জাতীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ভূমিকা

বদরুদ্দীন উমর

জাতীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ভূমিকা

১৯৫৩ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে সাম্প্রদায়িক চরিত্র পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করার পর পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি তার মধ্যে অনুপ্রবেশের সিদ্ধান্ত নেয় এবং বহুসংখ্যক নেতৃস্থানীয় কমিউনিস্ট কর্মী আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। তখনকার দিনে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনী থাকার ফলে প্রকাশ্য কাজের সুবিধা হবে এবং সেই কাজের মাধ্যমে পার্টি রাজনীতি ও সংগঠনকে জনপ্রিয় ও জোরদার করতে পারবেন মনে করেই তাঁরা সেই সিদ্ধান্ত নেন। কমিউনিস্টরা আওয়ামী লীগে কাজ শুরু করার পর থেকে আওয়ামী লীগের বামপন্থী অংশ নিঃসন্দেহে অনেকখানি শক্তিশালী হয়। এর থেকে কমিউনিস্টদের ধারণা হয় যে, আওয়ামী লীগের কাঠামোর মধ্যেই তাঁরা নিজেদের ঘরোয়া ও বৈদেশিক নীতি অনেকখানি কার্যকর করতে পারবেন। এ জাতীয় একটা উদ্দেশ্যের মধ্যে দোষের কিছু ছিলো না কিন্তু তবু এ কথা অনস্বীকার্য যে আওয়ামী লীগের মতো একটি পেটি বুর্জোয়া সংগঠনের মধ্যে নিজেদের নীতিকে কতখানি এবং কতদূর পর্যন্ত কার্যকর করা সম্ভব সে বিষয়ে তাঁদের তেমন কোন ধারণা থাকেনি। এই ধারণার অভাবের জন্যে একদিকে তাঁরা আওয়ামী লীগের ওপর মাত্রাতিরিক্ত ভরসা রেখে নিজেদের পার্টি সংগঠনকে নানা দিক দিয়ে দুর্বল করে রাখলেন, অন্যদিকে এমন কতকগুলি কর্মসূচী আওয়ামী লীগের মধ্যে তাঁরা এগিয়ে নিতে চাইলেন যেগুলিকে হজম করা সেই সংগঠনের সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান, শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন অংশের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হলো না। মওলানা ভাসানী সে সময়ে মোটামুটিভাবে আওয়ামী লীগের বামপন্থী মহলের সাথে ছিলেন এবং সেই হিসেবে কমিউনিস্টরা মনে করেছিলেন যে মওলানার মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের কর্মসূচীকে কার্যকর করবেন।

আওয়ামী লীগের মধ্যে বাম ও দক্ষিণপন্থীদের এই দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে ১৯৫৭ সালে অনুষ্ঠিত কাগমারী সম্মেলনে। এই সম্মেলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির ওপর একটি প্রস্তাব বামপন্থী মহলের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হয়। শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব, আতাউর রহমান খান প্রমুখ দক্ষিণপন্থী নেতারা ভয়ানকভাবে প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেন। এর ফলে তা গরিষ্ঠ ভোটে প্রত্যাখ্যাত হয়।

কমিউনিস্টরা এর থেকে ধারণা করে যে আওয়ামী লীগ প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তার কাঠামোর মধ্যে তাঁদের বামপন্থী রাজনীতি এগিয়ে নেওয়া আর সম্ভব নয়। এ ধারণা নিঃসন্দেহে সঠিক ছিলো। কিন্তু তার থেকে তাঁরা যে সিদ্ধান্ত করলেন তাতে তাঁদের পূর্ববর্তী ভুলেরই পুনরাবৃত্তি ঘটলো।

আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এসে কমিউনিস্টরা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এবং আওয়ামী লীগের অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল অংশকে নিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে একটি নোতুন পেটি বুর্জোয়া সংগঠন গঠন করলেন। তাঁরা মনে করলেন যে মোটামুটিভাবে তাঁদের নিজেদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি পেটি বুর্জোয়া পার্টিকে তাঁরা একটি যথার্থ জাতীয় রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলে একদিকে গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে জোরদার করবেন এবং অন্যদিকে পার্টি সংগঠনকেও এগিয়ে নিতে সক্ষম হবেন।

এ কাজ করতে গিয়ে কমিউনিস্টরা একটি মারাত্মক তত্ত্বগত এবং কৌশলগত ভুল করলেন। ভুলটি হলো শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি কর্তৃক একটি পেটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃ ত্ব দিতে যাওয়া। শ্রমিক শ্রেণীর পার্টির নেতৃত্ব পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর কবলে পড়লে যেমন তার মধ্যে সংশোধনবাদের রাজত্ব কায়েম হয়, তেমনি পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর কোন সংগঠন শ্রমিকশ্রেণীর পার্টির হুকুমবরদার হলে পেটি বুর্জোয়া সংগঠন হিসেবে তা কখনো যথাযথভাবে বিকাশ লাভ করতে পারে না। একথা শুধু শ্রমিকশ্রেণী ও পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর পক্ষেই প্রযোজ্য নয়। সব শ্রেণী সম্পর্কেই তা সত্য। কারণ প্রত্যেক শ্রেণীরই কতকগুলি নির্দিষ্ট স্বার্থ থাকে এবং তাদের সেই স্বার্থসমূহের দ্বারাই তারা মূলতঃ পরিচালিত হয়। এ জন্যে প্রত্যেক শ্রেণীরই মৌলিক রাজনৈতিক চরিত্র এবং অবস্থান স্বতন্ত্র হতে বাধ্য। এই স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকার করে প্রত্যেক শ্রেণীর রাজনীতি যদি সংগঠিত হয় তা হলেই তার দ্বারা সেই শ্রেণীর বিশেষ শ্রেণীগত স্বার্থ অগ্রসর হয়, অন্যথায় হয় না। আবার যে রাজনীতি সেই বিশেষ স্বার্থের প্রতি উদাসীন থাকে সে রাজনীতিও কখনো যথার্থভাবে সেই শ্রেণীর বিকাশ সাধন করতে পারে না।

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং তার পৃষ্ঠপোষক কমিউনিস্ট পার্টির পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। ১৯৫৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে তার মধ্যে কমিউনিস্টদের সাংগঠনিক, তত্ত্বগত ও কর্মসূচীগত প্রভাবের ফলে তারা পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর পার্টি হিসেবে অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের শ্রেণী-চরিত্র উত্তীর্ণ হয়ে অনেক অগ্রসর ধ্বনি তুলেছে সত্য কিন্তু সেই সব ধ্বনির মাধ্যমে তারা জাতীয় রাজনীতিতে পেটি বুর্জোয়ার এক নম্বর পার্টি হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারেনি। অন্যদিকে, একটি পেটি বুর্জোয়া পার্টিকে নিজেদের প্রভাবাধীন রাখার প্রাণপণ প্রচেষ্টায় নিযুক্ত থাকার ফলে কমিউনিস্টরা নিজেদের শক্তির এক বিরাট অংশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পেছনে খরচ করেছেন এবং তার ফলে নিজেদের পার্টিকে অগ্রসর করার কাজ তাদের দ্বারা বহুলভাবে অবহেলিত হয়েছে।

১৯৬৯-এর ব্যাপক গণআন্দোলনের সময়েই মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি সর্বপ্রথম তাঁদের পার্টির সাথে ন্যাপের (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির) সম্পর্কের এই দিকটির বিষয়ে সচেতন হন এবং পরিশেষে ১৯৭০ সালে তার সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্কচ্ছেদ করেন।

কিন্তু এই সম্পর্কচ্ছেদ যে সময়ে ঘটলো তখন পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর পার্টি হিসেবে ন্যাপের পক্ষে কোন অগ্রণী ভূমিকা পালন আর সম্ভব ছিলো না। আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যেই এই শ্রেণীকে এমনভাবে সংগঠিত করেছিলো যে সেই পর্যায়ে ন্যাপের অন্তর্ভুক্ত পেটি বুর্জোয়াদের পক্ষে তাদেরকে সেখান থেকে বের করে আনার কোন সম্ভাবনা থাকেনি। এর পরিণতিতে ন্যাপ একদিকে কমিউনিস্টদের থেকে এবং অন্যদিকে পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর রাজনীতির মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাধ্যতাবশতঃ শেষ পর্যন্ত ১৯৭০ এর নির্বাচন বর্জন করে বস্তুতঃপক্ষে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লো।

ন্যাপের এই পরিণতি দেশের পক্ষে খুব ক্ষতিকরই হয়েছিলো। এই ক্ষতির কারণ মূলতঃ ন্যাপের জন্মবৃত্তান্তের মধ্যেই নিহিত। ১৯৫৭ সালে ন্যাপ গঠনের সময় আওয়ামী লীগের সমগ্র প্রগতিশীল অংশকেই ভাঙ্গিয়ে আনা হয়েছিলো। এর ফলে আওয়ামী লীগের মধ্যে সেই সময় থেকেই দক্ষিণপন্থী প্রভাব প্রায় সার্বভৌম হয়ে ওঠে। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী এবং পরে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ঘরোয়া ও বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে দক্ষিণপন্থী নীতি অনুসরণ করেন এবং তার ফলে আওয়ামী লীগ মোটামুটিভাবে সাম্রাজ্যবাদের মুখাপেক্ষী এদেশের উঠতি মুৎসুদ্দী বুর্জোয়াদের প্রতিষ্ঠান হিসেবে ক্রমশঃ জোরদার হতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তান ভিত্তিক আমলা মুৎসুদ্দী শ্রেণীর শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে তারা কতকগুলি কৌশলগত ধ্বনি তোলে। এই ধ্বনিগুলি পূর্ব বাঙলায় সমগ্র জনগণের ওপর পাকিস্তান সরকারের জাতীয় নির্যাতনের স্বরূপকে ঠিক মতো তুলে না ধরলেও তার মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান কেন্দ্রিক শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত হতে থাকে। অন্যদিকে কমিউনিস্টদের প্রভাবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের প্রশ্ন, এমন কি জাতীয় নির্যাতনের প্রশ্নটিকে পর্যন্ত ন্যাপ উচিতমতো এবং জোরালোভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরতে অক্ষম হয়। এর ফলে কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) এবং ন্যাপ দুই- ই জনগণ থেকে অনেকাংশে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জাতীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের এই অক্ষমতার ফলে বাঙালী উঠতি মুৎসুদ্দী শ্রেণীর নির্যাতনের প্রকৃত শ্রেণী-চরিত্রের বিষয়ে জনগণকে সচেতন না করে সেই আন্দোলনকে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী খাতে পরিচালনা করলো। পূর্ববাঙলার ওপর পাকিস্তানের জাতীয় নির্যাতনের অবসানের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান বাঙলাদেশ সরকারের নানান কর্মসূচী এবং সেগুলি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে সেগুলির দিকে তাকালেই কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক কোন পেটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিতে যাওয়ার প্রচেষ্টা এবং একটি পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রগতিশীল অংশ কর্তৃক তার যথার্থ ভূমিকা পালন না করে নিজেদের দলীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বীকার করে নেওয়ার পরিণতি সুস্পষ্ট হবে।

সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও বৃহৎ পুঁজির বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিরোধকারী শ্রেণীর ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বের ভূমিকাকে একটি পেটি বুর্জোয়া পার্টির নেতৃত্বের ভূমিকার সাথে জড়িয়ে ফেলার ভ্রান্তি যদি না ঘটতো তাহলে কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পারস্পরিক সৌভ্রাতৃত্ব বজায় রেখেই সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই পরিচালনা করতে সক্ষম হতো এবং সে লড়াইকে সত্যিকার একটা গণতান্ত্রিক চরিত্র দিতে পারতো। পূর্ব বাঙলার রাজনীতি ক্ষেত্রে বাঙলাদেশ স্থাপনের পূর্ব পর্যন্ত যে তা হয়নি বাঙলাদেশের বর্তমান অবস্থাই তার সব থেকে বড়ো প্রমাণ।

এ তো গেলো পুরাতন ভুল-ভ্রান্তির কথা। বর্তমান বাঙলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি কোন্ ভূমিকা পালন করবে? ন্যাপ একটা পেটি বুর্জোয়া পার্টি হিসেবে জাতীয় রাজনীতিতে আজ কোন্ ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে? আদি ন্যাপের যে অংশটি বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে ১৯৫৭ সালের গাঁটছড়া এখনো বেঁধে আছে তাদের বিষয়ে এখানে আলোচনার বিশেষ কিছু নেই। মস্কো প্রভাবিত বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি যে সংস্কারবাদী ও শোধনবাদী নীতির ভিত্তিতে আজ পরিচালিত হচ্ছে তাতে ন্যাপের সাথে তার রাজনীতিগত পার্থক্য দিন দিন কমে আসছে এবং এই ব্যবধান শেষ পর্যন্ত কতকগুলি তাত্ত্বিক বচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। সেই হিসেবে এরা কোন শ্রেণীর রাজনীতিকেই সঠিকভাবে এগিয়ে নিতে ভবিষ্যতে সক্ষম হবে না।

কিন্তু মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি? তার ভবিষ্যৎ কি? জাতীয় রাজনীতিক্ষেত্রে তার অবস্থান আজ কোথায়? এ প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ এবং এর বিচার ও পর্যালোচনা প্রয়োজন।

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির এই অংশ ১৯৭০ সাল পর্যন্ত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক প্রভাবিত ছিলো। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্ব সত্ত্বেও তারাই বস্তুতঃপক্ষে ন্যাপের মৌলিক নীতি ও কর্মসূচী নির্ধারণ করতো। কিন্তু এখন এই ন্যাপের মধ্যে কোন সত্যিকার কমিউনিস্ট অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা আর নেই। পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর কোন রাজনৈতিক সংগঠনে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে যে কমিউনিস্ট পার্টিকে শক্তিশালী করা চলে না, এই রাজনৈতিক শিক্ষাই তার মূল কারণ। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টির নামে পরিচিতি সকল গ্রুপ সেই রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করেছে অথবা কমিউনিস্ট নামে পরিচিত ব্যক্তিরা নিজেদের সুবিধাবাদী স্বার্থ ও সংসদীয় আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ ও চরিতার্থ করার জন্যে ন্যাপের মধ্যে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। এ অনুপ্রবেশ তারা অবশ্যই করতে পারে এবং করছে। এর দ্বারা তারা যদি ন্যাপের মধ্যে নিজেদের অন্য গ্রুপগত সত্তা ক্রমশঃ হারিয়ে ফেলে তাহলে তাতে ন্যাপের কোন ক্ষতি নাই; উপরন্তু ন্যাপ তার দ্বারা শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু একটি অথবা একাধিক রাজনৈতিক দল যদি ন্যাপের মধ্যে নিজেদের উপদলীয় প্রভাব বিস্তার করতে লিপ্ত হয় তা হলে তার পরিণতি ন্যাপের জন্য মোটেই ভালো হবে না। অর্থাৎ তার ফলে ন্যাপ জাতীয় রাজনীতিতে একটি স্বতন্ত্র পেটি বুর্জোয়া দল হিসেবে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না; একটি গণতান্ত্রিক সংগঠন হিসেবে তার উপযুক্ত বিকাশও সাধিত হবে না। উপরন্তু নানান উপদলীয় দ্বন্দ্ব ও চক্রান্তের খপ্পরে পড়ে ক্রমাগত অবক্ষয়ের মাধ্যমে তা শেষ পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

ন্যাপের যা বর্তমান অবস্থা তাতে মওলানা ভাসানীই এই দলের সর্বেসর্বা, তাঁর ওপরেই এই সংগঠন সর্বতোভাবে নির্ভরশীল। এই ভিত্তির ওপর কোন রাজনৈতিক দল কখনো দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারে না। কাজেই পেটি বুর্জোয়া সংগঠন হিসেবে বর্তমান বাঙলাদেশে ন্যাপকে তার শ্রেণী-স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং শ্রমিক-শ্রেণী ও কৃষক সমাজের স্বার্থের সাথে তার নির্দিষ্ট স্বার্থের যোগটি উপলব্ধি করে একদিকে নিজেদের পার্টিকে একটি স্বতন্ত্র পার্টি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে এবং অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলা মুৎসুদ্দী পুঁজির বিরুদ্ধে ব্যাপক গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট শক্তিসমূহের সাথে হাত মেলাতে হবে। একথা তাদেরকে বুঝতে হবে যে, একদিকে যেমন পার্টিগতভাবে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীনে তাদের কোন স্বকীয় বিকাশ সম্ভব নয়, তেমনি অন্যদিকে কমিউনিস্টদের প্রতি শত্রুতা করেও তাদের ব্যাপক গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সাফল্যের কোন সম্ভাবনা নেই। পরস্পরের স্বার্থের পার্থক্য এবং ঐক্য সম্পর্কে যথাযথ উপলব্ধির দ্বারাই এক্ষেত্রে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কর্মসূচী ও মৈত্রী নীতি নির্ধারিত হওয়া দরকার।

একটি বিষয়ে এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা না হলে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাপের রাজনৈতিক অবস্থান ও তার সম্ভাবনা সম্পর্কে ধারণা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমরা জানি যে আওয়ামী লীগের মধ্যে দক্ষিণপন্থী প্রভাব সত্ত্বেও বামপন্থী মহলের নানান বিচ্যুতি এবং ভুল-ভ্রান্তির ফলে ১৯৬৯ সালের পরবর্তী পর্যায়ে বিশেষতঃ ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চের সামরিক আক্রমণের পর থেকে অসংখ্য গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্ম শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের আওতায় এসে পড়ে। আওয়ামী লীগের এই অংশ আজ প্রায় সম্পূর্ণভাবে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে গেছে এবং অদূর ভবিষ্যতে এই প্রক্রিয়া আরও দ্রুতগতিতে চলে আওয়ামী লীগকে পুরোপুরিভাবে জনগণের শ্রেণীশত্রুদের একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত করবে। আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসা অংশটি হয়তো ইতিমধ্যেই নিজেদেরকে অপ্রকাশ্যে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে সংগঠিত করেছে। তা না করে থাকলেও ভবিষ্যতে তাদেরকে সেটা করতেই হবে। ছাত্রলীগের রব-সিরাজ গ্রুপের ভাঙ্গন পরিণতিতে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দলের জন্ম দান করতে বাধ্য এবং বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট পরিচালিত ন্যাপ নয়, এই নোতুন পার্টিই বাঙলাদেশের রাজনীতিক্ষেত্রে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক সংগঠন।

নিকট ভবিষ্যতের বাঙলাদেশে কোন রাজনৈতিক সংগঠনই সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে অথবা নিজেদের নীতি, প্রচারণা অথবা কর্মসূচীর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার রেশ বজায় রেখে বেশী দূর অগ্রসর হতে পারবে না। এ বিষয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি যদি এখন থেকে সচেতন না থাকে তা হলে তার মধ্যে ভারতবিরোধিতার আড়ালে অনেক সাম্প্রদায়িক শক্তি এসে জড়ো হবে। ন্যাপ যদি এ অবস্থা কাটিয়ে উঠে শুধু কোন কোন ক্ষেত্রে মৌখিকভাবে নয়, নীতিগত ও কর্মসূচীগতভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিরোধীতার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে না আসে তাহলে বাঙলাদেশের একটি পেটি বুর্জোয়া সংগঠন হিসেবে তার বিকাশ লাভ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অর্জনের কোন সম্ভাবনা নেই।

মোট কথা, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি যদি একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে সাম্প্রদায়িকতা থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়ে এবং কমিউনিস্ট শক্তিসমূহের সাথে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ থেকে সামন্তবাদ, আমলা মুৎসুদ্দী পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী একটি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচীর ভিত্তিতে অগ্রসর হয় একমাত্র তাহলেই তা জাতীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রভাবশালী হবে, অন্যথায় নয়।

সাপ্তাহিক স্বাধিকার
২৪শে সেপ্টেম্বর ও ১লা অক্টোবর, ১৯৭২

সকল অধ্যায়

১. বাঙলাদেশে মার্কিন অনুপ্রবেশ
২. “গণমুখী” বক্তৃতা
৩. আওয়ামী লীগের জাতীয়করণ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে
৪. ভারত-বিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতা
৫. জাতীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ভূমিকা
৬. আওয়ামী লীগ সরকারের শ্রমনীতি
৭. সংবাদপত্র ও প্রকাশনার স্বাধীনতা
৮. আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত সংবিধান
৯. শাসনতন্ত্র প্রশ্নে বিরোধী দলগুলির ভূমিকা
১০. আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতি রক্ষা
১১. বাঙলাদেশের সংবিধান ও পরবর্তী নির্বাচন
১২. আইয়ুব খানের অস্ত্রাগার
১৩. আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণা
১৪. বাঙলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি
১৫. বাঙলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
১৬. বাঙলাদেশে শ্রমিক হত্যা
১৭. জাতি সমস্যা ও ভাষা আন্দোলন
১৮. আওয়ামী লীগের ‘শুদ্ধি অভিযান’ প্রসঙ্গে
১৯. মাধ্যমিক শিক্ষক ধর্মঘট প্রসঙ্গে
২০. মুদ্রাযন্ত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স ১৯৭৩
২১. ত্রিদলীয় ঐক্যজোট ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন
২২. ১৯৪৮ সাল থেকে পশ্চিম এশিয়ায় দু’ধরনের যুদ্ধ চলছে
২৩. বাঙলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি
২৪. বাঙলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি
২৫. ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন প্রসঙ্গে
২৬. সংসদীয় বিরোধী দলসমূহের ঐক্য প্রসঙ্গে
২৭. দালাল আইনে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি প্রসঙ্গে
২৮. জনগণ গণতান্ত্রিক বিরোধী দলগুলির ঐক্য কেন চাইছেন?
২৯. ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের তাৎপর্য
৩০. বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্বীকৃতি প্রসঙ্গে
৩১. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও বাঙলাদেশের স্বাধীনতা
৩২. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ও বাঙলাদেশে সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব
৩৩. সাম্রাজ্যবাদের যুগে জাতীয়তাবাদ
৩৪. গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বতঃস্ফূর্ততা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন