বদরুদ্দীন উমর
গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের অনেক প্রথম সারির নেতা ঘোষণা করেছিলেন যে, আমাদের দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রাজত্ব শেষ হয়েছে, তার প্রত্যাবর্তনের কোন সম্ভাবনা আর নেই। শুধু তাঁরাই নয়, অনেক সৎ আওয়ামী লীগ কর্মী এবং জনগণের একাংশও সেই বিশ্বাসে মোটামুটিভাবে দৃঢ় ছিলেন। কিন্তু আজ আমরা কী দেখছি? মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কি বাঙলাদেশে আজ অবাঞ্ছিত? তারা কি এখন আমাদের অর্থনীতি এবং সেই সাথে রাজনীতিক্ষেত্রে প্রভাব-প্রতিপ্রত্তিহীন? না, তা নয়। আমরা জানি বিগত ১৬ই ডিসেম্বরের পর থেকে অতিশয় চাতুর্যের সাথে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আমাদের দেশে প্রবেশ এবং অনুপ্রবেশ করতে শুরু করেছে এবং ইতিমধ্যেই তারা এ দেশে পরিণত হয়েছে একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী শক্তিতে।
বাঙলাদেশের আন্তর্জাতিক ‘বন্ধুত্বের’ ক্ষেত্রে ঘটনার এই বিকাশ কি আকস্মিক? তা কি বিস্ময়কর? বাঙলাদেশে বর্তমানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সরকার যা চেয়েছিলো এটা কি তার উল্টো? না, তা নয়। এটা আকস্মিক, বিস্ময়কর অথবা আওয়ামী লীগ যা চেয়েছিলো তার বিপরীত কিছু নয়। উপরন্তু এটাই হচ্ছে স্বাভাবিক, আকস্মিকের বিপরীত এবং আওয়ামী লীগ প্রকৃতপক্ষে যা চেয়েছিলো তাই।
সাম্রাজ্যবাদী অনুপ্রবেশের বিবেচনাকালে প্রথমেই যে কথাটি মনে রাখা দরকার তা হচ্ছে এই যে, সাম্রাজ্যবাদ কোন্ দেশে অনুপ্রবেশ করবে এবং কোন্ দেশে তা করবে না অথবা করতে সমর্থ হবে না সেটা সর্বতোভাবে নির্ভর করবে সেই দেশের মৌলিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর। কারণ এই ভিত্তিই নির্ণয় করে শাসকশ্রেণীর চরিত্র এবং বর্তমানকালের শাসকশ্রেণীর ঘাড়ে ভর করেই সাম্রাজ্যবাদ যে-কোন দেশে অনুপ্রবেশ করে বিস্তার করে তার আধিপত্য।
পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায় যে-সমস্ত দেশে সামন্তবাদী অর্থনীতি প্রচলিত এবং যেখানে সামন্তবাদের গুরুত্বপূর্ণ অবশেষসমূহ পুরোদস্তুর বিদ্যমান, সেই সমস্ত দেশে জনগণের উপর শোষণকারীরাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তারাই সেখানে শোষক ও শাসক দুই-ই। নিজেদের শাসন শোষণকে টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে এই সমস্ত দেশের শাসকশ্রেণীসমূহ নিজেদের শ্রেণী-স্বার্থেই সাম্রাজ্যবাদের সাথে হাত মেলায় এবং দ্রুতগতিতে পরিণত হয় তার দাসানুদাসে। উৎপাদন, বিশেষতঃ খাদ্য উৎপাদন এই দেশগুলিতে সামগ্রিক অর্থনীতির পশ্চাৎপদ চরিত্রের জন্যে থাকে অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ে এবং দেশীয় জনসংখ্যার প্রয়োজন মেটাতে মোটেই সক্ষম হয় না। এই অবস্থায় অন্যান্য নানা চাহিদার মধ্যে খাদ্যের চাহিদাই এদের জন্যে হয়ে দাঁড়ায় মারাত্মক জরুরী এবং সেই চাহিদা মেটানোর অজুহাতেই ঘটে দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদের, বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রথম অনুপ্রবেশ।
পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাঙলায় এই পথেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রথম প্রবেশ করেছিলো; পিএল ৪৮০-এর খাদ্য-সাহায্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলো আমাদের দরজায়। এখনো ঠিক তাই হচ্ছে। বাঙলাদেশে খাদ্য ঘাটতি পূরণের সুপরিচিত পথ দিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এদেশে তার হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করার ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে। পাকিস্তানী আমলের মতো বাঙলাদেশী আমলেও মার্কিন খাদ্যবাহী জাহাজ আমাদের জনগণের খাদ্যচাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম ও চালনায় নোঙর করেছে। কিন্তু শুধু খাদ্য সাহায্যই নয়, অগণিত “আরো অনেকরকম সাহায্য” দেওয়া-নেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে মার্কিন ও বাঙলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই পরস্পরের আলিঙ্গনাবদ্ধ। মার্কিন সাহায্য যে কোন দিন কোন ক্ষেত্রেই ‘শর্তহীন’ হয় না, এ অভিজ্ঞতা শুধু আমাদের নয়, দুনিয়ার সকল সাম্রাজ্যবাদ কবলিত দেশের মানুষের। কাজেই “মার্কিন সাহায্য শর্তহীন”, শর্তযুক্ত সাহায্য আমরা নেবো না ইত্যাদি বলে বাঙলাদেশ সরকার যতই চিৎকার করুন, আমরা জানি মার্কিন সাহায্যের এই আলিঙ্গনের অর্থ কি। সেদিক দিয়ে ‘কড়ি নেবো অথচ প্ৰেম দেবো না’ বাঙলাদেশ সরকারের এই হাস্যকর ঘোষণা ভণ্ডামী ছাড়া আর কিছুই নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী বোল-চাল যে নিতান্তই ভণ্ডামী সেটা হাতেনাতে প্রথম ধরা পড়েছিলো তাদের জাতীয়করণ কর্মসূচী ঘোষণার সময়। এই ঘোষণায় অনেক দেশীয় শিল্প এবং ব্যাংক-বীমা সরকার নিজের হাতে নিয়ে এলেও বৃটিশ-মার্কিন শিল্প, ব্যাংক, বীমা ইত্যাদিকে তাঁরা ‘পবিত্র’ জিনিস হিসেবে বিবেচনা করে সেগুলিকে জাতীয়করণ কর্মসূচীর আওতার বাইরে রেখেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী সাহায্যের প্রতি বাঙলাদেশ সরকার এবং তাদের পরিকল্পনাবিদদের লোলুপ দৃষ্টি তখনই ধরা পড়েছিলো। কারণ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং তার অর্থপুষ্ট বিভিন্ন “সাহায্যকারী” আন্তজাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ কোন মার্কিন স্বার্থ জাতীয়করণকারী দেশকে ঋণ অথবা “সাহায্য” দেয় না। যে-সমস্ত দেশ মার্কিন-শিল্প এবং অন্যান্য সংস্থাকে বাজেয়াপ্ত করে এবং তা করলেও ছয় মাসের মধ্যে সেই সিদ্ধান্তকে পুনর্বিবেচনা করে না হিকেলুপার এ্যামেন্ডমেন্ট অনুযায়ী তাদেরকে মার্কিন সাহায্য দেয়া হয় না। নিজেদের একটি পলিসি মেমোরেন্ডাম অনুযায়ী বিশ্বব্যাংক এমন কোন দেশকে ‘সাহায্য’ দেয় না, যে দেশ বিদেশী স্বার্থকে জাতীয়করণ করে।
বৃটিশ ও মার্কিন স্বার্থ, তাদের চা-বাগান (সিলেটের অধিকাংশ চা-বাগানের মালিক বৃটিশ), ব্যাংক, বীমা এবং পাট-স্বার্থ আওয়ামী লীগ সরকার কেন জাতীয়করণ করেনি উপরের তথ্য থেকেই সেটা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যাবে। আওয়ামী লীগের জাতীয়করণ কর্মসূচীর না-করার পরিষ্কার মাথা নিয়েই সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন।
এ সম্পর্কে ভবিষ্যতে যে আরো অনেক বিস্তৃত আলোচনা করা প্রয়োজন হবে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এখন শুধু এটুকুই মনে রাখা দরকার যে, বাঙলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বর্তমান সম্পর্ক এবং সেই সম্পর্কের উত্তরোত্তর উন্নতি কোন আকস্মিক, বিস্ময়কর অথবা অপরিকল্পিত ব্যাপার নয়। এর সমস্তটাই স্বাভাবিক, প্রত্যাশিত এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনার অধীন।
স্বাধিকার
২০ শে অগাস্ট, ১৯৭২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন