বদরুদ্দীন উমর
বাঙলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলি, বিশেষতঃ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এবং সামগ্রিকভাবে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি আজ এক সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এই সংকট একদিকে দলগুলির লক্ষ্যহীনতা ও নৈরাজ্যিক কার্যকলাপ এবং অন্যদিকে বিরোধী দলগুলির অনৈক্য ও নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে উত্তরোত্তর প্রতিফলিত হচ্ছে।
নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি শাসিত যে-কোন দেশে মোটামুটি একই শ্রেণীর শাসন কায়েম থাকলেও সেখানে কোন একটি রাজনৈতিক দলই শাসনতন্ত্রকে নিজেদের দলীয় শাসনতন্ত্র মনে করে না। এজন্যে প্রতিষ্ঠিত শাসনতন্ত্রের প্রতি অনুগত দুই বা ততোধিক রাজনৈতিক দলগুলির কখনো একটি কখনো বা অপরটি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে। অন্য শ্রেণীর ক্ষমতা লাভের ক্ষেত্রে তারা যেমন সমান উৎসাহ এবং সক্রিয়তার সাথে বিরোধিতা করে তেমনি একই শ্রেণীভুক্ত রাজনৈতিক দল হিসেবে পরস্পরের বিরোধিতা করলেও মৌলিক শ্রেণীগত প্রশ্নে তারা পরস্পরের সাথে সহযোগিতা করে। এই বিরোধিতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতেই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়।
ভারতবর্ষ বিভক্ত হওয়ার পর পাকিস্তানে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা লাভ করতে না পারার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল মুসলিম লীগ কর্তৃক পাকিস্তান রক্ষার দায়িত্ব একতরফা ও এককভাবে গ্রহণ করা। অন্য কোন বিরোধী রাজনৈতিক দল যে পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকতে পারে এ কথা তারা স্বীকার করতো না। এজন্যে সরকার ও রাষ্ট্রকেও তারা দেখতো এক করে। যে দেশের সরকার নিজের স্বার্থের সাথে রাষ্ট্রের স্বার্থকে এক করে দেখে সে দেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ মোটেই সম্ভব নয়। পাকিস্তানেও তা সম্ভব হয়নি। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে পূর্ব বাঙলায় বাঙলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পাকিস্তান রাজনীতির উপরোক্ত লক্ষণটি বাঙলাদেশেও প্রকটিত হচ্ছে। এখানেও আওয়ামী লীগ বাঙলাদেশ রাষ্ট্র রক্ষার দায়িত্ব নিজেরাই গ্রহণ করেছে (ত্রিদলীয় ঐক্যজোটের অন্য দল দুটিকে এ ক্ষেত্রে সরকারী দলেরই অঙ্গীভূত বলে ধরা যেতে পারে) এবং পাকিস্তানী আমলের মতো এখনও আওয়ামী লীগ সরকারের স্বার্থকে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সাথে প্রায় এক করেই দেখা হচ্ছে; এজন্যে পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগই যেমন ছিলো একমাত্র দেশপ্রেমিক প্রতিষ্ঠান (পরবর্তীকালে জামাত, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি এই জাতীয় দেশপ্রেমিকদের খাতায় নাম লিখিয়েছিলো) তেমনিই বাঙলাদেশেও এখন আওয়ামী লীগ এবং ত্রিদলীয় ঐক্য জোটে তার অঙ্গীভূত অন্য দুটি রাজনৈতিক দল (মস্কোপন্থী ন্যাপ ও বাঙলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি) হলো দেশপ্রেমিক প্রতিষ্ঠান। অন্য কোন রাজনৈতিক দলের যে দেশপ্রেম থাকতে পারে এ কথা সরকারী ঐক্যজোট কর্তৃক মোটেই স্বীকৃত নয়।
এই রাজনৈতিক আবহাওয়া (যা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সরকারী দলগুলির দায়িত্ব সর্বাধিক এবং মৌলিক) যে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রসার ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মোটেই সহায়ক নয়, উপরন্তু তার পরিপন্থী সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।
বাঙলাদেশে বিরোধী নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলির অক্ষমতা, নিষ্ক্রিয়তা এবং অনৈক্য লক্ষ্য করে সরকারী দলগুলি বর্তমানে উল্লসিত। এই উল্লাসের একটা সঙ্গত কারণ যেমন আছে তেমনি সেই কারণের মধ্যেই আবার নিহিত আছে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি পরিপূর্ণ বিলুপ্তির সম্ভাবনা। সঙ্গত কারণটি এই যে, বিরোধী দলগুলির দুর্বলতার ফলে তাদের শক্তির অভাব, অনৈক্য ইত্যাদির জন্যে তারা এখনো পর্যন্ত বাঙলাদেশে আওয়ামী লীগের বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদেরকে দাঁড় করাতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও যে পারবে সেটাও মনে হয় না। অন্যদিকে এর মধ্যেই নিয়তান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলিকে শক্তি সঞ্চয় করতে সাহায্য করা তো দূরের কথা সেক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ দেশময় যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে তার ফলে আওয়ামী লীগ নিজেও একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে গঠিত হতে পারবে না। নিয়তান্ত্রিক দলের কাঠামো সত্ত্বেও সরকারী দল হিসেবে তারা উত্তরোত্তর অনিয়মতান্ত্রিক কর্মপদ্ধতি ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিয়মতন্ত্র ও নিজেদের দ্বারাই প্রবর্তিত শাসনতান্ত্রিক রাজনীতির মূলে কুঠারাঘাত করবে। এর ফলে বিরোধী শক্তিসমূহ সামগ্রিকভাবে দুর্বল না হলেও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও বিলুপ্ত হবে। বাঙলাদেশে আজ যে সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে তার মধ্যে আমরা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির এই ক্রমশঃ বিলুপ্তিই লক্ষ্য করছি। নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী দলগুলির অনৈক্য এবং অন্যান্য সমস্যাগুলিকে এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে।
নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি শাসনতন্ত্রে নিষিদ্ধ নেই। উপরন্তু তা বর্তমান শাসনতন্ত্রসম্মত। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে বাঙলাদেশে আজ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির কোন সম্ভাবনা নেই। এই অবস্থার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েই বাঙলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলির প্রত্যেকটি ঘুরপাক খাচ্ছে। তাদের লক্ষ্যহীনতা, তাদের অনৈক্য, তাদের কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা সবকিছুই এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের বিকাশ একমাত্র ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতেই সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে প্রয়োজনীয়তার অভাবে সমাজতান্ত্রিক দেশে এবং উপযুক্ত সমাজভূমির অবর্তমানে আধা-সামন্ততান্ত্রিক ও নয়া ঔপনিবেশিক দেশসমূহে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্র কোন ক্ষেত্রেই প্রস্তুত হয়নি। এ জন্যে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে প্রচলিত হয় এক দলীয় রাজনীতি এবং আধা-সামন্ততান্ত্রিক ও নয়া ঔপনিবেশিক দেশসমূহে বহু দলের অস্তিত্ব অনেক সময়ে থাকলেও বাস্তবপক্ষে সেই সব দেশে এক ধরনের একদলীয় রাজনীতি কায়েম থেকে অন্য কোন নিয়মতান্ত্রিক দলের উপযুক্ত বিকাশ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনাকে প্রত্যক্ষভাবে ঠেকিয়ে রাখে।
নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী দলের বিকাশকে এইভাবে রুদ্ধ করার ফলে বিরোধিতাকে অবশ্য ঠেকিয়ে রাখা যায় না। এর ফলে বিরোধিতার চরিত্র পরিবর্তিত হয় মাত্র। অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে সরকার বিরোধিতা নিয়মতান্ত্রিক পথে শক্তিশালী না হয়ে অনিয়মতান্ত্রিক পথেই ক্রমাগতভাবে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে এবং তার পরিণতিতে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির কাঠামো এই ধরনের দেশগুলিতে সম্পূর্ণভাবে ধ্বসে পড়ে।
বাঙলাদেশে সংখ্যার দিক থেকে নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের কোন অভাব নেই। এগুলির মধ্যে কোন কোনটি পুরাতন, কোনটি নোতুন। কোনটি অপেক্ষাকৃত জনপ্রিয় ও সংগঠিত, কোনটি একেবারেই ভূঁইফোড় চরিত্রের। কোন কোনটি জন্মলগ্ন থেকেই মৃত অথবা মৃতপ্ৰায়।
কোনটি জন্মের পর কিছু শোরগোল তুলে, আওয়ামী লীগের একটা বিকল্প হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাতে সমর্থ হয়ে তার পরবর্তী পর্যায়ে আবার লক্ষ্যহীন, নিষ্ক্রিয় এবং অর্ধমৃত। এদিক দিয়ে বিভিন্ন নিয়মতান্ত্রিক দলগুলির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য দেখা গেলেও মূলগতভাবে তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কারণ আপাতদৃষ্টিতে এদের মধ্যে একটিকে বা একাধিককে সম্ভাবনাময় মনে হলেও বাস্তবতঃ এদের কোনটিরই কোন রাজনৈতিক সম্ভাবনা বাঙলাদেশে নেই। এই জিনিসটি লক্ষ্য করে সরকারী দল আওয়ামী লীগ এবং তার দুই অঙ্গদল মনে করছে যে, শুধু তাদের বিরোধী দলগুলির কোন রাজনৈতিক সম্ভাবনা না থাকার ফলে তাদের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাদের রাজনৈতিক শক্তির বুনিয়াদ আরও মজবুত হচ্ছে। এজন্য তারা উল্লসিত।
কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারী দলগুলির উল্লাসের কোন কারণ নেই। যে প্রক্রিয়ার জন্যে নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী দলগুলির কোন রাজনৈতিক সম্ভাবনা এদেশ থেকে এখন তিরোহিত হয়েছে সেই প্রক্রিয়া জারি থাকার ফলে তার দ্বারা সরকারী দলগুলিও নিয়মতান্ত্রিক দল হিসেবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে পরিণত হচ্ছে অনিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে। এর ফলে উত্তরোত্তর তারা যে সমস্ত কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করছে, যে কৌশল উদ্ভাবন করছে এবং আইন-শৃঙ্খলার প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন এবং শাসনতান্ত্রিক নীতিসমূহ ভঙ্গের মাধ্যমে তারা বিরোধী দলগুলিকে যেভাবে আঘাত করে নিজেদের ঘর গোছাতে যত্নবান হয়েছে তার পরিণতিতে একদিকে সকল নিয়মতান্ত্রিক দল বাস্তবক্ষেত্রে উচ্ছেদ হয়ে যাবে এবং সেই সাথে আওয়ামী লীগও নিয়মতান্ত্রিকতার বাহ্য আড়ম্বর পরিত্যাগ করে পরিণত হবে একটি অনিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগঠনে।
বাঙলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির এই সম্ভাবনা ও পরিণতির ফলে এ দেশে অতি অল্পদিনের মধ্যেই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির অবক্ষয় চরম পর্যায়ে উপনীত হবে এবং এ দেশের রাজনীতি পরিগ্রহ করবে এক সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিক চরিত্র। এই অনিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে এক পক্ষে থাকবে সরকারী দল বা দলসমূহের ঐক্যজোট এবং অন্যদিকে থাকবে বর্তমান নিয়মতান্ত্রিক দলগুলির পরিবর্তে এক বা একাধিক অনিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। এই অনিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলির পারস্পরিক সংঘর্ষই হবে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূল রূপ।
বঙ্গবার্তা
৯ই নভেম্বর, ১৯৭৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন