সমর পাল
মন্থন শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো আলোড়ন বা মথিত করা। যারা দুধকে মন্থন করে নবনীত বা ননি-মাখন তৈরি করতে দেখেছেন তারা জানেন যে, একটি বড় পাত্রে দুধ রেখে বাঁশের দণ্ড দড়ি পেঁচিয়ে ঐ দড়ি টেনে টেনে বাঁশের দণ্ড (মন্থনদণ্ড বা মউনি) দিয়ে কী ভাবে দুধের মধ্যে আড়োলন সৃষ্টি করে মাখন তোলা হয়।
সত্যযুগে সমুদ্রে ঐরূপ এক আলোড়ন সৃষ্টি করা হয়েছিল সমুদ্রনবনীত অমৃত পাবার আশায়। শ্রীমদ্ভাগবতের ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ অধ্যায় পর্যন্ত এই সমুদ্রমন্থনের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। রামায়ণের বালকাণ্ড ও মহাভারতের আদিকাণ্ডেও সমুদ্রমন্থনের বর্ণনা আছে। তবে বিভিন্ন বর্ণনায় কিছু কিছু ভিন্নতাও লক্ষণীয়। সংক্ষেপে সমুদ্রমন্থনের বিষয় নিম্নরূপ-
সত্যযুগে দেবতাগণ সিদ্ধান্ত নেন যে, তারা অমৃত পান করে অজর, অমর ও নিরাময় থেকে অক্ষয় হবেন। সুমেরু পর্বতে ব্রহ্মার সাথে তাদের সভা হলো। সমুদ্রকে মন্থন করা দেবতাদের দ্বারা অসম্ভব ব্যাপার। এজন্য চাই অসুরদের সাহায্য। ব্রহ্মা যুক্তি দিলেন অসুরদের সাথে আপাতত ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে সমুদ্রমন্থনের কাজে যেন দেবতারা অগ্রসর হন। কারণ অসুরদের এ কাজে নিয়োজিত করতে না পারলে অমৃত পাবার কোনোই সম্ভাবনা নেই।
ব্রহ্মার পরামর্শ অনুসারে প্রস্তুতি শুরু হলো। কশ্যপ-কদ্রুর জ্যেষ্ঠপুত্র নাগরাজ বাসুকি (মনসার ভাই শেষনাগ বা অনন্তনাগ) হলেন মন্থনরজ্জু বা দড়ি। দেবতাদের অনুরোধে বাসুকি বিশাল মন্দর পর্বতকে তুলে আনলেন সমুদ্রতীরে। তাকে করা হলো মন্থনদণ্ড বা মউনি। মন্দর পর্বতকে রাখা হলো সমুদ্রতলে দ্বিতীয় অবতার কর্মের (কচ্ছপরূপী বিষ্ণুর অবতার) পিঠে। বাসুকির লেজের দিকে ধরলেন দেবতারা আর মুখের দিকে অসুররা। দেবতারা বুদ্ধি খাটিয়ে লেজের দিক বেচে নেন। কারণ বাসুকির মুখ থেকে তীব্র শ্বাস তাদের জন্য ক্ষতিকর হবে। ক্ষীরোদ সমুদ্র মন্থন করা আরম্ভ হলো। এখান থেকেই তুলে আনতে হবে অভীষ্ট অমৃত যা দেবতা ও অসুরদের পরম লক্ষ্য।
বহুকাল মন্থনের ফলে সমুদ্র থেকে দুধ ও ঘি উৎপন্ন হলো। অমৃত না পাওয়া পর্যন্ত মন্থন চালাতে পরামর্শ দিলেন ব্রহ্মা। একে একে চন্দ্ৰদেব, ঘি হাতে লক্ষ্মী, কৌস্তুভ মণি এবং সবশেষে অমৃতভাণ্ড হাতে ধন্বন্তরি ও পরে গজরাজ ঐরাবত উঠে এলেন। বিষ্ণুর প্রতারণাপূর্ণ কৌশলে দেবতারা বেছে বেছে সেরা সম্পদগুলো নিজেদের ভাগে নিতে লাগলেন।
এরপর আরো মূল্যবান সম্পদ পাবার আশায় দেব-দানব মিলে আবার মন্থন শুরু করলেন। তোলপাড় করে সমুদ্রের রত্ননিধি পাবার লোভে এই অতিরিক্ত মন্থন। উঠে এলো তীব্র কালকূট বিষ। বিষের জালায় ত্রাহি ত্রাহি রব উঠলো অভিজাত দেবতা ও সাধারণ খেটে খাওয়া জনগণ অর্থাৎ তথাকথিত অসুর-দানবদের মধ্যে। দেবতাদের সাধ্য হলো না সে বিষ খেয়ে হজম করার। অবশেষে জগতের মঙ্গলার্থে অনার্য মানুষের পরমপ্রিয় নেতা (কিন্তু দেবতাদের কাছে নিন্দিত) মহাদেব এই কালকূট বিষ নিজে গ্রহণ করে হলেন নীলকণ্ঠ। জগতের মঙ্গল করায় তিনি মঙ্গলময় শিব। সমুদ্রমন্থনের যৌক্তিক বিশ্লেষণ অন্য কোথাও তুলে ধরার আশায় রইলাম। এখানে বিস্তারিত বলা হলো না।
অতি মন্থনে বিষ ওঠার কাহিনী আমরা নানা শাস্ত্রে পাই। এ রকম তুলনীয় প্রবাদ হচ্ছে—লেবু কচলাতে কচলাতে তেতো হয়ে যায়। অর্থাৎ একটি বিষয় নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত আলোড়ন ক্ষতিকারক হয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন