বদরুদ্দীন উমর
আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান সভায় বাঙলাদেশের জন্য একটা সংবিধান পেশ করেছেন। এই সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে যে, বাঙলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হবে চারটি : জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। উপরোক্ত মূল নীতিগুলিকে বাস্তবক্ষেত্রে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে ১৫৩টি ধারা খসড়া সংবিধানটিতে সংযোজিত হয়েছে।
সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্রটিতে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ঘোষিত হলেও একটা প্রাথমিক বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে যে, বস্তুতঃপক্ষে এই শাসনতন্ত্রটি উপরোক্ত চারটি মূলনীতির বিরুদ্ধেই সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালিত।
প্রথমেই সমাজতন্ত্রের কথায় আসা যাক। খসড়া সংবিধানটির ১০ নম্বর ধারায় মহা আড়ম্বরে ঘোষণা করা হয়েছে যে, বাঙলাদেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে। কিন্তু এই ঘোষণার পর সম্পত্তির অধিকার সম্পর্কে ১৩ এবং ৪২ ধারায় যে কথা বলা হয়েছে তার সাথে সামজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কোন সম্পর্ক নেই। ১৩ ধারায় সম্পত্তি সম্পর্কে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা করা হয়েছে : (ক) রাষ্ট্রীয় মালিকানা, (খ) সমবায় ব্যবস্থার অধীন ব্যক্তিগত মালিকানা, (গ) ব্যক্তিগত মালিকানা। (খ) এবং (গ) উভয় ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে যে ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও একথা কোন ধারায় উল্লিখিত হয়নি যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে বাঙলাদেশে পরিশেষে উচ্ছেদ করা হবে।
যে কোন অর্বাচীন বালকও জানে যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সাথে একেবারেই সামঞ্জস্যহীন। এ জন্য প্রত্যেক সমাজতান্ত্রিক দেশেই সম্পত্তিকে সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদের একটা পরিকল্পনা থাকে এবং সেই উদ্দেশ্য তাদের দ্বারা সংবিধানে বিধিবদ্ধ হয়। সম্পত্তিকে সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ করার এই ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ সংবিধানের কোন ধারায় বিধিবদ্ধ তো হয়নি, উপরন্তু ৪২ ধারায় সম্পত্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে সম্পত্তি অর্জন, রক্ষণ, হস্তান্তর ও অন্যভাবে বিলিব্যবস্থা করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে। এই অধিকারসমূহ যে আইনের দ্বারা আরোপিত বিধিনিষেধ সাপেক্ষ সেটা অবশ্য পূর্ববৎ উল্লেখ করা হয়েছে।
কিন্তু এই উল্লেখ সত্ত্বেও এটা স্পষ্টতঃ দেখা যাচ্ছে যে, আইনের দ্বারা বিধিনিষেধ কিভাবে আরোপিত হবে সে বিষয়ে কোন নিশ্চয়তা এর মধ্যে নেই। কাজেই এই অবস্থায় সম্পত্তির ওপর ভবিষ্যতে আইনগত কোন বিধিনিষেধ আরোপিত যদি না হয় তাহলে প্রস্তাবিত সংবিধান অনুযায়ী তাতে কারো বলার কিছু নেই। অর্থাৎ এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপিত হতেও পারে অথবা নাও হতে পারে।
খসড়া সংবিধানটির ১৩ ধারার গোড়াতেই সাধারণভাবে বলা হয়েছে যে, উৎপাদন যন্ত্র ও উৎপাদন ব্যবস্থাসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হবেন জনগণ। প্রকৃতপক্ষে সংবিধানে ব্যক্তিগত মালিকানা বিকাশের যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে এ ক্ষেত্রে ‘জনগণের মালিকানা’ ১৯৫৬ এবং ১৯৬২ সালের পাকিস্তানি সংবিধানে ‘সকল সম্পত্তির মালিক আল্লাহ-তাআলাই’ এর একটি নামান্তর মাত্র। পাকিস্তানী সংবিধানে আল্লাহকে মালিকানা দান করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে “আল্লাহ্ খেদমতকাররাই” জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ উদ্ধার করতো, শ্রমিক-কৃষকের শ্রমের ফসল লুণ্ঠন করতো। বর্তমান খসড়া সংবিধানেও ঢালাওভাবে ‘জনগণকে’ মালিকানা দান করা হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে ‘জনগণের খেদমতকাররাই’ যাতে জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ উদ্ধার করতে এবং শ্রমিক-কৃষকদের শ্রমের ফসল নোতুনভাবে লুণ্ঠন করতে পারে তারই ব্যবস্থা করা হয়েছে। এজন্যে কৃষকদের অধিকার ও মুক্তি এবং ‘কৃষিবিপ্লব’ সম্পর্কে অনেক গালভরা কথা বলা হলেও সমস্ত উৎপাদন সম্পর্কের বিলোপ এবং ভূমি ব্যবস্থার মধ্যে কোন মৌলিক পরিবর্তনের কথা এতে নেই। আওয়ামী লীগ সরকারের জাতীয়করণ কর্মসূচী ইতিমধ্যেই যে রীতিমতোভাবে পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিক স্বার্থের খপ্পরগত হয়ে ‘বানচাল’ হতে চলেছে সে বিষয়ে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সংবিধানে ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রতি যে কোমল মনোভাব দেখানো হয়েছে এবং তার বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগের যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তার থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে সংবিধানটি আমাদের দেশে চালু হওয়ার পর রাষ্ট্রীয় খাতে তার বিকাশের দিকেই সরকার দৃষ্টি দেবেন অনেক বেশী। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান আমলে দেশীয় সম্পত্তির ওপর শিল্পের ভিত্তি স্থাপন না করে সাম্রাজ্যবাদী লগ্নী পুঁজির ওপর তাকে যেভাবে দাঁড় করানো হয়েছিল সেইভাবেই এখানে বাঙালী কর্তৃত্বে নোতুনভাবে শিল্প ‘বিকাশেরও’ ভিত্তি স্থাপন করা হবে। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির বিনিয়োগের জন্যে সরকার বাঙলাদেশের দ্বার উন্মুক্ত রাখবেন এবং তার জন্যে প্রয়োজনীয় সবরকম আইনগত ব্যবস্থাই গ্রহণ করবেন।
ঠিক এই ধরনের একটি অবস্থা সৃষ্টির জন্যেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ চিলি থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত সমগ্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্যেই তারা জনগণের এবং জাতীয় শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে লড়াই করছে ভিয়েতনামে, লাওসে, ক্যাম্বোডিয়ায়, থাইল্যান্ডে। আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানে অর্থনৈতিক বিকাশ ও সম্পত্তি মালিকানার যে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন তাতে মার্কিন, জাপানী, বৃটিশ, জার্মান এবং ঐ ধরনের অন্যান্য দেশীয় করপোরেশনগুলির পক্ষে বাঙলাদেশে পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধাকে মোটামুটিভাব অবাধ করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, ভবিষ্যতে বাঙলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদ কবলিত করে রাখার বিবিধ উপযুক্ত ব্যবস্থা এই সংবিধানটির মাধ্যমে করা হয়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে দেখা যাবে যে, সম্পত্তি এবং অর্থনৈতিক ‘উন্নতির’ সম্পর্কে বিভিন্ন রকম বিধিব্যবস্থা অনুযায়ী বাঙলাদেশে শুধু যে সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে সাম্রাজ্যবাদ কবলিত পুঁজির বিকাশ ঘটানোর আয়োজন করা হচ্ছে তাই নয়। এর মাধ্যমে বাঙলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতাকে বিপন্ন এবং গৌরবকে ক্ষুণ্ন করার সব রকম ব্যবস্থাই করা হয়েছে। জাতীয় স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষার মূলভিত্তি হচ্ছে বিদেশী, বিশেষতঃ সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত থাকা। এর বিপরীত অবস্থা কোন অংশেই জাতীয় স্বাধীনতা ও মর্যাদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে না। এ জন্যই বাঙলাদেশে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিকে যে আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে তাকে আরও ‘গৌরবময়’ স্থান অধিকার করার জন্যে দরজা যেভাবে খোলা রাখা হয়েছে তাতে সরকারই পরিণত হবেন দেশীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে সব থেকে বড়ো জাতীয় স্বার্থবিরোধী শক্তিতে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ, মর্যাদা এবং গৌরব রক্ষার সংগ্রামে জনগণই হাতে তুলে নেবেন জাতীয় গৌরব, মর্যাদা এবং স্বাধীনতার পতাকা।
এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যেই আওয়ামী লীগ সরকার তাদের প্রস্তাবিত সংবিধানটিতে এমন কতকগুলি বিধান রেখেছেন যেগুলি গণতন্ত্রের বিপরীত। এগুলির দ্বারা বস্তুতঃপক্ষে বাঙলাদেশে গণতন্ত্রকে কবর দেওয়ারই চেষ্টা করা হয়েছে।
খসড়া সংবিধানটির ৬৩(৩) ধারায় খুব চাতুর্যের সাথে যুক্ত এবং আক্রমণের সাথে সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রশ্নটিকে একই সাথে এনে বলা হয়েছে যে, ঐ ধরনের জরুরী অবস্থায় সংসদ অর্থাৎ পার্লামেন্ট রাষ্ট্রকে রক্ষা করা এবং জননিরাপত্তার জন্যে যা কিছুকে করণীয় বলে ধার্য করবেন সেটাই তারা করতে পারবেন। সংবিধানের জন্যে অন্য কোন ধারা মতেই তার বিরুদ্ধে কোন বিধিনিষেধ আরোপ করা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ পূর্বোক্ত ধরনের জরুরী অবস্থায় সমগ্র সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় অধিকার সংক্রান্ত যে সমস্ত বিধান দেওয়া হয়েছে তার সবগুলিই বাতিল বলে ধরে নেয়া হবে।
যুদ্ধ এবং আক্রমণের ফলে আভ্যন্তরীণ সমস্ত বিদ্রোহের কথাটি এখানে জুড়ে দিয়ে সরকার বস্তুতঃপক্ষে ‘বিদ্রোহ’ দমনের উদ্দেশ্যে যে ক্ষমতা আইন পরিষদের বা পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে তুলে দিয়েছেন সে ক্ষমতা প্রকৃতপক্ষে ব্যবহৃত হবে সরকারের বিরোধী যে কোন শক্তিকে আঘাত ও বিপর্যস্ত করার উদ্দেশ্যে। ‘জননিরাপত্তার’ স্বার্থে পাকিস্তানী আমলেও সরকার নিজের হাতে এতদিন ধরে এত বেশী ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত রেখেছিলেন যে শুধুমাত্র ‘জননিরাপত্তার’ কথা সকল জনগণের অন্তরে এখন আর কোন আস্থা এবং ভরসার সৃষ্টি করে না। ‘জননিরাপত্তার’ নামে জনতার নিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন করার প্রক্রিয়ার সাথে তারা সুপরিচিত।
দ্বিতীয়তঃ, সশস্ত্র বিদ্রোহের চরিত্র এবং ব্যাপকতা সম্পর্কে এই ধারায় কিছুই বলা হয়নি। এর ফলে সামান্য কোন ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে জাতীয় জরুরী অবস্থা ঘোষণা করারই ব্যবস্থা এতে করা হয়েছে। কোন এলাকায় ছোটখাটো কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার সাথে যে কোন বিরোধী শক্তির যোগ আবিষ্কার করে ব্যাপকভাবে তাদেরকে দমন করা এই ধারা অনুসারে ভবিষ্যতে সহজেই সম্ভব হবে।
এছাড়া অন্যান্য অনেকগুলি ধারা অনুযায়ী যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তাতে প্রকৃতপক্ষে মৌলিক অধিকারকে পরিণত করা হয়েছে কাগুজে অধিকার। ৩৫ নম্বর ধারাতে প্রকাশ্য ও নিরপেক্ষ বিচারের অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই সাথে বলা হয়েছে যে, জননিরাপত্তা, নৈতিকতা অথবা অন্য কোন যুক্তিসঙ্গত কারণে প্রকাশ্য বিচারের পরিবর্তে গোপন বিচার অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা সংসদ প্রয়োজন অনুযায়ী করতে পারবে। এই কারণ যুক্তিসঙ্গত কিনা সেটা নির্ধারণ করবে কে–সেটা নির্দিষ্টভাবে এখানে কিছুই বলা হয়নি। এবং তার ফলে সেটা নির্ধারণের দায়িত্ব সংসদেরই অর্থাৎ সরকারের।
কিন্তু শুধু ৩৫ নম্বর ধারাই নয়। ৩৬, ৩৭ এবং ৩৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী চলাফেরা, সমাবেশ ও সংবিধানের যে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে সে স্বাধীনতাও ‘যুক্তিসঙ্গত কারণে কেড়ে নেওয়া যেতে পারে এবং এসব ক্ষেত্রেও কারণটি যুক্তিসঙ্গত কিনা সেটা নির্ধারণের মালিক সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের অধিকারী সরকার।
মতপ্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে সেটা আরও আশ্চর্যজনক। ৩৯ ধারায় এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, কোন ‘বন্ধু রাষ্ট্রের’ বিরুদ্ধে কিছু বলার স্বাধীনতা কোন ব্যক্তি অথবা সংবাদপত্রের নেই। এর অর্থ সরকার যাকে বন্ধুরাষ্ট্র বলে মনে করবেন তার সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন সরকার-বিরোধী বক্তব্য কেউ উচ্চারণ অথবা প্রকাশ করতে পারবেন না।
একথা সকলেরই জানা যে, কোন দেশের বৈদেশিক সম্পর্ক অপরিবর্তনশীল নয়। উপরন্তু তা সর্বাংশে পরিবর্তনশীল। আজ যার সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে আগামীকাল তার সঙ্গে বন্ধুত্ব নাও থাকতে পারে। তেমনি আজ যে শত্রুস্থানীয় আগামী কাল সে বন্ধুতে পরিণত হতে পারে। কাজেই বন্ধুরাষ্ট্র বলে সরকার যখনই যাকে বিবেচনা করবেন সেই হয়ে দাঁড়াবে সমালোচনার ঊর্ধ্বে। এর অর্থ কি এটা দাঁড়ায় না যে আগামী কাল যদি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে বাঙলাদেশ সরকার বন্ধুরূপে আলিঙ্গন করেন তাহলে এই সংবিধান অনুযায়ী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কোন বক্তব্য উত্থাপন অথবা প্রকাশ করা প্রায় রাষ্ট্রদ্রোহিতারই শামিল হয়ে দাঁড়াবে?
এই পরিস্থিতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার কি হবে? একথা সত্য যে, ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ যদি এই হয় যে বাঙলাদেশ ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হবে না, তাহলে বাঙলাদেশ নিশ্চয়ই একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। বর্তমান অবস্থায় এ ধরনের ঘোষণার দ্বারা লাভবান কেউই হবে না। এমনকি তার থেকে জনগণের চরমতম শ্রেণী-শত্রুদেরও আর লাভের কোন আশা নেই। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ যদি এই হয় যে, সরকার ধর্মকে রাজনীতিগতভাবে ব্যবহার করবেন না। (১২ গ ধারা) তাহলে বাঙলাদেশ সরকার কিছুতেই ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে পারে না। যে সরকার জনগণের অন্যান্য গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি এতখানি শত্রুভাবাপন্ন তারা জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ধর্মকে ব্যবহার করবে না এটা চিন্তা করাও বাতুলতা। ধর্মের যে ব্যবহার তারা প্রকাশ্যে করতে পারবে না, তারা সেটা করবে গোপনে। এজন্যে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে তারা বিভিন্ন ধর্মের আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদিকে যথাসাধ্য বাঁচিয়ে রেখে, লোকের মনে ধর্মীয় কুসংস্কারকে জীইয়ে রেখে সময়মতো এক সম্প্রদায়ের লোককে আর এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে।
প্রস্তাবিত সংবিধানটির মাধ্যমে বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিধান আওয়ামী লীগ সরকার দিতে যাচ্ছেন সে ব্যবস্থায় শুধু সরকার নয়, বিরোধীপক্ষীয় সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহ পর্যন্ত জোরদার হয়ে উঠে অবস্থা এবং সুযোগ-সুবিধা মতো সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ ঘটাতে যথেষ্ট তৎপর ও সচেষ্ট হবে। সংবিধান প্রচলিত হওয়ার পূর্বে ইতিমধ্যেই কি আমরা এই ধরনের সাম্প্রদায়িক হানাহানি এবং বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা আমাদের রাজনৈতিক জীবনে দেখতে পাচ্ছি না?
সাপ্তাহিক স্বাধিকার
২৯শে অক্টোবর, ১৯৭২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন