আওয়ামী লীগের জাতীয়করণ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে

বদরুদ্দীন উমর

আওয়ামী লীগের জাতীয়করণ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে

বাঙলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের ‘প্রথম পদক্ষেপ’ হিসেবে শিল্প, ব্যাংক, বীমা ইত্যাদি জাতীয়করণের যে নীতি ঘোষণা করেছেন, সে নীতিকে কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফ্ফর গ্রুপ) এবং তাদের অধীনস্থ অন্যান্য ছাত্র ও শ্রমিক সংস্থা নির্দ্বিধায় সমর্থন জানিয়েছিলো। সে সমর্থন এই সমস্ত আওয়ামী লীগ বশংবদ সংগঠনগুলি প্রত্যাহার করে নিয়েছে একথা বললে ভুল হবে। কিন্তু সমর্থন প্রত্যাহার না করলেও আওয়ামী লীগের জাতীয়করণ পরিকল্পনা যে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথে কোন মহাপদক্ষেপ নয় একথা তাদের পক্ষেও অস্বীকার করা আজ মুশকিল হয়ে পড়েছে। তারাও আজ একথা উপলব্ধি করছে যে, আওয়ামী লীগের নির্ভেজাল চাটুকার হিসেবে এদেশের রাজনীতিতে মূল বিস্তার করা তাদের দ্বারা আর সম্ভব নয়। সীমিতভাবে তাদের বিরোধিতা করা নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে তারা আজ কিছুটা প্রয়োজন মনে করছে এবং এই প্রয়োজনের তাগিদে তারা অন্যান্য বিষয় থেকে সরকারের জাতীয়করণ পরিকল্পনার সমালোচনার দিকেই যৎসামান্য নজর দিয়েছে।

এক্ষেত্রে সরকারের এই বশংবদ দলগুলির উল্লেখ করার উদ্দেশ্য জাতীয়করণ নীতি সম্পর্কে তাদের বক্তব্য আলোচনা নয়। এর উদ্দেশ্য হলো এটা দেখানো যে, জাতীয়করণ পরিকল্পনার সত্যিকার চরিত্র আজ জনগণের কাছে এতখানি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, চাটুকারদের পক্ষেও এ বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকা আর সম্ভব হচ্ছে না। ঔদাসীন্য কাটিয়ে এরা আজ যে কথাগুলি বলার চেষ্টা করছে সেগুলি সম্পর্কে পূর্বেই আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি। সে সময়ে এই দলগুলি আমাদের সমালোচনার কঠোর সমালোচনা করতে এগিয়ে এসেছে এবং পারিষদীয় কায়দায় বাবুদেরকে বাঁচিয়ে শতগুণ উৎসাহে অনেক কিছু বলেছে।

এখন প্রশ্ন হলো মাত্র কয়েকমাস পর উপরোক্ত দলগুলির আশাবাদ আজ অস্বস্তিতে পরিণত হলো কেন? এই ‘কেন’র জবাব পাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের জাতীয়করণ পরিকল্পনা সম্পর্কে কতকগুলি কথা বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে।

প্রথমেই বোঝা দরকার যে, কোন কিছুকে রাষ্ট্রায়ত্ত করার নামই সমাজতন্ত্র নয়। রাষ্ট্র নিজে যতক্ষণ পর্যন্ত না এক বিশেষ চরিত্র পরিগ্রহ করছে, শ্রেণীশোষণের অবসান ঘটিয়ে তা শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে সংগঠিত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সমাজতন্ত্রের কথা বলা শঠতা ও বাচালতা ব্যতীত আর কিছুই নয়। এজন্যে শিল্প, বাণিজ্য, ব্যাংক, বীমা ইত্যাদি জাতীয়করণ কখনো সমাজতন্ত্রের পথে প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে না। সমাজতন্ত্রের পথে প্রথম সঠিক পদক্ষেপ হলো শ্রেণী-সংগ্রামের মাধ্যমে এবং শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে সামন্তবুর্জোয়া রাষ্ট্রের পরিবর্তে শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত জনগণের রাষ্ট্র কায়েম করা। শ্রমিকশ্রেণীর নিজের হাতে রাষ্ট্রের নেতৃত্ব না আসা পর্যন্ত কোন কিছু রাষ্ট্রায়ত্তকরণের অর্থ সমাজতন্ত্রের পথে পদক্ষেপ নয়, উপরন্তু তা হলো সমাজতন্ত্রে উত্তরণের প্রথম পদক্ষেপ– সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার থেকে জনগণের দৃষ্টিকে সরিয়ে রাখার অপচেষ্টা।

বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকারের জাতীয়করণ নীতি যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে সে পরিস্থিতির মধ্যে তাই বিস্ময়কর কিছু নেই। তা অত্যন্ত প্রত্যাশিত এবং স্বাভাবিক। কারণ যে রাষ্ট্র আজ বিভিন্ন শিল্প, বাণিজ্য ও আর্থিক সংস্থাগুলি জাতীয়করণ করেছে সে রাষ্ট্রের নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক শ্রেণী নেই, আছে সামন্ত-বুর্জোয়া শ্রেণী। কাজেই তাদের নিজেদের দ্বারা রচিত যে-কোন নীতির মতো এই জাতীয়করণ নীতি তাদের নিজেদের শ্রেণীস্বার্থেই বিশেষভাবে পরিচালিত হওয়ার কথা এবং যা হওয়ার কথা প্রকৃতপক্ষে তাই হচ্ছে। সমাজতন্ত্রে উত্তরণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে যে জাতীয়করণ নীতি ঘোষিত হয়েছিলো যে নীতি আজ জনগণের কোন উপকারে আসেনি, উপরন্তু তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়েছে।

এই সাধারণ মন্তব্যের পর এবার বর্তমান সরকারের জাতীয়করণ নীতির কতকগুলি বিশেষ দিক সম্পর্কে খুব সংক্ষেপে উল্লেখ করা যাক।

প্রথমেই যে বিষয়টি এক্ষেত্রে চোখে পড়ার মতো তা হলো সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের প্রতি সরকারের নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব। বাঙলাদেশের চা-শিল্পের গরিষ্ঠ স্বার্থ এখনো বৃটিশ চা- বাগান মালিকদের। এই স্বার্থে সরকার কোন আঘাত দেয়নি। সরকারপক্ষীয় কোন কোন ব্যাখ্যাকার বলেছেন যে, চা-শিল্প এখন লোকসানের মুখে। কাজেই তা জাতীয়করণ করার অর্থ লোকসান জাতীয়করণ করা। এজন্যেই সরকার চা-বাগানগুলি জাতীয়করণ না করে পূর্ববর্তী মালিকদেরকেই বহাল রেখেছে। এই যুক্তি যে নিতান্তই শঠতাপূর্ণ তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ বিদেশী সম্পত্তি জাতীয়করণের যে-কোন নীতি মূলতঃ রাজনৈতিক, দেশের অর্থনীতিতে বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপ বন্ধ করার ক্ষেত্রে তা হলো এক অপরিহার্য পদক্ষেপ। যে-সমস্ত দেশ সমাজতান্ত্রিক শক্তিসমূহের অর্থাৎ শ্রমিক-কৃষক নেতৃত্বে জাতীয়করণ নীতি গ্রহণ করেছে তারা কোন সময়েই দেশীয় শিল্প জাতীয়করণ করে বিদেশী শিল্প-বাণিজ্য আর্থিক সংস্থাসমূহকে তার আওতার বাইরে রাখেনি। ছোট দেশ কিউবার উদাহরণ এদিক থেকে খুবই উল্লেখযোগ্য।

বাঙলাদেশে কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের ওপর কোন আঘাত বর্তমান সরকার দেয়নি। শুধু আঘাত দেয়নি তাই নয়, তাদের স্বার্থে যাতে কোনরকম আঁচড় না লাগে সেদিকে তারা সতর্ক দৃষ্টি দিয়েছে। এজন্যে মার্কিন শিল্প, ব্যাংক, বীমা ইত্যাদি জাতীয়করণের কোন ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ সরকারের সমাজতন্ত্র উত্তরণের ‘প্রথম পদক্ষেপ’ জাতীয়করণ নীতির মধ্যে নেওয়া হয়নি। বৃটিশ-মার্কিন স্বার্থ তাই বাঙলাদেশে পাকিস্তান আমলের মতোই নিরাপদ।

বৃটিশ-মার্কিন স্বার্থের এই নিরাপত্তার কারণ কি এই নয় যে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার সাম্রাজ্যবাদের অতিশয় বশংবদ? এর অর্থ কি এই নয় যে, বক্তৃতা-বিবৃতিতে বৃটিশ এবং বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে যত সমালোচনাই তাঁরা করুন না কেন আসলে তাঁদের গাঁটছড়া এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির সাথেই বেদম জোরে বাঁধা?

এর অর্থ যে অন্য কিছু নয় তার প্রমাণ বাঙলাদেশে মার্কিন-বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আর্থিক সংস্থাগুলির বর্তমান ভূমিকা। সাম্রাজ্যবাদীদের এই ভূমিকা যে পাকিস্তানী আমলে আমাদের দেশে তাদের ভূমিকা থেকে কোন অংশে জনগণের স্বার্থের পক্ষে বেশী অনুকূল নয় একথা বলাই বাহুল্য। ঋণ এবং তথাকথিত সাহায্যের জালে বাঙলাদেশকে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলে আমাদের জনগণকে শোষণ করার যে সুপরিচিত পরিকল্পনা তারা গ্রহণ করেছে, সেই পরিকল্পনাক্ষেত্রে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার হলো তাদের সক্রিয় সহযোগী।

জাতীয়করণ প্রসঙ্গে যে দ্বিতীয় জিনিসটি উল্লেখ করা দরকার তা হলো আওয়ামী লীগের ভূমি-নীতি। সরকার ঘোষণা করেছেন যে, পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত যাঁদের জমি আছে তাঁদের ভূমি-খাজনা মাফ করা হবে এবং পরিবার প্রতি একশো বিঘার ওপর জমি সরকার নিজের হাতে নিয়ে এসে তা ভূমিহীন ও গরীব কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করবেন। এ ছাড়া কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকার সমস্ত কিছু করার প্রতিশ্রুতিও প্রদান করেছেন।

কিন্তু সরকারের এই সমস্ত নীতি, বক্তব্য এবং প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও কৃষি, অর্থনীতি ও কৃষি- উৎপাদন ক্ষেত্রে আজ কি ঘটছে? এক্ষেত্রে যে আশাপ্রদ কিছুই ঘটছে না তার প্রমাণ আওয়ামী লীগের চাটুকারদের অস্বস্তিসূচক মৃদু চিৎকার। যদি কৃষিক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সামান্য কিছু পরিবর্তনও আসতো অথবা সে পরিবর্তন আসার কোন আশু সম্ভাবনা থাকতো তা হলে এরা এতটুকু মৃদু চিৎকার করতেও সাহস করতো না। সে সাহস করতে তারা এখন বাধ্য হচ্ছে। কারণ আওয়ামী লীগের ভূমি-নীতি যে কৃষকদের জন্য কোন বড়ো অথবা মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারেনি এবং সে পরিবর্তন আনার সম্ভাবনাও সুদূরপরাহত একথা সকলের কাছেই এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কাজেই চাটুকাররা গা-বাঁচিয়ে বলছে আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমি-নীতি খুব ভালো। কিন্তু সঠিকভাবে তাকে কার্যকর করার দিকে কারো নজর নেই। আমাদের কৃষি-সমস্যার যা বর্তমান চরিত্র তাতে পঁচিশ বিঘা জমির খাজনা মাফ, উৎপাদন ব্যবস্থা অথবা কৃষকদের অবস্থার মধ্যে কোন পরিবর্তনই আনতে পারে না। তা ছাড়া ভূমিহীন কৃষক ও বর্গাদারদেরকে এই খাজনা মওকুফের ফায়দা একেবারেই স্পর্শ করে না। তাদেরকে যা কিছুটা স্পর্শ করতে পারে তা হলো সরকারের অতিরিক্ত জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ। কিন্তু এই অতিরিক্ত জমি সরকার কর্তৃক সংগ্রহের ক্ষেত্রে আজ কি ঘটছে?

১৯৫০ সালে নূরুল আমীন সরকারের মতো এই সরকারও পরিবার প্রতি জমির ঊর্ধ্বতম পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন একশো বিঘা। বাঙলাদেশে জমির পরিমাণ মাথাপিছু এমনিতেই এত কম যে, একশো বিঘা জমি পরিবার প্রতি রাখার অনুমতি দেওয়ার পর যে পরিমাণ জমি সরকারের হাতে আসবে তার দ্বারা ভূমিহীনদের জমির চাহিদা মেটানোর প্রশ্ন ওঠে না। এর দ্বারা ঢাকা, ময়মনসিংহ ইত্যাদির মতো কয়েকটি জেলায় প্রকৃতপক্ষে কোন অতিরিক্ত জমি বিতরণের জন্যে সরকারের হাতে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কিন্তু সব থেকে বড়ো কথা হলো বর্গাপ্রথা উচ্ছেদ সম্পর্কে সরকারের সুস্পষ্ট নীতি এবং বক্তব্যের অভাব। তাঁরা যে ভূমি-নীতি ঘোষণা করেছেন তার ফলে একদিকে যেমন জমির মালিকেরা নানা প্রকার ফন্দির মাধ্যমে শুধু পরিবারপিছু একশো বিঘা নয়, আরও অনেক বেশী জমি নিজেদের হাতে রাখতে পারবে, তেমনি অন্যদিকে বর্গাপ্রথার মাধ্যমে ভূমিহীন ও গরীব কৃ ষকদের ওপর নিজেদের সামন্তশোষণও কায়েম রাখতে সক্ষম হবে। এই সামন্ত শোষণের ফলে আবার কায়েম থাকবে মহাজনী শোষণ। এইভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং সামন্তবাদের অবশেষ বর্গাদারী ও মহাজনী প্রথার আধিপত্য কৃষকজীবনে বজায় রেখে কৃষকদের শ্রেণীশত্রুরা গ্রামাঞ্চলে নিজেদেরকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে প্রতিষ্ঠিত রাখবে।

উপরোক্ত প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। এর ফলে অর্থনীতির ক্ষেত্রে উৎপাদন সম্পর্ক মোটামুটি অপরিবর্তিত থাকতে এবং উৎপাদন বৃদ্ধি শ্লথগতি হতে বাধ্য। এই অবস্থার ফলে একদিকে যেমন খাদ্য এবং অন্যান্য কৃষি উৎপন্ন দ্রব্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব হবে না, তেমনি অন্যদিকে কৃষি-উদ্বৃত্ত শিল্পখাতে নিয়োগ করে শিল্পের উন্নয়নের জন্য বিদেশের, বিশেষতঃ সাম্রাজ্যবাদের শক্তিসমূহের ওপর নির্ভরশীলতাও কমবে না। অর্থাৎ পাকিস্তানী আমলে পূর্ব বাঙলায় সামন্তশক্তি ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে যে সম্পর্ক ছিলো সে সম্পর্ক বাঙলাদেশেও মোটামুটিভাবে অটুট থাকবে।

সরকারের ভূমি-নীতির এই দিকটি যত স্পষ্ট হয়ে উঠছে ততই বিরোধী দলসমূহ এ বিষয়ে সোচ্চার হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এমন কি, বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফ্ফর গ্রুপ) ইত্যাদি আধা-সরকারী দলগুলি পর্যন্ত নিম্নকণ্ঠে সরকারের সমালোচনা না করে পারছে না।

আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান। কাজেই এ দেশের কৃষি-অর্থনীতির মধ্যে যতদিন পর্যন্ত না একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত বাঙলাদেশের অর্থনীতিকে সাম্রাজ্যবাদের কবলমুক্ত করার আস্ফালন হাস্যকর ব্যতীত কিছু নয়। এই হাস্যকর কাজই এখন সরকারীভাবে করা হচ্ছে। একদিকে সামন্তবাদী কৃষি-অর্থনীতিকে মোটামুটি টিকিয়ে রেখে, সাম্রাজ্যবাদের সাথে নানান অলিখিত আঁতাতে আবদ্ধ হয়ে, বর্তমান সরকার নিজের দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে দৃঢ় করছে। অন্যদিকে তারা সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অহরহ ‘সতর্কবাণী’ উচ্চারণ করে জনগণকে সর্বতোভাবে বিভ্রান্ত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের জাতীয়করণ পরিকল্পনা এবং কর্মসূচীর পর্যালোচনা করলেই তার সত্যিকার চরিত্র উপলব্ধি করা সম্ভব হবে। একমাত্র সেভাবেই বোঝা যাবে জনগণের জীবনের এই ‘মহা পরিকল্পনা’ এবং ‘সমাজতন্ত্রের’ পথে প্রথম পদক্ষেপের প্রকৃত অর্থ কি।

এই প্রসঙ্গে তৃতীয় আর একটি বিষয়ের উল্লেখ করা দরকার। এখন প্রায়ই বিভিন্ন মহল থেকে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে বলা হচ্ছে যে, সরকার যে সমস্ত শিল্প এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেছেন সেগুলিকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। শুধু তাই নয়। এই ষড়যন্ত্রের ফলে ইতিমধ্যেই জাতীয় অর্থনীতি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পদক্ষেপ হিসেবে জাতীয়করণ কর্মসূচী ব্যর্থ হতে চলেছে।

আওয়ামী লীগের জাতীয়করণ কর্মসূচীর এই পরিণতি যে ঘটবে সেটা পূর্বেই বলেছি। কারণ জাতীয়করণের ফলে যে-সমস্ত শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত হয়েছে সর্বক্ষেত্রে সেগুলি পরিচালনার দায়িত্ব এখন এক শ্রেণীর ব্যক্তি ও আমলাদের হাতে সরকার অর্পণ করেছে যারা সমাজতন্ত্রের ঘোর বিরোধী এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ঘোরতর উপাসক। এরা ছাড়া অন্যান্য অনেক সমাজবিরোধী ব্যক্তি এবং শক্তিও আজ উপরোক্ত সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে জড়িত। তারা নানাভাবে শিল্প, বাণিজ্য ও উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যাহত করছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প, বাণিজ্য ইত্যাদিকে উপরোক্ত শক্তিসমূহ স্বভাবতঃই জনগণের স্বার্থে পরিচালনা না করে এমন এক রাষ্ট্রের আয়ত্তাধীন স্বার্থ হিসেবে পরিচালনা করছে যে রাষ্ট্র শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত জনগণের নয়। এ ব্যবস্থা এমন এক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্রই পুঁজির মালিক এবং রাষ্ট্রের কর্ণধাররাই এই পুঁজির মুনাফাভোগী। সরকারের জাতীয়করণ কর্মসূচীর মুনাফা যে জনগণ আজও পাননি এবং পাওয়ার কোন সম্ভাবনাও তাঁরা দেখছেন না একথা কি এখন কাউকে বেশী করে বোঝানোর প্রয়োজন আছে?

আওয়ামী লীগের জাতীয়করণ পরিকল্পনা সম্পর্কে ওপরের আলোচনা থেকে যে জিনিসটি সুস্পষ্ট হচ্ছে তা হলো এই যে, এই পরিকল্পনা বাঙলাদেশ থেকে সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং পুঁজির শোষণকে কমিয়ে আনা অথবা বন্ধ করার মতো কিছুই করেনি। শুধু তাই নয়, এই পরিকল্পনা পূর্বের মতোই আমাদের দেশের জনগণকে সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং পুঁজির শোষণে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখারই মহাপরিকল্পনা।

আমাদের এই বক্তব্য যে কাল্পনিক নয়, বাস্তব অবস্থা এবং সঠিক তথ্যের ওপরেই তা প্রথম থেকেই প্রতিষ্ঠিত, তা এখন প্রমাণিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগের জাতীয়করণ কর্মসূচীর যে সমালোচনা আমরা করেছি সেই একই সূত্র ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী এবং ব্যক্তি এখন ধীরে ধীরে সমালোচনায় সোচ্চার হচ্ছেন। এই সমালোচনা যত দানা বাঁধবে, আরও যত তথ্যভিত্তিক হবে, ততই আমাদের দেশের জনগণ বুঝবেন যে, এই কর্মসূচী সমাজতন্ত্রে উত্তরণের প্রথম পদক্ষেপ নয়। এ পদক্ষেপ হলো বাঙলাদেশে শোষকশ্রেণীর শাসনকে আরও সুসংগঠিত করারই এক ব্যাপক এবং সুচতুর কর্মসূচী।

সাপ্তাহিক স্বাধিকার
৩রা সেপ্টেম্বর, ১৯৭২

সকল অধ্যায়

১. বাঙলাদেশে মার্কিন অনুপ্রবেশ
২. “গণমুখী” বক্তৃতা
৩. আওয়ামী লীগের জাতীয়করণ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে
৪. ভারত-বিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতা
৫. জাতীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ভূমিকা
৬. আওয়ামী লীগ সরকারের শ্রমনীতি
৭. সংবাদপত্র ও প্রকাশনার স্বাধীনতা
৮. আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত সংবিধান
৯. শাসনতন্ত্র প্রশ্নে বিরোধী দলগুলির ভূমিকা
১০. আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতি রক্ষা
১১. বাঙলাদেশের সংবিধান ও পরবর্তী নির্বাচন
১২. আইয়ুব খানের অস্ত্রাগার
১৩. আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণা
১৪. বাঙলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি
১৫. বাঙলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
১৬. বাঙলাদেশে শ্রমিক হত্যা
১৭. জাতি সমস্যা ও ভাষা আন্দোলন
১৮. আওয়ামী লীগের ‘শুদ্ধি অভিযান’ প্রসঙ্গে
১৯. মাধ্যমিক শিক্ষক ধর্মঘট প্রসঙ্গে
২০. মুদ্রাযন্ত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স ১৯৭৩
২১. ত্রিদলীয় ঐক্যজোট ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন
২২. ১৯৪৮ সাল থেকে পশ্চিম এশিয়ায় দু’ধরনের যুদ্ধ চলছে
২৩. বাঙলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি
২৪. বাঙলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি
২৫. ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন প্রসঙ্গে
২৬. সংসদীয় বিরোধী দলসমূহের ঐক্য প্রসঙ্গে
২৭. দালাল আইনে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি প্রসঙ্গে
২৮. জনগণ গণতান্ত্রিক বিরোধী দলগুলির ঐক্য কেন চাইছেন?
২৯. ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের তাৎপর্য
৩০. বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্বীকৃতি প্রসঙ্গে
৩১. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও বাঙলাদেশের স্বাধীনতা
৩২. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ও বাঙলাদেশে সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব
৩৩. সাম্রাজ্যবাদের যুগে জাতীয়তাবাদ
৩৪. গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বতঃস্ফূর্ততা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন