জনগণ গণতান্ত্রিক বিরোধী দলগুলির ঐক্য কেন চাইছেন?

বদরুদ্দীন উমর

বাঙলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও ব্যাপক জনগণ এখন সাধারণভাবে আওয়ামী লীগ এবং তার দুই লেজুড়ের ঐক্যজোটের বিরুদ্ধে। শোষক-শাসক শ্রেণীসমূহ এবং তাদের ঐক্যজোটের নির্যাতন-নিপীড়ন এমন এক পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছে, যেখানে জনগণ জীবন ও জীবিকার তাগিদে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। আওয়ামী লীগ শাসনের মধ্যে তাঁদের দলভুক্ত ফড়িয়াদের দ্বারা তাঁদের জীবনের কোন পরিবর্তনের সম্ভাবনা তাঁরা আর দেখতে পাচ্ছেন না।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় লীগ ইত্যাদি দলগুলি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বৰ্তমান সরকারের বিরোধিতা করছে। এই দলগুলির নীতিগত বক্তব্য, নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা-বিবৃতি, রাজনৈতিক প্রস্তাব ইত্যাদি থেকে যতটুকু বোঝা যায় তাতে করে শুধু সরকার বিরোধিতাই নয়, অন্য কতকগুলি বিষয়েও তাদের মধ্যে ঐক্যমত রয়েছে। এই অন্য বিষয়গুলি হলো সরকারী ঐক্যজোটের অন্তর্ভুক্ত মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির বিরোধিতা এবং বাঙলাদেশে মার্কিন, সোভিয়েত ও ভারতীয় নীতির বিরোধিতা। এই বিরোধিতা যে প্রত্যেকের ক্ষেত্রে সমান তীব্র সেটা না হলেও কয়টি বিষয়ে তাদের মধ্যে মোটামুটি ঐক্যমত আছে।

এক্ষেত্রে জনগণও পিছিয়ে নেই। তাঁরাও আজ আওয়ামী লীগ এবং তার লেজুড়দের বিরোধী, তাঁরাও বাঙলাদেশে মার্কিন, সোভিয়েত ও ভারতীয় আধিপত্য এবং শোষণের বিরোধী।

কোন একটি বিশেষ বিরোধী দল এখন পর্যন্ত নিজেদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে কোন একাধিপত্য অথবা প্রবল আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি। তাই জনগণ কোন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের পেছনে দাঁড়াতে প্রস্তুত নন। তাঁরা শুধু এটুকুই লক্ষ্য করছেন যে, একাধিক রাজনৈতিক দল মোটামুটি একই ধরনের বক্তব্য তাঁদের সামনে উপস্থিত করছে, অল্প-বিস্তর প্রায় একইভাবে সরকার এবং তার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মিত্রদের বিরুদ্ধে কথা বলছে।

বিরোধী দলগুলির এই অবস্থার জন্যে জনগণ একদিকে যেমন তাদের কোন একটির ওপর তেমন ভরসা রাখতে পারছেন না, তেমনি তাঁরা অন্যদিকে চাইছেন এই দলগুলির মধ্যে একটা ঐক্যমত, তাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার একটা ব্যাপক সাংগঠনিক প্রচেষ্টা। আলোচ্য রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে যদি তাঁরা তেমন কোন সুগভীর পার্থক্য লক্ষ্য করতেন তাহলে এই দলগুলির ঐক্যের অথবা তাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কথা তাঁরা চিন্তা করতেন না। এ চিন্তা তাদের মনে আসছে কারণ এই দলগুলির মতামত এবং অবস্থানের মধ্যে তাঁরা একটা মৌলিক সাদৃশ্য লক্ষ্য করছেন। সাদৃশ্যের এই উপলব্ধিই জনগণের মধ্যে জাগ্রত করছে এই সমস্ত দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ দেখার আকাঙ্ক্ষা।

সরকারী নীতির আওতায় গ্রামাঞ্চলে জোতদার, মহাজন, ইজারাদার, ইউনিয়ন কাউন্সিল ও রিলিফ কমিটির মেম্বার, চেয়ারম্যান এবং ফড়িয়াদের শোষণ-নির্যাতন জনগণের জীবনকে আজ অতিষ্ঠ করে তুলছে। এই শোষণ-নির্যাতনের সাথে যুক্ত হয়েছে সরকারী এবং সরকার প্ররোচিত সন্ত্রাস। শহরাঞ্চলে রাজনৈতিক টাউট ও ফড়িয়াশ্রেণী চাকরী, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির ক্ষেত্রে ব্যাপক অরাজকতার সৃষ্টি করেছে। শিল্প এলাকাসমূহে সরকারী শ্রমিক সংগঠন ও শিল্প প্রশাসন, লুটতরাজ এবং নিজেদের দ্বারা পালিত গুণ্ডাবাহিনীর সহায়তায় এমন এক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে যা উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ, শ্রমিকদের জীবনের ও জীবিকার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে রীতিমতো বিপজ্জনক।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে গ্রামাঞ্চলে উদ্বৃত্ত উৎপাদকের কিছুটা অতিরিক্ত আয় এখন হচ্ছে। কিন্তু তাদের সেই আয়ও মুদ্রাস্ফীতি এবং বস্ত্র প্রভৃতি অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির ফলে তাঁদেরকে খুব বেশী একটা সাহায্য করছে না। গ্রাম এবং শহরাঞ্চলে ক্ষেত- মজুর, রিক্সাচালক ইত্যাদি খেটে-খাওয়া লোকদের আয় কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তাঁদের জীবনেও কোন পরিবর্তন আনেনি। জীবনের ও জীবিকার নিরাপত্তা তাঁদের বাড়েনি।

সাধারণভাবে যাঁরা নির্দিষ্ট মাইনের চাকরীতে নিযুক্ত তাঁদের অবস্থা খুবই দুর্বিষহ। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তাঁদের জীবনকে আজ সর্বাংশে বিধ্বস্ত করে তুলছে। নির্দিষ্ট মাইনের চাকরিজীবী এই মধ্যবিত্তেরা হলেন বর্তমান অবস্থায় নিদারুণ বিপদগ্রস্ত।

সামগ্রিকভাবে বাঙলাদেশের কৃষক-শ্রমিক মধ্যবিত্ত জনগণ এখন চাইছেন এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে। যে দুঃসহ অবস্থা তাঁদের উপর পাহাড়ের মতো চেপে আছে তার থেকে পরিত্রাণের পথ তাঁরা খুঁজছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলি যে সমস্ত সরকারবিরোধী বক্তব্য নিয়ে তাঁদের সামনে সাধারণভাবে উপস্থিত হচ্ছে সেগুলি জনগণকে আকৃষ্ট করলেও তাঁরা এখনো পর্যন্ত কোন একটি দলের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছেন না। সব দলের সভাতেই তাঁরা অল্প বিস্তর যাচ্ছেন, সেগুলিতে লোক সমাগম হচ্ছে। বিভিন্ন দলের বক্তব্য এবং সেই বক্তব্যের সাথে তাঁদের নিজেদের অভিজ্ঞতালব্ধ বক্তব্যও অনেকাংশে মিলে যাচ্ছে। কিন্তু এতো মিল থাকা সত্ত্বেও একটি বিষয়ে গরমিলকে তাঁরা কিছুতেই উপলব্ধি ও সমর্থন করতে পারছেন না এবং সে বিষয়টি হলো প্রায় একই ধরনের বক্তব্য প্রদানকারী বিভিন্ন দলগুলির অনৈক্য। প্রত্যেকে বলছে সংগ্রামের কথা, আন্দোলনের কথা। শুধু তাই নয়, তারা বলছে একই সাধারণ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও আন্দোলনের কথা। কিন্তু তবু সেই সংগ্রাম ও আন্দোলনের ক্ষেত্রে ঐক্যের প্রশ্নকে তারা উপযুক্ত গুরুত্ব দিচ্ছে না।

গণতান্ত্রিক বিরোধী দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ দেখার জন্যে জনগণের এই আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে উপরোক্ত রাজনৈতিক দলগুলি যে অবহিত নয়, তা নয়। তারা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল এবং এই ওয়াকিবহাল থাকার জন্যেই তারা গণতান্ত্রিক বিরোধী দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্যে নিজেদের রাজনৈতিক প্রস্তাবসমূহের মাধ্যমে আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু এই আহ্বান সত্ত্বেও ঐক্য হচ্ছে না, কোন সংগ্রাম অথবা আন্দোলনও হচ্ছে না।

বিরোধী দলগুলি এককভাবে ঐক্যের আহ্বান জানালেও সেই ঐক্যকে বাস্তব রূপ দানের জন্য তারা কেউই প্রকৃতপক্ষে পরস্পরের সাথে আলাপ-আলোচন।র কোন চেষ্টা করছে না। প্রচেষ্টার এই অভাবের জন্যে জনগণের ঐক্যের আকাঙ্ক্ষা তো পূর্ণ হচ্ছেই না, উপরন্তু তাদের মধ্যে হতাশার মাত্রা অনেক ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী দলগুলির কোনটিই সরকারী নির্যাতন ও দমননীতির সামনে এককভাবে দাঁড়াতে পারছে না। এই অক্ষমতার জন্যে তাদের নেতৃত্বে কোন গণ আন্দোলন ও প্রতিরোধও সম্ভব হচ্ছে না। এ দুইকে সম্ভব করতে হলে বর্তমান অবস্থায় গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য ব্যতীত অন্য কোন পথ নেই। জনগণও এই ঐক্যের মধ্যে শক্তি সন্ধান করছেন। ঐক্যবদ্ধ গণ আন্দোলনই তাই এক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে প্রয়োজনীয় আস্থা সৃষ্টি এবং সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলন গঠনের একমাত্র পথ। এই পথকে এড়িয়ে গেলে অথবা পরিত্যাগ করলে প্রকাশ্য রাজনৈতিক দলগুলি শুধু যে প্রতিরোধ আন্দোলন গঠন করতে পারবে না তাই নয়। এর ফলে বাঙলাদেশে এখন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে সেই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যেটুকু বিকাশ ও শক্তি- বৃদ্ধি সম্ভব ছিলো এই দলগুলির কোনটিরই সে বিকাশ ও শক্তি-বৃদ্ধি আর হবে না।

বঙ্গবার্তা
১৩ই ডিসেম্বর, ১৯৭৩

সকল অধ্যায়

১. বাঙলাদেশে মার্কিন অনুপ্রবেশ
২. “গণমুখী” বক্তৃতা
৩. আওয়ামী লীগের জাতীয়করণ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে
৪. ভারত-বিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতা
৫. জাতীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ভূমিকা
৬. আওয়ামী লীগ সরকারের শ্রমনীতি
৭. সংবাদপত্র ও প্রকাশনার স্বাধীনতা
৮. আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত সংবিধান
৯. শাসনতন্ত্র প্রশ্নে বিরোধী দলগুলির ভূমিকা
১০. আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতি রক্ষা
১১. বাঙলাদেশের সংবিধান ও পরবর্তী নির্বাচন
১২. আইয়ুব খানের অস্ত্রাগার
১৩. আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণা
১৪. বাঙলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি
১৫. বাঙলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
১৬. বাঙলাদেশে শ্রমিক হত্যা
১৭. জাতি সমস্যা ও ভাষা আন্দোলন
১৮. আওয়ামী লীগের ‘শুদ্ধি অভিযান’ প্রসঙ্গে
১৯. মাধ্যমিক শিক্ষক ধর্মঘট প্রসঙ্গে
২০. মুদ্রাযন্ত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স ১৯৭৩
২১. ত্রিদলীয় ঐক্যজোট ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন
২২. ১৯৪৮ সাল থেকে পশ্চিম এশিয়ায় দু’ধরনের যুদ্ধ চলছে
২৩. বাঙলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি
২৪. বাঙলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি
২৫. ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন প্রসঙ্গে
২৬. সংসদীয় বিরোধী দলসমূহের ঐক্য প্রসঙ্গে
২৭. দালাল আইনে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি প্রসঙ্গে
২৮. জনগণ গণতান্ত্রিক বিরোধী দলগুলির ঐক্য কেন চাইছেন?
২৯. ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের তাৎপর্য
৩০. বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্বীকৃতি প্রসঙ্গে
৩১. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও বাঙলাদেশের স্বাধীনতা
৩২. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ও বাঙলাদেশে সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব
৩৩. সাম্রাজ্যবাদের যুগে জাতীয়তাবাদ
৩৪. গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বতঃস্ফূর্ততা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন