ভারত-বিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতা

বদরুদ্দীন উমর

ভারত-বিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতা

ভারত-বাঙলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে অনেকরকম বক্তব্য এবং প্রচারণা শুধু ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে নয় তার অনেক পূর্ব থেকে শুরু হয়েছে। এইসব বক্তব্য ও প্রচারণার মধ্যে সত্য- মিথ্যা এবং ঘটনা-গুজবের মিশ্রণ ঘটে তা এখন বাঙলাদেশের জনমতের ক্ষেত্রে একটা জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে এবং এই জটিলতার পরিণতিতে আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক চিন্তা-ভাবনা ও বক্তব্য আবার নোতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে।

একথা সত্য যে, আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কোন নির্দিষ্ট ভিত্তিতে সংগঠিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা আর নেই। সে সম্ভাবনা পূর্ব বাঙলা থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উচ্ছেদের ফলে শেষ হয়েছে। কিন্তু তবু একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সাম্প্রদায়িকতার সামাজিক ও আর্থিক ভিত্তিভূমি বিনষ্ট হলেও উপরিকাঠামো অর্থাৎ চিন্তার অভ্যাস, ভীতি- চেতনা ইত্যাদির মধ্যে এখনো সাম্প্রদায়িক প্রভাব খুবই প্রতিপত্তিশালী। এর ফলে আমাদের সংস্কৃতি-চেতনা, রাজনৈতিক ভাবনা ইত্যাদির ক্ষেত্রে আবার সাম্প্রদায়িকতার সাময়িক প্রভাব বৃদ্ধির যথেষ্ট সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনা যে ভারত-বিরোধী প্রচারণার ফলে অনেকখানি বাস্তবরূপ নিয়েছে সেটা এখন আর অস্বীকার করার উপায় নেই।

এটা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কারণ ১৯৪৭ থেকে পাকিস্তানে সরকারীভাবে সাম্প্রদায়িক প্রচারণা এবং ভারতবিরোধী প্রচারণার মধ্যে কোন পার্থক্য থাকেনি। ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র এবং তার জনগণকে আমাদের শত্রু হিসেবে চিত্রিত করে পাকিস্তান সরকার যে ক্রমাগত প্রচারণা চালিয়েছিলো জনগণ তাঁদের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিচালনাকালে তাকে প্রতিরোধ করেছিলেন সত্য, কিন্তু তবু কোন জাতিই এত অল্পসময়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার মতো এতো দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক ব্যাধির হাত থেকে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করতে পারে না। সাম্প্রদায়িক প্রভাব আমাদের জনগণের চিন্তাভাবনার মধ্যে এখন পর্যন্ত যতখানি আছে ততখানি থাকার অন্যতম প্রধান কারণ এই যে, পূর্ব বাঙলায় পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন, বিশেষতঃ ১৯৭১ সালের সংগ্রাম, শ্রেণী-সংগ্রামের ভিত্তিতে জাতীয় প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হতে পারেনি। এ আন্দোলনে তাই উপরিকাঠামোর ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতাকে উপযুক্ত আঘাত হানার কোন প্রশ্ন ওঠেনি। উপরন্তু বর্তমান শাসকশ্রেণী এবং তাদের রাজনীতির মধ্যে সামন্তবাদের অবশেষসমূহের যথেষ্ট প্রভাবের ফলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এখন বাস্তবক্ষেত্রে প্রায় পরিত্যক্তই হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠনসমূহকে বে-আইনী ঘোষণা করা সত্ত্বেও একথা সত্য।

যাই হোক, সোজা কথা এই যে, উপরিকাঠামোর ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা আমাদের সমাজে এখনো উচ্ছেদ হয়নি এবং ভারত-বিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতা সেজন্যেই বর্তমান অবস্থায় একে অন্যটির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।

এ কথার উল্লেখ করার প্রয়োজন এ জন্যেই যে, আমাদের দেশে এখন বাম এবং দক্ষিণ দুই মহল থেকেই ভারত সম্পর্কে নানান বিরুদ্ধ বক্তব্য উপস্থিত করা হচ্ছে এবং প্রথমোক্ত মহলের অসাবধানতাবশতঃ তার পরিপূর্ণ সুফল বর্তাচ্ছে শেষোক্ত মহলের ওপর। বামপন্থী মহলের এ ব্যাপারে যে অনেক বেশী দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল সে কথা বলাই বাহুল্য।

অনেক সময় মূলবক্তব্য সঠিক হলেও সেই বক্তব্য জনগণের সামনে উপস্থিত করার সময় অনেকখানি কৌশলগত সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন হয়। এই সাবধানতার অভাব ঘটলে তার ফলাফল উলটো হতে বাধ্য এবং বাঙলাদেশে বর্তমানে বামপন্থী মহল ঢালাওভাবে যে ভারত-বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন তার ফলও প্রকৃতপক্ষে দাঁড়াচ্ছে উলটো। এই সুযোগে অনেক প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি, দল ও উপদল বামপন্থী মুখোশ পরে জনগণের চিন্তাকে সামগ্রিকভাবে অগণতান্ত্রিক পথে চালনা করার চক্রান্তে সূক্ষ্মভাবে নিযুক্ত হয়েছে। সাম্প্রদয়িক আওয়াজ তুলে তারা জনগণকে ভারত-বিরোধী (অর্থাৎ প্রত্যক্ষভাবে ভারত সরকার-বিরোধী হলেও প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় জনগণবিরোধী) ‘সংগ্রামের’ দিকে পরিচালনা করতে ‘উদ্বুদ্ধ’ করছে এবং তার ফলে আমাদের জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম অগ্রসর হচ্ছে না, উপরন্তু জনগণের সংগ্রামী উদ্যোগ দেশী ও বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির চক্রান্তের আবর্তে পড়ে দস্তুরমতো বিপথগামী হচ্ছে।

এসব কথার অর্থ এই নয় যে, ভারত-বাঙলাদেশ সম্পর্ক পর্যালোচনার সময় ভারতের কোন সমালোচনা করলেই সেটা সাম্প্রদায়িক হয়ে দাঁড়াবে। তা কখনো হতে পারে না। এখানে শুধু এ কথাটাই একটি গণতান্ত্রিক দায়িত্ব হিসেবে স্মরণ রাখতে হবে যে, ভারত-বিরোধী প্রচারণা অতি সহজেই সাম্প্রদায়িক প্রচারণায় পরিণতি লাভ করতে পারে এবং সেটা হলে তার রাজনৈতিক ফলাফল অগণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের হাতকে জোরদার করতে বাধ্য। এ জন্যেই ভারত-বাঙলাদেশ সম্পর্কে যে কোন আলোচনা প্রত্যেক ক্ষেত্রেই উপযুক্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দাঁড় করানো উচিত। শুধু তাই নয়, সেই তথ্যকে এমনভাবে বিশ্লেষণ করা উচিত যার দ্বারা সমগ্র আলোচনা, সমালোচনা, বক্তব্য ও প্রচারণা সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহের হাতকে জোরদার না করে গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে শক্ত বুনিয়াদের ওপর স্থাপন করে।

বাঙলাদেশের বামপন্থী মহলের ভারত-বিরোধী প্রচারণা এতদিন পর্যন্ত এই চেতনা এবং উদ্দেশ্যের দ্বারা যথাযথভাবে চালিত হয়নি। তার ফলে দক্ষিণপন্থী মহল এবং আমাদের জনগণের বৈদেশিক শত্রুরাই লাভবান হয়েছে। তাদেরকে এই মুনাফা থেকে বঞ্চিত করাই এখন বাঙলাদেশের বামপন্থী মহলের একটি অতি অবশ্য রাজনৈতিক দায়িত্ব।

সাপ্তাহিক স্বাধিকার
১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭২

সকল অধ্যায়

১. বাঙলাদেশে মার্কিন অনুপ্রবেশ
২. “গণমুখী” বক্তৃতা
৩. আওয়ামী লীগের জাতীয়করণ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে
৪. ভারত-বিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতা
৫. জাতীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ভূমিকা
৬. আওয়ামী লীগ সরকারের শ্রমনীতি
৭. সংবাদপত্র ও প্রকাশনার স্বাধীনতা
৮. আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত সংবিধান
৯. শাসনতন্ত্র প্রশ্নে বিরোধী দলগুলির ভূমিকা
১০. আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতি রক্ষা
১১. বাঙলাদেশের সংবিধান ও পরবর্তী নির্বাচন
১২. আইয়ুব খানের অস্ত্রাগার
১৩. আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণা
১৪. বাঙলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি
১৫. বাঙলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
১৬. বাঙলাদেশে শ্রমিক হত্যা
১৭. জাতি সমস্যা ও ভাষা আন্দোলন
১৮. আওয়ামী লীগের ‘শুদ্ধি অভিযান’ প্রসঙ্গে
১৯. মাধ্যমিক শিক্ষক ধর্মঘট প্রসঙ্গে
২০. মুদ্রাযন্ত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স ১৯৭৩
২১. ত্রিদলীয় ঐক্যজোট ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন
২২. ১৯৪৮ সাল থেকে পশ্চিম এশিয়ায় দু’ধরনের যুদ্ধ চলছে
২৩. বাঙলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি
২৪. বাঙলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি
২৫. ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন প্রসঙ্গে
২৬. সংসদীয় বিরোধী দলসমূহের ঐক্য প্রসঙ্গে
২৭. দালাল আইনে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি প্রসঙ্গে
২৮. জনগণ গণতান্ত্রিক বিরোধী দলগুলির ঐক্য কেন চাইছেন?
২৯. ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের তাৎপর্য
৩০. বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্বীকৃতি প্রসঙ্গে
৩১. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও বাঙলাদেশের স্বাধীনতা
৩২. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ও বাঙলাদেশে সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব
৩৩. সাম্রাজ্যবাদের যুগে জাতীয়তাবাদ
৩৪. গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বতঃস্ফূর্ততা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন