গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বতঃস্ফূর্ততা

বদরুদ্দীন উমর

১৯৪৭ সালের পর থেকে পূর্ব বাঙলা নামে পরিচিত এবং বর্তমান বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের অন্তর্গত ভূখণ্ডে যে সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে সেগুলোতে স্বতঃস্ফূর্ততার প্রাধান্য বরাবরই লক্ষিত হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ততার প্রাধান্য কোন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত সুফলপ্রসূ হতে পারে না এবং এদেশেও তা হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্যাতনমূলক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে; কিন্তু এই আন্দোলনেও সেই স্বতঃস্ফূর্ততার প্রাধান্য আবার পরিলক্ষিত হচ্ছে। এজন্যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ততার প্রশ্নটিকে বিবেচনা করা একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্তব্য।

এদেশে প্রথম ব্যাপক গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে ভাষা আন্দোলনের উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৪৭ সালের আগস্ট থেকে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত মুসলিম লীগ সরকার কৃষক, শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত জনগণের ওপর যে শাসন-শোষণ চালায় তার ফলে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের একটা বাস্তব পরিস্থিতি যদি বিরাজ না করতো তাহলে ভাষা আন্দোলন অল্পসংখ্যক মধ্যশ্রেণীভুক্ত ছাত্রের প্রতিরোধ ও রক্তদান থেকে একটা ব্যাপক গণ-আন্দোলনে কিছুতেই পরিণত হতে পারতো না। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত পূর্ব বাঙলায় এমন কোন রাজনৈতিক দল ছিল না যে দলের কোন প্রকৃত নেতৃত্ব জনগণের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো। কিন্তু তবু রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির প্রতিরোধ আন্দোলন সেদিন জন্মদান করেছিলো দেশব্যাপী এক প্রচণ্ড বিক্ষোভের, যে বিক্ষোভে শুধু মধ্যশ্রেণীভুক্ত ছাত্ররাই অংশগ্রহণ করেনি, কৃষক-শ্রমিক এবং মধ্যবিত্ত মেহনতী জনগণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এলেও পরবর্তী পর্যায়ে সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে সুষ্ঠুভাবে উচ্চতর স্তরে পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন রাজনৈতিক দলেরই কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকেনি। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে যা করেছিলো, সেটাও ছিলো জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের সুযোগ গ্রহণ, অন্য কিছু নয়। ছয় বছরের নির্যাতন-কুশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের যে বিক্ষোভ ক্রমশঃ পুঞ্জীভূত হচ্ছিলো সেই বিক্ষোভই একটা অভিব্যক্তি লাভ করেছিলো জনগণের নির্বাচনী রায়ের মাধ্যমে। স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর নির্ভরশীলতা এবং জনগণকে রাজনীতিগতভাবে শিক্ষিত করা এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অক্ষমতার ফলেই ১৯৫৪ সালে বিরোধী দলসমূহের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী সাফল্য জনগণের বিজয়ে রূপান্তরিত হতে পারেনি। উপরন্তু সে সাফল্য কতকগুলি সংসদীয় দল-উপদলের ক্ষমতা দখলের বিবিধ চক্রান্তের পথই প্রশস্ত করেছিলো এবং সে চক্রান্তের পরিণতি শেষ পর্যন্ত ঘটেছিলো পাকিস্তানের সামরিক অভ্যুত্থানে।

সামরিক শাসনের আমলেও পূর্ব বাঙলায় যে সমস্ত গণআন্দোলন হয়েছে তার মধ্যেও স্বতঃস্ফূর্ততার প্রাধান্য বর্তমান ছিলো। ১৯৬৪-৬৫ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যে রায় প্রদান করেন তার মধ্যে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভেরই অভিব্যক্তি ঘটে। জনগণের মধ্যে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ ছয়-সাত বছর ধরে ক্রমশঃ পুঞ্জীভূত হচ্ছিলো সেই বিক্ষোভকে পুঁজি করেই দ্বিতীয়বার এদেশে বিরোধীদলীয় যুক্তফ্রন্ট ১৯৬৪-৬৫ সালে নির্বাচনী আসর গরম করেছিলো। এ দেশের শাসক-শোষক শ্রেণীর শ্রেণীগত চরিত্র, তাদের শাসন-শোষণের নানান কৌশল ইত্যাদি সম্পর্কে জনগণকে শিক্ষিত করে তার ভিত্তিতে তাঁদেরকে যথার্থভাবে সংগঠিত করার প্রয়াস এই সমস্ত বিরোধী দলের ছিলো না। তারা জনগণের বিক্ষোভ প্রবণতাকে মূলধন করেই নিজেদের রাজনীতি ব্যবসাকে প্রসার ও প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা করেছিলো মাত্র। এ জন্যে তাদের নির্বাচনী সাফল্য অথবা অন্যান্য ‘কৃতিত্ব’ শেষ পর্যন্ত জনগণের কোন উপকারেই আসেনি।

১৯৬৮-৬৯ সালে যে দেশব্যাপী ব্যাপক গণ-আন্দোলন ও বিক্ষোভ শুরু হয় তার চরিত্রও ছিলো মূলতঃ স্বতঃস্ফূর্ত। এই স্বতঃস্ফূর্ততার জন্যেই অদৃষ্টপূর্ব ব্যাপকতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে তীব্রতা সত্ত্বেও সে আন্দোলনের কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিলো না এবং শেষ পর্যন্ত সে আন্দোলনও সংসদীয় রাজনীতির ষড়যন্ত্রের মধ্যেই একটা পরিণতি লাভ করেছিলো। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন গোল টেবিলের রাজনীতিই সে সময়ে প্রাধান্যে এসেছিলো এবং তার ফলে জনগণের শাসন কায়েমের পরিবর্তে জনগণের শোষকদের রাজত্ব কায়েমের পদক্ষেপ হিসেবেই তারা সেই আন্দোলনকে ব্যবহার করেছিলো।

জনগণকে রাজনীতিগতভাবে সংগঠিত করা সম্ভব ছিলো না বলে আওয়ামী লীগ ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের আমলে কতকগুলো রাজনৈতিক ধ্বনি তুলে সেগুলির ভিত্তিতেই জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভকে ব্যবহার করে। অন্য কোন রাজনৈতিক দল স্বতঃস্ফূর্ততাকে ব্যবহার করতে অথবা জনগণকে যথার্থ রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং উপযুক্তভাবে সংগঠিত করতে না পারার ফলে আওয়ামী লীগই সর্ব প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রাধান্য লাভ করে এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়লাভ করে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনী বিজয়ের মতো সেই বিজয়েও ছিলো জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভেরই অভিব্যক্তি মাত্র।

নির্যাতিত ও বিক্ষুব্ধ জনগণ নিজেদের স্বতঃস্ফূর্ত চালিকাশক্তির মাহাত্ম্যে নির্বাচনের পরবর্তী পর্যায়ে রাজনীতিকে উত্তরোত্তর একটা সশস্ত্র সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিতে থাকেন। এ দিক দিয়ে ১৯৭১-এর পরিস্থিতি বিশেষ কোন ব্যতিক্রম ছিলো না। গান্ধীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনও প্রতিবারই নিজের গতিবেগে সশস্ত্র সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যেতো এবং গান্ধী প্রতিবারই অনশন অথবা অন্য কোন কৌশলে জনগণের সেই আন্দোলনের রাশ টেনে ধরতেন। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততাকে নষ্ট হতে না দিয়ে তিনি তাকে নিজেদের শ্রেণী-স্বার্থেই সব সময় ব্যবহার করতে সচেষ্ট এবং যত্নবান থাকতেন। ১৯৬৮-৬৯ সালে পূর্ব বাঙলাতে যা ঘটেছিলো তার মৌলিক চরিত্রও ঐ একই ছিলো।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৭১ সালে জনগণ ইয়াহিয়া খান কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে সংবিধান সভায় দেশের সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে নানান বাধা সৃষ্টি করতে দেখে ক্রমশঃ ধৈর্যচ্যুত হতে থাকেন। গান্ধীর মতোই আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ জনগণের সেই ধৈর্যচ্যুতিকে ‘বিপথে’ যেতে না দিয়ে নিজেদের স্বার্থের পথের পাথেয় হিসেবেই ব্যবহার করতে উদ্যোগী হন এবং অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

সেই পরিকল্পনার ফলে ব্যাপক জনগণের জীবনে কি অভিশাপ নেমে আসে তার বিস্তারিত বিবরণ এখানে প্রয়োজন নেই। কিন্তু যে কথা এখানে উল্লেখ করা দরকার তা হলো এই যে, ১৯৭১ সালে এখানে যে সশস্ত্র সংগ্রাম ও প্রতিরোধ শুরু হয় তার মধ্যেও রাজনৈতিক সচেতনতা এবং উপযুক্ত সাংগঠনিক তৎপরতার পরিবর্তে স্বতঃস্ফূর্ততার প্রাধান্যই পূর্ববৎ বজায় থাকে।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব তো বটেই এমনকি কর্মীবৃন্দেরও বিপুল অধিকাংশ ভারতে পলায়ন করলেও সচেতনভাবে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেকে দূরে থাকে এবং অস্ত্র সংগ্রহ করে নিজেদের ব্যক্তিগত ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ ভবিষ্যতে কিভাবে গুছিয়ে নেওয়া যায় সেই চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকে। অন্যদিকে অসংখ্য দেশপ্রেমিক যুবকেরা, যার মধ্যে অধিকাংশই কৃষক সন্তান, পূর্ব বাঙলার এলাকা থেকে ভারতে গিয়ে অথবা পূর্ব বাঙলার মাটিতে অবস্থান করেই আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতৃত্বের নির্দেশে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেন। পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে এরাই ছিলো সংখ্যায় সব থেকে বেশী এবং সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী।

কিন্তু এই যুবকেরা সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে, দেশের জনগণকে এক ব্যাপক সামরিক আক্রমণের হাত থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে। তার মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা যতটুকু ছিলো তার থেকে অনেক বেশী ছিলো স্বতঃস্ফূর্ততা। এই স্বতঃস্ফূর্ততার জন্যে পূর্ব বাঙলার মাটি থেকে পাকিস্তান উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সেই সমস্ত যুবক রাজনীতিগতভাবে তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি। একদিকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহ ১৯৭১ সালের স্বতঃস্ফূর্ত সশস্ত্র সংগ্রামের ফায়দা উঠিয়েছে এবং অন্যদিকে উপরোক্ত দেশপ্রেমিক যোদ্ধারা হয় বেকার যুবকে পরিণত হয়েছেন নতুবা অস্ত্রশস্ত্রের অরাজনৈতিক ব্যবহারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগওয়ালাদের মতোই নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে নিযুক্ত হয়েছেন। আজ সারা বাঙলাদেশে যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৈরাজ্য ও রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে সে অবস্থা পুরোপুরিভাবে এই স্বতঃস্ফূর্ততারই প্রত্যক্ষ পরিণতি। পূর্ব বাঙলায় ১৯৪৭ সাল থেকে শোষক শ্রেণীর শাসন – শোষণের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভকে সুকৌশলে কাজে লাগানোর যে রাজনৈতিক ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছিলো ১৯৭১ সালের সশস্ত্র সংঘর্ষ ছিলো সেই ঐতিহ্যেরই অন্তর্গত, তার বাইরে নয়। শুধু কি তাই? বাঙলাদেশ রাষ্ট্র স্থাপিত হওয়ার পরবর্তী পর্যায়েও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের যে ধারা এখনো পর্যন্ত লক্ষিত হচ্ছে সে ধারার মধ্যেও স্বতঃস্ফূর্ততার প্রাধান্য বিন্দুমাত্র কমেনি, পূর্ববৎ বজায় আছে।

আলোচনার এই পর্যায়ে দেখা দরকার স্বতঃস্ফূর্ততা কাকে বলে, স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর নির্ভরশীলতার অর্থ কি এবং স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর নির্ভর করে যারা নিজেদের রাজনৈতিক শক্তিকে সংহত করে অথবা করতে চেষ্টা করে তারা জনগণের সত্যিকার মুক্তি আনতে সক্ষম কি না।

স্বতঃস্ফূর্ত রাজনৈতিক বিক্ষোভ অথবা আন্দোলন সম্ভব হয় দুটি প্রধান শর্ত পূর্ণ হলে। প্রথমটি হলো শাসক শোষক শ্রেণীর একটানা নিমর্ম শোষণ ও নির্যাতন এবং দ্বিতীয়টি হলো উপযুক্ত রাজনৈতিক সচেতনতার ও সেই চেতনা সৃষ্ট সংগঠনের অভাব। ক্রমাগত শোষণ ও নির্যাতনের ফলে শাসক-শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে জনগণের একটা বিক্ষোভ ক্রমশঃ পুঞ্জীভূত হতে থাকে এবং রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবে সেই বিক্ষোভ জনগণের মধ্যে সাধারণভাবে একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর জন্ম দেয়। এই দৃষ্টিভঙ্গীর অর্থ বাস্তব ক্ষেত্রে দাঁড়ায় সরকার ও শাসক দলের পরিবর্তন প্রচেষ্টা শাসক দলকে ক্ষমতা চ্যুত করে এবং প্রতিষ্ঠিত সরকারের পতন ঘটিয়েই জনগণ এক্ষেত্রে নিজেদের মুক্তি আনতে সচেষ্ট হন।

স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর নির্ভলশীলতার প্রকৃত অর্থ জনগণকে সচেতনভাবে সংগঠিত করার চেষ্টা না করে প্রতিষ্ঠিত সরকার এবং শাসকদলকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর সুযোগ নিয়ে সেই সরকারের পতন ঘটিয়ে অন্য একটি সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা কিন্তু জনগণকে শ্রেণী সচেতন এবং উপযুক্তভাবে সংগঠিত করার কাজ থেকে সচেতনভাবে বিরত থাকা। এর ফলে যাঁরা স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর নির্ভর করেন তাঁরা যে শুধু সমাজের মধ্যে সামাজিক শক্তিগুলি বিন্যাসের ক্ষেত্রে কোন মৌলিক পরিবর্তন সাধন করতে সক্ষম হন না তাই নয়, যাতে সেই পরিবর্তন বাস্তব ক্ষেত্রে সাধিত না হয় তার জন্যেই তাঁরা নানান অপকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেন।

যাঁরা জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সরকার বিরোধিতার ওপর নির্ভর করে নিজেদের রাজনীতিকে সংগঠিত করতে চেষ্টা করেন, তাঁদের দ্বারা যে জনগণের সত্যিকার মুক্তি সম্ভব নয় সে কথা বলাই বাহুল্য। কারণ, জনগণের মুক্তি কোন ব্যক্তির শুভেচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়। কোন রাজনৈতিক জাদুবিদ্যার দ্বারাও সেই উদ্দেশ্য সাধন করা যায় না। জনগণের ওপর শাসক শোষক শ্রেণীর যে শাসন-শোষণ ও নির্যাতন জারী থাকে তার দায়িত্বও কোন ব্যক্তি বিশেষের কখনো হতে পারে না। কারণ, কোন ব্যক্তিই অতখানি শক্তিশালী নয়। এই শাসন-শোষণ- নির্যাতনের মূল কারণ কতকগুলি বাস্তব সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক। এই সম্পর্কগুলোর পরিবর্তন ব্যতীত জনগণের জীবনে কোন মৌলিক পরিবর্তন কখনো আসতে পারে না।

জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর নির্ভর করে যে রাজনীতি গড়ে ওঠে তার দ্বারা জনগণের মুক্তি আসতে পারে না। একথার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, এই স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের কোন রাজনৈতিক মূল্য নেই অথবা তাকে কোন প্রকারেই কাজে লাগানো যায় না। মোটেই তা নয় উপরন্তু জনগণের এই বিক্ষোভ এবং জনগণ কর্তৃক শাসক দলের পরিবর্তন কামনা সমাজে যে বাস্তব পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সে পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত কোন সত্যিকার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের চিন্তা ও প্রচেষ্টা কোন সমাজেই সম্ভব নয়।

এ ক্ষেত্রে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততাকে যদি নদীর বন্যার পানির সাথে তুলনা করা যায় তাহলে বিষয়টা হয়তো আরও পরিষ্কার হবে। আমাদের দেশে প্রতি বছরই প্রায় বন্যা হয় এবং বন্যার পানি প্রবল গতিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে ফসলের ক্ষতি তো করেই এমন কি মানুষ ও গবাদি পশুর জীবনহানিও ঘটায়। কিন্তু আমরা সকলে জানি যে, এই বন্যাকে যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঁধ নির্মাণ করে এবং অন্যান্যভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে তার থেকে অনেক উপকার সম্ভব। বিদ্যুৎ-শক্তি উৎপাদন, সেচব্যবস্থা, পলি মাটির আমদানী ইত্যাদির মাধ্যমে তখন কৃষির অশেষ উন্নতি সাধিত হতে পারে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে বন্যার পানির মধ্যে দোষের কিছু নেই। যা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে সেই পানিকে জনগণের স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করা। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত রাজনৈতিক বিক্ষোভ ও আন্দোলনেরও সেই অবস্থা। তার মধ্যেও এমনিতে কোন দোষ নেই। দোষ ঘটে তখনই যখন তাকে নিয়ন্ত্রণ না করে ছেড়ে দেওয়া হয়। রাজনৈতিক সচেতনতা ব্যতীত জনগণের এই স্বতঃস্ফূর্ততাকে নিয়ন্ত্রণ করার সুষ্ঠু চিন্তা ও পরিকল্পনা সম্ভব নয় এবং উপযুক্ত রাজনৈতিক সংগঠন ব্যতীত সেই স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভকে নিয়ন্ত্রণ করাও চলে না। সচেতনতা ও নিয়ন্ত্রণের এই অভাবই অনিয়ন্ত্রিত বন্যার পানির মতো সমাজের দুকূল ভাসিয়ে নিয়ে যায় কিন্তু তার দ্বারা জনগণের কোন উপকার হয় না। সমাজের মৌলিক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন ঘটে না। একদল শাসক শোষকের পরিবর্তে অন্য আর একদল শাসক-শোষক কর্তৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়ে জনগণকে পূর্বের মতোই অথবা আরও তীব্রতরভাবে শাসন ও শোষণ করতে থাকে।

স্বতঃস্ফূর্ত রাজনৈতিক আন্দোলনে স্বল্পকালের জন্য জনগণ একটা উত্তাল তরঙ্গের মতো সমাজে ভেসে উঠলেও রাজনৈতিক সচেতনতা ও সংগঠনের অভাবে তাঁরা নিজেদের শক্তিকে টিকিয়ে রাখতে পারেন না। তাঁদের ক্ষমতা হয় অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী এজন্যে তাদের ক্ষণস্থায়ী বিক্ষোভ আন্দোলনের পর যাঁরা ক্ষমতায় আসেন তাঁরা জনগণের কেউ নন। নিজেদের শ্রেণীস্বার্থেই কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্ত জনগণকে তারা প্রয়োজন ও সুযোগমতো শাসন ও শোষণ করেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাঙলাদেশে যে শাসন, শোষণ ও নির্যাতন শুরু হয়েছে তার ফলেও জনগণের মধ্যে একটা প্রচণ্ড বিক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে এবং পূর্ববর্তী সময়ের মতো এখনো স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর নির্ভরশীল হওয়ার একটা প্রবল প্রবণতা আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে লক্ষিত হচ্ছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের রাজনৈতিক স্বতঃস্ফূর্ততা এবং তার ওপর নির্ভরশীল রাজনীতি সম্পর্কে মৌলিক চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন নিতান্তই অপরিহার্য।

গণকণ্ঠ
১৮ই জানুয়ারী, ১৯৭৪

অধ্যায় ৩৪ / ৩৪

সকল অধ্যায়

১. বাঙলাদেশে মার্কিন অনুপ্রবেশ
২. “গণমুখী” বক্তৃতা
৩. আওয়ামী লীগের জাতীয়করণ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে
৪. ভারত-বিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতা
৫. জাতীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ভূমিকা
৬. আওয়ামী লীগ সরকারের শ্রমনীতি
৭. সংবাদপত্র ও প্রকাশনার স্বাধীনতা
৮. আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত সংবিধান
৯. শাসনতন্ত্র প্রশ্নে বিরোধী দলগুলির ভূমিকা
১০. আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতি রক্ষা
১১. বাঙলাদেশের সংবিধান ও পরবর্তী নির্বাচন
১২. আইয়ুব খানের অস্ত্রাগার
১৩. আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণা
১৪. বাঙলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি
১৫. বাঙলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
১৬. বাঙলাদেশে শ্রমিক হত্যা
১৭. জাতি সমস্যা ও ভাষা আন্দোলন
১৮. আওয়ামী লীগের ‘শুদ্ধি অভিযান’ প্রসঙ্গে
১৯. মাধ্যমিক শিক্ষক ধর্মঘট প্রসঙ্গে
২০. মুদ্রাযন্ত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স ১৯৭৩
২১. ত্রিদলীয় ঐক্যজোট ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন
২২. ১৯৪৮ সাল থেকে পশ্চিম এশিয়ায় দু’ধরনের যুদ্ধ চলছে
২৩. বাঙলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি
২৪. বাঙলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি
২৫. ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন প্রসঙ্গে
২৬. সংসদীয় বিরোধী দলসমূহের ঐক্য প্রসঙ্গে
২৭. দালাল আইনে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি প্রসঙ্গে
২৮. জনগণ গণতান্ত্রিক বিরোধী দলগুলির ঐক্য কেন চাইছেন?
২৯. ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের তাৎপর্য
৩০. বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্বীকৃতি প্রসঙ্গে
৩১. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও বাঙলাদেশের স্বাধীনতা
৩২. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ও বাঙলাদেশে সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব
৩৩. সাম্রাজ্যবাদের যুগে জাতীয়তাবাদ
৩৪. গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বতঃস্ফূর্ততা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন