খুর খুর করে মিলিয়ে যেতে লাগল।
লাফিয়ে নামল রসোগোল্লা-মামা।
এক লাথিতে ঘুঁটের একটা স্তূপ সরে গেল। তলায় বেশ একটা বড় গর্ত। দুটো দাড়া তখনও আঁকু পাঁকু করছে।
সেই গর্তটা থেকে কী না বেরোল। সিগারেটের রাংতা, টিনের কুচি, চকচকে সিকি। সবই চকচকে। আর সেখানেই ছিল তোমার জেন্নার নথ।”
“জ্যাজা, তা হলে কে চুরি করেছিল?”
“ওই কাঁকড়া বিছেটা আর কে?”
টুম্পু অবিশ্বাস্য গলায় বলল, “যা!”
বললাম, “রসোগোল্লা-মামাবাবু বলেছিল যে অনেক কীটপতঙ্গকে চকচকে জিনিস ভয়ানক টানে। কীটপতঙ্গ, পোকাদের মধ্যে চোর থাকতে পারে। কাঁকড়া বিছেদের মধ্যেও।”
টুম্পু জিগেস করল, “জ্যাজা, নেহাল মালি দৌড়োচ্ছিল কেন?”
“বাঘের ডাক শোনা গিয়েছিল কিনা তাই গোরু সামলাতে যাচ্ছিল।”
টুম্পু চলে যাচ্ছিল।
“টুম্পু”, ডাকলাম, “বলে গেলে না তো—জ্যাজাটা বড় বাজে কথা বলে?”
“বলেই তো।”
টুম্পু চলে গেল।
১৩৭৯
অলংকরণ পূর্ণেন্দু পত্রী
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন