বদরুদ্দীন উমর
মুসলিম লীগের দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে যে রাজনীতি উপমহাদেশে সংগঠিত হয়েছিলো তার পরিণতিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়েছিলো ভারত ও পাকিস্তান এই দুই রাষ্ট্রে। পাকিস্তানের পূর্বাংশ পূর্ব বাঙলায় ১৯৪৭ সালের পর থেকেই দ্বিজাতি তত্ত্বকে অস্বীকার করে, তার বিরোধিতার ভিত্তিতে যে রাজনীতি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সংগঠিত হয়েছিলো তারই পরিণতিতে পূর্ব বাঙলা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাঙলাদেশ নামে এক নোতুন এবং স্বতন্ত্র রাষ্ট্র।
এই নোতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা বলছেন যে, বাঙলাদেশীরা একটি জাতি এবং সেই হিসেবে বাঙলাদেশ একটি জাতীয় রাষ্ট্র। বাঙলাদেশীদেরকে একটি জাতি এবং বাঙলাদেশ রাষ্ট্রকে একটি জাতীয় রাষ্ট্র বলে যারা মাঠে-ময়দানে, রেডিও-টেলিভিশনে এবং পত্র-পত্রিকায় শোরগোল তুলছেন তাঁরা কিন্তু পূর্বতন পূর্ব বাঙলার এই মানবগোষ্ঠীর জাতীয়তার ভিত্তি সম্পর্কে কিছুই বলছেন না। তাঁরা মনে করছেন বাঙলাদেশীরা অর্থাৎ পূর্ব বাঙলার অধিবাসীরা একটি জাতি এই কথা বারংবার উচ্চারণ এবং প্রচার করলেই কাজ হাসিল হবে। এই অঞ্চলের লোকেরা নিজেদেরকে একটি স্বতন্ত্র ‘জাতি’ হিসেবে ধরে নিয়ে বাঙলাদেশেকে একটি ‘জাতীয় রাষ্ট্র’ হিসেবে গঠন করার উদ্দেশ্যে জানমাল কোরবান করবার জন্যে প্রস্তুত হবে। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে, বিষয়টি অতি সহজ অথবা সরল নয়।
পূর্ব বাঙলার দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করতে গিয়ে বলা হয়েছিলো ভাষার কথা, ঐতিহ্যের কথা, ইতিহাসের কথা। এই সমস্ত কথা বলে দেখানো হয়েছিলো পাকিস্তানের মুসলমানেরা সকলে এক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হলেও তাঁরা সকলে এক জাতিভুক্ত নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের সাথে পূর্ব বাঙলার জনগণের ‘জাতিগত’ পার্থক্য নির্দেশ করতে গিয়ে মোটামুটিভবে যে বক্তব্য দাঁড়িয়েছিলো তা হলো এই যে, বাঙালী নামে একটি স্বতন্ত্র জাতি আছে যার ভাষা বাঙলা; যার ঐতিহ্যের অন্তর্গত হলো রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মাইকেল, বঙ্কিমচন্দ্র, মীর মশাররফ হোসেন, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল ইসলাম; হাজার বছরের যে বাঙালী-সংস্কৃতি যে সংস্কৃতি পশ্চিম বাঙলার জনগণের যেমন পূর্ব বাঙলার জনগণেরও ঠিক তেমনি।
এখন যাঁরা বর্তমান বাঙলাদেশের অর্থাৎ পূর্ব বাঙলার অধিবাসীদেরকে একটি জাতি আখ্যা দিয়ে বাঙলাদেশকে একটি জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করছেন তাঁরা তাঁদের জাতীয়তাবাদকে কোন্ ভিত্তির ওপর দাঁড় করাবেন? যে ভিত্তির ওপরই তাঁরা তাকে দাঁড় করান একটি জিনিস তাঁদেরকে করতেই হবে। পশ্চিম বাঙলার জনগণের সাথে এক্ষেত্রে ‘জাতি’ হিসেবে তাঁদের পার্থক্যকে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করতে হবে।
১৯৪৭ সালে বাঙালী হিন্দু-মুসলমানকে দুই পৃথক জাতি হিসেবে যে ভিত্তিতে বিভক্ত করা হয়েছিলো সে ভিত্তি ছিলো সাম্প্রদায়িক। কাজেই তাকে বাঙলাদেশের জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে তত্ত্বগতভাবে আঁকড়ে ধরা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, ১৯৪৭ সালে কেউ যদি বলতো যে বর্তমান বাঙলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখার অন্তর্গত অঞ্চলের অধিবাসীরা পশ্চিম বাঙলার জনগণের থেকে একটা পৃথক জাতি তাহলে সেটা তখন হাস্যকরই মনে হতো। ১৯৪৭ সালে যে তত্ত্ব হাস্যকর মনে হতো, কি কারণে পাকিস্তান পূর্ব বাঙলা থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পরেই আওয়ামী লীগের হাতে তা বাঙলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শের মর্যাদা প্রাপ্ত হলো?
হয়তো বলা যেতে পারে, পূর্ব পাকিস্তানের ভৌগোলিক সীমারেখার অন্তর্গত অঞ্চলের অধিবাসীদের আর্থিক জীবন, সামাজিক জীবন, সাংস্কৃতিক জীবনের ক্ষেত্রে যে স্বতন্ত্র বিকাশ চব্বিশ বৎসর ধরে সাধিত হয়েছে সেগুলিই হলো বাঙলাদেশের জাতীয়তার ভিত্তি। আর্থিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের বিকাশের প্রশ্নটি এ প্রসঙ্গে প্রথমে বিবেচনা করা যেতে পারে। আর্থিক জীবনের ক্ষেত্রে চব্বিশ বৎসরে পূর্ব বাঙলার জনগণের জীবনে কি এমন পরিবর্তন ঘটেছিলো যার ফলে হাজার বৎসরের ঐতিহ্যওয়ালা একটি মানবগোষ্ঠী নিজেরাই অন্য একটি অংশ থেকে আজ এতোখানি পৃথক হয়ে গেলো, যার ফলে তারা পরিণত হলো একটি জাতিতে? আমরা তো জানি পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাঙলার আর্থিক উন্নতি দারুণভাবে ব্যাহত হয়েছিলো, সামন্তবাদের অবশেষসমূহ মূলত চব্বিশ বৎসরের পূর্বাবস্থাতেই বজায় ছিলো এবং এখনো আছে। ধনতান্ত্রিক উন্নতিও তাই এখানে তেমন ঘটেনি। এদিক থেকে বিচার করলে ১৯৪৭ সালে পশ্চিম বাঙলা ও পূর্ব বাঙলার মধ্যে যে পার্থক্য ছিলো বর্তমান পার্থক্যের ক্ষেত্রে তার মধ্যে এমন কোন বৈপ্লবিক তারতম্য ঘটেনি।
আর একটি কথা এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। আমরা জানি, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ও চক্রান্তের ফলে জার্মানী, কোরিয়া, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। এই সব দেশের দুই অংশে দুই ধরনের পরস্পরবিরোধী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রচলন ঘটেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পশ্চিম অথবা পূর্ব জার্মানী, উত্তর অথবা দক্ষিণ কোরিয়া, উত্তর অথবা দক্ষিণ ভিয়েতনাম এদের কোনটিই নিজেকে পৃথকভাবে ‘জাতি’ হিসেবে ঘোষণা করেনি। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, অর্থনৈতিক জীবনের মধ্যে বিরাট তারতম্য, মৌলিক প্রভেদ সত্ত্বেও পৃথক জাতি সত্তার প্রশ্ন ঐ সমস্ত দ্বিধাবিভক্ত দেশে ওঠেনি। কিন্তু বাঙলাদেশে আজ তা উঠেছে।
যাই হোক, এবার সংস্কৃতির প্রশ্নটি বিবেচনা করা যেতে পারে। পূর্ব বাঙলার সাংস্কৃতিক জীবনে ২৪ বৎসরে কী এমন পরিবর্তন ঘটেছে যার ফলে এক হাজার বৎসরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে অতিক্রম করে পূর্ব বাঙলার অধিবাসীরা এমন এক জাতিসত্ত্বার অধিকারী হয়েছে যা পশ্চিম বাঙলার জনগণের বাঙালী জাতিসত্তার থেকে স্বতন্ত্র? একটু লক্ষ্য করলে, প্রশ্নটি ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে দেখলে, স্পষ্ট বোঝা যাবে যে, পাকিস্তানী আমলে সে রকম কোন পরিবর্তন সাধিত হয়নি। এখানে এমন কোন উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ঘটেনি যা হাজার বছরের সাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিপুল বিক্রমে অতিক্রম করে একটা স্বতন্ত্র ভিত্তিতে নিজেকে দাঁড় করাতে সক্ষম। এবার সামাজিক জীবনের পরিবর্তনের প্রশ্নটিতে আসা যেতে পারে। এক্ষেত্রে যে তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য দেখা যাচ্ছে সেটা হচ্ছে এই যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পূর্ব বাঙলার সমাজের উচ্চ স্তরে, শাসন-শোষণ ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে সম্প্রদায়গতভাবে হিন্দুদের প্রাধান্যের পরিবর্তে মুসলমানদের প্রাধান্য স্থাপিত হয়েছে। অর্থনৈতিক জীবনের মধ্যে মৌলিক কোন পরিবর্তন না ঘটলেও জনগণের আর্থিক জীবন যারা নিয়ন্ত্রণ করতো, ব্যাপক অর্থে সমাজকে যারা শাসন করতো, তাদের সম্প্রদায়গত চরিত্র পরিবর্তিত হয়েছে। একমাত্র এই সম্প্রদায়গত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে চব্বিশ বৎসরে যে পরিবর্তন ঘটেছে তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং এক্ষেত্রেই পশ্চিম বাঙলার সাথে পূর্ব বাঙলার একটা স্পষ্ট পার্থক্য দেখা যাচ্ছে।
অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে পূর্ব বাঙলায় চব্বিশ বৎসরে যে পরিবর্তন ঘটেছে তার হিসেব নিয়ে তা হলে দেখা যাচ্ছে যে, এই পরিবর্তন তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে একমাত্র একটি ক্ষেত্রে এবং সে ক্ষেত্রটি হলো পূর্ব বাঙলার সামাজিক শাসক ও অর্থনৈতিক শোষকদের সম্প্রদায়গত চরিত্র পরিবর্তন।
এই সম্প্রদায়গত পরিবর্তনই কি তাহলে বাঙলাদেশী জাতীয়তার ভিত্তি নয়? এই জাতীয়তার ভিত্তির ওপরেই কি মুজিববাদের প্রতিষ্ঠা নয়? একমাত্র এই ভিত্তিতেই কি আজকের বাঙলাদেশের অধিবাসীরা পশ্চিম বাঙলার অধিবাসীদের থেকে স্বতন্ত্র নয়?
তা যদি হয়, তাহলে বাঙলাদেশের জাতীয়তার ধ্বনি তোলা, জাতীয় রাষ্ট্রের জিগির তোলার অর্থ কি জাতীয়তাকে আবার নোতুন করে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দাঁড় করানোর চেষ্টা নয়?
জার্মানী, কোরিয়া, ভিয়েতনামের দুই অংশে পৃথক পৃথক রাষ্ট্র স্থাপিত হওয়া সত্ত্বেও তারা পৃথক জাতিসত্তার প্রশ্ন উত্থানের কোন প্রয়োজন বোধ করেননি। কিন্তু বাঙলাদেশের শাসক দল সে প্রশ্ন উত্থাপনের প্রয়োজন বোধ করেছেন এবং একটু বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে যে, এই বাঙলাদেশী জাতীয়তার ভিত্তি মূলতঃ সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্ব ব্যতীত কিছুই নয়। তাই ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ভারতবর্ষের মুসলিম প্রধান দুই অংশে দুটি ‘মুসলিম রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার যে কথা বলা হয়েছিলো বস্তুতঃপক্ষে মুজিববাদের নামে আজ বাঙলাদেশে সেটাই কার্যকর হয়েছে।
দৈনিক আজাদ
২০শে ডিসেম্বর, ১৯৭২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন