বদরুদ্দীন উমর
পশ্চিম এশিয়ায় আরব-ইসরাইল সংঘর্ষের পর এবার নিরাপত্তা পরিষদ চতুর্থবারের মতো যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে। কিন্তু চতুর্থবার হলেও এ যুদ্ধবিরতি যে ঐ এলাকায় সর্বশেষ যুদ্ধবিরতি নয়, সেটা ইতিমধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। প্রকৃতঃপক্ষে এ ধরনের যুদ্ধবিরতি সংঘর্ষকে জীইয়ে রাখার উদ্দেশ্যেই প্রণোদিত, স্থায়ী শান্তির উদ্দেশ্যে নয়। শুধু তাই নয়, এই ধরনের যুদ্ধ যাদের মুরুব্বীয়ানায় বাধে এবং যুদ্ধবিরতি যাদের নিজেদের আপস আলোচনার মাধ্যমে ঘোষিত হয় তারা প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধলিপ্ত দেশগুলোকে যে নিজেদের স্বার্থে দাবার ঘুঁটির মতোই ব্যবহার করে এ সত্য পশ্চিম এশিয়ায় আবার একবার নোতুন করে প্রমাণিত হলো।
পশ্চিম এশিয়ায় ১৯৪৮ সাল থেকে দুই ধরনের যুদ্ধ চলছে। এক ধরনের যুদ্ধ স্বল্পস্থায়ী। বারবার যেমন এ যুদ্ধ হচ্ছে তেমনি যুদ্ধ বিরতিও বারবার হচ্ছে। অন্য এক ধরনের যুদ্ধ সেখানে ক্রমাগত। তার কোন বিরতি নেই। যত ছোট আকারেই হোক, আঘাত হানার ক্ষমতা তাদের যত অল্পই হোক, তারা ১৯৪৮ সালে অস্ত্র হাতে নেওয়ার পর থেকে সে অস্ত্র আর সংবরণ করেনি। যখনই পশ্চিম এশিয়ায় আরব-ইসরাইল বৃহৎ সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়েছে তখন তাতে তারা নোতুন উদ্যমে শরীক হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধবিরতির পর তাদের সে উদ্যম থাকেনি, যুদ্ধবিরতি তারা মানেনি। ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইনীয়ন গেরিলাদের এই যুদ্ধ ১৯৪৮ সাল থেকে আজও পর্যন্ত অবিরত আছে।
এক ধরনের যুদ্ধে বিরতি আছে এবং অন্য ধরনের যুদ্ধে কোন বিরতি নেই, অথচ এ দুই ধরণের যুদ্ধই বাহ্যত ইসরাইলের বিরুদ্ধে। এই তারতম্য ও পার্থক্যের কারণ, প্রথম ধরনের যুদ্ধে পৃথিবীর বৃহৎ ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্ণায়ক প্রভাব আছে কিন্তু দ্বিতীয় ধরনের যুদ্ধে সে গুরুত্ব অথবা প্রভাব কিছুই নেই। উপরন্তু সে যুদ্ধ শুধু ইসরাইলের বিরুদ্ধে নয়, ইসরাইলের জন্মদাতা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের বিরুদ্ধেও। সে যুদ্ধ ইসরাইল এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সমান তীব্রতা ও শত্রুতার সাথে পরিচালিত।
পশ্চিম এশিয়ায় চতুর্থ আরব-ইসরাইল যুদ্ধ বিরতির তাৎপর্য উপলব্ধির জন্যে এই দুই ধরনের যুদ্ধের প্রকৃতি অনুধাবন বিশ্বের যে-কোন দেশের জনগণ এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিসমূহের এক অপরিহার্য কর্তব্য।
আরব-ইসরাইল বৃহৎ সংঘর্ষের ক্ষেত্রে, অর্থাৎ যে সংঘর্ষগুলো ১৯৫৬ সাল থেকে শুধু হয়েছে সেই সংঘর্ষের ক্ষেত্রে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকেছে। শুধু একুটু বললে কথাটি সঠিকভাবে বলা হয় না। কারণ বস্তুতঃপক্ষে এই দুই বৃহৎ শক্তির অর্থনৈতিক এবং সামরিক ‘সাহায্য’ ব্যতিরেকে এইসব সংঘর্ষ ঘটেনি। যুদ্ধের পূর্বাবস্থায় যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রধান প্রধান আরব রাষ্ট্রগুলোকে অস্ত্র সাহায্য দিয়ে এসেছে তেমনি যুদ্ধকালীন অবস্থাতেও ক্ষতিপূরণের উদ্দেশ্যে তারা নিজেদের অস্ত্রের সরবরাহকে শুধু যে অব্যাহত রেখেছে তাই নয়, উপরন্তু সে সরবরাহকে আরও ব্যাপক এবং ত্বরান্বিত করেছে।
এ ধরনের মার্কিন ও সোভিয়েত সরবরাহ পশ্চিম এশিয়ায় আরব ইসরাইল সংঘর্ষের ক্ষেত্রে কোন ব্যতিক্রম অথবা নোতুন জিনিস নয়। চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, কিউবা, আলজিরিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন দেশের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে এ ধরনের অস্ত্র সরবরাহ দুই পক্ষকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন যথাক্রমে করে এসেছে। কাজেই এই সরবরাহের দ্বারা পশ্চিম এশিয়ায় এই পৌনঃপুনিক সংঘর্ষ এবং যুদ্ধবিরতির চরিত্রকে ঠিক বোঝা যাবে না। এক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো যুদ্ধের মেয়াদ, তার স্বল্পকাল স্থায়িত্ব।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর পক্ষে দখলভুক্ত দেশগুলোতে প্রত্যক্ষ শাসন বজায় রাখা নানা কারণে অসম্ভব হয়ে ওঠে। কাজেই তারা ‘উদারনীতি’ অবলম্বন করে তাদের অধীনস্থ দেশগুলোকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দানের সিদ্ধান্ত নেয় এবং অল্প কয়েক বৎসরের মধ্যেই বৃটেন, ফ্রান্স, হল্যান্ড, ইত্যাদি সেই সিদ্ধান্তকে কার্যকর করে। এর দ্বারা তাদের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক শাসন ও প্রশাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটলেও শোষণ তাদের অব্যাহত থাকলো। পূর্ববর্তী উপনিবেশগুলো পরিণত হলো বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের নয়া উপনিবেশে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এই নয়া ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই দ্রুতগতিতে প্রাধান্য লাভ করে। তার নোতুন স্বাধীনতা প্রাপ্ত’ দেশগুলোতে ‘সাহায্যের’ থলি নিয়ে হাজির হয়ে সেখানকার জনগণকে লুণ্ঠনের বিবিধ ব্যবস্থা কায়েম করতে উদ্যোগী এবং সক্ষম হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘নীতি’ এবং ‘উদ্যোগেরই’ অন্যতম বহিঃপ্রকাশ বিভিন্ন অনুন্নত অর্থাৎ সামন্তবাদ সাম্রাজ্যবাদ কবলিত প্রতিবেশী দেশসমূহের মধ্যে স্বল্পকালীন যুদ্ধ। এ ধরনের যুদ্ধ যে শুধু পশ্চিম এশিয়ায় বারংবার সংঘটিত হয়েছে তাই নয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ইত্যাদি সমস্ত এলাকাতেই তারা হয় এ ধরনের যুদ্ধ বাধিয়ে রেখেছে অথবা বাধাবার জন্যে প্রয়োজন অনুযায়ী সচেষ্ট ও সতর্ক আছে।
কিন্তু এ ধরনের স্বল্পকাল স্থায়ী যুদ্ধ কতকগুলো প্রতিবেশী দেশের মধ্যে লাগিয়ে দেওয়া অথবা লাগানোর চেষ্টা চালানোর প্রয়োজন কি? কোন কোন ক্ষেত্রে কেন একই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দুই পক্ষকেই অস্ত্র ও সামরিক সাহায্য সরবরাহ করে তাদেরকে পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হতে প্ররোচিত করে আসছে এবং কেনই বা তারা আবার মুরব্বীর ভূমিকায় যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টায় নিযুক্ত হয়ে শান্তির দূত হিসেবে নিজেদেরকে জাহির করছে?
এ বিষয়ে ধারণা পরিষ্কার করার জন্য প্রথমেই একটা জিনিস লক্ষ্য করা দরকার। সে জিনিসটি হলো যে, এই ধরনের স্বল্পকাল স্থায়ী যুদ্ধের পর সংঘর্ষে লিপ্ত দেশগুলো তাদের অস্ত্র সরবরাহকারী ও ‘সাহায্যকারী’ দেশগুলোর ওপর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পূর্বাপেক্ষা অধিকতর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে শুধু যে তারা সামরিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাই নয়। এর ফলে তাদের অর্থনৈতিক কাঠামোও অনেকখানি দুর্বল হয়ে পড়ে, অনেক ক্ষেত্রে ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়। এই দুর্বলতা ও ধ্বংসের হাত থেকে এবং বিশেষ করে তার পরিণতিতে ঐ সমস্ত এলাকার জনগণের সংগ্রামী আঘাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্যে তারা সাম্রাজ্যবাদের ‘সাহায্যের’ ওপর পূর্বের থেকে অনেক বেশী নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং সেই সাহায্যের সিঁড়ি বেয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো অনুন্নত দেশগুলোর ওপর অধিকতর প্রতিপত্তির সাথে চড়াও হয়।
এর থেকে যে কথাটি বেরিয়ে আসে তা হলো এই যে, এই ধরনের স্বল্পকাল স্থায়ী যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে সংঘর্ষে লিপ্ত দেশগুলোর একটি অথবা উভয়ের সাথে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অথবা শক্তিসমূহের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এই অবনতিকে রোধ এবং সেইসব দেশে নিজেদের অবস্থানের উন্নতি ও প্রভাবের বৃদ্ধির জন্যই তারা এ ধরনের যুদ্ধ বাধায়। এ জন্যেই এ ধরনের যুদ্ধ সর্বক্ষেত্রেই নিশ্চিতভাবে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তেরই প্রত্যক্ষ ফল।
এই সমস্ত কথা স্বরণে রেখে যদি ১৯৭৩ সালে পশ্চিম এশিয়া যুদ্ধের পূর্ববর্তী পর্যায়ে আরব তৈল রপ্তানীকারী দেশগুলোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের তৈল কোম্পানীগুলোর এবং কতকগুলো আরব রাষ্ট্র, বিশেষতঃ মিসরের সাথে, সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্কের অবনতির কথা বিবেচনা করা যায় তাহলে এই চতুর্থ যুদ্ধ বিরতির প্রকৃত চরিত্রও যে উদ্ঘাটিত হবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
দৈনিক বঙ্গবার্তা
৩১শে অক্টোবর, ১৯৭৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন