বদরুদ্দীন উমর
বিগত ১১ই নভেম্বর বাঙলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলনে উদ্বোধনী ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘যারা রাতের বেলায় গোপনে রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, সাধারণ মানুষকে হত্যা করে তাদের সঙ্গে ডাকাতদের কোন পার্থক্য নেই।… রাতের অন্ধকারে গোপনে হত্যা করে বিপ্লব করা যায় না। তোমরা যে পথ ও দর্শন বেছে নিয়েছো তা ভুল।… আমরা গণতন্ত্র দিয়েছি ঠিক। কিন্তু কেউ যদি রাতের বেলায় নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করতে পারে তাহলে জনগণের সরকার হিসেবে আমাদেরও তাদের গুলি করে হত্যা করার অধিকার আছে।’ (বঙ্গবার্তা, ১২ নভেম্বর, ১৯৭৩)
প্রধানমন্ত্রী উপরোক্ত ছাত্র সম্মেলনে আরও বলেন, ‘সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথে প্রয়োজনবোধে আরও রক্ত দিতে হইলে বা চিলির মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হইলেও এদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হইবে।’ (ইত্তেফাক, ১২ই নভেম্বর, ১৯৭৩)
ঐ একই দিন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী রাজশাহীর এক জনসভায় বলেন, ‘সরকার যেভাবে বিরোধীদলীয় কর্মী হত্যা করা শুরু করেছে তার ফলে এদেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ রুদ্ধ হতে চলেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আর কোন সভা-সমিতিতে ন্যাপ অংশগ্রহণ করতে পারবে না।… দমননীতির দ্বারা এবং মানুষকে হত্যা করে দেশ শাসন করা যায় না। আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের পতন হয়েছে, এভাবেই হত্যার রাজনীতি চলতে থাকলে এ সরকারের পতন অবশ্যম্ভাবী। … ইতিহাস থেকে শিক্ষা নাও। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি এবং বিরোধী দল ছাড়া কোন গণতান্ত্রিক সরকার বেঁচে থাকতে পারে না।’ (বঙ্গবার্তা, ১২ই নভেম্বর, ১৯৭৩)
বিরোধীদলীয় কর্মীদের হত্যা সম্পর্কে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের বক্তব্যও এক্ষেত্রে মওলানা ভাসানীর বক্তব্যের অনুরূপ।
প্রথমতঃ দেখা যাচ্ছে যে, বাঙলাদেশের শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিকে রক্ষা ও পরিচালনার প্রাথমিক দায়িত্বে অধিষ্ঠিত বাঙলাদেশের নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের বিরুদ্ধে এই মর্মে অভিযোগ করছেন যে, তারা রাতের অন্ধকারে গোপনে কর্মী, ছাত্র ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করছেন এবং সেই হিসেবে ডাকাতদের সাথে তাঁদের কোন পার্থক্য নেই এবং সে পার্থক্য নেই বলেই তাদেরকে হত্যা করার অধিকার সরকারের আছে বলেও তিনি ঘোষণা করেছেন। এই হত্যা করার ‘অধিকার’ বলে বলীয়ান হয়ে বৰ্তমান বাঙলাদেশ সরকার বিরোধীদলীয় এই ‘ডাকাত’ রাজনৈতিক কর্মী ও ব্যক্তিদেরকে বাস্তবতঃ হত্যা করছেন কিনা সে-কথা প্রধানমন্ত্রী অবশ্য তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেননি।
এদিকে মওলানা ভাসানী ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতৃবৃন্দ সরকারের বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ করছেন যে, সরকার যেভাবে বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যা করছেন তাতে এদেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ রুদ্ধ হতে চলেছে। বিরোধী দলগুলির প্রতি সরকারের চরম শত্রুতামূলক আচরণের উল্লেখ করে মওলানা ভাসানী সরকারকে ইতিহাস থেকে এই শিক্ষা নিতে বলছেন যে, বিরোধী দল ছাড়া কোন দেশে গণতান্ত্ৰিক রাজনীতির অস্তিত্ব থাকতে পারে না।
সরকার ও বিরোধী পক্ষের উপরোক্ত বক্তব্যসমূহ থেকে প্রথমেই যে জিনিসটি স্পষ্ট হয় তা হলো আজকের বাঙলাদেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির আবহাওয়া বর্তমান আছে একথা কেউই স্বীকার করছেন না। উভয় পক্ষই একমত হয়ে বলছেন যে, এদেশে যে রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে সেটা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে বিরাট বাধাস্বরূপ। কিন্তু এই একমতের পর দ্বিমত হচ্ছে তখন যখনই এই বাধা সৃষ্টির ক্ষেত্রে দায়িত্ব বণ্টনের প্রশ্ন উঠছে। বাঙলাদেশ সরকার এবং তার প্রধানমন্ত্রী বলছেন, এই অবস্থা সৃষ্টির সম্পূর্ণ দায়িত্ব বিরোধী দলের। এবং বিরোধী পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, সরকার তার বিভিন্ন বাহিনীর মাধ্যমে বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সন্ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে এবং সেই সরকারী সন্ত্রাসের কারণেই সমগ্র দেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ আজ রুদ্ধ হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের দুটি বিষয় এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথমতঃ, এক ধরনের বিরোধীদলীয় কর্মীদের ‘ডাকাত’ হিসেবে বর্ণনা এবং দ্বিতীয়তঃ, যেহেতু, তারা ‘ডাকাত’ সেজন্যে তাদেরকে গুলি করে হত্যার ক্ষেত্রে সরকারের ‘অধিকার’ থাকার কথা।
বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদেরকে ‘চোর’, ‘ডাকাত’, ‘ক্রিমিনাল’ ইত্যাদি আখ্যা দেওয়া ১৯৪৭ সাল থেকে এদেশের রাজনীতিতে কোন নোতুন ব্যাপার নয়। ১৯৫০ সালে নাচোলে ইলা মিত্রের নেতৃত্বে সাঁওতাল এবং অন্যান্য কৃষকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের সময় নূরুল আমীন সরকার ইলা মিত্রের দলকে (তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি প্রভাবাধীন ) এইসব আখ্যাতেই ভূষিত করেছিলেন। ইলা মিত্র যে ডাকাতদের সর্দার এ বিষয়ে তাঁরা এত ‘সুনিশ্চিত’ ছিলেন এবং ডাকাতদের সাথে যথেচ্ছ ব্যবহার যে সম্পূর্ণ ‘গণতান্ত্রিক ‘ এ ব্যাপারেও তাঁদের ‘বিশ্বাস’ এত দৃঢ় ছিলো যে, নূরুল আমীনের পুলিশ যখন ইলা মিত্রকে জেল-হাজতে ধর্ষণ করেছিলো তখন তার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেওয়া তারা প্রয়োজন বোধ করেননি। উপরন্তু তার প্রতি তাঁদের সমর্থনই প্রকারান্তরে জ্ঞাপন করেছিলেন। রাজশাহী জেলের খাপরা ওয়ার্ডে যে সমস্ত কমিউনিস্ট রাজবন্দীকে ১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিলো সেই সমস্ত দেশপ্রেমিককেও নূরুল আমীনের মুসলিম লীগ সরকার ক্রিমিনাল এবং দেশদ্রোহী আখ্যাতে ভূষিত করতে দ্বিধাবোধ করেনি। এই সে দিন পর্যন্ত ১৯৭০ সালে যখন রাজবন্দীদের মুক্তির দাবী জোরদার হয়ে উঠেছিলো তখন স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া খান তৎকালীন পূর্ব বাঙলার সমস্ত রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদেরকে ‘ক্রিমিনাল’ আখ্যা দিয়ে তাঁদের মুক্তির প্রশ্নকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছিলো। কিন্তু নূরুল আমীন সরকার থেকে শুরু করে ইয়াহিয়া খানের সরকার পর্যন্ত সবগুলো গণবিরোধী সরকার রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের সম্পর্কে তৎকালে যে মূল্যায়ন করেছিলো সে মূল্যায়ন এবং আখ্যা ইতিহাসের ধোপে টেকেনি। পরবর্তী রাজনৈতিক অগ্রগতি এবং পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছিলো যে মণি সিং, দেবেন শিকদার প্রভৃতি রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা আর যাই হোক, তাঁরা চোর, ডাকাত, ক্রিমিনাল নয়। উপরন্তু নূরুল আমীন এবং ইয়াহিয়া খানের দলই ছিলো প্রকৃত ক্রিমিনাল।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে (তাঁরা সরকারী মতে যতই ‘বিপথগামী’ অথবা চরমপন্থী হোক না কেন) যে চোর, ডাকাত ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত করা চলে না এবং সে চেষ্টা কোন সরকার কর্তৃক করা হলে তার পরিণতি যে শেষ পর্যন্ত কি হয়, সে কথা বাঙলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অজানা থাকার কথা নয়। পাকিস্তানের আমলের রাজনীতিতে এক্ষেত্রে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতাও অনেক। কিন্তু এতদিনকার রাজনীতির সেই অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাকে সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে দিয়ে বাঙলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদেরকে (তারা যত চরমপন্থীই হোক) চোর-ডাকাত হিসাবে বর্ণনা করে যে এদেশে গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ পরিষ্কার করছেন না, একথা বলাই বাহুল্য।
দ্বিতয়তঃ, ডাকাতদেরকে গুলি করে মারার অধিকার সম্পর্কিত প্রশ্ন। যে-কোন দেশেই চোর-ডাকাত থাকতে পারে, বিশেষতঃ অসমাজতান্ত্রিক ও শোষণভিত্তিক সমাজে। কিন্তু ডাকাতদেরকে পিটিয়ে অথবা সরাসরি গুলি করে হত্যা করা কোন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির অঙ্গ হতে পারে না। চোর-ডাকাতদেরকে সরকার কিভাবে শাস্তি দান করবেন সে ব্যবস্থা প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির দেশে নির্দিষ্টভাবে কতকগুলি আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় এবং আদালতই সেটা নির্ধারণ করেন, অন্য কেউ নন। প্রধানমন্ত্রী ডাকাতদেরকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে তাদেরকে গুলি করে মারার যে অধিকারের কথা (প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের কথা বাদ দিয়ে) বলেছেন সে অধিকার কোন সুসভ্য, গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার কোনক্রমেই সাধারণভাবে দাবি করতে পারে না।
একথা সত্য যে, বর্তমান বাঙলাদেশে এক অদৃষ্টপূর্ব অরাজকতার পরিস্থিতির মধ্যে একদল প্রকৃত ডাকাত ও দুষ্কৃতিকারী দেশময় লুটতরাজ, খুনখারাবী করে বেড়াচ্ছে। রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদের সাথে তাদের যথাযথ পার্থক্য নির্দেশ করে তাদেরকে সমুচিত শাস্তি প্রদান করা যে-কোন সরকারেরই দায়িত্ব। কিন্তু সে দায়িত্ব কোন্ পদ্ধতিতে পালন করা হবে, সে পদ্ধতি ‘দায়িত্বসম্মত’ ও গণতান্ত্রিক কিনা সেটা বিচার-বিবেচনাও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকারের দায়িত্ব। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় এই দায়িত্ব চেতনার অভাব নিদারুণভাবেই পরিলক্ষিত হয়েছে।
সরকার এবং বিরোধী দলসমূহ বাস্তব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পরস্পরের বিরুদ্ধে যে-সমস্ত বক্তব্য উপস্থিত করেছেন সেগুলির সত্যাসত্য নির্ধারণ বর্তমান আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। সে বিষয়বস্তুটি হলো এই যে, আমাদের দেশে আজ যে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে সে পরিস্থিতি সরকার এবং বিরোধী দল দুই পক্ষের দ্বারাই যেভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং সে পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্যে যে সমস্ত পদ্ধতির উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলি নিময়তান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে সহায়ক নয়। উপরন্তু তার মাধ্যমে এদেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির চরম ক্ষয়িষ্ণু অবস্থাই নির্ভুলভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এখানে আর একটি জিনিস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সরকার এবং উপরোক্ত বিরোধী দলসমূহ, এদেশে ‘সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প ঘোষণার ক্ষেত্রে কেউ কারও থেকে পিছিয়ে নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, সমাজতন্ত্র এদেশে তাঁরা কায়েম করবেনই করবেন। তার জন্য এদেশে চিলির মতো অবস্থা সৃষ্টি হলেও তাঁরা তার মোকাবেলা করবেন।
এ প্রসঙ্গে শুধু এইটুকুই বলা যেতে পারে যে, বাঙলাদেশের ‘চিলি’ হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ চিলি “চিলি’ হয়েছে এই কারণেই যে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তারা সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি বাজেয়াপ্ত করেছিলো। এ জন্যেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদসহ অন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আলেন্দে সরকারকে উচ্ছেদ করেছিলো। বাঙলাদেশ সেদিক দিয়ে ‘দুর্বল’ নয়। এদেশে সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ হিসেবে শিল্প, ব্যাংক, বীমা জাতীয়করণের সময় বাঙলাদেশের ‘বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন’ সরকার বিদেশী ও সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিকে স্পর্শ করেননি। তাদেরকে পাকিস্তানী আমলের মতই অক্ষত রেখেছেন। উপরন্তু বিদেশী ও সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির প্রসারের জন্য বাঙলাদেশের ‘সমাজতান্ত্রিক’ অর্থনীতি আজ সম্পূর্ণ প্রস্তুত। চিলির অবস্থার মধ্যে পতিত না হয়েও এবং নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করেও যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বিংশ শতাব্দীর বর্তমান যুগে সম্ভব বাঙলাদেশই তার এক প্রামাণ্য উদাহরণ।
বঙ্গবার্তা
১৫ই নভেম্বর, ১৯৭৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন