বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্বীকৃতি প্রসঙ্গে

বদরুদ্দীন উমর

বাঙলাদেশের বামপন্থী রাজনৈতিক মহলের একটি বিশেষ অংশে বাঙলাদেশকে একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির প্রশ্নে একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী প্রথম থেকেই দেখা যাচ্ছে। এই অস্বীকৃতির জন্য তাঁরা নিজেদের দলকে পূর্ব বাঙলার (যা ভৌগোলিক দিক দিয়ে এ অঞ্চলের স্বাভাবিক নাম) অথবা বাঙলাদেশের একটি দল হিসেবে পরিচয় না দিয়ে এখনো পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের একটি দল হিসেবেই তার পরিচয় দিচ্ছেন।

বাঙলাদেশের একটি দল হিসেবে তাঁরা নিজেদের পরিচয় না দেওয়ার কারণ তাঁদের মতে বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের ফলে এবং সেই সমস্ত বৈদেশিক শক্তিসমূহের স্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্যে। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর এই ভূখণ্ড ভারতের তদারকীতে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের উপনিবেশে পরিণত হয়েছে এবং এই তথাকথিত রাষ্ট্রের কোন স্বাধীনতা অথবা সার্বভৌমত্ব নেই।

বাঙলাদেশ একটি সার্বভৌম অথবা তাঁবেদার রাষ্ট্র, স্বাধীন রাষ্ট্র অথবা পুতুল রাষ্ট্র, এসব নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক অনেকে করতে পারেন, এবং বাস্তবক্ষেত্রে অনেকেই তা করছেন। কিন্তু এই তর্কের সাথে রাষ্ট্র হিসেবে বাঙলাদেশের অস্তিত্বের প্রশ্নটিকে জড়িত করার কোন যুক্তিসম্মত কারণ আছে কি না সেটা দেখা দরকার।

বিশ্বপরিসরে সাম্রাজ্যবাদের উত্থান এবং আধিপত্য সম্প্রসারণের পরিণতিতে আধা- ঔপনিবেশিক অথবা নয়া ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব কিছুতেই সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শক্তি এবং আধিপত্য বৃদ্ধি ও বিস্তারের সাথে সাথে অন্যান্য পুঁজিবাদী ও পিছিয়ে পড়া সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলিও তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব পরিপূর্ণভাবে রক্ষা করতে বর্তমান যুগে আর সক্ষম হচ্ছে না। সাম্রাজ্যবাদ তার লগ্নীপুঁজির মাধ্যমে এমনভাবে দেশে দেশে তার শোষণ ও আধিপত্যের জাল বিস্তার করে যে, সেই জাল ছিন্ন করে সার্বভৌম শক্তি হিসেবে উপরোক্ত ধরনের রাষ্ট্রগুলি দ্বারা কোন স্বাধীন পদক্ষেপ কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারেই গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।

কিন্তু আধা-ঔপনিবেশিক, নয়া-ঔপনিবেশিক এবং পিছিয়ে পড়া পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলি নিজেদের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে কমবেশী অসমর্থ হলেও পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী, সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদী অথবা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি রাষ্ট্র হিসেবে তাদের কারোর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে না।

অবশ্য ক্ষেত্র বিশেষে দেখা যায় যে, কোন কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে কোন কোন রাষ্ট্র স্বীকার করে না। উদাহরণস্বরূপ, সোভিয়েত ইউনিয়নকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ফ্রান্স ইত্যাদি বহুদিন স্বীকৃতি দেয়নি। মিশর, ইরাক, সিরিয়া, সৌদি আরব, পাকিস্তান, আলজিরিয়া, চীন ইত্যাদি ইসরাইল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি আজ পর্যন্ত দেয়নি। চীনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়নি এবং শেষ পর্যন্ত তার জাতিসংঘভুক্তির বিরোধিতা করেছে। চীন, আলবেনিয়া ইত্যাদি এখনো বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। এই সব অস্বীকৃতির প্রকৃত অর্থ এবং তাৎপর্য কি?

এই অস্বীকৃতির প্রকৃত অর্থ হলো, বিভিন্ন কারণে এক বা একাধিক রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য কোন বিশেষ রাষ্ট্রকে উচ্ছেদের চেষ্টা এবং সেই হিসেবে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনে অস্বীকৃতি অথবা সেই রাষ্ট্র এক বা একাধিক শর্ত পালন না করা পর্যন্ত তার সাথে সম্পর্ক স্থাপনে অস্বীকৃ তি। উভয় ক্ষেত্রেই এই আন্তর্জাতিক অস্বীকৃতির অর্থ কোন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় বাস্তবতাকে অস্বীকার করা নয়। কারণ যার বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হয় তাকে উচ্ছেদের অথবা তাকে কতকগুলি শর্তপালন করতে বাধ্য করানোর প্রশ্ন ওঠে না।

সে প্রশ্ন ওঠে না বলেই এ ধরনের কোন নোতুন রাষ্ট্রকে যে-সমস্ত রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয় না তারা হয় তার স্বপ্রদত্ত নামেই তাকে উল্লেখ করে অথবা সেই দেশের পূর্ব নামে তাকে উল্লেখ করে।

বাঙলাদেশ রাষ্ট্র সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়েই বর্তমান আলোচনার অবতারণা করা হয়েছে। এজন্যে বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে চীনের অস্বীকৃতির প্রসঙ্গটি এক্ষেত্রে উল্লেখ করা দরকার।

চীন স্পষ্টতঃই পাকিস্তানকে বিভক্ত করার বিরোধী ছিলো। কিন্তু পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙলাদেশ নামে একটি নোতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই নবগঠিত রাষ্ট্রের প্রতি চীনের দৃষ্টিভঙ্গি কী দাঁড়ালো? তারা এই রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে অস্বীকৃতি জানালো ঠিক, কিন্তু তারা কি এই রাষ্ট্রের বাস্তবতা এবং অস্তিত্বকে অস্বীকার করলো? না, সেটা তারা করেনি। তারা বাঙলাদেশকে বাঙলাদেশ নামেই উল্লেখ করেছে এবং যুদ্ধবন্দী সংক্রান্ত জাতিসংঘের প্রস্তাব কার্যকর করার জন্যে বাঙলাদেশের ওপর চাপ দিচ্ছে। বাঙলাদেশ জাতিসংঘের উপরোক্ত প্রস্তাব অনুযায়ী কাজ করলেই চীন তার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে অর্থাৎ এই রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য সম্পর্ক যথারীতি স্থাপন করবে।

কোন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অথবা অস্বীকৃতির প্রশ্ন এইভাবে আলোচনাকালে একটি বিষয় ভালোভাবে উপলব্ধি করা দরকার। সে বিষয়টি হলো এই যে, একটি রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য একটি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া অথবা না দেওয়ার প্রশ্নটির সাথে সেই রাষ্ট্রের অন্তর্গত কোন রাজনৈতিক দল কর্তৃক রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতি দেওয়া না দেওয়ার প্রশ্নের কোন সম্পর্কই বাস্তবত অথবা তত্ত্বগত কোন হিসেবেই থাকতে পারে না।

বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদের অবস্থানের জন্য জাতিসংঘভুক্ত অধিকাংশ রাষ্ট্রের কোন স্বাধীনতা অথবা সার্বভৌমত্ব প্রকৃত অর্থে নেই। এই রাষ্ট্রগুলি নয়া ঔপনিবেশিক এবং বিভিন্নভাবে সাম্রাজ্যবাদ কবলিত রাষ্ট্র হিসেবে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই স্বাধীনভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কিন্তু সেটা না পারলেও রাষ্ট্র হিসেবে তাদের একটা পৃথক এবং স্বতন্ত্র সত্তা আছে এবং আইনগতভাবে তাদের একটা আন্তর্জাতিক মর্যাদাও আছে। তৃতীয় বিশ্ব বলতে যে রাষ্ট্রগুলিকে বোঝায় সেগুলি মোটামুটিভাবে এই ধরনেরই রাষ্ট্র। তারা মোটামুটিভাবে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের অধীন এবং অনেক ক্ষেত্রে সেই আধিপত্যের বাইরে বেরিয়ে আসার প্রয়াসী। এই ধরনের যে কোন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি রাষ্ট্রের সামন্ততান্ত্রিক ও মুৎসুদ্দী চরিত্র পরিবর্তন করে সেখানে শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায় এবং সেই হিসেবে রাষ্ট্রশক্তির সাথে তাদের সংঘর্ষও বাধে। কিন্তু এই সংষর্ঘ সত্ত্বেও যে রাষ্ট্রের মধ্যে তারা বাস করে এবং যে রাষ্ট্র তারা পরিবর্তন, এমন কি উচ্ছেদ করতে চায় তার অস্তিত্বকে তারা অস্বীকার করে না। কারণ, রাষ্ট্রকে গণবিরোধী, শোষণমূলক, শত্রু ইত্যাদি আখ্যা দেওয়া এক কথা এবং তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা আর এক কথা। যার অস্তিত্বই নেই, যা অবাস্তব তা অলীক এবং যা অলীক তাকে গণবিরোধী, শোষণমূলক অথবা শত্রু কোন আখ্যাই দেওয়া চলে না। তার বিরুদ্ধে কোন সংগ্রামই করা চলে না।

এখানে স্বীকৃতির প্রশ্ন বিবেচনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের বাস্তবতার স্বীকৃতি এবং গণতান্ত্রিক, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে তার স্বীকৃতি এই দুইকে বস্তুতঃপক্ষে গুলিয়ে ফেলা হয়। এইভাবে দুটি পৃথক বিষয়কে তত্ত্বগতভাবে গুলিয়ে ফেলার জন্য চিন্তার মধ্যে বাস্তবতার পরিবর্তে কল্পনার প্রভাব বৃদ্ধি পায়।

লেনিন তাঁর ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে রাষ্ট্রের অর্থ সম্পর্কে বলতে গিয়ে মার্কসকে উল্লেখ করে লিখেছেন, “According to Marx the state is an organ of class rule, an organ for the oppression of one class by another; it is the creation of ‘order’, which legalises and perpetuates this oppression by moderating conflict between the classes.”

অর্থাৎ মার্কসের মতে রাষ্ট্র হচ্ছে শ্রেণী শাসনের একটি যন্ত্র, একটি শ্রেণী কর্তৃক অপর একটি শ্রেণীর ওপর নিপীড়নের যন্ত্র, এটা এমন একটা ব্যবস্থা সৃষ্টি করে যে ব্যবস্থা শ্রেণীসমূহের মধ্যে সংঘর্ষকে অনেকখানি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে এই নিপীড়নকে আইনসঙ্গত এবং স্থায়িত্বদান করে!

রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লেনিন বলেন, “Two instituions most characteristic of this state machine are the bureaucracy and the standing army. In thier works, Marx and Engles repeatelly show that the bourgeoisie are connected with these institutions by thousands of thread”

অর্থাৎ এই রাষ্ট্রযন্ত্রের দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, আমলাতন্ত্র এবং নিয়মিত সৈন্যবাহিনী। মার্কস এবং এঙ্গেলস নিজেদের রচনায় বারংবার দেখিয়েছেন যে, এই দুই ধরনের সংস্থার সাথে বুর্জোয়ারা সহস্র সূত্রে সম্পর্কিত থাকে।

মার্কস, এঙ্গেলস ও লেনিন রাষ্ট্রের যে-সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলি ওপরে উল্লেখ করেছেন সে অনুসারে বাঙলাদেশ কি একটি রাষ্ট্র নয়? এখানে কি শ্রেণী শোষণ ও শ্রেণী দ্বন্দ্ব নেই? শোষক-শাসক শ্রেণীর নিজস্ব আইন ব্যবস্থা নেই? এখানে কি আমলাতন্ত্র ও নিয়মিত সৈন্যবাহিনী নেই, এ সবই যদি থাকে তাহলে বাঙলাদেশ কি একটি রাষ্ট্র নয়? এবং তা যদি হয় তবে তাকে অস্বীকার করতে যাওয়ার অর্থ কী?

যাঁরা এই রাষ্ট্রকে রাষ্ট্র হিসেবে অস্বীকার করছেন, তাঁরা স্বভাবতঃই এই রাষ্ট্রের পরিবর্তন অথবা উচ্ছেদ চান। কিন্তু রাষ্ট্র পরিবর্তন অথবা উচ্ছেদ করে শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের সাথে এই রাষ্ট্রের বাস্তবতাকে অস্বীকার করার বিন্দুমাত্র কোন তাত্ত্বিক অথবা বাস্তব প্রয়োজন আছে কি? মোটেই নেই। উপরন্তু রাষ্ট্রকে পরিবর্তন এবং উচ্ছেদ করার কথা যে সমস্ত দল অথবা যে বিশেষ দল চিন্তা করবেন তাঁদেরকে এই রাষ্ট্রের বাস্তবতা স্বীকার করতেই হবে। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রের চরিত্র সম্পর্কে মতভেদ থাকলেও এই রাষ্ট্রকে যাঁরা টিকিয়ে রাখতে চান তাঁরা যেভাবে এর অস্তিত্ব ও বাস্তবতাকে স্বীকার করেন ঠিক সেইভাবেই তাকে স্বীকার করতে হবে।

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী হিসেবে যাঁরা রাষ্ট্র পরিবর্তন চান এবং যাঁরা তত্ত্বগতভাবে বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন না তাঁরাও এই স্বীকৃতি বাস্তবক্ষেত্রে দিচ্ছেন। কারণ এই রাষ্ট্রের দ্বারা সংগঠিত শোষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাঁরা কথা বলছেন এবং এই শোষণ ব্যবস্থা উচ্ছেদের জন্যে বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিবর্তনের আহ্বানও তাঁরা জনগণের কাছে দিচ্ছেন। অর্থাৎ কার্যক্ষেত্রে তাঁরাও বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের বাস্তবতাকে স্বীকার না করে পারছেন না।

কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই স্বীকৃতি সত্ত্বেও তাঁরা বাঙলাদেশ রাষ্ট্রকে বাঙলাদেশ নামে অভিহিত করতে চাইছেন না এবং এই অনিচ্ছাকে একটা তত্ত্বগত পোশাক পরানোর অনেক চেষ্টা করছেন। এইসব প্রচেষ্টা যে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বের সাথে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন এক ধরনের অপচেষ্টা তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই অপচেষ্টা যাঁরা করছেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই সততা ও নিষ্ঠার সাথে এ কাজ করছেন এবং বিভ্রান্ত হচ্ছেন। কাজেই শেষ পর্যন্ত অন্যান্য অনেকের মতো তাঁদেরও এই ভ্রান্তির অবসান ঘটবে এটা আশা করাই সঙ্গত।

যে সমস্ত তাত্ত্বিকরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে বাঙলাদেশ নামে অভিহিত করতে চাইছেন না, তাঁরা কী নামে একে চিহ্নিত করছেন? কী নাম ধরে একে উল্লেখ করছেন? নিজেদের দলকে অবশ্য এখনো তাঁরা একটি ‘পূর্ব পাকিস্তানী’ দল হিসেবে ঘোষণা করছেন। কিন্তু এই রাষ্ট্র? এর নাম কি পূর্ব পাকিস্তান? তাঁরা কি এখন নিজেদের কাজ-কর্মের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রের পরিবর্তন চাইছেন?

নিশ্চয়ই না। তাঁরা প্রকৃতপক্ষে চাইছেন এই বাঙলাদেশ রাষ্ট্রকেই পরিবর্তন করতে। তা যদি চান তাহলে এই রাষ্ট্রকে বাঙলাদেশ নামে ডাকতে, তাকে সেই হিসেবে স্বীকার করতে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী হিসেবে তাঁদের অসুবিধা কোথায়?

বাস্তব পরিস্থিতিকে অস্বীকার করে নানান তাত্ত্বিক বিড়ম্বনা সৃষ্টির ফলে রাষ্ট্র কাকে বলে সে কথাটিই তাঁরা ভুলে গেছেন। সেজন্য মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন রাষ্ট্র সম্পর্কে যা বলেছেন সে- সব কথা গ্রাহ্য করারও কোন প্রয়োজন তাঁরা বোধ করছেন না। কাজেই তত্ত্বের ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে গিয়ে তাঁরা এখনো পর্যন্ত বাঙলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্ট একটি রাষ্ট্রের নামে (যে নাম এখান থেকে ১৯৭১ সালে বাস্তবক্ষেত্রে ঘুচে গেছে) দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলকে এখনো পর্যন্ত আখ্যায়িত করে চলেছেন।

শুধু তাই নয়, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের যে তত্ত্ব খাড়া করেছেন সে তত্ত্বের দ্বারা পরিচালিত হয়ে বাঙলাদেশে বিপ্লব ঘটালে সেই বিপ্লবোত্তর রাষ্ট্র একটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে, শ্রমিক শ্রেণীর একটি রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার কোন চেষ্টা করবে না। সে রাষ্ট্র পাকিস্তানের (পূর্ববর্তী পশ্চিম পাকিস্তানের) সাথে আবার মিলিত হবে। অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে বিপ্লব ঘটিয়ে এ দেশের জনগণকে তাঁরা একটি সামন্ত-বুর্জোয়া রাষ্ট্রের পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দেবেন! এই উন্মাদ তাত্ত্বিক বক্তব্য এবং রাজনৈতিক লক্ষ্যের যাঁরা বিরোধী তাঁদেরকে এঁরা ‘জাতীয়তাবাদী’ আখ্যা দিয়ে নিশ্চিন্ত আছেন। কিন্তু চীন বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর তাঁদের এই নিশ্চিন্তভাব যে দূরীভূত হবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তেমনি। নাম ধরতে হলে জন্মদাতাদের দেওয়া নামই ধরা উচিত। সব দেশের বিপ্লবীরাই তাই করেছেন। কাজেই এই নাম না ধরার মধ্যে আত্যন্তিকভাবে বৈপ্লবিক কিছু নেই। উপরন্তু তাত্ত্বিক বিড়ম্বনা আছে। এই তাত্ত্বিক বিড়ম্বনা অন্য কোন কারণে না হলেও জনগণের স্বার্থে পরিত্যাগ করা দরকার। যাঁরা তা না করবেন তাঁদের দ্বারা এদেশে শ্রমিক শ্রেণীর শাসন কায়েমের বিন্দুমাত্র কোন সম্ভাবনা নেই।

বঙ্গবার্তা
১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭৩

সকল অধ্যায়

১. বাঙলাদেশে মার্কিন অনুপ্রবেশ
২. “গণমুখী” বক্তৃতা
৩. আওয়ামী লীগের জাতীয়করণ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে
৪. ভারত-বিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতা
৫. জাতীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ভূমিকা
৬. আওয়ামী লীগ সরকারের শ্রমনীতি
৭. সংবাদপত্র ও প্রকাশনার স্বাধীনতা
৮. আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত সংবিধান
৯. শাসনতন্ত্র প্রশ্নে বিরোধী দলগুলির ভূমিকা
১০. আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতি রক্ষা
১১. বাঙলাদেশের সংবিধান ও পরবর্তী নির্বাচন
১২. আইয়ুব খানের অস্ত্রাগার
১৩. আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণা
১৪. বাঙলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি
১৫. বাঙলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
১৬. বাঙলাদেশে শ্রমিক হত্যা
১৭. জাতি সমস্যা ও ভাষা আন্দোলন
১৮. আওয়ামী লীগের ‘শুদ্ধি অভিযান’ প্রসঙ্গে
১৯. মাধ্যমিক শিক্ষক ধর্মঘট প্রসঙ্গে
২০. মুদ্রাযন্ত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স ১৯৭৩
২১. ত্রিদলীয় ঐক্যজোট ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন
২২. ১৯৪৮ সাল থেকে পশ্চিম এশিয়ায় দু’ধরনের যুদ্ধ চলছে
২৩. বাঙলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি
২৪. বাঙলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি
২৫. ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন প্রসঙ্গে
২৬. সংসদীয় বিরোধী দলসমূহের ঐক্য প্রসঙ্গে
২৭. দালাল আইনে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি প্রসঙ্গে
২৮. জনগণ গণতান্ত্রিক বিরোধী দলগুলির ঐক্য কেন চাইছেন?
২৯. ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের তাৎপর্য
৩০. বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্বীকৃতি প্রসঙ্গে
৩১. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও বাঙলাদেশের স্বাধীনতা
৩২. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ও বাঙলাদেশে সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব
৩৩. সাম্রাজ্যবাদের যুগে জাতীয়তাবাদ
৩৪. গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বতঃস্ফূর্ততা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন