দেয়ালা – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পৌলোমী সেনগুপ্ত

এক যে ছিল গাছ তার ছিল এক ছাওয়া; এক যে ছিল মাঠ তার ছিল এক গাছ; আর এক ছিল যে কুঁড়ে তার ছিল একটা ঝাঁপ— সেটা কখনও খুলত কখনও বন্ধ হত। ঝাঁপ যখন বন্ধ হত তখন ঘরটা কিছুই দেখত না, অন্ধকারে পিদুম জ্বালিয়ে কুঁড়ে নিজের ভিতরটার দিকে চুপ করে বসে থাকত— পিদুমের আলো ঝিমোত, ঘরের জিনিসপত্র ঝিমোত, ঘরের মধ্যে যে কুঁড়ে মানুষগুলো তারাও ঝিমোত, কিন্তু ঝাঁপ খুললে আর রক্ষে নেই—পিদুমের আলো পিলসুজ ছেড়ে দৌড় দিত— সেই সে মাঠে যেখানে গাছে আর গাছের ছাওয়াতে কথা চলাচলি করছে।

ছাওয়া শুধোচ্ছে গাছকে— “ভাই কী দেখছিস?”

ছোট গাছ সে এ-দিক ও-দিকে চায়, চোখের পাত মেলে আর বলে— “মাঠ দেখছি!”

“মাঠের পরে কী ভাই?”

“মাঠের পরে একটা তালগাছ দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে।”

“তার পর?”

গাছটা হঠাৎ চুপ করে আর থির হয়ে চেয়ে থাকে। গাছের ছাওয়া সে-ও চুপ চুপ গল্প শোনবার জন্যে সটান শুয়ে থাকে মাটিতে।

ধু ধু-মাঠের ধুলোমাটি, খোয়াই-জোড়া রাঙা মাটি, বাঁধের ধারের পোড়া মাটি— তারা তো চেনে না ছোট গাছ আর তার এতটুকু ছাওয়াকে, তারা চলে যায় সেই যে তালগাছ আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে তার কাছে, আর বলে— “দেখলে কিছু?”

তালগাছ দাঁড়িয়েই থাকে— হেলে না, দোলে না, বলে না কিছু। তেপান্তর মাঠ স্তব্ধ হয়ে ভাবে—এত উঁচু থেকেও দেখা যায় না? অবাক হয়ে মাঠ চেয়ে থাকে—খুব উঁচুতে যে নীল আকাশ তারই পানে, আর মনে মনে বলে— আকাশকে কেমন করি শুধোই ওখান থেকে ও কী দেখতে পাচ্ছে? মাটি শুধোতে পারে না আকাশকে, সে কী দেখছে! আকাশ বলতে পারে না মাটিকে সে যা দেখছে! এইভাবে এ ওর দিকে চেয়েই আছে, দুপুরবেলা সবাই সবার দিকে দেখছে, কিন্তু কেউ কিছু বলে না, কয় না!

চুপচাপ থেকে থেকে গাছের চোখের পাতা ঝিমিয়ে এল, গাছের সাথি ছাওয়া মাটিতে নেতিয়ে পড়ে, ঘুমের ঘোরে দেয়ালা করে বলে উঠল— “মাঠের পরে তালগাছ পাহারা দিচ্ছে, তার পর?”

ছোট গাছ হঠাৎ চটকা ভেঙে জেগে উঠে বললে— “তালগাছটার মাথার উপরে একটা পাখি উড়ছে, যেন ঘুরে ঘুরে কী খুঁজে চলেছে!”

গাছের ছাওয়া ছোট্ট একটা নুড়ির উপরে দাঁড়িয়ে বললে— “আমি দেখব।”

বাতাস এতক্ষণ চুপ করে ছিল, বলে উঠল— “ইস্‌স্‌!” ছোট গাছ হেসে লুটোপুটি খেতে লাগল।

মাঠের শেষে পাহারা দিচ্ছিল যে উঁচু গাছ সে এইবার মাথা নেড়ে বললে— “দেখবেই তো, দেখবেই তো!” লজ্জায় ছোট গাছের ছাওয়া মাথা হেঁট করে মাটিতে মিলিয়ে গেল।

সন্ধ্যার আকাশের কোলে দেয়ালা দিচ্ছিল একখানি মেঘ, একবার সে রঙিন আলোয় রাঙা হয়ে উঠেই আবার ঘুমিয়ে পড়ল—নীল আকাশের আঁচলের আড়ালে। এমন সময় গাছ বলে উঠল— “ছাওয়া!” সাড়া নেই! গাছ ফিরে-ফিরে দেখে— ছাওয়া পালিয়েছে। গাছ মাটিকে বললে— “ছাওয়া গেল কোথা?”

মাঠ বললে— “এই তো ছিল, গেল কোথায়?”

তালগাছ বললে— “ছাওয়ার মতো কে যেন ওই পুবমুখে রোদে পুড়তে পুড়তে চলে গেল আমি দেখেছি।”

আকাশ বললে— “শুধাই তো রোদকে ছাওয়া যায় কোনখানে?”

সেই তালগাছের ওপারে যে তেপান্তর মাঠ, তার ওপারে যে নদী, তারও ওপারে যাকে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে, তার কোণে যে রোদ সে দেয়ালা দিয়ে হেসে বললে— “বলব না।”

তার পরেই আলোর চোখ ঢুলে পড়ল। সবাই, এমনকী গাছের পাতা, ফুল, পাখি ঘাটে মাঠে হাটে যে-যেখানে ছিল বলে উঠল—“কোথায় গেল সে? কোন দেশে?” গাছ আর মাঠ আর আকাশ আর বাতাসের মন ছোট ছাওয়াকে খুঁজে যখন কোথাও পেলে না, তখন তারা মুখ আঁধার করে ভাবতে লাগল—‘গেল কোথায়, এই ছিল?’ তারপর সবাই ঘুমিয়ে গেল ঘরে-বাইরে; শুধু তারাগুলো থেকে থেকে দেয়ালা করে চায় আর ভাবে গেল কোথায়?

গাছ ঘুমোয়, গাছের পাতা ঘুমোয়, মাঠ-ঘাট ঘুমোয়, মেঝেয় পড়ে কুঁড়ে মানুষ ঘুমোয়— সবাই স্বপন দেখে ছাওয়া তাদের বড় হয়েছে। সেই যে একটুখানি ছায়া— যে মাঠের শেষ দেখতে চাইত, পাখিদের সঙ্গে পাখি হয়ে উড়ে পালাতে চাইত আকাশের শেষে— সে-এখন সেইসব তেপান্তর মাঠের চেয়ে, সেই নীল আকাশের চেয়ে বড় হয়ে গেছে! ভয়ে গাছপালা মাঠঘাটের গা ঝিমঝিম করতে থাকে আর একবার চমকে উঠে তারা স্বপন দেখে, দেয়ালা করে, হাসে, কাঁদে, চায় আর ঘুমোয়। অন্ধকারের মধ্যে নিঃশব্দে সাঁতরে চলে একটার পর একটা বাদুর, ছাওয়াকে খুঁজতে-খুঁজতে দূর-দূর দেশে। সেই সময় চুপি-চুপি আলো আসে— একটুখানি চাঁদের আলো—বাতাসের গায়ে আলো পড়ে, গাছের শিয়রে আলো পড়ে, ঘুমের ঘোরে সবাই বলে— “ছাওয়া?” ঘুম-ভাঙানো পাখি ডেকে বলে— “ওই যে আলো, ওই যে ছাওয়া!” চমকে উঠে গাছ দেখে ছাওয়া!

ছাওয়া বলে— “তার পর?”

গাছ বলে—“ধু ধু করছে মাঠ, তার মাঝে একটি গাছ পাহারা দিচ্ছে— চুপ করে দাঁড়িয়ে।”

ছাওয়া বলে—“দ্যাখো-না ভাই ভাল করে তার পরে কী?”

গাছ বলে— “সেই একটি গাছ তার পরে রয়েছে আলো, না, আলো তো নয়, একটা আলো-মাখা মেঘ!”

ছায়া বলে— “সে আবার কী?”

গাছ বলে—“তা জানিনে ভাই, কিন্তু কালো ঠিক তোর মতো ঠান্ডা রং তার।” হঠাৎ ছাওয়ার উপর দু’-ফোঁটা জল পড়ে—।

ছাওয়া বলে— “ও কী কাঁদছিস কেন?”

গাছ মাথা দুলিয়ে বলে—“কাঁদব কেন?”

ছাওয়া বলে— “এই দ্যাখো-না জল।”

কুঁড়ে তার ঘরের ঝাঁপখানা ঝুপ করে বন্ধ করে দিয়ে বলে—“বিষ্টি রে বিষ্টি।”

টিপির টিপির জল ঝরে, আকাশ ঝিলিক দিয়ে থেকে থেকে দেয়ালা করে, বাতাস করে সারারাত এপাশ-ওপাশ। তারপর রাত কাটে, সকাল হয়, আকাশ জেগে ওঠে, আলো জেগে ওঠে, গাছপালা জেগে ওঠে, পাখি জেগে ওঠে, সেইসঙ্গে তাদের ছাওয়ারাও জেগে ওঠে৷

ছোট গাছের ছাওয়া বলে গাছকে—“আজ কী খবর?”

গাছ বলে— “আজ দেখছি কী জিনিস?”

ছাওয়া বলে— “কী?”

গাছ বলে— “সেই আমাদের পাতায় ঢাকা কুঁড়ি আজ ফুটেছে।”

ছাওয়া বলে— “তার পর?”

গাছ বলে— “প্রজাপতি তাকে দেখতে এল সোনার ডানা মেলে।”

ছাওয়া বলে— “তারপর—?”

গাছ বলে— “রোদ পড়ল তার গায়ে, বাতাস তাকে দুলিয়ে গেল।”

ছাওয়া বলে— “ওকে আমায় দে।”

গাছ বলে— “এই নে দেখ, কেমন সুন্দর ফুল।”

ফুলকে বুকে নিয়ে ছাওয়া বলে— “ফুল!” ফুল কথা কয় না।

ছাওয়া গাছকে বলে— “ফুল কথা কয় না যে?”

গাছ বলে— “ঘুমিয়ে আছে, জাগাসনি।” ফুল ঘুমিয়ে থাকে ছাওয়ার বুকে, ছাওয়া নড়ে-চড়ে ফুলকে দেখে। গাছ নড়ে-চড়ে শুধোয়— “কী করছে?”

ছাওয়া বলে— “ঘুমোচ্ছে।” এক-এক সময় বাতাস এসে ফুলকে ছুঁয়ে যায়, ছাওয়া বলে— “দেয়ালা করছে আমাদের ফুল।” কুঁড়ের ঝাঁপ খুলে দেখে মানুষ গাছের তলায় ঝরা ফুল, তার গায়ে ছাওয়া হাত বোলাচ্ছে। কুঁড়ে মানুষের ছেলেটা বেরিয়ে আসে, ফুল তোলে, বেড়ায় গাছে-গাছে।

গাছ বলে— “কী করবি ফুল নিয়ে?”

ছেলে বলে— “খেলা করব।” ফুল তুলে ছেলে চলে যায়। মেয়ে আসে, সে এতটুকু—গাছে হাত পায় না, ছাওয়ায়-ছাওয়ায় ফুল কুড়িয়ে বেড়ায়।

ছাওয়া বলে— “কী করবি ফুল নিয়ে?”

মেয়ে বলে— “ওকে মালায় গেঁথে ধরে রাখব।”

ছাওয়া বলে— “তার পর খেলা হলে ফিরিয়ে দিবি তো?”

মেয়ে ‘দোব না’ বলে ফুল আঁচলে তুলে নেয়।

ছাওয়া তার পা জড়িয়ে-বলে— “নিয়ে যেয়ো না।”

গাছ বলে— “যাক না নিয়ে, কাল সকালে দেখবি তোর ফুল পালিয়ে এসেছে তোর বুকে।” দিন কাটে, রাত কাটে, ফুলের স্বপন দেখে গাছ আর গাছের ছাওয়া দু’জনে মিলে; সকালে কুঁড়ি ফোটে গাছে ফুল ফেরে ছাওয়ার কোলে।

১৪০৫

সকল অধ্যায়

১. প্রোফেসর হিজিবিজ্‌বিজ্ – সত্যজিৎ রায়
২. বাহাদুর – আশাপূর্ণা দেবী
৩. কুমির – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
৪. ননীদা – মতি নন্দী
৫. হর্ষবর্ধনের ভাগনে ভাগ্য – শিবরাম চক্রবর্তী
৬. কর্ভাস – সত্যজিৎ রায়
৭. বেণী লস্করের মুণ্ডু – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৮. টুম্পুর গল্প – সুকুমার দে সরকার
৯. বারীন ভৌমিকের ব্যারাম – সত্যজিৎ রায়
১০. বীর হওয়ার বিড়ম্বনা – শিবরাম চক্রবর্তী
১১. নন্দগুপি – লীলা মজুমদার
১২. পালোয়ান ভূত – মনোজ বসু
১৩. হিসাব – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৪. গান – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৫. জ্যান্ত খেলনা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৬. মুড়ি – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
১৭. কর্নেল মিত্র – বিমল মিত্র
১৮. গুল-ই ঘনাদা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৯. ভয়ঙ্কর মুখোশ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
২০. দিনে ডাকাতি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
২১. গন্ধটা খুব সন্দেহজনক – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২২. মেজকর্তার খেরোখাতা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২৩. গোয়েন্দা বরদাচরণ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৪. সাধু কালাচাঁদের ফলাও কারবার – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
২৫. একটি ভুতুড়ে ঘড়ি – বিমল কর
২৬. বুনো হাতির বন্ধুত্ব – সমরেশ বসু
২৭. গোয়ায় গোগোলের প্রথম কীর্তি – সমরেশ বসু
২৮. ইঁদারায় গণ্ডগোল – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৯. চোর সাধু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৩০. টোরি জঙ্গলের ভক্ত-বাঘ – সুবোধ ঘোষ
৩১. জোনাকি-ভূতের বাড়ি – সমরেশ বসু
৩২. বনবিড়াল – বিমল কর
৩৩. ভয় ও ভূত – সুকুমার সেন
৩৪. সুপারমেন – সমরেশ মজুমদার
৩৫. রাত যখন বারোটা – অশোক বসু
৩৬. প্রেতাত্মার উপত্যকা – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৭. আলুর চপ – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
৩৮. হাবুলমামার ভূতের ব্যবসা এবং… – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৯. অশোকের কাণ্ড – হর্ষ দত্ত
৪০. হারাধন – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪১. হয়তো এইরকমই – আশাপূর্ণা দেবী
৪২. মহারাজা তারিণীখুড়ো – সত্যজিৎ রায়
৪৩. খুড়ো-ভাইপো – বাণী বসু
৪৪. সহযাত্রী – সত্যজিৎ রায়
৪৫. দারিৎসু – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৪৬. চার বুড়োর আড্ডা – আশাপূর্ণা দেবী
৪৭. রামপলের অন্তর্ধান রহস্য – রূপক সাহা
৪৮. দেয়ালা – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪৯. শুভ জন্মদিন – জয় গোস্বামী
৫০. ইন্দ্রনাথ সামন্তের বাড়ি – সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন