মুদ্রাযন্ত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স ১৯৭৩

বদরুদ্দীন উমর

আইয়ুব খানের আমলে প্রবর্তিত ‘প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’ বাতিল করে বাঙলাদেশ সরকার ‘মুদ্রণযন্ত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৩’ নামে একটি নোতুন অর্ডিন্যান্স জারী করেছেন।

একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে, এই নোতুন অর্ডিন্যান্সটির নোতুনত্ব কিছুই নেই। পুরাতন অর্ডিন্যান্সটির বলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, পত্র-পত্রিকা বের করার স্বাধীনতা, নিরপেক্ষভাবে সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি যেভাবে খর্ব ও ব্যাহত হতো এবং তার বলে যে ভাবে পত্র-পত্রিকা সরকারের ইচ্ছেমতো বন্ধ করা হতো, বিরোধী মতাবলম্বী প্রকাশক-সম্পাদকদের ওপর জেল হুলিয়া যেভাবে চাপানো যেতো, নোতুন অর্ডিন্যান্সটিতেও ঠিক সেই একইভাবে সেই সমস্ত করা যাবে। কারণ, পুরাতনটি ১৯৬০ সালে সামরিক শাসনকর্তা আইয়ুব খানের দ্বারা প্রবর্তিত এবং নোতুনটি ১৯৭৩ সালে ‘জনপ্রিয়’ ও ‘দেশপ্রেমিক’ আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত হলেও দুই অর্ডিন্যান্সের ভেতরের মাল মসলার মধ্যে কোন তফাৎ নেই।

নোতুন অর্ডিন্যান্সটির ৪১ ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে যে, পূর্ববর্তী অর্ডিন্যান্সটির বলে সরকার যে সমস্ত কাজ করেছেন ও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেগুলি যদি নোতুন অর্ডিন্যান্সের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ না হয়, তাহলে সেগুলির কোন পরিবর্তন আর প্রয়োজন হবে না। নোতুন অর্ডিন্যান্সের বলেই সেই সমস্ত পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে।

এই ৪১ ধারার আলোকেই এখন নোতুন অর্ডিন্যান্সটির প্রকৃত চরিত্র বিচার করে দেখা দরকার। এই দেখার জন্যে প্রথমে প্রয়োজন হবে বর্তমান সরকার কর্তৃক গৃহীত কতকগুলি পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের উল্লেখ করা। ১৯৭২ সালে পুরাতন অর্ডিন্যান্সটির বলে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমে হামলা চালান সাপ্তাহিক ‘গণশক্তির’ ওপর। কতকগুলি আইনকানুনগত কারণ দেখিয়ে তাদের পুলিশ ‘গণশক্তির’ অফিস দখল করে তাতে তালা দেয় এবং সম্পাদক মোহাম্মদ তোয়াহা ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হাবিবুর রহমানের ওপর হুলিয়া জারী করে। এর ফলে ‘গণশক্তি’ বন্ধ হয়ে যায়। এই হামলার পর ক্রমাগতভাবে, একের পর এক, আরও অনেক হামলা হয়। ‘লাল পতাকা’ নিষিদ্ধ করা হয়, সাপ্তাহিক ‘হক কথা বন্ধ করে তার সম্পাদককে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর সাপ্তাহিক ‘মুখপত্র’ এবং ইংরেজী সাপ্তাহিক ‘Spokesman’ বন্ধ করে এই পত্রিকা দুটির সম্পাদক ফয়েজুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এঁদের কারো বিচার কোন আদালতে করার প্রশ্ন ওঠেনি। তাঁদের বিনা বিচারে আটক রাখা হয়েছে এবং তাঁদের পত্রিকাও আজ পর্যন্ত বন্ধ আছে। দৈনিক ‘গণকণ্ঠের’ সম্পর্কে সরকার যখন কতকগুলি অক্ষম যুক্তি দেখিয়ে তাদের ছাপাখানায় তালা ঝুলিয়ে পত্রিকা বন্ধ করার চেষ্টা করে তখন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে জনমত অনেকখানি জোরদার হয়ে উঠেছিলো। কাজেই সে সময়ে চারিদিকে প্রতিবাদের ঝড় উঠলো। সরকার পিছিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ‘গণকণ্ঠ’ বন্ধ করতে অক্ষম হলো। এরপর আক্রমণ হলো সাপ্তাহিক ‘নয়া যুগের’ ওপর। পত্রিকাটির প্রেস আটক করা হলো, সম্পাদককে গ্রেপ্তার করা হলো এবং প্রকাশক কাজী জাফরের ওপর জারী করা হলো হুলিয়া। পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলো। সর্বশেষে আক্রমণ এলো চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘দেশ বাংলার’ ওপর। পত্রিকার অফিস পুলিশ কর্তৃক দখল করিয়ে বার্তা সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে আওয়ামী লীগ সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দিলেন। ‘দেশ বাংলার’ গ্রেফতারকৃত সাংবাদিকদের কয়েকজনকে ছেড়ে দিলেও বার্তা সম্পাদক মৃণাল চক্রবর্তীকে এখনো মুক্তি দেওয়া হয়নি এবং দৈনিক ‘দেশ বাংলা’ এখনো বন্ধ আছে।

এই হলো সামরিক শাসক আইয়ুব খানের প্রেস অর্ডিন্যান্সের হাতিয়ার ‘দেশপ্রেমিক’ ও ‘গণতান্ত্রিক’ আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ব্যবহারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

নোতুন অর্ডিন্যান্সটি জারী হওয়ার পর সরকার পুরাতন অর্ডিন্যান্স বলে যে সমস্ত দুষ্কার্য এবং গণবিরোধী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তার কোনটি সম্পর্কেই নোতুনভাবে চিন্তা করার অথবা সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোন কারণ দেখেননি। উপরোল্লিখিত নির্যাতনের প্রত্যেকটি এখনো জারী আছে। মুদ্রণযন্ত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা, জেল, হুলিয়া, পত্রিকা অফিসের তালা সমস্তই পূর্ববৎ বহাল আছে। এগুলি বহাল থাকার সরল অর্থ হলো এই যে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, পত্র-পত্রিকার স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পুরাতন অর্ডিন্যান্সটির চরিত্র এবং ভূমিকা যা ছিলো বর্তমান অর্ডিন্যান্সটির চরিত্র ও ভূমিকা পুরোপুরি তাই। এজন্যেই সাংবাদিক ইউনিয়নের এক শ্রেণীর কর্মকর্তারা পুরাতন অর্ডিন্যান্স বাতিল করা এবং নোতুন অর্পিন্যান্স জারী করার জন্যে সরকারকে অভিনন্দন জানাবার নানান কৌশল অবলম্বনের চেষ্টা করলেও নোতুন অর্ডিন্যান্স জারী হওয়ার পরও তাঁদেরকে গণভবনে গিয়ে মৃণাল চক্রবর্তীর জন্যে দরবার করতে হচ্ছে।

পুরাতন অর্ডিন্যান্স বলে ধৃত মৃণাল চক্রবর্তীর মুক্তির জন্যে নোতুন অর্ডিন্যান্স জারীর পর সাংবাদিক ইউনিয়নকে এই দরবার করতে হচ্ছে কেন? তার কারণ কি? এর কারণ হলো এই যে, পুরাতন ও নোতুন অর্ডিন্যান্সের মধ্যে কথার সামান্য হেরফের ব্যতীত প্রকৃত কোন তফাৎ নেই। আইয়ুব খানের তলোয়ারকেই ‘জনপ্রিয়’, ‘দেশপ্রেমিক’, ‘গণতান্ত্রিক’ আওয়ামী লীগ সরকার একটি নোতুন খাপে ঢুকিয়েছেন।

এই অবস্থায় ‘ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট’ এবং ‘ঢাকা ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট’ এই দুই সাংবাদিক ইউনিয়ন কর্তৃক ঘোষিত ১৯৬০ সালের অর্ডিন্যান্স বাতিল আন্দোলনসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কি হবে সেটাই লক্ষণীয় বিষয়। কারণ সাংবাদিকদের আন্দোলনের মুখে সরকার কর্তৃক এই নোতুন অর্ডিন্যান্স জারীর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে মত প্রকাশ, সংবাদ পরিবেশন এবং পত্র-পত্রিকার স্বাধীনতার আন্দোলনকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করা। এর উদ্দেশ্য হলো, পুরাতন অর্ডিন্যান্স বাতিল হচ্ছে এই অজুহাতে যারা নোতুন অর্ডিন্যান্সটির পূর্ববৎ প্রতিক্রিয়াশীল এবং অগণতান্ত্রিক চরিত্র থেকে সাংবাদিকদের দৃষ্টি সরিয়ে রেখে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন বানচাল করতে চায়, আন্দোলনকে ছুরিকাঘাত করতে চায়, তাদের হাতকে জোরদার করা।

একথা বলাই বাহুল্য যে, পুরাতন অর্ডিন্যান্স বাতিল হয়ে গেছে, এই যুক্তিতে যারা নোতুন অর্ডিন্যান্সটি বাতিলের আন্দোলন না করার কথা বলবে এবং সাংবাদিকদের ‘চরমপন্থীদের কবলে পতিত না হওয়ার হিতোপদেশ দেবে তারা শোষক শ্রেণী ও সরকারের প্রচ্ছন্ন দালাল ব্যতীত কিছুই নয়। খুব সম্ভবতঃ এই সমস্ত সাংবাদিকদের সাথে যোগসাজশ ও চক্রান্ত করেই সরকার পুরাতন অর্ডিন্যান্সটির নাম এবং ভাষা পরিবর্তন করে তাকে নোতুন খাপে ঢোকাতে, তাকে নবজীবন দান করতে সাহস করেছে।

এই ধরনের সাংবাদিকদের সম্পর্কে সদা সতর্ক না থাকলে, সাংবাদিক এবং সেই সাথে বৃহত্তম জনসাধারণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলন বানচাল করার নানান কলাকৌশল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হলে, আন্দোলন আর অগ্রসর হবে না এবং সাংবাদিকরা জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আইয়ুব খানের আমলের মতই শাসক-শোষক শ্রেণীর সেবাদাস রূপে নিজেদের নেতাদের মাখন-রুটি খাওয়া, গাড়ী-ঘোড়া চড়া, বিদেশ ভ্রমণ ও মেদ বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করবেন।

সাপ্তাহিক গণবাংলা
৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩

সকল অধ্যায়

১. বাঙলাদেশে মার্কিন অনুপ্রবেশ
২. “গণমুখী” বক্তৃতা
৩. আওয়ামী লীগের জাতীয়করণ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে
৪. ভারত-বিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতা
৫. জাতীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ভূমিকা
৬. আওয়ামী লীগ সরকারের শ্রমনীতি
৭. সংবাদপত্র ও প্রকাশনার স্বাধীনতা
৮. আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত সংবিধান
৯. শাসনতন্ত্র প্রশ্নে বিরোধী দলগুলির ভূমিকা
১০. আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতি রক্ষা
১১. বাঙলাদেশের সংবিধান ও পরবর্তী নির্বাচন
১২. আইয়ুব খানের অস্ত্রাগার
১৩. আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণা
১৪. বাঙলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি
১৫. বাঙলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
১৬. বাঙলাদেশে শ্রমিক হত্যা
১৭. জাতি সমস্যা ও ভাষা আন্দোলন
১৮. আওয়ামী লীগের ‘শুদ্ধি অভিযান’ প্রসঙ্গে
১৯. মাধ্যমিক শিক্ষক ধর্মঘট প্রসঙ্গে
২০. মুদ্রাযন্ত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স ১৯৭৩
২১. ত্রিদলীয় ঐক্যজোট ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন
২২. ১৯৪৮ সাল থেকে পশ্চিম এশিয়ায় দু’ধরনের যুদ্ধ চলছে
২৩. বাঙলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি
২৪. বাঙলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি
২৫. ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন প্রসঙ্গে
২৬. সংসদীয় বিরোধী দলসমূহের ঐক্য প্রসঙ্গে
২৭. দালাল আইনে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি প্রসঙ্গে
২৮. জনগণ গণতান্ত্রিক বিরোধী দলগুলির ঐক্য কেন চাইছেন?
২৯. ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের তাৎপর্য
৩০. বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্বীকৃতি প্রসঙ্গে
৩১. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও বাঙলাদেশের স্বাধীনতা
৩২. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ও বাঙলাদেশে সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব
৩৩. সাম্রাজ্যবাদের যুগে জাতীয়তাবাদ
৩৪. গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বতঃস্ফূর্ততা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন