কাজী আনোয়ার হোসেন
আগে কখনও অনিদ্রায় ভুগতে হয়নি রিটা জোসেফের। গত বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে ওর শরীর ও মগজ বারবার করে বলছে, অনেক তো হলো, এবার একটু বিশ্রাম নাও। বরাবরের মত বিছানায় শুয়ে তিন মিনিটে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু তখনই এল একের পর এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। ক’বার ঘুম ভাঙার পর এখন ভয় লাগছে ওর ঘুমাতে।
দুঃস্বপ্নে দেখছে, দ্বীপে নিয়ে আসা অপরাধীদের একজন ও নিজে। ওকে ধর্ষণ করতে চাইছে নাৎসি লোকটা। বাধা দেয়ার ফাঁকে তার গোড়ালির লাল ট্যাব খুলতে চাইছে রিটা। কিন্তু কোনভাবেই ধরা যাচ্ছে না ওটা। লাথি দিচ্ছে স্লাইডারের তলপেটে। ঘুষি মারছে মুখে ও মাথায়। খামচি মেরে রক্ত বের করে দিচ্ছে লোকটার, কিন্তু ভূতের মত বায়বীয় দেহে কোন আঘাত লাগছে না তার। চারপাশে ভিড় করেছে অনেকে। হাসতে হাসতে তারা দেখছে রিটা ও স্লাইডারের অসম লড়াই।
লোকগুলো আমেরিকান ও জাপানি মিলিটারির পোশাক পরা। কারও হাত নেই, কারও পা। মৃত অপরাধীদের দেখা যাচ্ছে তাদের ভেতরে। নিষ্ঠুরভাবে খলখল করে হাসছে ইতালিয়ান খুনি বিয়াঞ্চি, ধর্ষক লোপাতিন ও পতিতা ইসাবেলা। সবার চোখে-মুখে ওর প্রতি তীব্র ঘৃণা। চোখের সামনে ধীরে ধীরে বদলে গিয়ে স্নাইডার হলো ব্র্যাড স্টিল। আর তখনই শীতল ঘামে ভিজে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসতে বাধ্য হচ্ছে রিটা। ভীষণ ভয়ে ধকধক করছে ওর বুক। মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে চরম বাস্তবতা।
এরই ভেতরে বুঝে গেছে, কোনভাবেই আর ঘুমাতে পারবে না। মন অন্যদিকে সরাতে গিয়ে ভাবল, এখন আসলে কী করা উচিত ওর?
নিশ্চয় অনেকের কাছেই আপত্তিকর বলে মনে হচ্ছে ডার্টি গেম শো। যদিও নিশ্চিতভাবে জানার উপায় নেই যে তারা কোন প্রতিবাদ করবে কি না। সবার মধ্যে সিলভারম্যানকে বেশি বিব্রত হতে দেখেছে রিটা। তার সঙ্গে জোট বাঁধলে হয়তো স্টিলকে বোঝানো যাবে, কতবড় অনৈতিক কাজ করছে সে। ক্যাম্পের সবাই তাকে ভয় পেলেও রিটা ও সিলভি নেতৃত্ব দিলে হয়তো বন্ধ করা যাবে স্টিলের জঘন্য এই শো।
আরামদায়ক বিছানা ছেড়ে নিজেদের ব্যক্তিগত তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল রিটা, সোজা গিয়ে ঢুকল বিশাল তাঁবুর ভেতরে। ওর দৈহিক সৌন্দর্যের কারণে প্রভাব খাটাতে পারবে স্টিলের ওপরে, তবে সেক্ষেত্রে আগে মন থেকে দূর করতে হবে সব ভয়। তারপর দলে টানতে হবে অন্যদেরকে।
কী একটা বিষয়ে উত্তপ্ত তর্কে জড়িয়ে গেছে স্টিল ও সিলভি। একটু দূরে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনতে লাগল রিটা।
‘তুমি তো জানো, আবারও উধাও হয়ে গেছে মাসুদ রানা। আমার কোন স্ক্রিনে সে নেই। গ্রিডেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। একবার লেন্সে পেয়েও আবার তাকে হারিয়ে ফেলেছি। আর সেটা হয়েছে, কারণ সরাসরি আমাদের দিকে আসছে সে। এদিকে যথেষ্ট ক্যামেরা রাখা হয়নি। আর সেজন্যে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি। যে-কোন সময়ে আমাদের ওপরে হামলা করবে ক্রিমিনালেরা।’
‘অত বেশি ভেবো না,’ নিশ্চিন্ত চেহারায় বলল স্টিল। ‘ওদের কেউ এদিকে আসবে না।’ আরও জরুরি একটা কারণে চিন্তায় পড়ে গেছে সে। সত্যি যদি দ্বীপের ক্যামেরাহীন কোন অংশে শ্যানন ও তানাকার হাতে খুন হয়ে যায় মাসুদ রানা, তা হলে তার মৃত্যু-দৃশ্য কোন লেন্সে ধরা পড়বে না।
‘খুনি আর ধর্ষকেরা দ্বীপের অন্যদিকে থাকলে তখন মনে একটু স্বস্তি পাব, ব্র্যাড, বলল সিলভারম্যান। ‘কথাটা বুঝেছ?’
পকেট থেকে অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট নিয়ে খোসা খুলে মুখে ফেলল সে। ওয়াকিটকি তুলে দলের লোকদের নির্দেশ দিল, যাতে বাইরের কম্পাউণ্ডে বসানো হয় আরও তিনটে ক্যামেরা।
মনে মনে হাসল স্টিল। তা-ও ভাল, মনের অনুভূতি আবারও প্রকাশ করতে শুরু করেছে সিলভারম্যান। এদিকে নিজে দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে গেছে ব্র্যাড। যতই চেষ্টা করুক, কোন অপরাধী ঢুকতে পারবে না এই কম্পাউণ্ডে। চারপাশে পাহারা দিচ্ছে সশস্ত্র গার্ডেরা। তা ছাড়া, এখানে এসে লাভ কী কারও?
না, উপযুক্ত কারণ ছাড়াই ভয় পেয়েছে সিলভারম্যান। একটু দূরে চেয়ারে বসে আছে রিভ সিম্পসন। মাসুদ রানা এদিকে আসছে শুনে কালচে হয়ে গেছে তার মুখ। বাঙালি শয়তানটার কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে বেগুনি বর্ণ ধারণ করেছে তার থুতনি। আগে কখনও সিস্পসনকে এভাবে বোকা বানাতে পারেনি কেউ। যদি সত্যিই লোকটা এদিকে আসে, স্টিলের ভাল লাগুক বা না লাগুক, প্রথম সুযোগে তাকে যমপুরীতে পাঠিয়ে দেবে সে।
‘আমি ওকে খুঁজে নেব,’ তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল সিম্পসন।
পেছন থেকে তাকে দেখল সিলভি। সিকিউরিটি চিফ চলে যেতেই তার চোখ পড়ল রিটার চোখে। পরস্পরের দিকে চেয়ে দু’জনই বুঝে গেল, একই দলে আছে ওরা। আর ভাবছে, অপরাধীদের ওপরে চরম অন্যায় করছে ডার্টি গেম শো-র পরিচালক স্টিল।
.
তাঁবুর তৈরি গ্রামের ওপরে দূর থেকে চোখ রেখেছে রানা। কম্পাউণ্ড ঘিরে নেয়া হয়েছে দশ ফুটি রেযর ওয়াএয়ার দিয়ে। ভেতরেও বৃত্তাকার আরেকটা তারের বেড়া। ওটা না টপকে গ্রামে পা রাখতে পারবে না কেউ। অভিজ্ঞ যে-কেউ বলবে, নিরাপত্তার জন্যে সীমান্তের কাছে মিলিটারি থেকে তৈরি করা হয়েছে এই গ্রাম। রানার মনে পড়ল, এমনই সব ড্রাগের কারখানা দেখেছে এল সালভেদরের জঙ্গলে। সেসব জায়গায় ঢুকতে হয়েছে খুব সতর্কতার সঙ্গে।
বৃষ্টি থেমে যেতে ভালভাবে গ্রামটা দেখতে পাচ্ছে রানা। ওয়েদার টাওয়ারের একটু দূরে একের পর এক তাঁবু। ওগুলোর ভেতরে একটা বহু গুণ বড়। হেলিকপ্টার থেকে যে বিশাল স্যাটেলাইট ডিশ দেখেছে রানা, আগের মতই কাত হয়ে আছে ওটা। কম্পাউণ্ডে কমপক্ষে বারোজন সশস্ত্র গার্ড। আড়ালে হয়তো আরও আছে। ওর বুঝতে দেরি হলো না, এই গ্রাম স্টিলের হেডকোয়ার্টার। দুনিয়া জুড়ে যে ভিডিয়ো ছড়িয়ে দিচ্ছে লোকটা, সেটা ড্রাগের চেয়েও ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। অবশ্য তার শো বন্ধ করে দেয়ার কথা ভাবছে না রানা। ওর উদ্দেশ্য আসলে বিসিআইকে জানানো যে এই দ্বীপ আসলে কোথায়।
এল সালভেদরের জঙ্গলের ড্রাগের কারখানাগুলোর মতই এখানে পাহারা দিচ্ছে অটোমেটিক অস্ত্রসহ গার্ডেরা। রানার মনে পড়ল পুরনো কিছু স্মৃতি। অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সাপ্লাইসহ এল সালভেদরে ওকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ডিআইএর চিফ। কথা দিয়েছিলেন, রানা গ্রেফতার হলে রাজনৈতিক চাপ তৈরি করবেন সে দেশের সরকারের ওপরে। তার মাধ্যমে ওকে বের করে আনবেন জেল থেকে। কিন্তু গত তিন মাসে ও বুঝে গেছে, ডাহা মিথ্যা বলেছেন তিনি। সোনসোনেট জেলখানার সুপার যদিও বলেছে, ওকে ফেরত চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ সরকার থেকে। কিন্তু সেটা গ্রাহ্য করেনি এল সালভেদর সরকার।
এখন ওর কাছে কোন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র নেই। গোপনে ঢুকতে হবে সামনের কম্পাউণ্ডে।
ওর মনে পড়ল এল সালভেদরের জঙ্গলে তারের বেড়া কেটে ঢুকেছিল প্রথম টার্গেট এরিয়ায়। পিস্তলের বাঁটের বাড়ি মেরে অজ্ঞান করেছিল এক গার্ডকে। দ্বিতীয়জন আক্রমণ করে বসলে বাধ্য হয়ে ছোরা দিয়ে ফুটো করে দিয়েছিল তার হৃৎপিণ্ড। পরের কারখানাগুলোতে ঢুকতে গিয়ে খুন করতে হয়েছে আরও বেশ কয়েকজন গার্ডকে। অবশ্য তাদের মৃত্যুর জন্যে এল সালভেদরের আদালত থেকে ওকে কোন ধরনের শাস্তি দেয়নি। প্রধানমন্ত্রীর আপন ভাগ্নে আর তার সঙ্গী ড্রাগ লর্ডদের খুনের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে ওকে।
এখন তারের বেড়া কেটে ঢোকার জন্যে কোন কাটার নেই রানার কাছে। এমন কী একটা ছোরাও নেই। তবে কপাল মন্দ না হলে ঠিকই ঢুকতে পারবে কম্পাউণ্ডে। কঠোরভাবে পাহারা দেয়া হচ্ছে মেইন গেট। ওদিক দিয়ে ঢুকতে গেলে গুলি শুরু করবে শত্রুপক্ষ। সেক্ষেত্রে শুরুতেই ভেস্তে যাবে ওর প্ল্যান। সুতরাং গোপনে ড্রাগ কারখানার মত করেই ঢুকতে হবে সামনের গ্রামে।
তারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে দূরে তালাবদ্ধ আরেকটা গেট দেখছে রানা। আকারে ওটা মেইন গেটের অর্ধেক। পাশে আনমনে বিরক্তি প্রকাশ করতে করতে দামি সিকিউরিটি ক্যামেরা বসাচ্ছে পলিনেশিয়ান এক টেকনিশিয়ান। তার সামান্য দূরে ওয়েদার টাওয়ার। ওটার ভেতরে দেখা যাচ্ছে একজন লোককে। মনে মনে বলল রানা, মাত্র দু’জন লোককে নিরস্ত্র করলে ওয়েদার টাওয়ারে উঠে মেসেজ পাঠাতে পারব।
এইমাত্র মেইন গেট খুলে জিপ নিয়ে জঙ্গুলে পথে বেরোল ক’জন সশস্ত্র গার্ড। একই সময়ে আঙিনায় এসে থামল রিভ সিম্পসন। তার সঙ্গে আছে তিনজন গার্ড। সবার হাতে বিআর ১৮ অ্যাসল্ট রাইফেল। সিকিউরিটি চিফের হাতের শেকলে বিশাল এক জার্মান শেফার্ড কুকুর। চাপা গর্জন ছাড়ছে ওটা। নিজেদের ভেতরে কী যেন আলাপ করছে চারজন। তারা দূরে আছে বলে কিছুই শুনতে পেল না রানা।. দু’ভাগে ভাগ হয়ে দু’দিকে চলল লোকগুলো। রানার মাত্র পাঁচ ফুট দূর দিয়ে গেল তাদের দু’জন, জানে না কাছেই ঝোপে বসে আছে ও। তারা চোখের আড়ালে চলে যেতেই বেড়ার পাশের ঝোপগুলোর ভেতর দিয়ে হেঁটে পেছনের ছোট গেটের কাছে গেল রানা। একইসময়ে নিজের কাজ শেষ করেছে ক্যামেরা টেকনিশিয়ান। এখনও অন করেনি যন্ত্রের এলইডি পাওয়ার লাইট। ওটা চালু করার আগেই যা করার করতে হবে, বুঝে গেল রানা।
গেটের পাশের কলামে ঠেস দেয়া মই থেকে নেমে এল দীর্ঘকায় পলিনেশিয়ান টেকনিশিয়ান। কোমর থেকে নিল চাবির ছোট একটা ছড়া। অলস ভঙ্গিতে চাবি বেছে নিয়ে খুলল গেটের তালা। হ্যাঁচকা টানে ভেতরের দিকে নিল গেট। আর তখনই ঝোপ থেকে ছিটকে বেরিয়ে চিতার বেগে লোকটার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা। ওর ডানহাতের প্রচণ্ড এক ঘুষি লাগল বিস্মিত টেকনিশিয়ানের থুতনির ওপরে। একসেকেণ্ডে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে। সামনে বেড়ে ক্যামেরার তার ছিঁড়ল রানা। গেট বুজে দিয়ে তালার ভেতরে রেখে দিল চাবি। দরকার হলে গেট খুলে হাওয়া হবে জঙ্গলে।
মাত্র বিশ ফুট দূরে গ্রামের তাঁবুর সারি। ভেতরের তারের বেড়ায় কোন কাঁটা নেই। সহজে বেড়া টপকে গেল রানা। দ্রুত গিয়ে থামল ওয়েদার টাওয়ারের পুরনো মইয়ের কাছে। একবার মনোযোগ দিয়ে দেখল এদিক-ওদিক। আকাশ কালো হলেও একটু পর ভোরের আলো ফুটলে ধরা পড়তে হবে ওকে।
ওয়েদার টাওয়ারের ওপরের ঘরে আছে অন্তত একজন।
আপাতত অন্ধকারে কেউ দেখতে পাবে না রানাকে। এখানে-ওখানে জ্বলছে গ্রামের সাদা রঙের বাতি। জোরালো আলো ফেলা হয়েছে মেইন গেট ও তাঁবুতে ঢোকার পথের ওপরে। ওয়েদার টাওয়ারের মইয়ের কাছে জ্বলছে একটা হলদে বাতি। ওটাকে পাশ কাটিয়ে মই বেয়ে উঠতে হবে ঘরে। আবারও চারপাশে তাকাল রানা। একটু পর ওর মনে হলো এদিকে চেয়ে নেই গার্ডদের কেউ। ঝড়ের বেগে মই বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল রানা। চোখের কোণে দেখল ল্যাট্রিন থেকে বেরিয়ে বড় তাঁবুর দিকে চলেছে এক লোক। ওদিকে ঘুরঘুর করছে কয়েকজন সশস্ত্র গার্ড। রানার মনে পড়ল, হ্যাঙারে দেখেছে অপেশাদার গার্ডদের নিয়ে নিজের দল তৈরি করেছে সিম্পসন। তবুও সতর্ক হতে হবে ওকে। যে-কাউকে খুন করতে আসলে লাগে মাত্র একটা বুলেট। তার ওপরে ওর নিজের কাছে কোন অস্ত্র নেই।
ওয়েদার টাওয়ারের মইয়ের মাঝামাঝি উঠে আবারও বড় তাঁবুর দিকে তাকাল রানা। ওর বুঝতে অসুবিধে হলো না যে বিশাল তাঁবুতে বসেই ডার্টি গেম শো চালাচ্ছে ব্র্যাড স্টিল।
একবার ভাবল রানা, বন্ধ করে দেব তার ব্রডকাস্ট? সহজেই খুন করতে পারব যে-কোন গার্ডকে। তারপর তার অস্ত্র সংগ্রহ করে জিপ চালিয়ে ঢুকতে পারব প্রধান তাঁবুর ভেতরে। সেক্ষেত্রে চুরমার হবে কমপিউটার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি। জিম্মি করা যাবে লোকগুলোকে। কিন্তু তাতে বড় সমস্যা হচ্ছে: তখনও টিকটিক করে কমে আসবে গোড়ালির টাইম বোমার ঘড়ি।
কাউকে খুন করে কোন ধরনের ফায়দা হবে না, তাই সুযোগ পেয়েও পলিনেশিয়ান লোকটাকে খুন করেনি রানা। আসলে চরম শাস্তি দেয়া উচিত ব্র্যাড স্টিল আর তার সিকিউরিটি চিফ রিভ সিম্পসনকে। তবে তাদেরকে খুঁজতে গেলে গোলাগুলিতে মরবে নিরীহ লোকজন। নিজেও হয়তো খুন হবে রানা। না, এখন ওর প্রথম কাজ হওয়া উচিত বিসিআই-এর কমিউনিকেশন সেন্টারে যোগাযোগ করা। সরাসরি কথা বলতে হবে বসের সঙ্গে।
আবারও মই বেয়ে উঠতে লাগল রানা।
ওয়েদার টাওয়ারের ওপরের মেঝে তিন শ’ ষাট ডিগ্রি অর্থাৎ বৃত্তাকার। মাঝে টিনের ছাতওয়ালা ঘর। জানালার ঘোলাটে কাঁচ দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল রানা।
ঘরের মেঝে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে বড়জোর পনেরো ফুট। ছাতের বিম থেকে ঝুলছে জ্বলন্ত চাইনিয ল্যাম্প। যা ভেবেছে, সেটাই দেখতে পেল রানা। দু’দিকের দেয়াল ঘেঁষে বসানো হয়েছে নতুন ওয়েদার ট্র্যাকিং ও স্যাটেলাইট ইকুইপমেন্ট। সেগুলোর ওপরে চোখ রেখেছে বছর তিরিশেকের এক টেকনিশিয়ান। তার পিঠ এখন ওর দিকে।
রানার মনে হলো না লোকটা সশস্ত্র। নিঃশব্দে কয়েক পা সরে নব ঘুরিয়ে ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল ও। নিচু গলায় বলল, ‘কী খবর?’
পরিচিত কেউ এসেছে ভেবে ঘুরে তাকাল লোকটা। কিন্তু চাইনিয ল্যাম্পের উজ্জ্বল আলোয় একসেকেণ্ডে বুঝে গেল, এই লোক অপরাধী দলের কেউ। মস্তবড় হাঁ মেলে চিৎকার দিতে গেল সে। কিন্তু সামনে বেড়ে তার কানের পাশে জোর এক ঘুষি বসাল রানা। জ্ঞান হারিয়ে চেয়ার থেকে কাত হয়ে মেঝেতে পড়ল লোকটা।
ডেস্কে নানান জিনিসপত্র। ওগুলোর ভেতরে আছে কলম, কাগজ, কাটার ও অর্ধেক খরচ করা ডাক্ট টেপ। শেষেরটা দিয়ে টেকনিশিয়ানের মুখ-হাত-পা বাঁধবে কি না ভাবল রানা।’ পরক্ষণে বুঝল, সেটা করতে হবে না। লোকটার জ্ঞান ফেরার অনেক আগেই এখান থেকে উধাও হবে ও। টেপ অবশ্য পরে অন্য কাজে লাগতে পারে। রোলটা পকেটে রেখে কন্সোলের সামনে বসে পড়ল রানা।
গুপ্তচর হিসেবে যে ধরনের ট্রেনিং ওকে দেয়া হয়েছে, তার ভেতরে আছে স্যাটেলাইট ও জিপিএস কমিউনিকেশন স্কিল। অরবিটে আছে কমপক্ষে দেড় শ’ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট। তার অন্তত এক শ’টা জিয়োসিনক্রোনাই অরবিটে। বিশ্বের ইকুয়েটরের থেকে একটা বেছে নেবে রানা। এক স্যাটেলাইট থেকে ঠিকরে অন্য স্যাটেলাইটে যাবে ওর দেয়া তথ্য। এভাবে নির্বিঘ্নে চব্বিশ ঘণ্টা ধরে চলছে পৃথিবীতে দেশ থেকে অন্য দেশের জরুরি যোগাযোগ। এই একই টেকনোলজি ব্যবহার করে ডিজিটাল ফোন। কিন্তু দ্বীপে ওয়াএয়ারলেস নেটওঅর্কের কোন টাওয়ার দেখতে পায়নি রানা। সুতরাং ওর যোগাযোগ করতে হবে কোন স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে।
জিয়োসিনক্রোনাইয স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হলেও ব্রডকাস্টিং টিভি ও ইন্টারনেটের সঙ্গে সম্পর্ক নেই গ্লোবাল পযিশনিঙের। পৃথিবী জুড়ে আছে মাত্র একত্রিশটা জিপিএস লো আল্টিচ্যুড স্যাটেলাইট। সেই টেকনোলজি ব্যবহার করে ট্র্যাক করা যাবে দ্বীপের ক্রিমিনালদের। যদিও তার অর্থ এমন নয় যে দুর্গম এই দ্বীপে চট্ করে এসে ওদেরকে উদ্ধার করতে পারবে কেউ।
আপাতত জিপিএস সিস্টেমের কথা ভুলে টেবিল থেকে স্যাটেলাইট ফোন নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল প্রিফেক্স কোড ব্যবহার করে বিসিআই হেডকোয়ার্টারে কল দিল রানা। রিসিভারে শুনতে পেল ওদিকে টিট-টিট শব্দে বাজছে রিং।
‘হ্যালো, কে বলছেন?’ ওদিক থেকে বলল কেউ।
‘আমি মাসুদ রানা,’ বলল রানা।
‘মাসুদ ভাই?’ চমকে গেছে মানুষটা। ‘আমি এখনই বসের কাছে লাইন দিচ্ছি। জাস্ট আ মিনিট!’
পেরোল পঁয়তাল্লিশ সেকেণ্ড, তারপর লাইনে রানা শুনতে পেল গুরুগম্ভীর কণ্ঠ: ‘তুমি এখন কোথায়, রানা?’
‘স্যর, এক দ্বীপে। পাপুয়া নিউ গিনির কোথাও।’
চুপ করে আছেন বিসিআই চিফ। তারপর বললেন, ‘তুমি তো ছিলে সোনসোনেট প্রিযনে। কীভাবে গেলে পাপুয়া নিউ গিনির দ্বীপে?’
মাত্র তিন মিনিটে সংক্ষেপে রিপোর্ট দিল রানা। ওর কথা শেষ হতে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন রাহাত খান, ‘এজন্যে জবাব দিতে হবে ডিআইএর চিফকে।
‘স্যর, এবার জিপিএস কোঅর্ডিনেট্স্ দিচ্ছি।’
‘গুড, দেরি না করে পাঠিয়ে দাও। তারপর টাইম বম ডিফিউস করে যত দ্রুত সম্ভব চলে যাও চোখের আড়ালে। আমরা দেখছি তোমাকে কীভাবে ওখান থেকে বের করে আনা যায়।’
‘জী, স্যর।’ বলল রানা। এবার সংখ্যাগুলো দেখে জানিয়ে দেবে জিপিএস কোঅর্ডিনেট্স্।
.
প্রায় ভোর। গাঢ় নীলচে আকাশে ঝাপসা হয়ে গেছে নানান রঙের নক্ষত্রের মিছিল। ব্র্যাড স্টিলের কম্পাউণ্ডের পেছন গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে সিকিউরিটি চিফ রিভ সিম্পসন। কঠোর চোখে দেখছে অচেতন পলিনেশিয়ান টেকনিশিয়ানকে। এরই মধ্যে চারদিকে তল্লাসী শুরু করেছে গার্ডেরা।
‘মিস্টার স্টিল, পুব গেট দিয়ে ঢুকে পড়েছে অপরাধীদের কেউ,’ হেডসেটে বলল সিম্পসন।
নিজের লাউঞ্জ চেয়ারে আয়েস করে বসে কথাগুলো শুনল ব্র্যাড স্টিল। মাত্র একসেকেণ্ডে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখ। কোন কথা না বলে চেয়ার ছেড়ে দূরে সরে গেল সে।
স্টিলের দিকে চেয়ে আছে সিলভি। বন্ধুর পাণ্ডুর মুখ দেখে চট্ করে জিজ্ঞেস করল, ‘খারাপ কিছু?’
‘মাসুদ রানা এসে ঢুকে পড়েছে কম্পাউণ্ডে,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল ব্র্যাড।
‘বাহ্, এ তো দারুণ সংবাদ!’ মুখে বললেও শুকিয়ে গেছে সিলভির মুখ। ‘এবার বোধহয় এসে ঢুকবে এখানে!’
‘এত সহজ নয়,’ বলল ব্র্যাড। ‘বাইরে অস্ত্র হাতে পাহারা দিচ্ছে সিম্পসন আর তার দলের লোকেরা।’
.
বাইরের আঙিনায় রাইফেলের স্কোপের মত নানান দিকে চোখ বোলাচ্ছে সিকিউরিটি চিফ। গেট থেকে সবচেয়ে কাছের স্থাপনা ওয়েদার টাওয়ার। ওটার ওপরে স্থির হলো তার চোখ। কেউ আছে টাওয়ারের ঘরে। ডিউটি দেয়ার কথা টেকনিশিয়ানের। টিনের ঘরের ভেতরে চোখ বোলাবার জন্যে কয়েক পা এগোল সিম্পসন। পরক্ষণে বুঝে গেল কন্সোলে ঝুঁকে কী যেন করছে মাসুদ রানা!
‘সে টাওয়ারের ওপরে,’ হেডসেটে বলল সিম্পসন।
চট্ করে সিলভারম্যানের দিকে তাকাল স্টিল। ‘আপাতত বন্ধ করে দাও টাওয়ারের জেনারেটর।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন