বদরুদ্দীন উমর
সংসদীয় বিরোধী দলসমূহের ঐক্য সম্পর্কে তাদের নিজেদের মধ্যে একটা সক্রিয় চিন্তা- ভাবনা এখন দেখা যাচ্ছে। এই ধরনের ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা জনগণ বহুদিন থেকেই বোধ করছেন। এতদিনে সংসদীয় বিরোধীদলসমূহ নিজেরাই তার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন এবং সেই ঐক্য গঠনের জন্যে পরস্পরের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এই দলসমূহের মধ্যে প্রধান হলো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। এই দুই দলই প্রকাশ্যে নিজেদের দলের দ্বারা আহূত জনসভায় ও দলের কার্যকরী সমিতির সভায় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছে এবং একটি সম্মত কর্মসূচীর ভিত্তিতে সেই ঐক্য গড়ে তোলার জন্যে সব রকম চেষ্টা করবে বলে জনগণের কাছে ঘোষণাও করেছে। অন্যান্য সংসদীয় বিরোধী দলসমূহও এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। তারাও এই ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা জানাচ্ছে। ঐক্যের প্রশ্ন যেখানে আছে, বিরোধিতার প্রশ্ন ও সেখানে থাকতে হবে, কারণ সুস্থ ও শক্তিশালী বিরোধিতার প্রয়োজন থেকেই ঐক্যের প্রয়োজন জন্ম লাভ করে। এজন্যে যার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হয় তার উপরই নির্ভর করে কে কার সাথে ঐক্যবদ্ধ হবে এবং ঐক্য জোট কি ধরনের কর্মসূচী গ্রহণ করবে।
বাঙলাদেশে কার বিরুদ্ধে সংসদীয় বিরোধী দলসমূহ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে এবং সে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারণ এই বিরোধিতা ইতিমধ্যেই খুব সুস্পষ্ট। তারা প্রত্যেকেই এককভাবে ঘোষণা করেছে যে, তারা শুধু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগই নয়, তার সাথে ‘দেশপ্রেমের’ গাঁটছড়ায় বাঁধা বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিরও (মস্কো পন্থী) বিরোধী। কাজেই সংসদীয় বিরোধী দলের ঐক্যজোট এ ক্ষেত্রে ঐক্য জোটের বিরুদ্ধেই নিজেকে সংগঠিত ও পরিচালিত করতে চাচ্ছে। এত সহজ কথাগুলি এত সরলভাবে এতক্ষণ বলার একটা কারণ আছে। সে কারণটি হলো এই যে, এই ধরনের ঐক্য গঠন প্রচেষ্টা অনেক সময় রাজনৈতিক শত্রু অথবা বিরোধী শক্তিকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে অক্ষমতার জন্যেই একটা প্রাথমিক বাধার সম্মুখীন হয়। এই ধরনের অসুবিধা ও বাধা পশ্চিম বাঙলার বিরোধী দলসমূহের ঐক্যজোটের ক্ষেত্রে এবং ঐক্যবদ্ধ বিশেষ বিশেষ আন্দোলনের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছে। কখনো তাই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য কমিটি মার্কসবাদী পার্টির সাথে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে হাত মেলাচ্ছে এবং সেই হাত মেলানোর জন্যে বামপন্থী বিরোধী দলগুলির ঐক্যজোটের একটি অংশ অর্থাৎ কয়েকটি পার্টি সেই আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে (যেমন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক আহূত বন্ধের ক্ষেত্রে)। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে আট-নয়টি বামপন্থী পার্টি একত্রে যখন বন্ধের ঘোষণা দিচ্ছে (যেমন ১৭ই নভেম্বরের বন্ধের ক্ষেত্রে) তখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ঐভাবে কংগ্রেসের বিরোধিতায় রাজী না থাকায় তারা একটা নিরপেক্ষ ভূমিকা নিচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা কংগ্রেসের সাথে একজোট হয়ে বিশেষ বিশেষভাবে কতকগুলি কর্মসূচীও গ্রহণ করছে।
পশ্চিম বাঙলার এই ধরনের পরিস্থিতির মতো কোন পরিস্থিতি এখানে নেই। ভারতের মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেসকে সংকটের সময় সাহায্য করতে এগিয়ে আসে এবং প্রায় সমস্ত গুরুতর ব্যাপারেই সরকারের সাথে সহযোগিতা করে, তার মধ্যে মাঝে মাঝে কিছুটা সংসদীয় বিরোধিতার প্রবণতাও দেখা যায়। কিন্তু বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং মস্কোপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মধ্যে সে ধরনের কোন দোদুল্যমানতা নেই I উপরন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের খেদমত যাতে পরিপূর্ণ নিবেদিত চিত্ত হয়ে করতে পারে সেজন্যে তারা আওয়ামী লীগকে ও নিজেদেরকে একমাত্র দেশপ্রেমিক দল হিসেবে ঘোষণা করে দেশপ্রেমিকদের এক ঐক্যজোটে মিলিত হয়েছে। কাজেই এতদিন আওয়ামী লীগের বাইরে অবস্থিত এই দুটি দল এখন যে সংসদীয় বিরোধী দলসমূহের ঐক্যজোটের প্রশ্ন উঠেছে, সে ঐক্যজোট এই সরকারী ত্রিদলীয় ঐক্যজোটের বিরুদ্ধেই নিজেকে দৃঢ়ভাবে স্থাপন করার চেষ্টা করছে।
বিরোধী দলগুলির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এবং ঐক্যজোটের ক্ষেত্রে মস্ত একটা প্রতিবন্ধকতা, অর্থাৎ রাজনৈতিক বিরোধিতা মূলতঃ কার বিরুদ্ধে পরিচালিত হবে সে বিষয়ে দোদুল্যমানতা থেকে উদ্ভূত প্রতিবন্ধকতা বাঙলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে না থাকলেও দলগুলি সরকারী ঐক্যজোটের বিরুদ্ধে নিজেদের ঐক্যজোট গঠনে এখনো পর্যন্ত কোন অগ্রগতি সাধন করতে পারছে না কেন, সেই প্রশ্নটি হলো গুরুত্বপূর্ণ এবং এই প্রশ্নটির গুরুত্ব উপযুক্তভাবে বোঝার জন্যেই এতক্ষণ উপরোক্ত প্রতিবন্ধকতা এবং বাঙলাদেশে সেই প্রতিবন্ধকতার অভাবের বিষয়টি উল্লেখ করা হলো।
প্রশ্নটিকে এবার আরও সোজাসুজি এবং সরলভাবে উত্থাপন করা যায়। সরকারের বিরুদ্ধে এবং সরকারী ঐক্যজোটের বিরুদ্ধে সমালোচনা এবং সক্রিয় আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ঘোষণা সত্ত্বেও বাস্তবক্ষেত্রে এই দলগুলি নিজেদের একটি কার্যকরী ঐক্যজোট এখনো পর্যন্ত গঠন করতে পারছে না কেন? এক্ষেত্রে মূল প্রতিবন্ধকতা অথবা প্রতিবন্ধকতাগুলির প্রকৃতি ও চরিত্র কি?
প্রথম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে যেটা উল্লেখ করা যেতে পারে, তা হলো এই দলগুলির গণআন্দোলন বিমুখতা। গত দুবছরের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, সংসদীয় বিরোধী দলগুলির কোনটিই প্রকৃত গণআন্দোলনের পথে যেতে চাইছে না অথবা যাওয়ার মতো কোন সত্যিকার উৎসাহ প্রকাশ করছে না। তাদের কাছে গণআন্দোলনের অর্থ এ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে বিবৃতির মাধ্যমে হরতাল ঘোষণা করে দেওয়া এবং মাঝে মাঝে দুই একটি সভার আয়োজন করা। বিবৃতির ওপর নির্ভরশীলতাই এই বিরোধিতার মূল রাজনৈতিক দুর্বলতা। জনগণের ওপর তাঁদের কোন সত্যিকার আস্থা নেই। এজন্যে জনগণকে সাথে নিয়ে একটা বিরাট ব্যাপক গণ-আন্দোলন (যে আন্দোলনের জন্যে, যে আলোড়নের জন্যে সারা দেশের জনগণ এখন অনেকখানি প্রস্তুত) গড়ে তোলার কোন বাস্তব ও সক্রিয় প্রচেষ্টা কোন সংসদীয় বিরোধী দলের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে না।
জনগণের এত সমস্যা এবং তাঁদের ওপর এতো রকমের সরকারী নির্যাতন সত্ত্বেও বিরোধী দলগুলি জনগণের পাশে ঠিকমতো দাঁড়াতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ না হওয়ার জন্যেই তারা কোন রাজনৈতিক কর্মসূচীও গ্রহণ করতে পারছে না। কতকগুলি বাঁধাধরা বুলি উচ্চারণ করে, সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়ে, দায় সারা মনোবৃত্তি নিয়ে সরকারের বিরোধিতা করতেই তারা বেশী আগ্রহী। অর্থাৎ জনগণকে বাইরে রেখে ‘জনগণের জন্যে সংগ্রামের’ এই কৌশলকেই সংসদীয় বিরোধী দলগুলির গণ আন্দোলন ভিত্তিক ঐক্যজোট গঠনের ক্ষেত্রে সব থেকে বড়ো প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
সংসদীয় দলগুলির গণ আন্দোলন ভীতির সর্বপ্রধান কারণ যে সরকারী নির্যাতনের ভয়, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বাঙলাদেশের মতো একটি কৃষিনির্ভর ও কৃষক প্রধান দেশে কোন গণ আন্দোলন কৃষকদেরকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। কিন্তু বাঙলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যেখানেই আন্দোলনের কিছুমাত্র সূত্রপাত হচ্ছে সেখানেই সরকারী নির্যাতন পুরোমাত্রায় জারী হচ্ছে। এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফলে সংসদীয় দলগুলি ব্যাপকভাবে কোন গণ- আন্দোলনের সূত্রপাত করতে এবং তাকে এগিয়ে নিতে সাহস করছে না। সরকারী নির্যাতনভীতি তাদেরকে এইভাবে জনগণের মধ্যে আন্দোলন গঠন থেকে বিরত রাখছে। একদিকে সরকারী নির্যাতনের অত্যধিক মাত্রা, সেই নির্যাতনের অনিয়মতান্ত্রিক ও সন্ত্রাসবাদী চরিত্র এবং অন্যদিকে জনগণের ওপর প্রকৃত নির্ভরশীলতার অভাব, এই উভয় কারণ মিলিতভাবে সংসদীয় বিরোধী দলগুলিকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শুধু যে ঐক্যবদ্ধ হতে বাধা দিচ্ছে তাই নয়, তাদেরকে কোন একক কর্মসূচী গ্রহণেও যথেষ্ট উৎসাহী করছে না। বিরোধী দল যে সরকারের বিরোধিতা করতে, পরস্পরের সাথে একটা কার্যকরী ঐক্যজোট গঠন করতে এবং সর্বোপরি ক্ষমতা দখল করতে চায় না তা নয়। কিন্তু কি উপায়ে এবং কোন্ কর্মসূচীর মাধ্যমে উপরোক্ত রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলি অর্জন করা সম্ভব সে বিষয়ে তাদের কোন সঠিক, সুষ্ঠু ও নির্দিষ্ট ধারণা এখন পর্যন্ত নেই।
কেবলমাত্র হরতাল আহ্বান করে, দুই একটি সভা-সমিতি করে অথবা সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে যে গণ আন্দোলন গঠন করা যায় না, সে কথা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এই নেতিবাচক উপলব্ধি বিরোধী দলগুলির মধ্যে এখনো পর্যন্ত বাহ্যত কোন ইতিবাচক চিন্তার জন্ম দান করেনি।
এই চিন্তার অভাবই আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলির একক এবং যৌথ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সব থেকে বড়ো বাধা।
খাদ্যাভাব, বস্ত্রাভাব, দ্রব্যমূল্যের অদৃষ্টপূর্ব বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তার অভাব জনগণের মধ্যে যে ব্যাপক অসন্তোষ আজ শোষক শ্রেণী, তাদের সরকার এবং সরকারী মিত্রদের বিরুদ্ধে সৃষ্টি করেছে ব্যাপক গণ আন্দোলনের মাধ্যমে সেই অসন্তোষকে একটা রাজনৈতিক চরিত্র প্রদান করা সম্ভব হবে যদি বিরোধী দলসমূহ কেবলমাত্র জনসভা, হরতাল, বিবৃতিদান ইত্যাদির মধ্যে নিজেদের কর্মসূচীকে সীমাবদ্ধ না রেখে জনগণের ওপর যে দৈনন্দিন নির্যাতন বিভিন্ন স্থানে বিচিত্রভাবে ঘটছে সেগুলিকে প্রতিরোধ করতে জনগণের মধ্যে উপস্থিত হন, জনগণকে সাথে নিয়েই সেগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে এগিয়ে যান। সেক্ষেত্রে একদিকে জনগণও যেমন বিরোধী দলগুলিকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হতে থাকবেন তেমনি বিরোধী দলগুলিও জনগণের সক্রিয় সমর্থন থেকে শক্তি সঞ্চয় করে নিজেদের বিরুদ্ধে সরকারী নির্যাতনকেও অনেকখানি প্রতিরোধ করতে পারবে।
এইভাবে একদিকে জনগণের সমস্যাগুলিকে ভিত্তি করে আন্দোলন গঠন করলে এবং জনগণের বিরুদ্ধে নির্যাতনকে সারা দেশের সর্বত্র সংগঠিতভাবে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে গেলে শুধু যে বিরোধী দলগুলির পক্ষে এককভাবে কর্মসূচী গ্রহণ সম্ভব হবে তাই নয়। সেই আন্দোলন এবং প্রতিরোধ বিরোধী দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ হতেও সহায়তা করবে এবং সামগ্রিকভাবে বাঙলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে অনেকাংশে এগিয়ে দেবে। কিন্তু সরকারী নির্যাতনকে প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে বিরোধী দলগুলি যদি কোন সক্রিয়, বাস্তব ও কার্যকরী ব্যবস্থা ও নীতি অবলম্বন করতে অসমর্থ হয়, তাহলে তাদের পক্ষে কোন অর্থপূর্ণ ঐক্যজোট গঠন যেমন সম্ভব হবে না, তেমনি তাদের দ্বারা গণ আন্দোলন গঠন ও পরিচালনাও হবে সুদূরপরাহত।
বঙ্গবার্তা
২৯শে নভেম্বর, ১৯৭৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন