বদরুদ্দীন উমর
১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে নির্বাচন দিয়ে আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যেই নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে গেছে। তারা যে এ দেশে গণতন্ত্রের খোলসটুকু পর্যন্ত অতি শীঘ্র ছিঁড়ে ফেলবে সেটা তাদের নির্বাচনী প্রচারণার বর্তমান ধারা থেকেই বেশ বোঝা যাচ্ছে।
প্রথমতঃ, নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করার জন্য সরকারী গাড়ী-ঘোড়ায় চড়ে তারা অবিশ্রান্তভাবে বলে বেড়াচ্ছে যে ‘তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে’ তারা স্বাধীনতা এনেছে; কাজেই বাঙলাদেশে তাদেরই রাজত্ব। অন্য কারো সেখানে বাড়াবাড়ি করার অধিকার নেই।
এই প্রথম বক্তব্য থেকেই তাদের দ্বিতীয় বক্তব্য : যারা এ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কোন অংশগ্রহণ করেনি তারা দেশপ্রেমিক নয়, তারা হলো মূলতঃ ‘দালাল’। অবশ্য তাদের কাছে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার মূল অর্থ ভারতে হিজরত করা এবং সেই হিসেবে অংশ না নেওয়ার অর্থ দেশে থেকে যাওয়া। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের’ এই অর্থ বের করাই অন্যতম প্রধান কারণ যার জন্যে বাঙলাদেশের মুসলমান জনগণের মধ্যে দ্রুতগতিতে একটি ভারতবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাব জাগ্রত হয়েছে এবং বিস্তার লাভ করেছে। বিরোধী দলের কোন কোন অংশ সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যে কিছুটা দায়ী হলেও এজন্যেই তার মূল দায়িত্ব হলো আওয়ামী লীগের, তাদের নেতৃত্বের। প্রথম দিকে এসে ঢালাওভাবে সাড়ে ছয় কোটি দেশবাসীকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দালাল আখ্যা দিয়েই এরা স্থাপন করেছে বাঙলাদেশে নব পর্যায়ে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিভূমি।
আওয়ামী লীগের উপরিউক্ত প্রথম ও দ্বিতীয় বক্তব্যের থেকেই তাদের তৃতীয় বক্তব্যের উদ্ভব। এই বক্তব্যটি হলো এই যে, বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে (তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সংজ্ঞা অনুযায়ী) যারা অংশ গ্রহণ করেনি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কোন সমালোচনার অধিকার তাদের নেই। কাজেই তারা যদি অধিকারের সীমা অতিক্রম করে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করতে এগিয়ে আসে তাহলে তাদেরকে কয়েদ করা ‘জনস্বার্থের’ জন্য অপরিহার্য।
নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে তাদের চতুর্থ বক্তব্য হলো, যারাই সরকারের অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সমালোচনা করছে তারাই কোন না কোন বিদেশী রাষ্ট্রের চর। এই চতুর্থ ধরনের প্রচারণাকে জোরালো করার জন্যে ইতিমধ্যেই তারা বিশেষ বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করে তাদেরকে বিদেশী চর আখ্যা দিয়ে শাস্তি প্রদানের জন্য নিজেদের সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণার উপরিউক্ত ধারা সম্পর্কে যা উল্লেখ করা হলো সেটা কোন কাল্পনিক ব্যাপার নয়। সরকারী খেদমতগর পত্র-পত্রিকাগুলিতে প্রতিদিনই এই ধরনের প্রচারণার নিত্য নোতুন উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই ধরনের প্রচারণা যে সরকারী দলের পক্ষ থেকে লাগামহীনভাবে বিরোধী দলসমূহের বিরুদ্ধে করা হয় সে দলের হাতে গণতন্ত্রের গতি কি হতে পারে? আওয়ামী লীগ এবং তার নেতারা এ দেশের স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করেছেন, অন্যেরা কিছু করেননি, কাজেই তাদেরকে এ দেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকতে হবে; আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তাদের কোন সমালোচনা চলবে না। এই সমস্ত বক্তব্য যারা হাজির করছেন তাঁদের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন সরাসরিভাবে তুলে ধরা যেতে পারে।
সে প্রশ্নগুলি হলো এই প্রথমতঃ, গণতান্ত্রিক সমালোচনার অধিকার বলতে তাঁরা কি বোঝেন? এই অধিকার কি শুধু শাসক শ্রেণীর ও দলের অধিকার, না সেই শ্রেণীর ও দলের বাইরের অগণিত মানুষের পক্ষেও তা প্রযোজ্য? দ্বিতীয়তঃ, অন্যেরা স্বাধীনতা সংগ্রামে কিছু করেনি, সেই সংগ্রামে তাদের কোন ভূমিকা নেই বলে তাঁরা যে রটনা করে বেড়াচ্ছেন তার সাথে সঙ্গতি রেখে তাঁরা নিজেরা কে কি করছেন তার একটা বিস্তারিত তালিকা নির্বাচনের পূর্বে জনগণের সামনে দাখিল করা তাঁরা কি প্রয়োজনীয় মনে করেন না? এই সমস্ত ‘দেশপ্রেমিক’ নেতাদের প্রথম দেশপ্রেমমূলক কাজ যে ছিলো শ্রীচরণ ভরসা করে দেশত্যাগ সে কথা আমাদের জনগণ ভালোভাবেই জানেন। কিন্ত ভারতে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে তাঁরা কে কিভাবে ‘সংগ্রামে’ অংশ গ্রহণ করেছেন তার বিশেষ কিছুই এখানকার ‘দালাল’ জনগণ জানেন না। এই ‘দালালরা’ যেহেতু ভোটের মালিক সেজন্যে তাদেরকে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে অবহিত করা কি তাঁদের উচিত নয়?
তৃতীয়তঃ, এখানকার সাধারণ জনগণের ধারণা, বিগত নয় মাসের যুদ্ধে এবং বাঙলাদেশের ‘স্বাধীনতার’ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতাদের থেকে ভারতীয় জাওয়ানদের অবদান অনেক বেশী। এই অবদানের প্রতিদানে বাঙলাদেশ সরকার যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ গ্রহণকারী এই ভারতীয় জওয়ানদেরকে বিশেষ মর্যাদা দানের জন্য আজ পর্যন্ত কি করেছেন? বাঙলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে প্রত্যক্ষভাবে লড়াই করাই যদি রাজনৈতিক অধিকারের মাপকাঠি হয়, তাহলে আওয়ামী লীগ সরকারের উচিত উপরিউক্ত ভারতীয় জওয়ানদেরকে অন্ততঃপক্ষে এই দেশের নাগরিকত্ব এবং ভোটাধিকার প্রদান করা। তাঁরা এ কাজ করছেন না কেন?
আসল কথা হলো, “স্বাধীন বাঙলাদেশের পরিপক্ব ফলটি বিশেষ কতকগুলি ঐতিহাসিক কারণে আকস্মিকভাবে আওয়ামী লীগের কোলে পতিত হয়েছে এবং সে কারণেই এই স্বাধীনতাকে নিয়ে এঁরা কি করবে তার কোন হদিস এঁদের জানা নেই।
রাজনৈতিক অধিকার বলতে তাই এঁরা পাকিস্তান আমলে যা বুঝে এসেছে সেই ‘জ্ঞান’কেই এখন কাজে লাগাচ্ছে। এ জন্যেই আজ বাঙলাদেশে যা ঘটছে তা নব পর্যায়ের এক ‘পাকিস্তানী’ কর্মকাণ্ড ব্যতীত আর কিছুই নয়। পাকিস্তানীদের মতো এঁরাও তাই জনগণের উপর একইভাবে টহলদারী করছে। এই টহলদারীর ক্ষেত্রেও এঁরা তেমন কোন নোতুনত্ব দেখাতে পারেনি। ‘পাকিস্তানের’ স্থানে ‘বাঙলাদেশ” ‘ইসলামের’ স্থানে ‘বাঙালী জাতীয়তা’, ‘কায়েদে আজমের’ স্থানে ‘বঙ্গবন্ধু’ ইত্যাদি শব্দসম্ভার আমদানী করে এঁরা এঁদের পূর্ববর্তী পাকিস্তানী শাসক শ্রেণীর নানান গণবিরোধী কর্মকাণ্ডকেই পুরোদমে নকল করছে।
এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার বহু সংখ্যক দেশের মতো বাঙলাদেশ এখনও সামন্ত প্রভাবে পঙ্গু এবং সাম্রাজ্যবাদ কবলিত। কাজেই এ ধরনের অন্যান্য দেশগুলির ক্ষেত্রে আমরা যে আধা ফ্যাসিবাদের রাজত্ব দেখছি বাঙলাদেশের শাসকশ্রেণী এবং তাঁদের সরকারও যে বাঙলাদেশে সেই ধরনের আধা-ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাস এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করার ক্ষেত্রে বিবিধ রকম পদক্ষেপ নেবে তাতে আর আশ্চর্য কি? আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণা আজ সুনিশ্চিতভাবে বাঙলাদেশে শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক বিকাশের সেই ধারাকেই চিহ্নিত করছে।
সাপ্তাহিক স্বাধিকার
১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন