বদরুদ্দীন উমর
মাধ্যমিক শিক্ষকদের ধর্মঘট এখন একটা সংকটের মধ্য দিয়ে উত্তীর্ণ হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, সংকট সত্ত্বেও এ ধর্মঘট এখনো ভেঙ্গে পড়েনি এবং কেন্দ্রীয় সংগ্রাম কমিটির আপসমুখিতা, দোদুল্যমানতা ও বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও তারা এখনো পর্যন্ত তাঁদের মূল দাবীগুলোর ভিত্তিতে আন্দোলনকে অব্যাহত রাখতে সমর্থ হয়েছেন। কিন্তু এই আপেক্ষিক সাফল্য সত্ত্বেও শিক্ষক ধর্মঘট এবং শিক্ষকদের শিক্ষা বিষয়ক আন্দোলনকে যথাযথভাবে সংগঠিত ও পুরোপুরি সফল করার জন্যে কতকগুলি বিষয়ে বিশেষ সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার।
প্রথমতঃ, মনে রাখা দরকার যে, শিক্ষক-ধর্মঘটের সময় ছাত্র এবং বৃহত্তর জনগণ থেকে ধর্মঘটী শিক্ষকরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে সে ধর্মঘট কখনো সফল হতে পারে না। শিল্প-শ্রমিক ধর্মঘট, পরিবহন-শ্রমিক ধর্মঘট, ছাত্রধর্মঘট ইত্যাদির সাথে শিক্ষক-ধর্মঘটের এখানেই একটা বড়ো তফাৎ। জনগণের সাথে বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও অন্যান্য ধর্মঘট যেখানে আংশিক অথবা পুরোপুরি সাফল্য অনেক ক্ষেত্রেই অর্জন করতে পারে সেখানে শিক্ষক-ধর্মঘট এই বিচ্ছিন্নতার মুখে কোন ক্রমেই টিকে থাকতে পারে না। জনগণের সমর্থন শিক্ষক-ধর্মঘটের সাফল্যের পক্ষে অপরিহার্য।
জনগণ শিক্ষক-ধর্মঘটের ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারেন, তাকে সমর্থন দিতে পারেন তখনই যখন শিক্ষকদের এই সংগ্রামকে তাঁরা সাধারণভাবে শিক্ষাসমস্যার সাথে সম্পর্কিত হিসেবে দেখতে পান। এদিক দিয়ে তাই শিক্ষক-ধর্মঘটের সাফল্য নির্ভর করবে শিক্ষকদের দাবী- দাওয়াকে শিক্ষাসমস্যার সাথে কতখানি সাফল্যের সাথে যুক্ত করা সম্ভব হয়েছে তার ওপর কিন্তু শিক্ষকদের সমস্যা ও শিক্ষাসমস্যাকেও শুধু একটা আনুষ্ঠানিক কর্মসূচীর মধ্যে যুক্ত করলেই এ কাজ সম্পন্ন হয় না। তার জন্যে প্রয়োজন সেই কর্মসূচীর ভিত্তিতে সক্রিয়ভাবে জনগণের সাথে সংযোগ স্থাপনের কতকগুলি বাস্তব উদ্যোগ। এই উদ্যোগের ক্ষেত্রে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার।
শিক্ষক-ধর্মঘট সম্পর্কে শিক্ষক এবং অশিক্ষক মহল থেকে একটি কথা প্রায়ই শোনা যায়। সে কথাটি হলো শিক্ষকদের রাজনীতি থেকে বিরত থাকা উচিত, শিক্ষার পবিত্র অঙ্গনে রাজনীতি আমাদানী করা নিতান্ত অসমীচীন ইত্যাদি। শিক্ষক সম্প্রদায় ও রাজনীতি সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য নোতুন নয়। পাকিস্তানী আমলে, এমনকি তার পূর্বেও শিক্ষক-ধর্মঘটের সময় সমাজের অন্যান্য অংশ থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন রাখার উদ্দেশ্যে এ জাতীয় কথা হামেশাই সরকারী, আধা সরকারী পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। যখনই শিক্ষকরা নিজেদের দাবী-দাওয়া ও ধর্মঘটের সমর্থনের জন্যে জনগণের বিভিন্ন অংশের কাছে আবেদন করেছেন এবং তাদের সহযোগিতা প্রার্থনা করেছেন তখনই শিক্ষকদের রাজনীতি সম্পর্কে উপরিউক্ত বক্তব্য হাজির করে তাঁদেরকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা হয়েছে। বর্তমান বেসরকারী, মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষক-ধর্মঘটের সময়েও ঠিক সেই চেষ্টা চলছে।
প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, রাজনীতির বিরুদ্ধে সাধারণভাবে যারা এইসব মন্তব্য প্রকাশ করে এবং শিক্ষার ‘পবিত্র’ অঙ্গনকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখার জন্যে আবেদন ও দাবী জানায় তারা মূলগতভাবে জনগণের শত্রু। জনগণের এই শত্রুরা জনগণের হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই এই সমস্ত ধ্যান-ধারণা ও প্রচারণার জন্মদান করে। কিন্তু এ সম্পর্কে অন্য আলোচনার পূর্বে দেখা দরকার রাজনীতি কাকে বলে।
রাজনীতি হচ্ছে এমন একটা প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সমাজকে সামগ্রিকভাবে বোঝা ও নিয়ন্ত্রণ করা যায় অথবা তার চেষ্টা করা হয়। এজন্যেই রাজনৈতিক চেতনার অর্থ সমগ্র সমাজ সম্পর্কে, তার বিভিন্ন অংশের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্পর্কে চেতনা। সামাজিক চেতনা এবং রাজনৈতিক চেতনা এজন্যেই আবার ওতপ্রোত যোগসূত্রে গ্রথিত।
সমাজের বিভিন্ন অংশ পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন তো নয়ই, উপরন্ত তার প্রত্যেক অংশই একে অন্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এজন্য সমাজের যে-কোন অংশের সমস্যাও পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষভাবে অন্যান্য অংশের সমস্যার সাথে যুক্ত। এই যোগসূত্রের জন্যেই রাজনৈতিক প্রশ্ন সমাজের যে-কোন গুরুতর সমস্যার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক।
সমাজের এক অংশের লোক যখন অন্য অংশের লোকের সমস্যার সাথে নিজেদের সম্পর্ক দেখতে পায় এবং সামগ্রিক সামাজিক ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সমস্যাগুলোকে বোঝার ও তার সমাধানের চেষ্টা করে তখনই তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার জন্ম হয় ও তার বিকাশ ঘটে। এজন্যে দেখা যায় শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, অফিস-কর্মচারী ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক দাবী-দাওয়ার আন্দোলন একটা উচ্চতর স্তরে ওঠার সাথে সাথে একটা রাজনৈতিক চরিত্র পরিগ্রহ করে এবং এই চরিত্র-পরিগ্রহের মাধ্যমে সেই সীমিত আন্দোলনও লাভ করে একটা ব্যাপক চরিত্র। সমাজের অন্যান্য অংশের বিভিন্ন আন্দোলনের সাথে একটা যোগসূত্র স্থাপিত হয়ে সমগ্র সমাজের পরিবর্তন তার মাধ্যমে হয় ত্বরান্বিত। ভারতে বৃটিশ শাসন এবং পূর্ব বাঙলার পাকিস্তানী শাসন আমলে ঠিক এটাই ঘটেছে। এজন্যে তখনও শাসক-শোষকশ্রেণী এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দল ও ব্যক্তিরা সমাজের প্রত্যেক অংশের আন্দোলনকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চেয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সফল হয়নি। অবস্থার ক্রমবিকাশ এবং পরিস্থিতির চাপে সমাজের বিভিন্ন অংশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আন্দোলনের ধারা পরস্পরের সাথে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করেছে উত্তাল তরঙ্গ এবং সেই তরঙ্গের আঘাতে প্রতিষ্ঠিত শাসনকাঠামো ভেঙ্গেচুরে তছনছ হয়েছে, তার স্থলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নোতুন কাঠামো।
বাঙলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং তার বিশ্বস্ত দুই জো-হুজুর দল তাদের পূর্ববর্তী প্রতিক্রিয়াশীল শাসক দলের মতোই যে-কোন আন্দোলন, ধর্মঘট, বিক্ষোভকে ‘বিদেশী চক্রান্ত’ এবং ‘দেশদ্রোহী’ দল ও ব্যক্তিদের ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করে আসছে। বিশেষ করে জো-হুজুর দল দুটির ভূমিকা এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। কারণ, এদের একটি কমিউনিস্ট নামধারী (বাঙলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি) এবং অপরটি কমিউনিস্ট নামধারী না হলেও সমাজতন্ত্রের ভেকধারী। মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্রের কোন্ শিক্ষকের মতানুযায়ী ‘শিক্ষার পবিত্র-অঙ্গনে’ রাজনীতির প্রবেশ নিষিদ্ধ সেটা আমরা জানি না। কিন্তু এই ভেকধারীরা নিজেদেরকে কমিউনিস্ট এবং সমাজতন্ত্রী নামে আখ্যায়িত করলেও শিক্ষার পবিত্র অঙ্গনকে ‘রাজনীতির কলুষমুক্ত’ করতে এরাই আজ সব থেকে আগ্রহী।
ধর্মঘটী মাধ্যমিক শিক্ষকরা কেন্দ্রীয় কমিটির আওয়ামী লীগ, মোজাফ্ফর ন্যাপ ও বাঙলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টিভুক্ত নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতার হাত থেকে ধর্মঘটকে বাঁচানোর জন্যে গোড়া থেকেই চেষ্টা করছিলেন। সাধারণ শিক্ষকদের চাপে বহুদিন পর্যন্ত উপরোক্ত নেতৃত্ব বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগ পায়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গণভবন ও ‘বঙ্গবন্ধু’র দোহাই পেড়ে তারা সে কাজ করেছে। নিজেদের এই বিশ্বাসঘাতকতাকে কার্যকর করার উদ্দেশ্যেই জনগণের বিভিন্ন অংশের সাথে শিক্ষকদের সংযোগ স্থাপনে তারা নানা উপায়ে এতদিন বাধা সৃষ্টি করে এসেছে এবং সেই চেষ্টাকে ‘শিক্ষার পবিত্র অঙ্গনে রাজনীতি আমদানী’ বলে বানচাল করতে চেয়েছে।
এখন দেখা যাচ্ছে যে, উপরোক্ত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও শিক্ষক ধর্মঘট চলছে। সমগ্র দেশে সামান্য কয়েকটি স্কুল ব্যতীত সমস্ত স্কুলই বন্ধ আছে। ঢাকায় প্রকৃতপক্ষে কোন স্কুলই এখন খোলা নেই। নিজেদের এই ব্যর্থতাকে ঢাকা দেওয়ার জন্যে একদিকে যেমন তারা সরকারী সংবাদপত্র ও সংবাদ সরবরাহ সংস্থাগুলিকে দিয়ে একের পর এক মিথ্যা ছড়াচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি ‘শিক্ষার পবিত্র অঙ্গনে’ ইত্যাদি বলে শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে একটা দেশদ্রোহী চরিত্র দান করতেও তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।
একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে, বিশ্বাসঘাতক পূর্ববর্তী কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রায় সকলেই হয় আওয়ামী লীগ অথবা মোজাফ্ফর ন্যাপ ও বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংযুক্ত। কিন্তু যে অগণিত শিক্ষক এখন ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের সে রকম কোন সুস্পষ্ট রাজনৈতিক পরিচয় নেই। তাঁরা শিক্ষকদের দাবী-দাওয়া নিয়ে ধর্মঘটের পথে নেমেছিলেন এবং ধর্মঘটের তাগিদে ও সরকারী নীতির ফলে একদিকে যেমন তাঁরা সরকার ও তার জো-হুজুর দল দুটির বিরোধী হয়েছেন অন্যদিকে তেমনি তাঁরা চেষ্টা করছেন বৃহত্তর জনসংযোগের। এই দুই প্রচেষ্টার মধ্যে যেটুকু রাজনীতি আছে সে রাজনীতি ধর্মঘটের স্বার্থ, শিক্ষকদের স্বার্থ, শিক্ষার স্বার্থ এবং গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহের স্বার্থে সম্পূর্ণ অপরিহার্য। ধর্মঘটী শিক্ষকদের এখন অন্যতম দায়িত্ব হওয়া উচিত শুধু ধর্মঘটকে টিকিয়ে রাখা নয়, নোতুন পরিস্থিতিতে মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতিকে আবার নোতুনভাবে সংগঠিত করা। এই সংগঠনের কাজ ধর্মঘট পরিচালনার সাথে চালিয়ে না গেলে একদিকে ধর্মঘট যেমন একটা মোটামুটি সফল পরিণতি লাভ করবে না, অন্যদিকে তেমনি ধর্মঘটের পরবর্তী পর্যায়ে শিক্ষক সমিতির কাজ প্রতিক্রিয়াশীল ও বিশ্বাসঘাতকদের দ্বারা নানাভাবে বাধাপ্রাপ্ত ও বিঘ্নিত হবে। এই সব বাধাবিঘ্ন সাফল্যের সাথে অতিক্রম করতে হলে একদিকে যেমন প্রয়োজন সচেতনভাবে সমাজের বিভিন্ন অংশের জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপন, অন্যদিকে তেমনি প্রয়োজন শিক্ষক সম্প্রদায়ের নিজেদের মধ্যে সংগ্রামী ঐক্যকে টিকিয়ে রাখার জন্যে শিক্ষক সংগঠনকে উপযুক্তভাবে গড়ে তোলা। এই উভয়বিধ কাজ করতে পারলে শিক্ষকরা একদিকে যেমন শিক্ষকদের স্বার্থ রক্ষা করতে সমর্থ হবেন, অন্যদিকে তেমনি বৃহত্তর সমাজের প্রতি নিজেদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও সাফল্য অর্জন করবেন।
সাপ্তাহিক গণবাংলা
৩১শে আগস্ট, ১৯৭৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন