বদরুদ্দীন উমর
বাঙলাদেশে আগামী ডিসেম্বর মাসে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ১১ই নভেম্বর মওলানা ভাসানী রাজশাহীর এক জনসভায় নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে ঘোষণা করেন যে, তাঁর দল এই নির্বাচনে কোন অংশ গ্রহণ করবে না। দিনই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে যে দলগতভাবে তারা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে না। এ সম্পর্কে তাদের দ্বারা গৃহীত প্রস্তাবটি সম্পর্কে ১২ই নভেম্বর তাদের মুখপত্র ‘গণকণ্ঠে’ বলা হয়, সারাদেশে মুজিব-মণি- মোজাফফর চক্রের ত্রিদলীয় ষড়যন্ত্রজাল, মুজিববাদী শ্বেত সন্ত্রাস, রক্ষীবাহিনী, মুজিববাদী ও অন্যান্য গুণ্ডা বাহিনীসমূহের নির্যাতন, নিপীড়ন ও পাশবিক স্বৈরাচারের মুখে বর্তমানে বিরাজমান দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক অচলাবস্থা ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে নির্বাচন একটি প্রহসনে পরিণত হয়েছে বলে প্রস্তাবে মন্তব্য করা হয়। এই নির্বাচনে সরকারী ক্ষমতার অপব্যবহার, চোরাপথে সরকারী পয়সার ঢালাও অপচয়, জাল ভোট এবং জনগণের রায়কে বানচাল করার জন্যে সরকারী দলের সকল প্রকার অসৎ কায়দা-কৌশল ব্যবহারের জন্যে জনগণের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মতামত প্ৰকাশ হতে পারে না বলেও মন্তব্য করা হয়।
এর পর ১৩ই নভেম্বর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এক বিবৃতিতে বলেন যে, ‘আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষ হইতে কোন প্রার্থীকে মনোনয়ন দান করা হইবে না। কেননা জনগণের নিজস্ব ও সংগ্রামী প্রতিষ্ঠান আওয়ামী স্ব স্ব এলাকায় সৎ ও উপযুক্ত ব্যক্তিদের নির্বাচিত করিয়া শোষণহীন সমাজ গড়িয়া তোলার পক্ষে সহায়তা করিবেন।’ (ইত্তেফাক, ১৪ই নভেম্বর)
বাঙলাদেশের তিনটি প্রধান নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের উপরোক্ত ঘোষণাসমূহ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে তারা কেউই দলগতভাবে অংশ গ্রহণ করবে না। কিন্তু সিদ্ধান্ত এক হলেও নির্বাচনে যোগদান না করার কারণ হিসেবে যেগুলি উল্লিখিত হয়েছে, তার মধ্যে সরকারী এবং বিরোধী দল দুটির মধ্যে দুস্তর পার্থক্য।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের পক্ষ থেকে নিরাপত্তাহীনতা, শ্বেত সন্ত্রাস ইত্যাদি উল্লেখ করে নির্বাচনের ‘স্বাধীন’ চরিত্র সম্পর্কে পরিপূর্ণ অনাস্থা প্রকাশ করে, দলগতভাবে নির্বাচন বর্জন করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ দলগতভাবে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্তের কারণ উল্লেখ করে বলেছে যে, জনগণ যাতে নিজেদের এলাকায় সৎ এবং উপযুক্ত ব্যক্তিদের নির্বাচন করতে পারে তার জন্যই তারা উপরোক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে।
বিরোধী দলের যুক্তি সম্পর্কে উল্লেখ করার পূর্বে প্রথমে বলা দরকার যে, এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের যুক্তি সত্যিই খুব অদ্ভুত। তাদের বক্তব্যের সারমর্ম দাঁড়ায় এই যে, সংগঠনগতভাবে তারা অথবা অন্য কেউ যদি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে তাহলে বিভিন্ন এলাকার জনগণ নিজেরা সৎ এবং উপযুক্ত ব্যক্তিদের নির্বাচন করতে সক্ষম হবে না। কোন সংসদীয় ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল যে এই ধরনের কোন বক্তব্য নির্বাচন সম্পর্কে উপস্থিত করতে পারে তা এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। একথা অবশ্য সত্য যে, বিভিন্ন কারণেই যে-কোন নিয়মতান্ত্রিক দল বা ঐ ধরনের একাধিক দল ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ইত্যাদি স্থানীয় নির্বাচনে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রার্থী দাঁড় না করানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু দলগতভাবে প্রার্থী দাঁড় করালে প্রার্থীদের দলগত চরিত্র সৎ এবং উপযুক্ত ব্যক্তিদের নির্বাচনে প্রতিবন্ধক হবে, এ যুক্তি সমগ্র নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে মারাত্মক। শুধু তাই নয়, এ ধরনের বক্তব্য নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে আস্থাহীন একটি দলের পক্ষেই বাস্তবতঃ প্রদান করা সম্ভব।
শ্বেত সন্ত্রাস ও নিরাপত্তাহীনতার কথা বলে বিরোধী দল দুটি সংগঠনগতভাবে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত ঘোষণার মাত্র কয়েকদিন পর ১৬ই নভেম্বর সংবাদপত্রে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শ্বেত সন্ত্রাসের কয়েকটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। যে ঘটনাগুলোর কথা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলি ঘটেছে মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন, ১৫ই নভেম্বর। অস্ত্রধারী লোকজন তাদের প্রতিপক্ষকে মনোনয়নপত্র দাখিল থেকে বিরত করার উদ্দেশ্যে তাদের অস্ত্রের ব্যবহার করেছে এবং ব্যবহারের হুমকি দিয়েছে, এই কথার পর রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে, এইসব প্রতিপক্ষেরা বস্তুতঃপক্ষে বিরোধী দলভুক্ত মনোয়নপত্র দাখিলকারী। এই সমস্ত প্রার্থীদেরকে যেহেতু এইভাবে নির্বাচনে অংশ গ্রহণে বাধা দান করা হচ্ছে, তাই একথা স্বাভাবিকভাবেই মনে করা যেতে পারে যে, অস্ত্রধারী বাধাদানকারীরা সরকার পক্ষেরই লোক। শুধু তাই নয়, সরকারী লোক হিসেবে তারা স্থায়ীভাবে অপরিচিত নয়।
ইউনিয়ন কাউন্সিল পর্যায়ে আইয়ুব খানও ১৯৬৪ সালের নির্বাচনে দলগতভাবে কোন প্রার্থী দাঁড় না করানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারী দল এই ঘোষণা প্রথমে করে এবং তারপর সম্মিলিত বিরোধী দলও অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেয়। কনভেনশন মুসলিম লীগের পক্ষে সেক্ষেত্রে প্রধান বিবেচনার বিষয় ছিলো এই যে, যে-কোন দলের কথা বলে নির্বাচিত হলেও নির্বাচিত প্রার্থীরা নিজেদের স্বার্থের খাতিরে শেষ পর্যন্ত সরকারী দলেই ভিড়ে যাবে। কারণ একমাত্র সরকারী দলই মৌলিক গণতন্ত্রের ইউনিয়ন কাউন্সিলগুলিকে রক্ষণের প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ ছিলো। অন্যেরা ছিলো তার উচ্ছেদের পক্ষপাতী। কাজেই সরকারী দলের সাথে থাকলে তাদের সদস্যপদ ও চেয়ারম্যানের পদ এবং সেইসব পদের সাথে যুক্ত মুনাফার সম্ভাবনা সবই রক্ষা পাবে এবং সরকারী দলের বিরুদ্ধে গেলে সেগুলি সবই খোয়া যাবে। কাজেই নির্বাচনের পর নির্বাচিত সদস্যেরা বিপুল সংখ্যায় সরকারী দল কনভেনশন লীগে যোগদান করবে এবং সেইভাবেই সরকারের পক্ষে সব থেকে অধিক সংখ্যক সদস্যের সমর্থন পাওয়া সম্ভব। সরকারী দল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী খাড়া করলে বিরোধী দলীয় প্রার্থীদের কাছে তাদের অধিকাংশের পরাজয়ের সমূহ সম্ভাবনা ছিলো। কাজেই সবদিক হিসেব করে আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্রের ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে প্রার্থী দলগতভাবে খাড়া না করারই সিদ্ধান্ত নেয়। আইয়ুবের সে সিদ্ধান্ত যে তাদের নিজেদের স্বার্থের দিক থেকে খুবই সুবিবেচনা প্রসূত ছিলো তার প্রমাণ নির্বাচনের পরেই পাওয়া গেল। কারণ বিরোধী দলের নাম নিয়ে, আইয়ুবকে গালিগালাজ করে যারা নির্বাচিত হলো তাদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক সত্যি সত্যি আইয়ুবের দিকেই ঝুঁকলো। ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের সময় এই কারণেই পূর্ব বাঙলায় আইয়ুবের পক্ষে সম্ভব হলো সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা। কিন্তু এই কৌশলের ফলে আইয়ুবের জয় হলেও পাকিস্তানে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পুরো কাঠামো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসের পথই দ্রুতভাবে প্রশস্ত হলো।
বিরোধী দলগুলি তখন নিজেদের নামে প্রার্থী খাড়া করলেই পরবর্তী প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে তাদের জয়ের সম্ভাবনা অনেক বৃদ্ধি পেতো। কিন্তু তাদের সাংগঠনিক কাঠামো ইউনিয়ন কাউন্সিল পর্যন্ত না থাকার জন্যে তারা সে পথে যেতে সাহস করেনি। এর ফলে সরকার বিরোধিতার আওয়াজ তুলে যে সমস্ত প্রার্থী ভোট প্রার্থনা করে তাদেরকে বিরোধী দল থেকে সমর্থন দেওয়া হয় এবং সেই সমর্থনের জোরে নির্বাচিত হয়ে তারা পরবর্তী পর্যায়ে নিজেদের আনুগত্য পরিবর্তন করে সরকারী দলের খাতায় নাম লেখায়।
আওয়ামী লীগ আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলগতভাবে প্রার্থী দাঁড় না করানোর সিদ্ধান্ত সম্পর্কে যে যুক্তি দেখিয়েছে সেটা যে নিতান্ত অসার তা বোঝার কোন অসুবিধে নেই। তাদের সিদ্ধান্তের অবশ্য কয়েকটি বিশেষ কারণ আছে। বিগত সাধারণ নির্বাচনের অভিজ্ঞতার পর এ কারণগুলির গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথমতঃ, স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নাম নিয়ে প্রার্থীদের পক্ষে এখন জয়লাভ অধিকাংশক্ষেত্রেই অসম্ভব। এ জন্যে নির্বাচনে সন্ত্রাসের আশ্রয় আরও জরুরীভাবে নেওয়া দরকার। সরকারী দলের প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে সন্ত্রাসের সাহায্যে নির্বাচিত হলে সরকারের যে দুর্নামের সম্ভাবনা, প্রার্থী সেইভাবে দাঁড় না করালে তাতে দুর্নামের সম্ভাবনা অনেক কম। সেক্ষেত্রে বলা যেতে পারবে যে, এক প্রার্থী আর এক প্রার্থীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসমূলক আচরণ করছে, তার সাথে সরকারী দলের কোন যোগাযোগ অথবা সম্পর্ক নেই।
বেশী দুর্নামের অংশীদার না হয়ে বেসরকারীভাবে সরকারী প্রার্থীদেরকে দাঁড় করানোর এই সিদ্ধান্তের ফলেই সরকারী দলের পক্ষে মুখোশ পরে সন্ত্রাস চালানো বিভিন্ন এলাকায় সম্ভব হচ্ছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টগুলি থেকে বোঝা যাচ্ছে, ঠিক নির্বাচনের সময় কি ধরনের আরও সব ঘটনা ঘটা সম্ভব।
নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, বিশেষতঃ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দল হিসেবে আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে উপরোক্ত সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ যে এ দেশের প্রায়- বিলুপ্ত নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিকে পরিপূর্ণ বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিতেই সহায়তা করছে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
বঙ্গবার্তা
২১শে নভেম্বর, ১৯৭৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন