বদরুদ্দীন উমর
বাঙলাদেশের পত্র-পত্রিকায় এখন প্রতিদিনই এক ধরনের বক্তৃতা-বিবৃতি ছাপা হয়। এই বক্তৃতা-বিবৃতিগুলির মধ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিৎসা, যানবাহন, গৃহসংস্থান ইত্যাদি সব কিছুকেই ‘গণমুখী’ করে তোলার জন্যে দাবী উত্থাপন ও ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এই সমস্ত আখ্যান, দাবী ও প্রতিশ্রুতির মূল কথা হলো এই যে, অতীতে আমাদের দেশে শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিৎসা ইত্যাদির ক্ষেত্রে জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, অতীতের সমস্ত ব্যবস্থাই বস্তুতঃপক্ষে চালিত হয়েছে জনগণের শত্রুদের স্বার্থে। এই অবস্থার মধ্যে মৌলিক পরিবর্তনসাধন করে এখন উপরোক্ত সব কিছুকেই জনগণের স্বার্থে পরিচালনা করতে হবে এবং সকল কর্মসূচীকে হতে হবে ‘গণমুখী’। সে জন্যেই প্রয়োজন ‘গণমুখী শিক্ষা’, ‘গণমুখী সংস্কৃতি’, ‘গণমুখী চিকিৎসা।
যে-কোন সমাজের বিবর্তনের ক্ষেত্রে কতকগুলি নোতুন নোতুন শব্দ বিভিন্ন পর্যায়ে জনপ্রিয় হয় এবং সেগুলির ব্যবহার সেই হিসেবে হয় ব্যাপক। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবলমুক্ত হয়ে ১৯৪৭ সালে রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের পর আমাদের দেশে পাকিস্তান কায়েম হয় এবং সেই পাকিস্তানী আমলে, বিশেষতঃ তার গোড়ার দিকে, কতকগুলি বিশেষ শব্দ জনপ্রিয় হয় এবং শাসক-শোষক শ্রেণীর মুখে মুখে সে-সব শব্দ অহরহ উচ্চারিত হতে থাকে। তখনকার সেই সমস্ত শব্দমালা প্রধানতঃ ইসলামকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি ও প্রচলিত হয়। ইসলামের প্রতি ব্যাপক জনগণের অন্ধ আনুগত্য এবং রাজনীতিতে ধর্মের সাধারণ প্রভাবের ফলে সে সময়ে শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিন্তা-ভাবনা সবকিছুকেই ‘ইসলামী’ করে তোলার আহ্বান এবং প্রতিশ্রুতি চারদিকে ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। ১৯৪৭ সালের পর আমাদের সমাজে যে আভ্যন্তরীণ পরিবর্তন ঘটতে থাকে তার একটা বিশেষ পরিণতি ঘটে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার মধ্যে। এই নোতুন রাষ্ট্রে অনেক শব্দ জনপ্রিয় হয়েছে, অনেক নোতুন ভাবধারা প্রবল হয়েছে এবং অনেক নোতুন বচন শাসক-শোষক শ্রেণীকে সমাজের আভ্যন্তরীণ তাগিদের আয়ত্ত করতে হয়েছে। ‘গণমুখী’ শব্দটি নিঃসন্দেহে এই নোতুন শব্দমালার অন্যতম। কিন্তু বাঙলাদেশের বর্তমান শাসকশ্রেণীর পাণ্ডা ব্যক্তিরা এবং তাদের অনুকরণে তাদের চেলাচামুণ্ডারা একঘেঁয়েভাবে প্রতিদিন সমস্ত কিছুকে ‘গণমুখী’ করে তোলার কথা বলে চললেও শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিৎসা, বাসস্থান, যানবাহন ইত্যাদি কোন কিছুই যে এখনো পর্যন্ত বর্তমান সরকারের তত্ত্বাবধানে জনগণের স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে না সেটা ইতিমধ্যে সকলের কাছেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং এই সত্য যতই স্পষ্ট হয়ে উঠছে শাসকশ্রেণীর ‘গণমুখী’ বক্তৃতা ততই একদিকে যেমন হচ্ছে উগ্রতর, তেমনি অন্যদিকে তা হচ্ছে অন্তঃসারশূন্য, ফাঁকা এবং খাপছাড়া।
বস্তুতঃপক্ষে, বাঙলাদেশে এখন আমরা কী দেখছি? ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব বাঙলার জনগণের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো নানা কারণে তা বাধাপ্রাপ্ত ও বিপথগামী হয়েছে, তার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে অনেক জটিলতা। এই সমস্ত কিছুর ফলে বাঙলাদেশও সম্মুখীন হয়েছে অনেক জটিল সমস্যার এবং এ দেশের জনগণের জীবনে কোন মৌলিক পরিবর্তন সাধনের পথও যে এখনো পর্যন্ত উন্মুক্ত হয়নি সে কথা শাসক- শোষকশ্রেণীর স্বীকার করার কথা নয়। তারা সেটা স্বীকার করছেও না। উপরন্তু এর উল্টোটি জনগণের কাছে যতই বেশী করে স্পষ্ট হচ্ছে ততই তাদের ‘গণমুখী’ বক্তৃতার বহরও বাড়ছে। অবাধ লুঠতরাজ, চুরি-ডাকাতি, চোরাকারবারী, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের নিদারুণ মূল্যবৃদ্ধি, মুনাফাখোরী, আইনের চোখের সামনে এবং চোখে ধুলো দিয়ে অন্যের সম্পত্তি দখল, প্রকৃত দালালদের অনেককে ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে দিয়ে সরকারবিরোধী এবং অন্যান্য অনেক সরকারি দুষ্কৃতির বিরোধিতাকারীদেরকে মিথ্যাভাবে দালাল আখ্যা দিয়ে শাস্তি প্ৰদান ইত্যাদির ফলে আমাদের দেশে বস্তুতঃপক্ষে আজ এক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অরাজকতা দেখা দিয়েছে। এই অরাজকতা যতই বাড়ছে শাসক-শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিদের ‘গণমুখী’ বক্তৃতার প্রবণতাও ততই বাড়ছে।
কিন্তু প্রয়োজনে এবং নিষ্প্রয়োজনে, প্রাসঙ্গিকভাবে এবং অপ্রাসঙ্গিকভাবে, সমস্ত কিছুকে ‘গণমুখী’ করার কথা অহরহ বলে বেড়ালেও শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিৎসা ইত্যাদিকে ‘গণমুখী’ করার প্রকৃত অর্থ কি এবং সরকার সেটা করার জন্য কি কি বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তার কোন বিবরণ দেয়ার কোন প্রয়োজন তারা কেউ বোধ করছেন না। তাঁরা সকলেই শুধু মন্ত্র আবৃত্তির মতো করে বলে বেড়াচ্ছেন যে, সব কিছুকেই ‘গণমুখী’ করা দরকার ও এই ‘গণমুখী’ অভিযানে কৃতকার্য হতে এবং এই ‘অভিযানের’ বিরুদ্ধে যারা দাঁড়াবে অথবা কথা বলবে তাদেরকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে তারা বদ্ধপরিকর।
কিন্তু এই সমস্ত বক্তৃতা এবং হুশিয়ারী সত্ত্বেও বাঙলাদেশের মানুষ আজ আর ছয়মাস আগের মতো তার দ্বারা সম্মোহিত হয়ে থাকছেন না। প্রত্যেকটি জিনিসকে, সরকারের কথা ও কাজকে, তার প্রত্যেকটি বিঘোষিত নীতি ও বাস্তব কর্মকাণ্ডকে তাঁরা সতর্কদৃষ্টিতে বিচার করতে শুরু করেছেন। তাই শুধু দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, সম্পত্তি দখল, চোরাকারবারী, মুনাফাখোরী ইত্যাদির ক্ষেত্রেই তাঁদের সতর্কতা আজ সীমাবদ্ধ নেই।
সরকারের ‘গণমুখী’ কৃষক-নীতির একটা দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। সরকার ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকদের খাজনা মাফ করেছেন। এই ঘোষণা ভূমিহীন বর্গাচাষী ও কৃষি-শ্রমিকদের অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে কোন পরিবর্তন যে আনতে পারে না সেটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু যাদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমি আছে তারাই বা এর দ্বারা কতখানি উপকৃত হয়েছে? কৃষি-ক্ষেত্রে সরকারের অন্যান্য নীতির সাথে মিলিয়ে দেখলে মাঝে মাঝে ব্যাপারটি যে একটি বিরাট প্রহসন সে কথা বোঝার কোন অসুবিধা কারো হবে না। সাধারণভাবে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির কথা বাদ দিয়ে কৃষিকার্যের জন্যে নিতান্ত প্রয়োজনীয় সারের কথা যদি বিবেচনা করা যায়, তাহলে কৃষক ও কৃষির প্রতি সরকারী ‘সুনজরের’ প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যাবে এবং তা যে কতখানি প্রতারণামূলক সেটা বোঝারও কোন অসুবিধা হবে না। বাঙলাদেশে বিঘাপ্রতি খাজনা জমি হিসেবে ক্ষেত্রবিশেষে কম-বেশী হয়। কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই সে খাজনা আড়াই কি তিন টাকার বেশী নয়। কাজেই খাজনা মাফ হলে বিঘাপ্রতি কৃষককে সেই পরিমাণ টাকা সরকারকে দিতে হচ্ছে না। কিন্তু অন্যদিকে কি হচ্ছে? বিঘাপ্রতি সার প্রয়োজন হয় এক মণের মতো। এই সারের মূল্য সরকারীভাবে এখন শতকরা একশো ভাগের মতো বৃদ্ধি করা হয়েছে। সব থেকে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত সার ইউরিয়ার মূল্য পূর্বে ছিলো মণপ্রতি দশ টাকা। এখন তার দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে বিশ টাকা। এর ফল দাঁড়াচ্ছে এই যে, বিঘাপ্রতি তিন টাকা খাজনা বাবদ টাকা দিতে না হলেও সারের মূল্য বৃদ্ধির ফলে কৃষককে বিঘাপ্রতি বেশী দিতে হচ্ছে দশ টাকা। অর্থাৎ যোগ-বিয়োগ করে দেখলে বিঘাপ্রতি কৃষককে দিতে হচ্ছে পূর্বের তুলনায় অতিরিক্ত সাত টাকা। কৃষির উন্নতিতে উৎসাহ প্রদান এবং কৃষকের আর্থিক অবস্থা উন্নতির জন্যে সরকার যা করেছেন তার কোন তুলনা সত্যিই নেই!
কিন্তু শুধু এই একটি ক্ষেত্রেই নয়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকারী নীতির যথার্থভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, তার দ্বারা এই কয় মাসে জনগণের কোন উপকার না হয়ে তাঁদের অবস্থার দ্রুত এবং উত্তরোত্তর অবনতিই ঘটে চলেছে। এই অবনতির সাথে তাল রেখে কেবলমাত্র আর একটি জিনিসই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেটি হলো শাসক-শোষক শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিদের ‘গণমুখী’ বক্তৃতা।
তবে বাঙলাদেশে এই কয় মাসে কোন জিনিসই যে ‘গণমুখী’ হয়নি সে কথা বললে সত্যের বিকৃতি এবং মিথ্যাভাষণ হবে। একটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে এবং এই ব্যতিক্রমই হলো শোষণের ক্ষেত্রে।
বিগত কয়েক মাসে যে জিনিসটি প্রকৃতপক্ষে ‘গণমুখী’ হয়েছে সেটা হচ্ছে শোষণ। এই ‘গণমুখী’ শোষণেই বাঙলাদেশের মানুষ আজ জর্জরিত।
আজাদ
৬ই ভাদ্র, ১৩৭৯
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন