বদরুদ্দীন উমর
ভারতীয় উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসনের জন্যে একদিকে যেমন ভারতবর্ষে ধনতন্ত্রের বিকাশ রুদ্ধ হয়েছিল, অন্যদিকে তেমনি এই ভূখণ্ডে বিভিন্ন জাতির বিকাশও সঠিক ও যথার্থভাবে সম্ভব হয়নি। বহু ভাষাভাষী, জনগোষ্ঠী এবং বহু জাতি সমন্বিত ভারতবর্ষে জাতির বিকাশ এইভাবে রুদ্ধ হওয়ায় পরিণতি হিসেবে জাতীয় চেতনা ও সাম্রাজ্যবাদের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও অনেকখানি জটিলতা দেখা দেয়। এই জটিলতার একটি দিকের পরিচয় পাওয়া যায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের’ ধ্বনিতে এবং অন্য দিকটির পরিচয় মেলে ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগের’ মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও পাকিস্তান ধ্বনির মধ্যে।
অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদকেই অবলম্বন করে ভারতবর্ষে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের মধ্যে পরিণতি লাভ করে। হিন্দু ও মুসলমান সামন্ত বুর্জোয়া শ্রেণীর পারস্পারিক দ্বন্দ্ব ও বিরোধিতা বৃটিশ আমলে নানা কারণে এই দুই সম্প্রদায়ের অসম বিকাশের ফলেই সৃষ্টি হয়। অপেক্ষাকৃ ত অগ্রসর এবং সংগঠিত হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত শিল্পপতি, ব্যবসায়িক ও চাকরিজীবী শ্রেণী সারা ভারতে একটা সুবিধাজনক অবস্থায় থেকে সেই সুবিধাকে, রাজনৈতিক সুবিধাকে রাজনৈতিক শক্তির মাধ্যমে আরও ব্যাপক ও দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে এক অখণ্ড ভারতীয়তাবাদের ধ্বনি তুলে সচেষ্ট হয় একটি শক্তিশালী ভারতীয় সরকার গঠন করতে। এই উদ্দেশ্য সাধন করতে গিয়ে তারা বহু ভাষা-ভাষীর দেশ ভারতবর্ষে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার প্রশ্নকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে বর্জন ও পরিশেষে অস্বীকার করে। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত শিল্পপতি ব্যবসায়িক ও চাকরিজীবী শ্রেণীও সেই শ্রেণীর হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত অংশের আওতামুক্ত হয়ে ‘স্বাধীন’ বিকাশের সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও দ্বিজাতিতত্ত্বের ধ্বনি তুলে সচেষ্ট হয় তাদের জন্য পৃথক ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠন করতে। এই উদ্দেশ্য সাধন করতে গিয়ে ভারতবর্ষে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার প্রশ্নকে তারাও সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে এবং এই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশকে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বিভক্ত করে দুটি পৃথক রাষ্ট্র-ভারত ও পাকিস্তানে।
১৯৪৭ সালের জুন মাসে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতবর্ষকে বিভক্ত করার পরিকল্পনা পেশ করার পরেই পূর্ব বাঙলার মুসলিম লীগভুক্ত কর্মীদের একাংশের কাছে মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটি সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি হয় এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ঢাকা শহরে মুসলিম ও হিন্দু যুবকর্মীদের এক সমাবেশে পূর্ব বাঙলার অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনীতি গঠনের ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে এই উদ্যোগই ছিলো পূর্ব বাঙলার মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ। অবশ্য সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা সকলে যে এ বিষয়ে পুরোপুরি সচেতন ছিলেন তা নয়। কিন্তু তবু ঐতিহাসিক বিচারে ৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই সমাবেশই ছিলো পাকিস্তান রাষ্ট্রকে খতম করার ক্ষেত্রে বাঙলা ভাষা-ভাষী জনগণের প্রথম সংগঠিত উদ্যোগ।
এই সমাবেশের মাত্র ছয় মাসের মধ্যে মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা ইসলামের দোহাই পেড়ে ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান গণপরিষদে যখন বাঙলা ভাষার ওপর হামলা করলো তখন তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বাঙলা ভাষার পতাকা হাতে নিয়ে পূর্ব বাঙলার ছাত্র ও যুবসমাজের এক বিরাট অংশ মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে আঘাত হানতে এগিয়ে এলেন। এক্ষেত্রেও যে তাঁরা তাঁদের এই বিক্ষোভ, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের যথার্থ চরিত্র এবং পরিণতি সম্পর্কে উপযুক্তভাবে সচেতন ছিলেন না তা নয়। উপরন্তু মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এবং সাচ্চা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর ছাত্র ও যুবকদের একটা অংশ (তমদ্দুন মজলিশ) এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু এসব সত্ত্বেও একথা সত্য যে, ইতিহাসের অচেতন মাপকাঠি হিসেবে তাঁরাই ছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ঠিক পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তানের বুনিয়াদে বলিষ্ঠভাবে আঘাতকারীর দল।
ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানে পূর্ব বাঙলার জনগণের ওপর ১৯৪৭ সাল থেকে যে নির্মম জাতিগত নির্যাতন শুরু হলো, শাসন-শোষণের যে ব্যাপক জাল তারা চতুর্দিকে বিস্তার করলো তার ফলে মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রকৃত তাৎপর্য তাঁদের কাছে উত্তরোত্তর স্পষ্ট হতে থাকলো। তিন-চার বৎসরের মধ্যেই পূর্ব বাঙলার জনগণ ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে বহুলাংশে বীতশ্রদ্ধ এবং মুসলিম লীগের শাসনের বিরুদ্ধে ভয়ানকভাবে বিক্ষুব্ধ হলেন। তাঁদের এই বিক্ষোভের একটা উল্লেখযোগ্য বহিঃপ্রকাশ দেখা গেলো ১৯৪৯ এর জুন মাসে গণতান্ত্রিক যুবলীগের (সেপ্টেম্বর ১৯৪৭-এ প্রতিষ্ঠিত) নেতৃস্থানীয় কর্মী শামসুল হকের কাছে মুসলিম লীগ প্রার্থী খুররম খান পন্নীর (বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের একজন রাষ্ট্রদূত) শোচনীয় পরাজয়ের মাধ্যমে। এই পরাজয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব বাঙলায় অনেকদিন পর্যন্ত সাধারণ নির্বাচন তো দূরের কথা, অন্য কোন উপনির্বাচন পর্যন্ত দিতে সাহস করলো না। নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে রায় দানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় পূর্ব বাঙলার নিপীড়িত জনগণের, কৃষক-শ্রমিক, নিম্নমধ্যবিত্তের, বিক্ষোভ অবরুদ্ধ থাকলো এবং এই অবরুদ্ধ বিক্ষোভই ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী চৌচির হয়ে ফেটে পড়ে শুধু মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধেই নয়, মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও পাকিস্তানের ভিত্তিমূলেও এক সুতীব্র আঘাত হানলো। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলো পূর্ব বাঙলায় এক ভাষাভিত্তিক জাতীয় আন্দোলনের।
একথা সত্য যে, পাকিস্তানী শাসক-শোষকশ্রেণীর অবাধ ও নির্মম জাতীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে এই ভাষাভিত্তিক জাতীয় আন্দোলন পরবর্তী পর্যায়ে নানা কারণে বহুলাংশে বিপথগামী হয়েছে। তবু একথাও আবার অনস্বীকার্য যে, এই আন্দোলনের মাধ্যমেই পূর্ব বাঙলার জনগণ সামন্তবাদী ভাবধারায় সমৃদ্ধ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদের ধারণার বিরুদ্ধে সংগ্রামকে প্রাথমিক পর্যায়ে সংগঠিত করেছেন। এই সংগ্রাম বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন, সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহের উত্থান ইত্যাদি সত্ত্বেও ভারতবর্ষের মাটিতে অনিবার্য ছিলো। ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম এবং ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ববাদের দ্বারাই এই সংগ্ৰাম সর্বাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে।
এজন্যই মুসলিম জাতীয়তাবাদকে বাতিল করে আজ যে কেবলমাত্র পূর্ব বাঙলায় একটা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছে তাই নয়, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের এই বিকাশ শুরু হয়েছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানেও। পাকিস্তানী শাসকশ্রেণী সেই বিকাশকে রুদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালানোর ফলেই সেখানে এখন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে বিভিন্ন এলাকার জনগণের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। শুধু তাই নয়, ভারতীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় কিছুদিন থেকে ভাষাভিত্তিক যে-সমস্ত আন্দোলন গঠিত এবং জোরদার হচ্ছে সেগুলোর চরিত্রও মূলগতভাবে ঐ একই। প্রকৃতঃপক্ষে ভারতের এই সব ভাষাভিত্তিক আন্দোলনও অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধেই মৌলিকভাবে স্থাপিত। ভারতকে বহুজাতি- অধ্যুষিত একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তার অন্তর্গত বিভিন্ন জাতির স্বকীয় বিকাশের উপযুক্ত সুযোগ সৃষ্টি করতে ভারতীয় শাসকশ্রেণী এতদিন পর্যন্ত সফল হয়নি। ভাষার ভিত্তিতে কতকগুলো রাজ্যের এলাকা নোতুনভাবে নির্দিষ্টকরণ করা সত্ত্বেও একথা সত্য। এ জন্যে দেখা যাচ্ছে যে, ভারতের বিভিন্ন এলাকায় স্বাতন্ত্র্যবাদী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছে। এই আন্দোলনকারীরা এখনো পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা হয়তো করছেন না এবং ধ্বনিও তুলছেন না। কিন্তু এইসব ভাষাভিত্তিক আন্দোলনের মধ্যে যে স্বাতন্ত্র্যবাদিতার ও বিচ্ছিন্নবাদিতার অঙ্কুর নিহিত আছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
এ জন্যই পূর্ব বাঙলার ভাষা-আন্দোলন সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে যে দিকনির্দেশ করেছে, তার তাৎপর্য শুধুমাত্র পূর্ব বাঙলার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই। ভারত ও পাকিস্তানসহ পূর্ববর্তীকালে বৃটিশ শাসনাধীন সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রে তার তাৎপর্য আজ অনস্বীকার্য।
দৈনিক গণকণ্ঠ
২১শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন