বদরুদ্দীন উমর
বাঙলাদেশের সংবিধান সভায় ২৫শে অক্টোবর ভোর রাত্রিতে আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত সংবিধান পাস হয়েছে। যেভাবে এই সংবিধান আমাদের দেশের মৌলিক আইনে পরিণত হলো তার একটা অতি সংক্ষিপ্ত উল্লেখ প্ৰয়োজন।
প্রথমতঃ দেখা যাচ্ছে, এই সংবিধান আলোচনার সময় প্রথম পাঠের (সাধারণ আলোচনা) অপেক্ষা দ্বিতীয় পাঠে (ধারাবাহিক আলোচনা) সময় লেগেছে অনেক কম। পৃথিবীর সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাসে এটা একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা। কারণ ধারাবাহিক আলোচনায় প্রত্যেকটি ধারা অথবা অনুচ্ছেদকে এক এক করে আলোচনা করার ফলে তাতে স্বাভাবিকভাবে সাধারণ আলোচনার থেকে সময় লাগে অনেকখানি বেশী। বাঙলাদেশের সংবিধান সভায় সে রকমটি না হয়ে তার অন্যথা হলো কেন? এই ব্যতিক্রমের কারণ রাজনৈতিক দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যাঁরাই সংবিধান সভার আলোচনা একটু লক্ষ্য করেছেন তাঁরাই দেখেছেন যে সংবিধান সভার সদস্যরা স্বাধীন আলোচনার দিকে যাননি। কারণ সেখানকার সমস্ত পরিবেশটাই ছিলো অনেকটা সার্কাসের মতো। রসিকতার নামে সেখানে মাঝে মাঝে যে সমস্ত উক্তি করা হয়েছে সেগুলির মধ্যেও কোন প্রাণ ছিলো না। রসিকতার নামে এক ধরনের যে ভাঁড়ামী আমরা সাংবিধানিক আলোচনার সময় লক্ষ্য করেছি সেটাও সার্কাসের ভাঁড়ামীর সাথে তুলনীয়। অর্থাৎ সংবিধান সভার আলোচনাকালে যা কিছু বলা অথবা করা হয়েছে তার সমস্ত কিছুই হয়েছে একটা যান্ত্রিক নিয়মে, হুকুম তামিলের কায়দায়।
এই পরিবেশে সত্যিকার সমালোচনা ও বিতর্কের যে কোন স্থান ছিলো না সেটা পরিষদ সদস্যদের প্রত্যেকের কাছেই খুব স্পষ্ট ছিলো। এজন্যে যাঁরা এই তথাকথিত বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁরা খসড়া সংবিধানের গুণকীর্তন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে এত তাড়াতাড়ি জাতিকে একটা সংবিধান দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজেদের বক্তৃ তা সমাপ্ত করেছেন। এর ফলে সদস্যদের রসজ্ঞান, বিদ্যে-বুদ্ধি এবং বক্তৃতার ক্ষমতা সবকিছুই প্রথম পাঠের সময়েই প্রায় নিঃশেষিত হয়েছিলো।
এর ফলে সংবিধান সভায় দ্বিতীয় পাঠের কোন প্রয়োজন বস্তুতঃপক্ষে ছিলো না। কিন্তু দ্বিতীয় পাঠ ব্যতীত কি কোন সংবিধান সভায় সংবিধান প্রণীত হয়? কাজেই দ্বিতীয় পাঠের ব্যবস্থা। এই পাঠ শুরু হওয়ার পর পাইকারী হারে কয়েক দফায় এগুলির সংক্ষিপ্ত এবং ঢালাও আলোচনার পর এগুলো পাস হয়ে গেলো। তারপর তৃতীয় পাঠ। দ্বিতীয় পাঠের মতো এই তৃতীয় পাঠও সমান নিষ্প্রয়োজন এবং অপরিহার্য। কাজেই তৃতীয় পাঠও সংবিধান সভায় হলো। এই পাঠ অবশ্য দ্বিতীয় পাঠের থেকে কিছুটা ‘প্রাণবন্ত’। কারণ এ সময় ৩০ লক্ষ মৃত বাঙালীর জন্যে অনেক অশ্রুপাত এবং আবেগপূর্ণ বক্তৃতার সুযোগ ছিলো। এইভাবে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পাঠের পর আওয়ামী লীগ বাঙলাদেশের জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলো।
যে পদ্ধতিতে নিজেদের প্রদত্ত এই প্রতিশ্রুতি আওয়ামী লীগ রক্ষা করলো সেটা দেখে মনে হয় যে, সংবিধান সভায় বিতর্ক ইত্যাদির ঝামেলা সৃষ্টি না করে তাঁরা একটা সরকারী অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমেও নিজেদের প্রতিশ্রুতি অনায়াসে রক্ষা করতে পারতেন।
সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় আর একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে হরদম জোরালোভাবে বলা হচ্ছে যে, তাঁরা বাঙলাদেশের জনগণকে অতিদ্রুততার সাথে একটা সংবিধান দিয়েছেন। সত্যিই কি তাই? এই দ্রুততার কথা উঠেছে নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ণে বিলম্বের সাথে তুলনা করতে গিয়ে। কিন্তু সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের যে সমস্ত অসুবিধা ছিলো সেগুলি কি এখন আছে? বাঙলাদেশে কোন প্রদেশ নেই। বিশেষত এমন এক প্রদেশ যেটা এক হাজার মাইল দূরত্বের দ্বারা বিচ্ছিন্ন। এখানে অন্য কোন ভাষা নেই, কোন গুরুতর অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে কোন সমস্যা এখনো সৃষ্টি হয়নি এবং সর্বোপরি সংবিধান প্রণয়নের জন্য সংবিধান সভায় প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতারও কোন অভাব এখানে ছিলো না। কাজেই সংবিধান তৈরী এখানে বিলম্বিত হবে কোন কারণে? এক্ষেত্রে সরকারের বিরুদ্ধে একথা কি বলা চলে না যে সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে কোন রকম বাস্তব বাধা না থাকা সত্ত্বেও সংবিধান তাঁরা অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্রণয়ন না করে সেটা করতে অহেতুকভাবে অনেক সময় নিয়েছেন? অর্থাৎ কোন সত্যিকার গণতান্ত্রিক সরকার এই অবস্থায় দেশকে একটি সংবিধান দিতে আওয়ামী লীগ সরকারের মতো এতখানি বেশী সময় কোন মতেই নিতো না। কাজেই সময়ের প্রশ্নেও সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কৃতিত্বের থেকে কৃতিত্বের অভাবই কি বেশী নয়?
একথা নিছক সমালোচনার খাতিরে বলা হচ্ছে না। এটা বলার একটা গুরুতর কারণ আছে এবং এই কারণটিই সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে সরকারের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা হিসেবে উপস্থিত করা চলে। আমরা জানি যে সংবিধানটির প্রথম খসড়া রচিত হওয়ার পর বাঙলাদেশের আইন মন্ত্রী সেটি সাথে নিয়ে কয়েকটি বিদেশী রাষ্ট্রে গিয়ে সেখানকার বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করেছেন। এ ভাষ্য সংবাদপত্রের মাধ্যমেই পরিবেশিত হয়েছিলো। এই সমস্ত বিদেশীরা নিশ্চয় সংবিধান সম্পর্কে কিছু কিছু, হয়তো বা অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সুযোগ পেয়েছিলেন (সংবিধান সভার সদস্যদের ক্ষেত্রে এই সুযোগের অর্থ সংশোধনী পেশ)। স্বাধীন ও সার্বভৌম নামে ঘোষিত কোন রাষ্ট্রের সংবিধান সেই দেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সংবিধান সভার সদস্যদের পূর্বে বিদেশী রাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞদেরকে দেখিয়ে বিশুদ্ধ করিয়ে আনার ঘটনা রীতিমতো তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষতঃ আমরা যখন লক্ষ্য করি যে, সংবিধান সভার সময়ের কার্পণ্য দেখিয়ে যেখানে খসড়া সংবিধান আলোচনাকে বিশ্রীভাবে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে সেখানে বিদেশীদেরকে সেই সংবিধান দেখিয়ে আনার ব্যাপারে সময়ের কোন কার্পণ্য সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়নি। বিদেশীদেরকে আলোচনা এবং খসড়া পরিবর্তনের যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে সেই সুযোগ নির্বাচিত সংবিধান সভাকে না দেওয়ার অর্থ জনগণকে, বিশেষত সচেতন রাজনৈতিক কর্মীদেরকে, কি বুঝিয়ে বলতে হবে?
যাই হোক, পরিশেষে একথা নিশ্চিতভাবে বলা চলে যে, বাঙলাদেশের জন্যে প্রণীত এই সংবিধানে জনগণকে যা দেওয়া হয়েছে তার সাথে কিভাবে তাদেরকে তা দেওয়া হয়েছে সেটা যদি মিলিয়ে দেখা যায় তাহলে তার মধ্যে একটা যোগসূত্র পাওয়া যাবে। এই যোগসূত্রের মধ্যে শুধু যে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অগণতান্ত্রিক এবং মুৎসুদ্দী চরিত্রই সুস্পষ্ট হবে তাই নয়। বাঙলাদেশের শোষক শ্রেণীসমূহের চরিত্রের হদিসও এর মধ্যেই পাওয়া যাবে।
সাপ্তাহিক স্বাধিকার
১৯শে নভেম্বর, ১৯৭২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন