বদরুদ্দীন উমর
সমাজতন্ত্রের ভেকধারী বাঙলাদেশ সরকারের আমলে বাঙলাদেশের বিভিন্ন শিল্প এলাকায়, বিশেষতঃ খুলনা ও চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে শ্রমিক হত্যা শুরু হয়েছে। এই ব্যাপক শ্ৰমিক হত্যা যে অরাজনৈতিক নয়, সেটা খুব সহজেই বোঝা যায়।
কিছুদিন পূর্বে খুলনায় একদল শ্রমিককে আর এক দলের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে শ্রমিক শ্রেণী এবং এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শত্রুরা অসংখ্য শ্রমিককে খুন করেছে, তাদের গৃহ লুণ্ঠন ও দাহ করেছে, তাদের পরিবার-পরিজনদেরকেও তারা কোনদিক থেকেই রেহাই দেয়নি। শ্রমিকদের এক বিরাট অংশকে এইভাবে শাসক-শোষক শ্রেণীর সুপরিকল্পিত ও সশস্ত্র হামলার দ্বারা নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। এই কাজ ‘সুসম্পন্ন’ করার উদ্দেশ্যে চাতুর্যের সাথে শ্রমিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা হয়েছে।
১৯৭৩ সালের গোড়াতেই, জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে ভিয়েতনামকে উপলক্ষ করে পরিচালিত বিক্ষোভ মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণকে কেন্দ্র করে যখন ঢাকা এবং দেশের সর্বত্র তোলপাড় হচ্ছে সেই সুযোগে শ্রমিক শ্রেণীর শত্রুদের দ্বারা পরিচালিত একটি শ্রমিক সংগঠনের আক্রমণে কালুরঘাটে অসংখ্য শ্রমিক হতাহত হন। সেখানে শ্রমিক ইউনিয়নকে ভেঙ্গে দিয়ে নিজেদের তাঁবেদার ইউনিয়ন গঠনের জন্য তারা এ কাজ করে।
বিগত ৪ঠা ফেব্রুয়ারী বাড়বকুণ্ডে অবস্থিত আরআর টেক্সটাইল মিলের শ্রমিকদের ওপর ব্যাপক হামলার খবর এখন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। সরকারী হিসেব মতে সেখানে নিহতের সংখ্যা ইতিমধ্যে দাঁড়িয়েছে ২২ জনে। বেসরকারী শ্রমিক ও অন্যান্য সূত্রের খবরে বলা হচ্ছে যে, সেখানে নিহতের সংখ্যা শতাধিক। সব মিলিয়ে সেখানে হতাহতের সংখ্যা বিরাট।
শ্রমিকদের ওপর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত বিরাট এক বাহিনীর এই সংগঠিত আক্রমণ যে অপরিকল্পিত ও রাজনীতির সাথে সম্পর্কহীন গুণ্ডাশ্রেণী ও দুষ্কৃতিকারীদের কর্মকাণ্ড এটা মনে করার কোন কারণ নেই। যা কিছু তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে তা থেকে এটা খুব স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এই আক্রমণ সুপরিকল্পিত এবং শোষকশ্রেণীর রাজনীতির সাথে গভীর ও নিবিড় যোগসূত্রে আবদ্ধ। এই ফ্যাসিবাদী হামলা যে সেখানকার শ্রমিকদের মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে বর্তমান ইউনিয়নকে ভেঙ্গে দিয়ে শোষকশ্রেণীর একটি তাঁবেদার শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা সে বিষয়েও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
শ্রমিকদের ওপর এই উত্তরোত্তর নৃশংস আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা দরকার। দেখা যাচ্ছে যে, বাঙলাদেশে ছাত্রদের উপর আক্রমণ হলে ছাত্রসমাজ যত সংগঠিতভাবে তার প্রতিবাদে এগিয়ে আসেন, তার বিরুদ্ধে যেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং জনগণ যেভাবে সেই প্রতিরোধ ও প্রতিবাদে শরীক হন শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ঠিক সেরকমটি হয় না। শ্রমিকদের ওপর কোন এলাকায় আক্রমণ হলে (এবং এই আক্রমণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছাত্রদের ওপর আক্রমণের থেকে অনেক বেশী ব্যাপক, নৃশংস এবং ধ্বংসাত্মক) তার বিরুদ্ধে বাঙলাদেশের শ্রমিকরা সর্বত্র উচিতভাবে সংগঠিত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসেন না। জনগণও শ্রমিকদের ওপর এই আক্রমণকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ওপর একটা হামলা হিসেবে দেখেন না। তাদের সহানুভূতি ও সক্রিয় সমর্থনের এ ক্ষেত্রে যে-রকম অভাব দেখা যায় ছাত্রদের ওপর আক্রমণের ক্ষেত্রে ঠিক সে-রকম অভাব দেখা যায় না।
ছাত্র ও শ্রমিক হত্যার প্রতিরোধ ও জনগণের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে তারতম্যের কতকগুলো নির্দিষ্ট কারণ আছে এবং সে কারণগুলোকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার। প্রথমতঃ, এই তারতম্যের কারণ হলো ছাত্রেরা বাঙলাদেশে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে এখনো পর্যন্ত শ্রমিকদের থেকে অনেক বেশী সুসংগঠিত। প্রত্যেক শ্রমিক এলাকাতেই শ্রমিক ইউনিয়ন আছে, অনেক ক্ষেত্রে একাধিক শ্রমিক ইউনিয়ন আছে। কিন্তু এই ইউনিয়নগুলো আর্থিক সংগ্রামের মধ্যে এমন গভীরভাবে নিমজ্জিত যে, রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত সেখানে হয় অনুপস্থিত অথবা সন্তোষজনকভাবে উপস্থিত নয়। এইভাবে শুধুমাত্র আর্থিক দাবী-দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে তাঁদের ইউনিয়নগত ক্রিয়াকর্ম কেবলমাত্র নিজেদের শিল্প এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকে, তার বাইরে যে শ্রমিকজগৎ, তার সাথে তাঁদের কোন সঠিক সম্পর্ক থাকে না। অনেকক্ষেত্রে প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠনগুলো কর্তৃত্বাধীনে থাকা সত্ত্বেও ইউনিয়নগুলো এই মৌলিক ত্রুটি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয় না। এর ফলেই এক এলাকার ঘটনা অন্য এলাকায় উপযুক্ত প্রতিধ্বনি অথবা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। এক শ্রমিক এলাকার শ্রমিকদের উপর হামলা হলে অন্য এলাকার শ্রমিকরা ব্যাপকভাবে তার প্রতিবাদে এগিয়ে আসেন না, তার বিরুদ্ধে দেশময় প্রতিরোধ গঠন করতে সক্ষম হন না। এই অক্ষমতার জন্যে শ্রমিকরা নিজেদের উপর এই আক্রমণকে বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে, তাকে একটা রাজনৈতিক আক্রমণ হিসেবে উপলব্ধি করতে অক্ষম হন। রাজনৈতিক আক্রমণ হিসেবে এই আক্রমণকে সঠিকভাবে দেখতে সক্ষম না হওয়ার ফলেই তাঁদের বিরুদ্ধে অন্যান্যরা তো বটেই, এমন কি শ্রমিকরা নিজেরাও দেশব্যাপী প্রতিরোধে দৃঢ় এবং সংগঠিত হতে পারেন না। তাঁদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শাসক-শোষক শ্রেণী তাঁদের ওপর একের পর এক এলাকায় নোতুন নোতুন আক্রমণ চালনা করে।
শ্রমিকের ওপর আক্রমণের ক্ষেত্রে জনগণের প্রতিক্রিয়া অনেকখানি ভিন্ন হওয়ার দ্বিতীয় কারণ, ছাত্রসমাজের সাথে মধ্যবিত্ত জনগণের শ্রেণীগত ঐক্য। ছাত্রসমাজের এক বিরাট অংশের সাথে কৃষকসমাজের ঘনিষ্ঠ যোগ থাকলেও, তাঁদের পরিবার কৃষকসমাজের অন্তর্ভুক্ত হলেও, ছাত্র হিসেবে তাঁদের অবস্থান মধ্যশ্রেণীতে। এজন্যে ছাত্রসমাজকে সাধারণভাবে মধ্যশ্রেণীরই একটা অংশ বলে ধরা চলে। মধ্যশ্রেণীভুক্ত জনগণ একারণেই ছাত্রদের ওপর আক্রমণের ক্ষেত্রে যে স্পর্শকাতরতা ও সহানুভূতিপরায়ণতা দেখান, সেটা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে তাঁরা স্বভাবতঃই দেখাতে পারেন না। এ জন্যেই দেখা যায় যে, শুধু বিরোধীদলীয় পত্র – পত্রিকাতেই নয়, সরকারী কর্তৃত্বাধীন পত্র-পত্রিকাগুলোও ছাত্রদের ওপর আক্রমণের বিরুদ্ধে যেভাবে সোচ্চার হয়, যেভাবে তার সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলীকে প্রচার করে, শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সেটা করে না। এইসব পত্র-পত্রিকার মালিকেরা, সেগুলোর কর্মরত সাংবাদিকরা মধ্যশ্রেণীভুক্ত হওয়ার ফলেই এই তারতম্য ঘটে থাকে।
এই পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহ, শোষকশ্রেণী এবং সরকারের পক্ষে শ্রমিকদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করা, তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানো যতটা সহজ হয়, অন্যক্ষেত্রে তত সহজ হয় না। একাজ তারা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে অনেকখানি নির্বিঘ্নেই করতে পারে এবং বাঙলাদেশে তাঁরা করছেও ঠিক তাই।
শ্রমিকশ্রেণী যে-কোন দেশে শ্রেণীগতভাবে সব থেকে প্রগতিশীল, সব থেকে বিপ্লবী শ্রেণী। তাই যে দেশে শ্রমিকশ্রেণীর রাজনীতির এই অবস্থা, যে দেশে শ্রমিকশ্রেণীর’ ওপর শুধু শ্রমিকদেরই নয়, সমগ্র জনগণের শ্রেণীশত্রুরা অবধি আক্রমণ চালাতে সক্ষম হয়, সেখানে গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন যে কোন্ পর্যায়ে অবস্থান করে, তা সহজেই অনুমান করা চলে।
শ্রমিক হত্যা ব্যাপকভাবে হলেও জনগণের মধ্যে তার কোন সন্তোষজনক প্রতিক্রিয়া না হওয়ার কারণগুলো বাঙলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শাসক-শোষকশ্রেণী এই তাৎপর্যকে অনেকখানি সঠিকভাবে উপলব্ধি করলেও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের মধ্যে, বিশেষতঃ শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে এই উপলব্ধি যে সঠিকভাবে বর্তমান নেই, সেকথা বলাই বাহুল্য।
বাঙলাদেশে আজ প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই সমাজতন্ত্রের আওয়াজ তুলেছে। এই দেশজোড়া আওয়াজের সাথে শ্রমিকশ্রেণীর রাজনীতির এই অবস্থা, শ্রমিকশ্রেণীর শ্রেণীগত স্বার্থের প্রশ্নে, এমনকি তাদের দৈহিক নিরাপত্তার প্রশ্নেও ব্যাপক জনগণের অপরিসীম ঔদাসীন্য যে ভয়ানক বিসদৃশ এবং সামঞ্জস্যহীন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই বৈসাদৃশ্য এবং সামঞ্জস্যহীনতা প্রমাণ করে যে, সমাজতন্ত্রের এই আওয়াজ সত্ত্বেও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ এবং সমাজতন্ত্রের শক্তিসমূহের রাজনৈতিক সংগঠন এখানে কতখানি দুর্বল, কতখানি তাৎপর্যহীন। শুধু সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি নয়, সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সত্যিকার বুনিয়াদও বাঙলাদেশে আজ কতখানি দুর্বল তার হিসেব শ্রমিকশ্রেণীর ওপর একের পর এক সংগঠিত আক্রমণ, তার বিরুদ্ধে সঠিক প্রতিরোধ গঠনে শ্রমিকশ্রেণী, ছাত্রসমাজ ও ব্যাপক জনগণের অক্ষমতা এবং ঔদাসীন্য থেকেই পাওয়া যায়। এ জন্যেই আজ প্রয়োজন শুধু ছাত্রদের এবং মধ্যমশ্রেণীর অন্যান্য অংশের ওপর আক্রমণকেই নয়, শ্রমিকদের ওপর এই আক্রমণকেও তার যথার্থ রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বোঝার চেষ্টা করা, ব্যাপক জনগণের মধ্যে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করা এবং সর্বোপরি শ্রমিকশ্রেণীকে অর্থনৈতিক আন্দোলনের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকতে না দিয়ে তাদেরকে তাদের যথার্থ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করার ক্ষেত্রে সর্বতোভাবে সহায়তা করা। এই রাজনৈতিক দায়িত্বপালনে অক্ষম হলে বাঙলাদেশে সে সত্যিকার কোন গণতান্ত্রিক, বৈপ্লবিক ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন গঠন ও তাকে জয়যুক্ত করা সম্ভব হবে না সে কথা বলাই বাহুল্য।
দৈনিক গণকণ্ঠ
৯ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন