ধর্মের ষাঁড়

সমর পাল

ধর্মের ষাঁড়

বরাহপুরাণমতে ব্রহ্মা যখন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হন, তখন তার শরীরের ডান অংশ থেকে এক পুরুষের আবির্ভাব ঘটে। এই পুরুষ হলেন ধর্ম। ব্রহ্মার আদেশে ধর্ম হলেন চার পা-বিশিষ্ট এবং বৃষভাকৃতি (ষাঁড়ের আকৃতি)। তার কাজ হলো প্রজাপালন।

সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার নির্দেশ অনুযায়ী ধর্ম সত্যযুগে চতুষ্পদ, ত্রেতায় ত্রিপদ, দ্বাপরে দ্বিপদ ও কলিতে একপদ হয়ে জ্ঞানী-গুণী তথা ব্রাহ্মণদের সম্পূর্ণ, যোদ্ধা ও শাসকদের তিন ভাগ, কৃষিকাজ ও পশুপালনকারী বৈশ্যদের দুই ভাগ ও শূদ্রদের এক ভাগ দিয়ে রক্ষা ও পালন করতে থাকেন।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর (১৮৫৩-১৯৩১ খ্রি.) মতে ধর্মপূজা বৌদ্ধধর্মের রূপান্তর মাত্র। পালবংশীয় রাজা ধর্মপালের (৭৮১-৮২১ খ্রি.) সময় এদেশে ধর্মপূজা ব্যাপকতা লাভ করে। ডোম-পুরোহিতরাই এ পূজার প্রধান পুরোহিত ছিলেন। হরপ্রসাদ বলেছেন—

‘ধর্মঠাকুরকে কোনো কোনো স্থলে বিষ্ণুরূপে পূজা করে, তুলসী দেয়, বলিদান করে না। কোথাও শিবরূপে পূজা করে, বিল্বপত্র (বেলপাতা) দেয়। কোথাও বা ছাগবলি, মেষবলিও দেয়, কিন্তু অধিকাংশ স্থলে মুরগি, শূকর বলিই হয়। ধর্মঠাকুরের পুরোহিত কোথাও কৈবর্ত, কোথাও দুলে (ডুলি, পালকি ইত্যাদির বাহক), কোথাও বাগদি, কোথাও আগুরি (উগ্র ক্ষত্রিয় জাতি)। কিন্তু অধিকাংশ স্থলে ডোম বা পোদ। শেষোক্ত দুই জাতি এখনো ব্রাহ্মণ লয় নাই, এখনো তাহারা আপনাদের জাতীয় পণ্ডিত দিয়া সব কাজ করায়। ধর্মঠাকুর ইহাদের নিজস্ব দেবতা।’

সমগ্র বাংলাদেশ বৌদ্ধ আমলে ধর্মপূজার আয়োজনে ব্যস্ত থাকতো। উচ্চশ্রেণীর বৌদ্ধ ডোম পুরোহিতরা ধর্মান্তরিত না হওয়ায় এদেশে সম্মান- সম্ভ্রমের সাথে আগের মতো সমাজের মাথা হয়ে থাকতে পারেনি। অনেকে বেদনির্ধারিত আচার-নিয়ম মেনে নিলেও তারা নেয়নি বলে সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে পেছনে পড়ে যায়, এমনকি জীবিকার প্রয়োজনে নিম্নশ্রেণীর কাজে নিয়োজিত হতে বাধ্য হয়। কিন্তু আজকের সনাতন ধর্মের মূলে যতটা বেদের প্রাধান্য তার চাইতে অনেকগুণ বেশি মহাযানী বৌদ্ধপ্রভাব—এ কথা অস্বীকার করার হেতু আছে বলে মনে হয় না। বৌদ্ধদের শাস্ত্র আমাদের কাছে ব্রাহ্মণ্য চেহারায় হাজির করা হলেও সনাতন হিন্দুদের বোধ ও আচার-আচরণে সামগ্রিকভাবে মহাযানী বৌদ্ধপ্রভাব স্পষ্ট। বৌদ্ধ আমলের দেবদেবীকে হিন্দুরা আজও ভক্তিশ্রদ্ধা করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।

ধর্ম বা ধর্মঠাকুর আজও আমাদের সমাজে পূজনীয়—কখনো নিষ্ণুরূপে, কখনো শিবরূপে আবার কখনো যম বা অন্য মহিমায়। বৌদ্ধযুগের মতো ধর্মের নামে মানত করে ষাঁড় বা ছাগল ছেড়ে দেয়ার নিয়ম এখনো দেখা যায় বাঙালি সমাজে। বিভিন্ন হাটবাজারে মুক্ত অবস্থায় দু’একটি ষাঁড় বা পাঁঠা এখনো দেখা যায় যেগুলো ধর্মের নামে ছেড়ে দেয়া। এরা যত্রতত্র তরিতরকারির ডালা বা অন্য কোনো ক্ষেতের ফসল খেলেও মানুষ তাদের উপর অত্যাচার করে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতি হলেও তারা যেন মেনে নেয় এই অবস্থা।

ধর্মঠাকুর বা ধর্ম নিয়ে বেশি কথা না বলে বলা যায় যে, ধর্মের নামে উৎসর্গ করা ষাঁড় (হত্যা না করে) ছেড়ে দেয়ার পর তারা অবাধ ঘুরে বেড়ায়, অনেক মানুষের ক্ষতি করে। কিন্তু তাদের শাস্তি দেয় না মানুষ। এটি সামাজিক সহনশীলতা। তবে ষাঁড়ের বদলে এ ধরনের আচরণ মানুষের মধ্যে পাওয়া গেলে অর্থাৎ স্বচ্ছন্দে বিচরণকারী পরের অনিষ্টকারী লোককে আমরা ধর্মের ষাঁড় বলে থাকি। আবার খায় দায় আর কোনো কাজকর্মের দিকে মনোযোগ দেয় না এমন লোককেও ধর্মের ষাঁড় নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্যসূচক অনেক প্রবাদ চালু আছে এদেশে। যজ্ঞের ঘোড়া, গোকুলের ষাঁড় ও খোদার খাসি প্রবাদের সাথে এই প্রবাদ তুলনীয়।

সকল অধ্যায়

১. অকাল কুষ্মাণ্ড
২. অগস্ত্যযাত্রা
৩. অজার যুদ্ধে আঁটুনি সার
৪. অতি দর্পে হত লঙ্কা
৫. অতি দানে বলির পাতালে হলো ঠাঁই
৬. অতি মন্থনে বিষ ওঠে
৭. অতি লোভে তাঁতি নষ্ট
৮. অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট
৯. অন্ধের হাতি দেখা
১০. অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী
১১. অশ্বত্থামা হত ইতি গজ
১২. আগ নাংলা যে দিকে যায় পাছ নাংলা সে দিকে যায়
১৩. আষাঢ়ে গল্প
১৪. আসলে মুষল নাই ঢেঁকিঘরে চাঁদোয়া
১৫. ইল্লত যায় না ধুলে খাসলত যায় না মলে
১৬. ওঝার ব্যাটা বনগরু
১৭. কংসমামা
১৮. কাকতালীয় ব্যাপার
১৯. কালনেমির লঙ্কাভাগ
২০. কুম্ভকর্ণের ঘুম
২১. কুরুক্ষেত্র কাণ্ড
২২. কড়ায় গণ্ডায়
২৩. খর দজ্জাল
২৪. খাঞ্জা খাঁ
২৫. খয়ের খাঁ
২৬. গজকচ্ছপের লড়াই
২৭. গজকপিত্থবৎ
২৮. গদাই লশকরি চাল
২৯. গন্ধমাদন বয়ে আনা
৩০. গোঁফ খেজুরে
৩১. গোকুলের ষাঁড়
৩২. গৌরচন্দ্রিকা
৩৩. ঘরভেদী বিভীষণ
৩৪. ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে
৩৫. ঘুঁটো জগন্নাথ
৩৬. চিত্রগুপ্তের খাতা
৩৭. চেনা বামুনের পৈতা লাগে না
৩৮. চোরে চোরে মাসতুতো ভাই
৩৯. ছকড়া নকড়া
৪০. জগা খিচুড়ি
৪১. জড়ভরত
৪২. ঢাক পেটানো
৪৩. ঢাকের বাঁয়া
৪৪. ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দার
৪৫. ত্রিশঙ্কু অবস্থা
৪৬. দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার
৪৭. দশচক্রে ভগবান ভূত
৪৮. দেবতার বেলা লীলাখেলা পাপ লিখেছে মানুষের বেলা
৪৯. দৈত্যকুলে প্ৰহ্লাদ
৫০. ধনুর্ভঙ্গ পণ
৫১. ধন্বন্তরি
৫২. ধর লক্ষ্মণ
৫৩. ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির
৫৪. ধর্মের ষাঁড়
৫৫. ধান ভানতে শিবের গীত
৫৬. ধুন্ধুমার কাণ্ড
৫৭. নরাণাং মাতুলক্রমঃ
৫৮. পরশুরামের কুঠার
৫৯. পরের ধনে পোদ্দারি
৬০. পাততাড়ি গুটানো
৬১. পান্তা ভাতে ঘি নষ্ট বাপের বাড়ি ঝি নষ্ট
৬২. পিপুফিশু
৬৩. পোয়া বারো
৬৪. ফতো নবাব
৬৫. ফপর দালালি
৬৬. ফেউ লাগা
৬৭. বাজখাঁই আওয়াজ
৬৮. বিদুরের খুদ
৬৯. বিন্দেদূতী
৭০. ভবতি বিজ্ঞতমঃ ক্রমশো জনঃ
৭১. ভস্মে ঘি ঢালা
৭২. ভাগের মা গঙ্গা পায় না
৭৩. ভানুমতির খেল
৭৪. ভিজা বিড়াল
৭৫. ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা
৭৬. ভুশুণ্ডি কাক
৭৭. ভেড়াকান্ত
৭৮. ভেড়ার পাল
৭৯. মগের মুলুক
৮০. মরার সময় মকরধ্বজ
৮১. মাছি মারা কেরানি
৮২. মাছের মায়ের পুত্রশোক
৮৩. মান্ধাতার আমল
৮৪. মারের ওপর ওষুধ নাই
৮৫. মাৎস্যন্যায় অবস্থা
৮৬. যক্ষের ধন বা কুবেরের ধন
৮৭. যণ্ডামার্ক বা যণ্ডামার্কা
৮৮. যত দোষ নন্দ ঘোষ
৮৯. যে দামে কেনা সেই দামে বিক্রি
৯০. রথ দেখা ও কলাবেচা
৯১. রাবণের চিতা
৯২. লঙ্কাকাণ্ড
৯৩. লাগে টাকা দেবে গৌরীসেন
৯৪. লেফাফাদুরস্ত
৯৫. শকুনিমামা
৯৬. শনির দশা
৯৭. শাঁখের করাত
৯৮. শাপে বর
৯৯. শিখণ্ডী খাড়া করা
১০০. শিবরাত্রির সলতে
১০১. শুভঙ্করের ফাঁকি
১০২. শ্যাম রাখি কি কুল রাখি
১০৩. ষাঁড়ের গোবর
১০৪. সরফরাজি চাল
১০৫. সস্তার তিন অবস্থা
১০৬. সাক্ষীগোপাল
১০৭. সাত নকলে আসল খাস্তা
১০৮. হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রী
১০৯. হরি ঘোষের গোয়াল
১১০. হরিহর আত্মা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন