আইয়ুব খানের অস্ত্রাগার

বদরুদ্দীন উমর

আইয়ুব খানের অস্ত্রাগার

একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাঙলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক বৎসর পর বাঙলাদেশ সরকারের আইনমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে, আগামী ১৬ই ডিসেম্বর সংবিধান আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবর্তিত হওয়ার পর সংবিধানের সাথে সঙ্গতিহীন যে সমস্ত খারাপ আইন এ পর্যন্ত জারী আছে সেগুলি বাতিল করা হবে।

সংবিধান প্রবর্তিত হওয়ার পর কোন কোন আইন (অর্থাৎ মূলত আইয়ুব ও ইয়াহিয়া প্রবর্তিত আইন) তার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে, সে বিষয়ে কোন উল্লেখ উপরোক্ত ঘোষণায় নেই। তবে এই ঘোষণার মাধ্যমে সরকারীভাবে যা স্বীকৃত হয়েছে সেটা হচ্ছে এই যে, ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১-এর পরও বাঙলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার এমন কতকগুলি আইনের অস্ত্র ব্যবহার করে এসেছেন যেগুলি তাঁদের নিজেদের মতেও খারাপ। আইয়ুবের সামরিক শাসনের অস্ত্রাগারে যে সমস্ত নির্যাতনমূলক কালাকানুন বাঙলাদেশ সরকার এ পর্যন্ত ব্যবহার করে আসছেন তার মধ্যে দুটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য–প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স এবং বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স। এছাড়া দালাল আইনের নামে তাঁরা নোতুনভাবে যে আইন প্রবর্তন করেছেন সেটাও বস্তুতঃপক্ষে আইয়ুব সরকারের নিরাপত্তা আইন, দেশরক্ষা আইন ইত্যাদিরই বাঙলাদেশী সংস্করণ ব্যতীত আর কিছুই নয়। দালালদেরকে গ্রেফতার করা, তাদেরকে সমুচিত শাস্তি দেওয়ার যে সার্বজনীন দাবী জনগণ উত্থাপন করেছিলেন তার সুযোগ নিয়ে সরকার এমন এক দালাল আইন প্রণয়ন করেছেন যার আওতা অত্যন্ত ব্যাপক। দালাল ধরার নামে এই আইনের যে নির্যাতনমূলক ব্যবহার এ পর্যন্ত হয়েছে তার সাথে সকলেই পরিচিত। সরকারের বিরুদ্ধ পক্ষ, বামপন্থী এবং ব্যাপক জনগণের বিরুদ্ধে বহুক্ষেত্রে দালাল আইনের যে ব্যবহার হয়েছে তার জন্যেই আজ অনেকে সভা- সমিতিতে পর্যন্ত এই আইন রদ করার দাবী জানাচ্ছেন, এ নির্যাতনমূলক ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন এবং সব থেকে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো এই যে, যে জনগণ দালাল ধরার জন্যে এ ধরনের আইন প্রবর্তনে খুশী হয়েছিলেন তারাই সভা সমিতিতে দালাল আইন উচ্ছেদের দাবীর বিরুদ্ধে কিছু বলছেন না, উপরন্তু সেই দাবীকে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সমর্থনই দান করছেন। এই অবস্থার মূল কারণ প্রকৃত দালাল আল-বদর, রাজাকার, আল-শামস ধরার থেকে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর নির্যাতন এবং এই আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে এলোপাতাড়ি কর্মকাণ্ড।

আইয়ুব খানের কুখ্যাত কালাকানুন প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স এদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সামরিক শাসন আমলে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে ছিলো। অনেকে মনে করেছিলেন বাঙলাদেশ সরকার প্রথম চোটেই এ ধরনের একটা অগণতান্ত্রিক ও নির্যাতনমূলক আইন বাতিল করে দেবেন। কিন্তু না, তাঁরা তা করেননি। উপরন্তু আইয়ুব খানের আমলে এই আইনের যে প্রয়োগ হয়েছিলো তার থেকে কঠোরভাবে তাঁরা এর প্রয়োগ করেছেন। এই আইনের বলে তাঁরা বিরোধী পক্ষীয় সাংবাদিকদেরকে বিনা বিচারে আটক করা, বিরোধী পক্ষীয় কোন ব্যক্তি বা দলকে কোন নোতুন পত্র-পত্রিকা, এমন কি, সাহিত্য- পত্রিকা পর্যন্ত প্রকাশের অনুমতি না দেওয়া, সমস্ত কিছুই করেছেন এবং করছেন। যে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনের বিনিময়ে বাঙলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই রাষ্ট্র প্রথম দিন থেকে শুরু করে বিগত এক বৎসরে আইয়ুবের নির্যাতনমূলক ও গণবিরোধী অস্ত্রশস্ত্রকে ব্যবহার করে আসছে, তাকে বাতিল অথবা পরিত্যাগ করেনি।

কুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স নামক কালাকানুনটিকেও এতদিন তাঁরা বাতিল করার প্রয়োজন মনে করেননি। আইয়ুবের অস্ত্র হাতে নিয়েই তাঁরা ছাত্র-শিক্ষকদের বিগত এক বৎসর শাসন করে এসেছেন।

এতদিন এই সব নির্যাতনমূলক আইন পুরোদস্তুরভাবে ব্যবহার করে আসার পর আজ আওয়ামী লীগ সরকার জনগণকে আশার বাণী শোনাচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, শাসনতন্ত্রের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ সমস্ত ‘খারাপ’ আইন তাঁরা বাতিল করবেন।

আইয়ুব আমলের এই সমস্ত কালা-কানুন যে ‘খারাপ’ সেটা সংবিধানের সাথে মিলিয়ে দেখে তাঁরা যাচাই করে বাতিল করতে চাইছেন। জনগণ কিন্তু এই সমস্ত আইনের বিরুদ্ধে অনেক পূর্বেই নিজেদের রায় ঘোষণা করেছেন। আওয়ামী লীগও নির্বাচনের সময় এই সমস্ত আইন বাতিল করার গালভরা প্রতিশ্রুতি জনগণকে দিয়েছিলেন। কিন্তু বাঙলাদেশে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আইয়ুবের কোন কালা-কানুনই তাঁরা নিজেরা আজ পর্যন্ত বাতিল করেননি। উপরন্তু আইয়ুবের মতোই বিরোধী পক্ষকে আঘাত হানার জন্যে সর্বতোভাবে তার ব্যবহার করেছেন।

নির্যাতনমূলক আইয়ুবী কালা-কানুনগুলি বাতিলের জন্যে আজ জনগণের মধ্যে যে দাবী উত্থিত হচ্ছে তাকে কিছুটা ঠেকিয়ে রাখার জন্য সরকারীভাবে ঘোষণা করা হয়েছে ১৬ ডিসেম্বরের পর খারাপ আইনগুলি বাতিল করা হবে। আইয়ুবী কোন্ কোন্ কালা-কানুনকে সরকার প্রকৃতপক্ষে ‘খারাপ’ বলে বিবেচনা করবেন এবং আইয়ুবের অস্ত্রাগার কতখানি শূন্য হবে সেটাই জনগণ বিশেষভাবে লক্ষ্য করবেন।

সাপ্তাহিক জয়বাংলা
১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭২-এর বিশেষ সংখ্য

সকল অধ্যায়

১. বাঙলাদেশে মার্কিন অনুপ্রবেশ
২. “গণমুখী” বক্তৃতা
৩. আওয়ামী লীগের জাতীয়করণ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে
৪. ভারত-বিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতা
৫. জাতীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ভূমিকা
৬. আওয়ামী লীগ সরকারের শ্রমনীতি
৭. সংবাদপত্র ও প্রকাশনার স্বাধীনতা
৮. আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত সংবিধান
৯. শাসনতন্ত্র প্রশ্নে বিরোধী দলগুলির ভূমিকা
১০. আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতি রক্ষা
১১. বাঙলাদেশের সংবিধান ও পরবর্তী নির্বাচন
১২. আইয়ুব খানের অস্ত্রাগার
১৩. আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণা
১৪. বাঙলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি
১৫. বাঙলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
১৬. বাঙলাদেশে শ্রমিক হত্যা
১৭. জাতি সমস্যা ও ভাষা আন্দোলন
১৮. আওয়ামী লীগের ‘শুদ্ধি অভিযান’ প্রসঙ্গে
১৯. মাধ্যমিক শিক্ষক ধর্মঘট প্রসঙ্গে
২০. মুদ্রাযন্ত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স ১৯৭৩
২১. ত্রিদলীয় ঐক্যজোট ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন
২২. ১৯৪৮ সাল থেকে পশ্চিম এশিয়ায় দু’ধরনের যুদ্ধ চলছে
২৩. বাঙলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি
২৪. বাঙলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি
২৫. ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন প্রসঙ্গে
২৬. সংসদীয় বিরোধী দলসমূহের ঐক্য প্রসঙ্গে
২৭. দালাল আইনে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি প্রসঙ্গে
২৮. জনগণ গণতান্ত্রিক বিরোধী দলগুলির ঐক্য কেন চাইছেন?
২৯. ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের তাৎপর্য
৩০. বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্বীকৃতি প্রসঙ্গে
৩১. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও বাঙলাদেশের স্বাধীনতা
৩২. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ও বাঙলাদেশে সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব
৩৩. সাম্রাজ্যবাদের যুগে জাতীয়তাবাদ
৩৪. গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বতঃস্ফূর্ততা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন