বদরুদ্দীন উমর
সামরিক শাসনামলে সংবাদপত্রকে সম্পূর্ণভাবে সরকারী নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখার জন্য আইয়ুব খাঁন প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স করেছিলো। এই অর্ডিন্যান্সের জোরে সংবাদপত্র ও অন্যান্য পত্রিকার ক্ষেত্রে সাধারণভাবে সরকারী অনুমতি ব্যতীত কোন কিছু প্রকাশ করা সম্ভব ছিলো না। এর ফলে সরকার যাকে অনুমতি দেওয়ার ইচ্ছে করতো তাকে অনুমতি দিতো এবং যাকে যতটুকু পর্যন্ত স্বাধীনতা দেওয়ার ইচ্ছে করতো তাকে ততটুকু স্বাধীনতাই দান করতো। এই অবস্থার ফলে সরকার-বিরোধী অথবা সরকারের পক্ষে অনুপযোগী পত্র- পত্রিকা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রকাশ করতে হলে তার জন্যে অনেক ঘোরালো পথ অনুসরণ করতে হতো। কিন্তু সরকারী সতর্কতার ফলে তাতেও বিশেষ সুবিধা হতো না। অর্থাৎ সে সময় প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে সরকার সংবাদপত্র ও পত্র- পত্রিকাগুলির প্রকাশনাকে যতদূর সম্ভব নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে জনতাকে বিভ্রান্ত হওয়ার কবল থেকে রক্ষা করতো।
জনমতকে এই বিভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও তাঁদের পূর্ববর্তী আইয়ুব-ইয়াহিয়া সরকারের মতো পূর্বোক্ত প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্সকে পূর্ববৎ কার্যকর রেখেছেন। রাখারই কথা। কারণ জনমতকে যে সমস্ত শক্তি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসন আমলে ‘বিভ্রান্ত’ করতো সেই সমস্ত শক্তি বাঙলাদেশের বর্তমান ‘স্বাধীন ও মুক্ত’ পরিবেশে সেই একই ধরনের ‘বিভ্রান্তি’ সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। কাজেই পাকিস্তানী আমলে যে আওয়ামী লীগ প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্সের মহিমা না বুঝে তার গুণ কীর্তনের পরিবর্তে তার বিরুদ্ধে শোরগোল তুলেছিলো তারা এখন আইয়ুব-ইয়াহিয়া সরকারের মতোই এই অর্ডিন্যান্সটির মহিমা পুরোপুরি উপলব্ধি করে তার প্রাণ রক্ষার জন্যে বদ্ধপরিকর। সবই ইতিহাসের লীলা!
সামরিক শাসন আমলে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্সের মতো একটি অর্ডিন্যান্স কোন বিস্ময়কর ব্যাপার ছিলো না। উপরন্তু তা ছিলো সব দিক দিয়ে, এমন কি বাহ্যত তাদের রাজনৈতিক অবস্থানের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। সামরিক শাসন, সে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ যাই হোক, তার অর্থ গণতন্ত্রের বিপরীত। তাই সেখানে এই ধরনের অর্ডিন্যান্সের মতো রাজনৈতিক অস্ত্র জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন সরকারের পক্ষে নিতান্তই অপরিহার্য।
কিন্তু যে রাজনৈতিক অস্ত্র সামরিক আমলে অপরিহার্য ছিলো সে অস্ত্র এখনো পর্যন্ত ‘গণতন্ত্রের’ লীলাভূমি বাঙলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে কেন? এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের কোন বাহ্যিক ঘোষণার ওপর নির্ভর করে থাকলে চলবে না। তার জন্যে প্রয়োজন বর্তমান বাঙলাদেশের চরিত্র বিশ্লেষণ। এই বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, পূর্বের মতো বাঙলাদেশে এখনো পর্যন্ত সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং তার দাসানুদাস মুৎসুদ্দী আমলা পুঁজির আধিপত)ই বজায় আছে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মুৎসুদ্দীদের জাতীয় চরিত্র এবং বিশেষ বিশেষ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের আধিপত্যের ক্ষেত্রে কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটলেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের শত্রুরা বর্তমান বাঙলাদেশে নোতুন জীবন লাভ করেছে এবং জনগণের সাথে তাদের পূর্ব শত্রুতায় আবার লিপ্ত হয়েছে। নোতুন বাঙলাদেশ রাষ্ট্রে জনগণের সেই পুরাতন শত্রুরা সাময়িকভাবে তাদের শক্তি অনেক ক্ষেত্রে কিছুটা হারিয়ে ফেললেও সে শক্তি তারা আবার ফেরত পেয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে আজ সেই পুরাতন শক্তিসমূহেরই নোতুন সমাবেশ। এই সমাবেশের ফলেই আওয়ামী লীগ জনগণ থেকে পূর্বের তুলনায় এখন অনেক বেশী বিচ্ছিন্ন। এ জন্যেই তাদের পক্ষেও আজ প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স প্ৰায় তাদের পূর্ববর্তীদের মতোই সমান অপরিহার্য। কিন্তু এই অর্ডিন্যান্সটিকে বাঁচিয়ে রেখে এবং প্রয়োজন মতো তার প্রয়োগ করেই যে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষান্ত হবে তা নয়। তারা এর পর হয়তো নিজেদের স্বপক্ষে জনমতকে টেনে রাখার এবং আরও দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে কুখ্যাত প্রেস ট্রাস্টের মতো একটা নোতুন সংস্থা গড়ে তুলতেও দ্বিধাবোধ করবে না। যে প্রেস ট্রাস্টের পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজকে ১৯৬৯ সালের ২৪শে জানুয়ারী জনগণ দগ্ধ করেছিলেন এবং যার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগও তখন ভয়ানক সোচ্চার ছিলো এই প্রেস ট্রাষ্টের নবজন্ম হলেও এখন আর বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। তার মাধ্যমে জনগণের পুরাতন শত্রুদের জয়ধ্বনিই আবার নোতুন করে শোনা যাবে।
এ অবস্থায় জনগণ কী করবেন? আওয়ামী লীগ বাঙলাদেশে তার নানান নীতির মাধ্যমে যে ‘গণতন্ত্র’ চালু করতে বদ্ধপরিকর হয়েছে সে গণতন্ত্র ইতিহাসে নোতুন জিনিস নয়। কাজেই আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন ক্রিয়া জনগণের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে তাও ঐতিহাসিক নিয়মেই নিয়ন্ত্রিত হবে। কারণ আওয়ামী লীগের নিয়মতন্ত্র ইতিহাসের এই নিয়মতন্ত্রের বাইরে নয়, সর্বাংশে তার অধীন।
সাপ্তাহিক স্বাধিকার
১৫ই অক্টোবর, ১৯৭২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন