সমর পাল
শিখণ্ডী খাড়া করা বা শিখণ্ডী করে রাখার প্রবাদ আমাদের সমাজে চালু আছে: যার আড়ালে থেকে অন্যায় কাজ করা যায় সে শিখণ্ডী বলে পরিচিত হয়।
মহাভারতের কাহিনী অনুসারে শিখণ্ডীর কাহিনী সংক্ষেপে নিম্নরূপ— কাশীরাজের কন্যা অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকা। ভীষ্ম চিরকুমার থাকবেন বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। স্বয়ংবর সভা থেকে বৈমাত্রেয় ভাই বিচিত্রবীর্যের বিয়ের জন্য ভীষ্ম হরণ করেছিলেন কাশীরাজের এই তিন কন্যাকে। বড় বোন অম্বা প্রথমে শাল্বরাজ ও পরে ভীষ্মকে বধ করার জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়ে মহাদেবের তপস্যা করেন। অবশ্য অম্বিকা ও অম্বালিকা বিচিত্রবীর্যের স্ত্রী হয়েছিলেন।
অম্বার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাকে বর দিলেন যে, “তুমি জন্মান্তরে দ্রুপদ রাজার ঘরে ক্লীবরূপে জন্মগ্রহণ করে ভীষ্মবধের কারণ হবে।’ এই বর পাবার পর অম্বা আগুনে প্রাণ বিসর্জন দেন।
পরজন্মে অম্বা পাঞ্চাল দেশের রাজা দ্রুপদের ঘরে শিখণ্ডিনী নামে কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করেন। আসলে তিনি ক্লীব ছিলেন কিন্তু প্রকাশ্যে পুরুষ বলে পরিচিত ছিলেন। দশার্ণ দেশের রাজকুমারীর সাথে তার বনে চলে যান। সেখানে কুবেরের অনুচর স্কুলকর্ণ নামক যক্ষের সাথে তার দেখা হয়। ঐ যক্ষ বিস্তারিত জানার পর শিখণ্ডিনীকে নিজের পৌরুষ দান করে তার ক্লীবত্ব গ্রহণ করেন। শিখণ্ডিনী হলেন শিখণ্ডী। শিখণ্ডীর মৃত্যুর পর আবার স্কুলকর্ণ ক্লীব থেকে পুরুষ হবেন এমন সিদ্ধান্ত ছিল কুবেরের। এ বিষয়ে মহাভারতের উদ্যোগপর্বে বিস্তারিত বিবরণ আছে।
শিখণ্ডী ফিরে গেলেন বাবার কাছে। পুরুষ বলে প্রমাণিত হলেন তিনি। দ্রোণাচার্যের কাছে তিনি অস্ত্রবিদ্যা ও ধনুর্বেদ শিক্ষা করেন এবং দক্ষ যোদ্ধায় পরিণত হন। কিন্তু ভীষ্ম জানতে পারেন যে, অম্বাই শিখণ্ডীরূপে পরিণত হয়েছে এবং তাকে বধ করার জন্য জন্মগ্রহণ করেছে। যৌবনে ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা ছিল যে, স্ত্রীলোক, ক্লীব, স্ত্রীলোক থেকে রূপান্তরিত পুরুষ এবং অস্ত্রহীন—এদের বিরুদ্ধে তিনি কখনো যুদ্ধাস্ত্র প্রয়োগ করবেন না।
কুরুক্ষেত্রের মহাসমরে (যুদ্ধ হয়েছিল ১৮ দিন) যুদ্ধ করার ১০ দিন পর ভীষ্মের মনে ইচ্ছামৃত্যুর আশা জাগে। ঐ যুদ্ধে কৌরবপক্ষের হয়ে ভীষ্ম যুদ্ধ করছেন। এদিকে অর্জুন শিখণ্ডীকে সামনে রেখে প্রবল পরাক্রান্ত বীর ভীষ্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। শিখণ্ডীর স্ত্রীরূপ স্মরণ করে ভীষ্ম অস্ত্র পরিত্যাগ করেন। নয়টি তীক্ষ্ণ বাণ ভীষ্মের বুকে বিদ্ধ করেন অর্জুন। শিখণ্ডীকে সামনে রাখায় ভীষ্ম কোনো অস্ত্র প্রয়োগ করেননি। ঐ অবস্থায় অর্জুন ভীষ্মের পতন ঘটান। এভাবে পূর্বজন্মের কাশীরাজকন্যা অম্বা পরজন্মে শিখণ্ডী হয়ে ভীষ্মবধের কারণ হন। এখানে উল্লেখ্য যে, পরবর্তী সময়ে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামার খড়গাঘাতে শিখণ্ডী মৃত্যুবরণ করেছিলেন। মহাভারতের চরিত্র শিখণ্ডী আমাদের আলোচ্য প্রবাদকথার উৎস।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন