ডার্টি গেম – ১৬

কাজী আনোয়ার হোসেন

ষোলো

মাত্র পাঁচ মিনিটের ভেতরে কবজিতে শেকল বেঁধে বড় এক গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয়া হলো আলকারাযকে। পিঠে ঘষা দিচ্ছে রুক্ষ বাকল। মাটি থেকে মাত্র তিন ইঞ্চি ওপরে ঝুলছে ওর দু’পা। প্রচণ্ড ব্যথায় পাগল হয়ে গেছে সে। গোঙানি চেপে দেখছে একটু দূরে শুইয়ে নেয়া হয়েছে ইসাবেলাকে। এবার ওর স্ত্রীর কপালে কী আছে, সেটা ভেবে অপমানে ও দুঃখে চোখদুটো বেয়ে দরদর করে অশ্রু ঝরল তার।

মেক্সিকান ডাকাতের ভাবনাগুলো বুঝতে পারছে শ্যানন। মনে মনে হাসছে সে। তার জানা আছে, মানুষকে নানানভাবে নির্যাতন করা যায়। আলকারাযকে দৈহিকভাবে ব্যথা দিলে সে যতটা যন্ত্রণা ভোগ করবে, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাবে চোখের সামনে প্রিয় স্ত্রীকে ধর্ষিত হতে দেখলে। যুবক বারবার ভাববে, সে একজন ব্যর্থ মানুষ, তাই বাঁচাতে পারছে না ইসাবেলাকে। আলকারায মানসিক কষ্ট ভোগ করুক সেটাই চাইছে শ্যানন। মনে মনে জানে, মেয়েটাকে খতম করার পর বাঁচতে দেবে না আলকারাযকেও। তবে তার আগে অপরাধী কপোতীকে নিয়ে একটু ফূর্তি না করে নিলে নিজের কাছেই দোষী হয়ে যাবে সে।

গাছের সামনে থেমে আলকারাযের ভুরুতে আলতো করে আঙুল বোলাল শ্যানন। বুঝিয়ে দিচ্ছে, বাচ্চা ছেলের সমান ক্ষমতাও এখন নেই মেক্সিকানের।

‘আলকারায, তুমি বাছা বরং মাথা ঠাণ্ডা করো,’ নরম সুরে বলল শ্যানন, ‘আমরা আবার তোমার বউয়ের সঙ্গে মৌজ করতে গিয়ে বেশিক্ষণ সময় নেব না।’

রাগ-ক্ষোভে ইংরেজ খুনির মুখে থুতু ছিটাল আলকারায। চাইছে যেন দ্রুত মেরে ফেলা হয় তাকে। সেক্ষেত্রে ইসাবেলার করুণ পরিণতি দেখতে হবে না। তার মন বলছে, একবার সুযোগ পেলে খুন করত জানোয়ারটাকে। কিন্তু মুখে থুতু মেরে অপমান করা ছাড়া আর কিছুই তার করার নেই।

‘এই কাজ আবারও করলে তোর বউয়ের সামনের গর্ত আর পেছনের গর্তে এমনভাবে পেনিস চালাব, ওখানে আস্ত একটা পুকুর তৈরি হবে,’ হাতের তালু দিয়ে মুখ মুছল শ্যানন। আগের চেয়ে নরম সুরে বলল, ‘আমি চাই তুমি আমাদের বন্ধু হও। তোমাকে খুন করতে চাই না। হাঁটুর ব্যথা কি এখন খুব বেশি?’ আলকারাযের ভাঙা হাঁটুর বাটির ওপরে প্রচণ্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিল সে।

ভীষণ ব্যথায় বিকট আর্তনাদ করল মেক্সিকান ডাকাত।

স্বামী কতটা ব্যথার ভেতরে আছে, সেটা বুঝে কেঁদে ফেলল ইসাবেলা। তানাকাকে ঠেলে ধড়মড় করে উঠে বসল। কিন্তু ছোট এক গাছ ঘুরিয়ে এনে ওর হাঁটুতে শেকল জড়িয়ে তালা মেরে দিয়েছে তানাকা। ইসাবেলার পাশেই আছে সে, চোখে তীব্র যৌন-লালসা। কারাগারে যাওয়ার পর পুরো চার বছর কোন মেয়েকে ভোগ করতে পারেনি সে।

আলকারাযের গালে আলতো করে টোকা দিল শ্যানন। বাতাসে শুঁকল কী যেন। ‘গন্ধটা কি পাচ্ছ, আলকারায?’ আরও জোরে নাক টানল সে। ‘এটা তো দেখি ভালবাসার গন্ধ। বাতাসে তুমি প্রেমের গন্ধ পাচ্ছ না? তুমি আসলে খুবই সৌভাগ্যবান একজন মানুষ। দারুণ সুন্দরী এক বউ পেয়ে গেছ। আর আমরা এখন ওকে মজা দেয়ার জন্যে খুব পরিশ্রম করব!’

ক্ষুধার্ত শেয়ালের চোখে ইসাবেলাকে দেখল সে।

তার দৃষ্টি অনুসরণ করল আলকারায। এরই ভেতরে ইসাবেলাকে শুইয়ে দিয়ে ওর ব্লাউয ছিঁড়ে নিয়েছে তানাকা। জোর করে শুয়ে পড়ল মেয়েটার ওপরে।

‘হায়, আমার বেলা!’ হাহাকার করল আলকারায। ভুলে গেছে ভাঙা হাড়ের ব্যথা।

গিরিখাদের দিকে এগিয়ে নরম সুরে বলল শ্যানন, ‘তোমার এত তাড়া কিসের, তানাকা? আরে, বাবা, একটু ধৈর্য ধরো। আমাকে আগে দাও মেয়েটার সঙ্গে ফূর্তি করতে!’

কড়া চোখে তাকে দেখল তানাকা, তারপর কী যেন ভেবে নেমে পড়ল ইসাবেলার বুকের ওপর থেকে।

‘অনুমতি ছাড়া কোন মেয়েকে জোর করে ভোগ করতে নেই,’ মাথা নাড়ল শ্যানন। ইসাবেলার চোখে চেয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘আমি কি ঠিক বলেছি, কী বলো, ডার্লিং?’

ইসাবেলার পায়ের কাছে থেমেছে সে। হাত বাড়াল মেঘের মত কালো চুল স্পর্শ করতে। আর তখনই তার হাঁটুর নিচের হাড়ে কষে লাথি দিল ইসাবেলা।

মারাত্মক ব্যথা পেয়েও কিছু বলল না শ্যানন। যৌন- সঙ্গমের আগে মারকুটে মেয়েদের, বাড়াবাড়ি চুপচাপ সহ্য করে সে। ‘তোমার তেজ দেখি অন্যসব মেয়ের চেয়ে বেশি।’ তানাকার দিকে চেয়ে হাসল শ্যানন। ইসাবেলার পাশে থেমে চিমটি কাটল ওর স্তনবৃন্তে। ‘দেখি তো কতটা মজা লাগে তোমার!’

জবাবে গায়ের জোরে তার গালে চড় দিল ইসাবেলা। কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে হতভম্ব হয়ে গেল শ্যানন। স্বামীর মত শরীরে অত জোর নেই ইসাবেলার, কিন্তু কৈশোর ও তারুণ্যে বিপদে পড়ে শিখে নিয়েছে কীভাবে রক্ষা করতে হবে নিজের সম্মান। ভাবছে, মরেই যদি যাই, তো তার আগে লড়াই করাই তো ভাল!

রাগে উন্মাদ হয়ে গেছে শ্যানন। তার কাছে যৌনতা মানে হিংস্রতা, যেখানে থাকবে না কোমল কোন অনুভূতি। গায়ের জোরে ধর্ষণের পর শেষ করে দেবে মেয়েটাকে, যাতে তার মাধ্যমে কোন বিপদ তৈরি না হয়। চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টানে ইসাবেলাকে দাঁড় করিয়ে নিল শ্যানন। পরক্ষণে গায়ের জোরে ঘুষি মারল মেয়েটার চোয়ালে। ধপ্ করে মাটিতে পড়ে গেল ইসাবেলা। ওর মাথার পাশে একের পর এক লাথি মারতে লাগল শ্যানন।

কর্কশ গলায় চিৎকার জুড়েছে আলকারায। বারবার ঝটকা দিয়ে শেকল থেকে ছুটিয়ে নিতে চাইছে নিজের দুই হাত। বুঝে গেছে, থামাতে না পারলে চোখের সামনে ওর স্ত্রীকে খুন করবে উন্মাদ লোকটা।

ইসাবেলার নাক ভেসে যাচ্ছে রক্তে, চোখে ঘোলাটে দৃষ্টি। তবুও বুঝে গেল, খুনিটার হাতে এখন ছোরা। ইসাবেলার গালে প্রচণ্ড চড় দিল শ্যানন। তারপর ছোরা দিয়ে ফড়ফড় করে ছিঁড়ে দিল ব্রেসিয়ার। মানসচক্ষে ভেসে উঠেছে রুয়াণ্ডার শান্তিরক্ষা মিশনের দৃশ্য। মিলিটারি ছাড়া আর কোথাও এত হালকাভাবে নেয়া হয় না সাধারণ মানুষের ওপরে নির্যাতন ও খুনের বিষয়। রুয়াণ্ডায় সেবার এক গ্রামে বিদ্রোহীরা হামলা করেছে শুনে নিজের সৈন্যদের নিয়ে হাজির হয়েছিল শ্যানন। কিন্তু গ্রামে ছিল সবমিলিয়ে নিরীহ তিনজন মানুষ। তাদের দু’জন আবার খুব ভিতু বুড়ো। তাদেরকে অপরাধ স্বীকার করতে বললে পরস্পরের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে ছিল। তখন বাধ্য হয়ে তাদেরকে জবাই করেছিল শ্যানন। দলের কয়েকজনকে নিয়ে নাবালক মেয়েটাকে ধর্ষণ করে গলা টিপে মেরে ফেলেছিল।

আর ওটাই ছিল চরম ভুল। উচিত ছিল দলের সবাইকে খুন করে ফেলা। সেক্ষেত্রে ধরা পড়ত না শ্যাননের কোন অপরাধ।

ওই সামান্য দোষে আমরণ জেল হয়ে গিয়েছিল তার। নিজের দেশের জন্যে অন্তর ঢেলে কাজ করেও শিকার হতে হয়েছিল চরম অন্যায়ের!

.

বিশাল তাঁবুর ভেতরে ঢুকে স্পিকারে পুরুষ-নারীর সম্মিলিত আর্তচিৎকার শুনতে পেল রিটা। এ-ছাড়া আর কোন শব্দ নেই তাঁবুর ভেতরে। মস্ত স্ক্রিনের দিকে বিস্ময় ও ঘৃণা নিয়ে চেয়ে আছে স্টিলের সহকর্মীরা।

রাশান লোকটা বোমা ফেটে মরার পর যখন বারবার সে- দৃশ্য দেখানো হচ্ছিল, নিজের ল্যাপটপ অফ করে দিয়েছে রিটা। এতক্ষণ কম্পাউণ্ডের এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়িয়েছে। ভেবে বের করতে চেয়েছে, আসলে কেমন ধরনের শো তৈরি করছে ব্র্যাড স্টিল! আর নিজেই বা কেন এসবে জড়াতে গেল ও! শেষমেশ স্থির করেছে, স্টিলের সামনে তুলে ধরবে ওর নিজের আপত্তি। কিন্তু এখন তাঁবুর সবার থমথমে নীরবতা ও নারী-পুরুষের আর্তচিৎকার যেন বলে দিচ্ছে, আপাতত চুপ করে থাকাই ওর জন্যে ভাল।

স্ক্রিনে বারবার দেখা যাচ্ছে আলকারাযের বিকৃত মুখ। ব্যাকগ্রাউণ্ডে আরও তিনজন। অন্য এক ক্যামেরায় দেখা গেল, একটা গাছের সঙ্গে ধর্ষিতা, বিপর্যস্ত ইসাবেলার পা বেঁধে রেখেছে তানাকা। এ-সুযোগে মেয়েটার মুখে-মাথায় ঘুষি মারছে শ্যানন। একই সময়ে ছোরা দিয়ে চিরে দিচ্ছে বেচারির বুক ও পেট। ভয়ঙ্কর ব্যথা সহ্য করতে না পেরে হাউমাউ করে কাঁদছে রক্তাক্ত ইসাবেলা। গলা ফাটিয়ে প্রতিবাদ করছে ওর স্বামী।

অন্যদের মতই চরম অবিশ্বাস নিয়ে দৃশ্যটা দেখছে রিটা। এদিকে সিলভির পাশে চলে গেছে ব্র্যাড স্টিল। বুঝতে দেরি হয়নি তার, এসব দৃশ্য দেখতে মোটেই ভাল লাগছে না তার বন্ধুর।

‘কতগুলো অ্যাঙ্গেলে দেখাচ্ছ?’ নিচু গলায় জানতে চাইল স্টিল।

স্ক্রিন থেকে মুখ ফিরিয়ে ফিসফিস করল সিলভি, ‘বাড়তি আর কোন ক্যামেরা নেই।’

‘দৃশ্য কিন্তু খুব পরিষ্কার নয়,’ আপত্তির সুরে বলল ব্র্যাড।

হতবাক হয়ে তার দিকে তাকাল সিলভারম্যান।

সিওয়ার্সের দিকে তাকাল স্টিল। ভয়ঙ্কর শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য দেখে স্ক্রিন থেকে চোখ সরাতে পারছে না যুবক।

‘সিওয়ার্স, আমাদের লাইভ ইউনিট কোথায়?’

স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে নিজের ডিসপ্লেতে ম্যাপ দেখল সিওয়ার্স। ওখানে আছে কিছু + চিহ্ন। শ্যানন, আলকারায, তানাকা ও ইসাবেলার যেসব দৃশ্য তুলছে গুচ্ছ ক্যামেরা, তার একটু দূরে নীল রঙের ক্যামেরার আইকন। দপদপ করছে ওটা।

‘বেশি দূরে নেই।’

স্ক্রিনের দৃশ্য দেখছে সিকিউরিটি চিফ রিভ সিম্পসন। তার সামনে গিয়ে থামল স্টিল। ‘ওখানে লাইভ ইউনিট পাঠাও!’

গিরিখাদের ভেতরে রক্তাক্ত মেয়েটাকে ধর্ষণের পর খুন করবে ভেবেছে শ্যানন। সে জানে, ক্যামেরার লেন্স এখন তার দিকে তাক করা। মনে মনে বলছে সে-’দ্যাখ, শালারা, কীভাবে ফূর্তি করার পর মেয়েদের খুন করতে হয়!’

জঙ্গলে নড়ে উঠল কিছু। শ্যানন, তানাকা, আলকারায ও ইসাবেলা জানল না, এগিয়ে এসেছে আস্ত এক ঝোপ। ওটার ভেতরে আছে ক্যামোফ্লেজ পরা ক্যামেরাম্যান। মুখে মুখোশ, হাতে গ্লাভ্স্ আর পুরো শরীরে একগাদা নকল পাতা। শক্ত হাতে ধরেছে দামি ক্যামেরা। সে না নড়লে কারও সাধ্য নেই যে বুঝবে, ওখানে কেউ বসে আছে।

অস্ট্রেলিয়ান ক্যামেরাম্যানের নাম জোহানসন। ওর সামনেই বেলারুশের জেলে বিক্রি করা হয়েছিল রাশান অপরাধী ম্যানইয়া লোপাতিনকে। আট ঘণ্টারও বেশি জঙ্গলে ঘাপটি মেরে বসে আছে সে। একটা ক্লিপ ছবিও তুলতে হয়নি। সেজন্যে কারও প্রতি কোন অভিযোগও নেই তার। হেডসেটের মাধ্যমে বরাবর জেনে গেছে, এরই ভেতরে খুন হয়েছে তিনজন অপরাধী। জোহানসন বুঝে গেছে, এবার তার চোখের সামনে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হবে আরও দু’জনকে। আর সেই দৃশ্য ক্যামেরায় তুলতে হবে ওকে।

‘ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগেই এগোও,’ সিম্পসনের কণ্ঠস্বর হেডসেটে শুনল জোহানসন। ‘নইলে দেরি হয়ে যাবে।

ধীরে ধীরে এগোল জোহানসন। পেছনে এল আরেকটা ঝোপ। সে একজন গার্ড, হাতে বিআর ১৮ অ্যাসল্ট রাইফেল। জোহানসন বিপদে পড়লে গুলি চালাবে অপরাধীদের ওপরে।

একটু পর শ্যাননের হামলা থেমে যেতে লাশের মত পড়ে থাকল ইসাবেলা। এবার ওকে ধর্ষণ করবে তানাকা। অপরাধের ঘটনা যেখানে ঘটছে, তার তিরিশ গজের ভেতরে পৌঁছে জঙ্গলের কিনারায় থামল জোহানসন। দক্ষ হাতে যুম করল লেন্স।

‘লাইভ ইউনিট এখন পযিশনে,’ টেকনিকাল ডিরেক্টরকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল স্টিল। ‘এবার ফিল্ম স্ক্রিনে দাও।’

অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেইন স্ক্রিনে লাইভ ক্যামেরার ফিড দিল সিলভারম্যান। জোহানসনের তোলা ছায়াছবিতে দেখা যাচ্ছে বীভৎস দৃশ্য। তাঁবুর ভেতরে স্টিল ছাড়া আঁৎকে উঠেছে অন্যরা। মস্ত স্ক্রিনে ক্লোয-আপে দেখা যাচ্ছে, শ্যানন ছুরিকাঘাত করার পরেও ধর্ষিতা ইসাবেলাকে ভোগ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে তানাকা।

এখন আর হাসি নেই স্টিলের মুখে। চোখে ভীতির ছাপ। নিচু গলায় বলল, ‘সিওয়ার্স… দর্শক কত হলো?’

স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়ে দ্রুত কিবোর্ডে আঙুল চালাল সিওয়ার্স। এখন পর্যন্ত যা দেখেছে, তাতে ওর মনে হচ্ছে এনসি-১৭ হরর ফিল্ম এসবের কাছে কিছুই নয়। স্টিলের বদলে অন্য কেউ কখনও দেখাতে পারবে না এরচেয়ে বাস্তব সব মৃত্যু-দৃশ্য। ‘দর্শক দ্রুত বাড়ছে। এখন আছে পনেরো মিলিয়ন।’

‘এসব বন্ধ করো,’ ভারী কণ্ঠে বলল রিটা।

ওর দিকে ধীরে ধীরে ঘুরে হাসি-হাসি চেহারায় তাকাল স্টিল। প্রেমিকা ফিরে এসে প্রতিবাদ করবে সেটা ভাবেনি। ‘কী বললে, রিটা? ওই মেয়ে তো প্রমাণিত একজন খুনি। তার আগে ছিল পতিতা।’

‘কিন্তু মানুষ তো!’

‘এমন একজন, যে কি না স্বামীর সঙ্গে নানান শহরে গিয়ে নিরীহ বহু মানুষকে গুলি করে মেরেছিল,’ হালকাভাবে কাঁধ ঝাঁকাল স্টিল। ‘গুয়াতেমালায় ওদেরকে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিত। তোমার বোধহয় মনে নেই, আজই সেই দেশে ওদের ছিল শেষ দিন।’

ফ্যাকাসে হয়ে গেছে রিটা। চাপা স্বরে বলে উঠল, ‘এরা যাই করুক, ভুলে যেয়ো না যে তুমি যেটা করছ, সেটা চরম অন্যায়।’ এত জোরে কথাগুলো বলেছে, তাঁবুর ভেতরে এমন কেউ নেই যে কি না শুনতে পায়নি।

মাত্র একসেকেণ্ডে প্রচণ্ড রাগে রক্তবর্ণ হলো স্টিলের চেহারা। ভেবে পাচ্ছে না, কেন হঠাৎ দল ত্যাগ করেছে রিটা। তার ওপর কাজটা করেছে তার কর্মচারীদের সামনে। অস্বীকার করেছে তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব। নিশ্চয়ই অন্যরা এখন ভাবছে, যে-লোক নিজের প্রেমিকাকে সামলে রাখতে পারে না, তার আবার কিসের সম্মান!

‘রিটা, আমি চেয়েছি নাটকীয়তা থাকবে এই শো-তে,’ অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা গলায় বলল স্টিল। আঙুল তাক করল স্ক্রিনের দিকে। ‘তোমার দেখতে ইচ্ছে না হলে আমাদের তাঁবুতে গিয়ে বিশ্রাম নাও। আরও কিছু বলার থাকলে সেটা পরে জানাবে। ঠিক আছে?’

অনুরোধের সুরে কথাটা বলেনি স্টিল। থমথম করছে তার চেহারা। জবাবে স্টিলের চোখে চেয়ে রইল রিটা। মনে পড়েছে, এই লোক জীবনে আসার আগে চমৎকার ছিল ওর সময়টা। কারও নির্দেশ মেনে চলতে হতো না। আর এখনও কোন প্রয়োজন নেই কারও কথা মেনে নেয়ার। আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল রিটা, ‘তুমি কী করে এমন নৃশংস শো দুনিয়ার মানুষকে দেখাচ্ছ, সেটা আমার মাথায় ঢুকছে না।’

চট করে ঘুরে কর্মচারীদের দেখল স্টিল। অন্যদিকে চেয়ে আছে তারা, যেন কিছুই শোনেনি। স্টিল বুঝে গেল, আপাতত যেভাবে হোক সামলে নিতে হবে রিটাকে। তাই রাগ ও বিরক্তি চেপে নরম সুরে বলল, ‘বাস্তবে যা হওয়ার কথা, ঠিক সেটাই হচ্ছে, রিটা। আমরা শুধু ক্যামেরায় সেসব ছায়াছবি তুলছি দর্শকের জন্যে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে দৃশ্যগুলো নৃশংস। তবে ভেবে দেখেছ, আমরা তো আর নিজেরা এসব করছি না।’

‘তুমি জেনে-বুঝে এদেরকে দিয়ে অন্যায় করাচ্ছ। আর সেজন্যে কোনভাবেই দায় এড়াতে পারবে না।’

‘হ্যাঁ, এটা বলতে পারো যে, দ্বীপে দশজন খুনিকে ছেড়ে দিয়েছি আমি,’ ভদ্রলোকের মুখোশ খুলে কড়া গলায় বলল স্টিল। ‘আর তাতে যা ঘটছে, সেটার দায় আসলে ওই মানুষগুলোর। দুনিয়া জুড়ে সবাই সেটাই দেখছে। বাস্তবতা আসলে এমনই হয়। আমার কথা কি তুমি বুঝতে পেরেছ, রিটা? দয়া করে এরপর থেকে এই বিষয়ে আর কোন তর্ক আমার সঙ্গে করবে না।’

নার্ভাস চোখে স্টিল ও রিটাকে দেখছে ডার্টি গেমের কর্মচারীরা। বাবা-মা ঝগড়া করলে এভাবেই তাদের দিকে অসহায় চোখে চেয়ে থাকে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা। স্টিল বুঝে গেছে, এখনই কৰ্তৃত্ব প্রমাণ করার শেষ সময়, নইলে যে- কোন সময়ে বিদ্রোহ করবে তারই দলের লোকেরা।

‘আমরা বাস্তব শো নিয়ে এখানে ব্যস্ত,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল স্টিল। ‘ওই মেয়েলোককে মরতেই হতো। আমি তো আর তার রায় লিখিনি। সেটা করেছে গুয়াতেমালার জুরিরা। এই দ্বীপে এসে বাঁচার ভাল একটা সুযোগ পেয়েছিল। তবে সেটা কাজে লাগাতে পারেনি। আর আমি তাকে বাঁচাবার জন্যে কোন চেষ্টা করিনি, কারণ সেটা করলে শো-র বাস্তবতার দিকটা বিনষ্ট হতো। গুয়াতেমালায় মেয়েটার মৃত্যু আমি ঠেকাতে পারতাম না। তা হলে এই দ্বীপেই বা কেন তাকে আমি বাঁচাতে যাব? ইসাবেলা আলকারায প্রমাণিত অপরাধী। তার যা প্রাপ্য সেটাই সে পাচ্ছে। অন্যরা এরপর লড়াই করে মারা গেলে আমি কে তাদেরকে বাঁচিয়ে দেয়ার!’

শুধু রিটা নয়, গোটা তাঁবুর সবার জন্যে কথাগুলো বলেছে স্টিল। তার কথায় মাথা দোলাল ক’জন। বিশেষ করে এমিলি ও সিওয়ার্স।

বন্ধুর দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারছে না সিলভারম্যান। রিটার মতই বিব্রত বোধ করছে বলে স্ক্রিনের দিকেও চেয়ে নেই সে।

‘তোমার আরও কত কোটি ডলার চাই, স্টিল?’ সরাসরি প্রেমিকের চোখে চেয়ে বলল রিটা।

মনের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে রিটার গালে চড় দেয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখল স্টিল। নিস্পৃহ করে রেখেছে চোখ- মুখ। কয়েক পা গিয়ে রিটার সামনে থামল সে। প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘এসব টাকা রোজগারের জন্যে করছি না, রিটা। কোটি মানুষ এখন দেখছে আমার শো। তারা জানে ওটা তৈরি করেছে কে। আর এমন অনুষ্ঠান তৈরি করার কাজে আমার কোন তুলনা নেই। বলতে পারো আমিই সেরা।’

অন্তর থেকে কথাগুলো বলেছে স্টিল। তার চোখে চেয়ে বুঝে গেল রিটা, একফোঁটা মিথ্যা বলছে না ওর প্রেমিক। বুকের ভেতরে ভীষণ ভয় ঢুকে গেল রিটার। আর কোন কথা না বলে বিশাল তাঁবু ত্যাগ করে চলল নিজেদের তাঁবুর দিকে। বহু দিনের বিশ্বস্ত বন্ধু সিলভির দিকে ঘুরে তাকাল স্টিল। প্রতিটি অনুষ্ঠানে সে ছিল ওর ডানহাত। কিন্তু এখন চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। তার চেয়েও খারাপ কথা, কন্সোল ছেড়ে তাঁবুর দরজার দিকে চলেছে সে।

‘অ্যাই, সিলভি, তুমি আবার কোথায় চললে?’

‘আমার তাজা বাতাস লাগবে,’ না থেমে দরজার দিকে এগোল সিলভারম্যান।

এখন আপত্তি না জানালে সিলভির মত অন্যরাও হয়তো বিদ্রোহ করবে, কাজেই কড়া গলায় বলল স্টিল, ‘কী, এত সহজেই ঘাবড়ে গেলে? শেষমেশ বন্ধুর কাছ থেকেও পালিয়ে যাচ্ছ? তা হলে কি হঠাৎ তোমার মনে ফালতু কোন আবেগ কাজ করছে? তা-ও আবার একদল খুনি-ধর্ষকের জন্যে?’

ফ্যাকাসে মুখে ঘুরে স্টিলের চোখে তাকাল সিলভি। সত্যিই দংশন হচ্ছে তার বিবেকে। আর সেটা শুরু হয়েছে প্রথম লোকটা মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। তখনও নিজের কাজ করে গেছে, কারণ কোন বন্ধুকে বা কোন শো ফেলে কখনও চলে যায়নি সে। কিন্তু এখন তিক্ততায় ভরে গেছে তার মন।

‘না, স্টিল, আসলে… আমার মনে হয় না… আমরা এসব ঠিক কাজ করছি,’ মস্ত স্ক্রিন দেখাল সিলভারম্যান। এখন আর তীব্র ব্যথায় আর্তচিৎকার করছে না ইসাবেলা। লাশটাকে ছোরার আঘাতে বিকৃত করছে শ্যানন। ‘এসব মৃত্যু দেখা সহজ কোন কাজ নয়। তবে এখনও তোমার সঙ্গেই আছি। একবার ঘুরে আসি বাইরে থেকে। এখানে বমি করতে চাইছি না।’

‘বেশ, ঘুরে এসো,’ বিরক্তির সুরে বলল স্টিল। তার মনে হচ্ছে, কখন যেন হারিয়ে বসেছে পুরনো বন্ধুকে। এই শো- তে সে নিজে ছাড়া এমন কেউ নেই, যে দায়িত্ব পালন না করলে ক্ষতি হবে না। সিলভির বদলে কাজ চালিয়ে নিতে পারবে সিওয়ার্স ও এমিলি, কিন্তু সেক্ষেত্রে সেরা মানের হবে না শো।

‘সিওয়ার্স?’ নরম সুরে বলল স্টিল, ‘তুমি আমার সঙ্গে আছ তো?’

‘নিশ্চয়ই, বস্!’ হাসল যুবক। ‘কাজটা আমি পছন্দ করি।’

‘এমিলি?’

‘এই কাজ আমি সত্যিই ভালবাসি। আমরা তো আসলে খুব ভাল একটা টিম।’

আন্তরিক হাসল স্টিল। ‘ভবিষ্যতে দেখবে এরচেয়ে ঢের বেশি রোজগার হবে তোমাদের।’

তাঁবুর দরজার দিকে তাকাল স্টিল। এরই ভেতরে বিবেকের ছোরা চিরে দিচ্ছে সিলভারম্যানের অন্তর। সুতরাং আগে বা পরে, একসময় বেঁকে বসবে সে।

স্ক্রিনের দিকে তাকাল স্টিল। ইসাবেলা আলকারাযের ছবির ওপরে এখন লাল একটা ক্রস চিহ্ন।

এরই মধ্যে থিতিয়ে এসেছে তাঁবুর ভেতরের উত্তেজনা। মন দিয়ে স্ক্রিন দেখছে সবাই।

ইসাবেলার ওপর থেকে উঠে দাঁড়াল শ্যানন, সারাশরীরে মেখে আছে নব্য লাশের তাজা রক্ত। কিছুটা দূরে হতাশা নিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে তানাকা। মেয়েটা মারা যাওয়ায় তাকে ভোগ করতে না পেরে তিক্ত হয়ে গেছে ওর মন। তানাকার সামনে গিয়ে হাতের ইশারা করল শ্যানন। ‘চলো, আমাদের কাজ এখানে প্রায় শেষ।’

বিড়বিড় করে জাপানি গালি দিল তানাকা, তারপর গিরিখাদের দিকে চলল তারা। এর মাত্র ছয় সেকেণ্ড পর বিস্ফোরিত হলো ইসাবেলার গোড়ালির বোমা। বিকট শব্দের সঙ্গে ভুস্ করে মিলিয়ে গেল লাশ।

কনুই ধরে তানাকাকে থামিয়ে ঘুরে তাকাল শ্যানন।

এবার পালা এসেছে আলেক্যান্দ্রো আলকারাযের।

ঘন ধোঁয়া সরে যাবে সেজন্যে অপেক্ষা করছে শ্যানন ও তানাকা। মিনিটখানেক পর দেখতে পেল, কীভাবে যেন শেকলসহ উধাও হয়ে গেছে আলকারায।

যুবক নেই জেনেও গাছটার দিকে দু’পা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল শ্যানন। তার জানা আছে, হাঁটুর বাটি ফেটে যাওয়ায় লড়তে পারবে না আলকারায। হাসি-হাসি মুখে তানাকাকে বলল সে, ‘ওকে নিয়ে একদম ভাববে না। ব্যাটা পালিয়ে যাবে কোথায়!’

সকল অধ্যায়

১. ডার্টি গেম – ১
২. ডার্টি গেম – ২
৩. ডার্টি গেম – ৩
৪. ডার্টি গেম – ৪
৫. ডার্টি গেম – ৫
৬. ডার্টি গেম – ৬
৭. ডার্টি গেম – ৭
৮. ডার্টি গেম – ৮
৯. ডার্টি গেম – ৯
১০. ডার্টি গেম – ১০
১১. ডার্টি গেম – ১১
১২. ডার্টি গেম – ১২
১৩. ডার্টি গেম – ১৩
১৪. ডার্টি গেম – ১৪
১৫. ডার্টি গেম – ১৫
১৬. ডার্টি গেম – ১৬
১৭. ডার্টি গেম – ১৭
১৮. ডার্টি গেম – ১৮
১৯. ডার্টি গেম – ১৯
২০. ডার্টি গেম – ২০
২১. ডার্টি গেম – ২১
২২. ডার্টি গেম – ২২
২৩. ডার্টি গেম – ২৩
২৪. ডার্টি গেম – ২৪
২৫. ডার্টি গেম – ২৫
২৬. ডার্টি গেম – ২৬
২৭. ডার্টি গেম – ২৭
২৮. ডার্টি গেম – ২৮
২৯. ডার্টি গেম – ২৯
৩০. ডার্টি গেম – ৩০
৩১. ডার্টি গেম – ৩১
৩২. ডার্টি গেম – ৩২
৩৩. ডার্টি গেম – ৩৩
৩৪. ডার্টি গেম – ৩৪
৩৫. ডার্টি গেম – ৩৫
৩৬. ডার্টি গেম – ৩৬
৩৭. ডার্টি গেম – ৩৭

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন