কাজী আনোয়ার হোসেন
সিকিউরিটি চিফ রিভ সিম্পসনের দেয়া কোঅর্ডিনেট্স্ অনুযায়ী উপত্যকার বড় গাছগুলোর মাথা ছুঁয়ে দ্বীপের অভ্যন্তর লক্ষ্য করে উড়ে চলেছে হেলিকপ্টার। ওটার গন্তব্য জঙ্গলের মাঝে ছোট এক ফাঁকা ময়দান। রানা ও আলকারা বা শ্যানন ও তানাকার মাঝে পড়বে জায়গাটা।
এখন রানা ও আলকারাযকে অনুসরণ করছে শ্যানন ও তানাকা। যে গিরিখাদে নিষ্ঠুরভাবে খুন করেছে ইসাবেলাকে, এরই ভেতরে জায়গাটা অনেক পেছনে ফেলে এসেছে তারা। আর সামনে যারা রয়ে গেছে, কে যেন খুব দক্ষতার সঙ্গে মুছে দিচ্ছে তাদের পদচিহ্ন। শ্যানন বুঝে গেছে, চিহ্ন গোপনকারী লোকটা অবশ্যই বাংলাদেশ আর্মি আর ব্রিটেনের এসএএস ফোর্স থেকে ট্ৰেইণ্ড কমাণ্ডো মাসুদ রানা।
নিজের কাজ খুব ভালভাবে বোঝে সে। তবে যতই দক্ষ হোক, কোন না কোন সীমাবদ্ধতা থাকে যে-কোন মানুষের। ল্যাংড়া হাঁসের মত বাতিল এক লোককে সঙ্গে রেখে মস্তবড় ভুল করে বসেছে রানা। কেন যে মেক্সিকান ডাকাতকে সাহায্য করছে সে, সেটা মাথায় ঢুকছে না শ্যাননের। তার হাতে আছে তুরুপের টেক্কা, কাজেই বেশি কিছু ভাবতেও চাইছে না সে।
হেলিকপ্টারের ধুপ-ধুপ আওয়াজ শুনে মুখ তুলে আকাশে তাকাল শ্যানন ও তানাকা। এক কিলোমিটার সামনে আকাশে জ্বলে উঠে নামতে শুরু করেছে লালচে এক আলো।
‘আমাদের স্যান্টা ক্ল্য দেখি আবারও ব্যাগ ভরা উপহার দেবে!’ দুই কানে চলে গেল শ্যাননের হাসি।
দৌড়ে এক কিলোমিটার জঙ্গল পার করে মাঠের মত এক জায়গায় পৌঁছে গেল তারা। ঝিরঝির আওয়াজে পুড়ছে ফ্লেয়ার। আশপাশে কেউ থাকলে আলো দেখতে পাবে, তাতে হতে পারে বড় ধরনের বিপদ। তাড়াহুড়ো করে আগুন নিভিয়ে দিল শ্যানন। ব্যাগ সংগ্রহ করে সরে গেল মাঠের একপাশে। ওদের জন্যে হেলিকপ্টার থেকে ফেলা হয়েছে ভারী এক কালো ডাফেল ব্যাগ। ওটার চেইন খুলে হাতড়াতে লাগল শ্যানন। ভেতরে দেয়া হয়েছে দরকারি অনেক কিছুই।
‘শালারা তো দেখি ক্রিসমাসের উপহার পাঠিয়ে দিয়েছে, ‘ খুশিমনে বলল শ্যানন। ‘স্যাণ্ডউইচ, আপেল, পানি, ছোরা… আবার দামি চুরুট!’ তানাকার পিঠে চাপড় দিল সে। ‘দোস্ত, আমরা তো দেখি পেয়ে গেছি জ্যাক পট!’
শুধু যে তামাক আর খাবার দেয়া হয়েছে, তা নয়, ব্যাগে আছে কমপাস, পেশাদারী ধনুক ও তৃণ ভরা তীর। এ-ছাড়া আছে তিন ফুটি ম্যাচেটি, কয়েক ক্যান ভরা অকটেন, দুটো ম্যাচের বাক্স ও অন্যান্য কিছু জিনিস।
তারা স্বর্গে পৌঁছে গেছে বলে ভাবছে শ্যানন ও তানাকা ব্যাগ হাতড়ে দ্বীপের ম্যাপ পেয়ে ওটা নিল শ্যানন। ‘আমরা এখানে আছি,’ একটা বৃত্ত দেখাল সে। একটু দূরে জাপানি এক কমাণ্ড পোস্টের ভেতরে আছে দুটো লাল চিহ্ন। নির্বোধ না হলে যে-কেউ বুঝবে, শ্যানন ও তানাকার জন্যে ওখানে অপেক্ষা করছে দুটো অসহায় শিকার।
টপটপ করে তিনটে পানির ফোঁটা পড়ল ম্যাপের ওপরে। তখনই গুডগুড করে উঠল আকাশ। ম্যাপ গুটিয়ে ব্যাগের ভেতরে রেখে দিল শ্যানন। মুখ তুলে তাকাল ওপরের দিকে। কালো মেঘে ভরে গেছে আকাশ। ব্যাগ থেকে ধনুক ও তীর ভরা তূণ নিল সে। ফাইবারগ্লাস, অ্যালিউমিনিয়াম ও কাঠের তৈরি ধনুক প্রস্তুত করা হয়েছে আমেরিকান আর্মির জন্যে। মাইক্রোপুলি সিস্টেমের কল্যাণে বহু দূরে যাবে গ্রাফাইট তীর। এক কথায় সাধারণ তীরন্দাজের জন্যে নয়, অস্ত্রটা তৈরি করা হয়েছে মানব-হত্যার জন্যে।
দুটো বোলো নাইফ নিয়ে খেলতে শুরু করেছে তানাকা। ছোরাগুলোর হাতল ক্যারিব্যুর শিং দিয়ে তৈরি। ফলা আঠারো ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের। জিনিসদুটো এসেছে সরাসরি ফিলিপিন্স থেকে। এই ধরনের ছোরা ব্যবহার করে খতম করা হয় শুয়োর, মুরগি ও গরু। অবশ্য এবার ওগুলো কাজে লাগবে মানুষ হত্যায়।
‘বাছা, তুমি তৈরি হও,’ তানাকাকে চোখ টিপে বলল শ্যানন, ‘আমাদেরকে এবার দারুণ একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হবে।’
জবাবে কুং-ফুর স্টাইলে ঝোড়ো বেগে দু’হাত ঘোরাল তানাকা। বুঝিয়ে দিল, আক্রমণ করার জন্যে সে তৈরি।
‘তো রেডি?’ হাসল শ্যানন। হাতে অস্ত্র পেয়ে নিজেও বেশ উত্তেজিত হয়ে গেছে। এবার রানা আর আলকারাযকে একহাত নেবে সে। তাদেরকে বন্দি করে নির্যাতন করার পর জবাই করবে হাসতে হাসতে।
জাপানি স্থাপনার দিকে রওনা হওয়ার আগেই ঝমঝম করে নামল তুমুল বৃষ্টি। তারই ভেতর দিয়ে হনহন করে এগিয়ে চলল তারা। আশা করছে বিশ মিনিটে পৌঁছে যাবে টার্গেট এরিয়ায়। রানা আর আলকারায জানেও না, কী ধরনের ভয়ঙ্কর বিপদে পড়ে গেছে ওরা।
.
হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনতে পেয়েছে রানা। তবে জঙ্গলের গভীরে কমাণ্ড পোস্টে আছে বলে দেখতে পায়নি ফ্লেয়ারের লাল আলো। তা ছাড়া, হেলিকপ্টার থেকে ব্যাগ ফেলা হয়েছে ছোট এক টিলার ওদিকে। রানার কাছে মনে হয়েছে, এবার হয়তো আশপাশে পড়বে খাবারের কোন ব্যাগ। তবে সেটা সংগ্রহ করতে গিয়ে সময় নষ্ট করার কোন উপায় নেই ওর। প্ল্যান অনুযায়ী আগে শেষ করতে হবে হাতের কাজ। একবার জিপিএস অফ করতে পারলে রওনা হবে ওয়েদার টাওয়ার লক্ষ্য করে।
প্রথমবার বাঙ্কার সার্চ করতে গিয়ে রানা জেনে গেছে, পেছনে পাহাড়ি এলাকা। নিরেট পাথর কেটে একদিকে তৈরি করা হয়েছে একফুটি ভিউয়িং স্লিট। ওটার ভেতর থেকে নাক বের করে সামনের দিকে তাক করা আছে জঙে ভরা টাইপ ৯১ টেন-সেন্টিমিটারের হাওয়াইট্যার। বিশাল অস্ত্রটা অবশ্য ওদের কোন কাজে আসবে না।
অন্ধকার বাঙ্কারে আবারও ঢুকে ভেতরের দিক হাতের ছোঁয়ায় বুঝতে চাইল রানা। মেঝের একদিকে অব্যবহৃত কিছু আর্টিলারি শেল। এখন না লাগলেও পরে হয়তো কোন কাজে ওগুলো লাগবে।
বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে লোডিং ডকের কাছে ফিরল রানা। আগের জায়গা থেকে সরে গেছে আলকারায।
‘ভেতরে খাওয়ার মত কিছু আছে?’ জানতে চাইল সে। আকাশ-পাতাল বৃষ্টি শুরু হতেই হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়েছে কমাণ্ড পোস্টে।
তার কথার জবাব না দিয়ে অক্ষশক্তি ও মিত্র শক্তির ফেলে যাওয়া নানান জিনিস ঘেঁটে দেখছে রানা। ফুটো হয়ে গেছে টিনের ছাত। বেশ কয়েকটি ধারায় নিচে ঝরছে বৃষ্টির পানি। ঘরের ভেতরে তেমন কিছু নেই যা কাজে আসবে। অস্ত্র নেই, অ্যামিউনিশন নেই, খাবারও নেই। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় পচে গেছে সবই।
আরও কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে কাজে লাগবে এমন মাত্র একটা জিনিসই খুঁজে পেল রানা। ওটা আছে জাপানি পুরনো এক ধুলোভরা রেডিয়োর পাশে। জিনিসটা ১৯৪৩ সালের সার্কা লিড-অ্যাসিড ব্যাটারি।
রানা আগেই দেখতে পেয়েছে লোডিং ডকের পাশে আধুনিক কিছু লেন্স। কমাণ্ড পোস্টে বোধহয় কোন ক্যামেরা নেই। তবে খুব সতর্কতার সঙ্গে চোখ বোলাবার পর রানা বুঝে গেল, অফিসের কোণে আছে আরেকটা ভিডিয়ো ক্যামেরা। ভুলবশত ধাক্কা দিয়েছে এমন ভঙ্গি করে লেন্সের সামনে ক’টা ক্রেট ঠেলে ফেলল রানা। ব্র্যাড স্টিলের লোকেরা ধরে নেবে ওর বোকামির কারণে ব্লক হয়ে গেছে তাদের লেন্স।
এখন কেউ দেখবে না ওকে, সেটা বুঝে ঘরের কোনার কংক্রিটের দেয়ালে বাড়ি মেরে ব্যাটারিটা ভাঙল রানা। নিজের গোড়ালির ব্রেসলেট দেখিয়ে আলকারাযকে বলল, ‘ডিভাইসে জিপিএস আছে। ওটা বন্ধ হলে আমাকে আর ট্র্যাক করতে পারবে না।’
জাপানি ব্যাটারিতে আছে সীসার সরু কিছু নমনীয় পাত। ওখান থেকে দুটো নিয়ে ইলেকট্রনিক জিপিএস ইউনিটের সামনে ও পেছনে আটকে নিল রানা। এবার ভুল না হলে সীসার পাতের জন্যে রিসিভারে তথ্য পাঠাতে পারবে না জিপিএস ডিভাইস। যদিও নিশ্চয়তা নেই যে এতে কাজ হবে, তবুও ঝুঁকি না নিয়ে কোন উপায়ও তো নেই রানার।
এবার ছাত থেকে ঝরঝর করে নেমে আসা বৃষ্টির পানির ধারার নিচে বড় একটা কাঠের গামলা রাখল রানা। একটু পর পানিতে ভরে যাবে ওটা। ‘তোমার জন্যে পানি,’ আলকারাযকে বলল ও। ‘এটা নাও।’ ধুলোভরা এক তাকে পাওয়া জং-ধরা ছোরা তার হাতে তুলে দিল রানা। অস্ত্র হিসেবে হয়তো ওটা কিছুই নয়, তবে মানসিক স্বস্তি পাবে আলকারায। রানা আশা করছে, এতক্ষণে বৃষ্টির পানিতে মুছে গেছে ওদের পায়ের ছাপ। সেক্ষেত্রে এখানে হয়তো আসবে না শ্যানন আর তানাকা। আর সেক্ষেত্রে ছোরা হাতে লোকগুলোর বিরুদ্ধে লড়তে হবে না আহত যুবকের।
কমাণ্ড পোস্ট থেকে বেরোবার আগে তার দিকে তাকাল রানা। ভাল থেকো বলতে গিয়েও চুপ রয়ে গেল। আপাতত কপাল ভাল থাকলেও একসময় মরতেই হবে আলকারাযের। গোড়ালির টাইম বোমার জন্যে প্রতি সেকেণ্ডে কমছে ওদের সবার বাঁচার সময়। একবার আলকারাযের দিকে চেয়ে ঘর থেকে বেরোবে রানা, এমন সময় পেছন থেকে বলল মেক্সিকান দস্যু, ‘অনেক ধন্যবাদ, বন্ধু। তুমি ভাল থেকো।’
অন্য কারও জন্যে যা করত, আলকারাযের জন্যেও তার চেয়ে বেশি কিছু করেনি রানা। মৃদু মাথা দুলিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল ও। আগের চেয়ে জোরে পড়ছে বৃষ্টি। কমাণ্ড পোস্ট থেকে সরে সেতুর দিকে চলল রানা। ওর জানা নেই, শ্যানন ও তানাকার কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে আধুনিক একটি ম্যাপ। ওটাতে চিহ্ন বসিয়ে জানিয়ে দিয়েছে ঠিক কোথায় তারা পাবে অপ্রস্তুত দুই শিকারকে।
তীব্র ব্যথা সহ্য করে মেঝেতে চুপচাপ পড়ে আছে আলকারায। ওর জানা নেই, মাত্র পঁচিশ মিনিট পর ওকে মুঠোর ভেতরে পাবে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর দুই খুনি।
.
রানা যখন চুরমার করছে জাপানি পুরনো ব্যাটারি, একই সময়ে দর্শক-সংখ্যা ও ব্লগ দেখার কাজে ব্যস্ত ছিল সিওয়ার্স। এদিকে দর্শকেরা যাতে বিরক্ত হয়ে লগ আউট না করে, সেজন্যে নির্ঘুম চোখে সংক্ষিপ্ত এক রিলের হাইলাইট মেইন স্ক্রিনে দিয়েছে এমিলি। বিশাল তাঁবুর ভেতরে স্টিল, সিওয়ার্স আর সে আশা করছে, একটু পর খুনোখুনির উত্তেজনাপূর্ণ আবহ তৈরি করবে শ্যানন ও তানাকা। বিরক্ত হয়ে কপালের দোষ দিচ্ছে সিলভারম্যান।
ব্লগ চেক করার পর শ্যানন কতটা এগোল সেটা দেখার জন্যে আবারও গ্রিড ম্যাপের দিকে তাকাল সিওয়ার্স। সবুজ দুটো + সাইন ধীরে ধীরে চলেছে আরও দুটো + সাইনের দিকে। কিন্তু জাপানি ধ্বংসস্তূপে হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেল সবুজ একটা + চিহ্ন।
‘সর্বনাশ!’ বিড়বিড় করল সিওয়ার্স। ‘মিস্টার স্টিল! কী করে যেন উবে গেছে মাসুদ রানা! ব্যাটা বোমা ফেটে মরল নাকি!’
মেইন স্ক্রিনে শো-র সেরা অভিনেতা শ্যাননের ক্লোযআপ ছবি দেখছে স্টিল। পিঠে কালো ডাফেল ব্যাগ ঝুলিয়ে নিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে ইংরেজ লোকটা, হাতে ধনুক। বোলো ছোরা হাতে তার পেছনে পেছনে আসছে তানাকা।
‘কী বললে, সিওয়ার্স? অদৃশ্য হয়ে গেছে?
‘হঠাৎ করেই নেই। আমার গ্রিডে তাকে আর পাচ্ছি না।’ ম্যাপের দিকে স্টিলের মনোযোগ আকর্ষণ করল সিওয়ার্স। ‘আর কোন সিগনাল দেখতে পাচ্ছি না।’
‘এটা কীভাবে সম্ভব? এই সময়ে এ-ধরনের টেকনিকাল ম্যালফাংশন হলে তো মহাবিপদ!’
‘নিশ্চয়ই তার ব্রেসলেটে বড় কোন সমস্যা হয়েছে,’ বলল সিওয়ার্স, ‘সফটওয়্যার তো ঠিক আছে।’
জিপিএস ইউনিটের দায়িত্ব সিওয়ার্সের নয়, কাজেই তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে লাভ হবে না, সেটা জানে স্টিল। তার সব রাগ গিয়ে পড়ল সিলভারম্যানের ওপরে। শ্যাননের কাছে ব্যাগ পৌঁছে দেয়ার পর মাত্র দুটো শব্দ উচ্চারণ করেছে সে।
‘সিলভি, লোকটাকে খুঁজে বের করো।’
মাথা দোলাল সিলভারম্যান। মন দিল অসংখ্য ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের দিকে। ভাবছে, নৃশংস এই শো ফেলে আবার যদি ফিরতে পারত অতীতে ফুটবলের দৃশ্য ধারণে! কিন্তু সেটা তো আর আপাতত সম্ভব নয়।
জাপানি কমাণ্ড পোস্টের ভেতরে কিছু ক্রেট পড়ে গেছে, ওগুলোর কারণে অবরুদ্ধ হয়ে গেছে ক্যামেরার লেন্স। হয়তো এখনও বাঙ্কারের ভেতরেই আছে মাসুদ রানা। তবে সেটা আপাতত নিশ্চিত হওয়ার কোন উপায় নেই।
নানান স্ক্রিনের ওপরে চোখ রেখে এক এক করে পেরিয়ে গেল কয়েক মিনিট, তারপর স্বস্তির শ্বাস ফেলল সিলভারম্যান। ‘ওকে পেয়েছি!’ স্টিলের জন্যে বড় স্ক্রিনে দৃশ্যটা দিল সে।
সেতুর কেব্ল্ দু’হাত ও দু’পায়ে আঁকড়ে ধরে গিরিখাদের ওপরে ঝুলতে ঝুলতে এগিয়ে চলেছে রানা।
চোখ কুঁচকে স্টিল বুঝতে চাইল বাঙালি লোকটা আসলে কী করতে চাইছে। ‘করে কী ব্যাটা?’
‘জানি না,’ বলল সিলভারম্যান।
‘ওর ওপরে চোখ রাখো।’
সেটা আবার বলতে, মনে মনে বলল সিলভারম্যান। শত শত ক্যামেরার ওপরে চোখ রাখছে সে। এটাই তার কাজ। স্টিল আবারও বেফাঁস কিছু বললে হয়তো তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে বসবে সে। নাৎসি, রাশান ও মেক্সিকান মেয়েটার প্রতিটি দৃশ্য কে ক্যামেরায় ঠিকভাবে ধরেছে? আর এসব ভিডিয়ো করতে গিয়ে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে গেছে সিলভি। তার ধারণা, আগে কখনও এত ভয়াবহ দৃশ্য দেখেনি বলে ওর মতই অসুস্থ হয়ে গেছে স্টিলের প্রেমিকা রিটা। মেয়েটার শুধু জোগান দেয়ার কথা অপরাধীদের উপযুক্ত পোশাক। রিটা যে স্টিলের মত অশুভ আর নিষ্ঠুর নয়, সেটা বুঝে গেছে সিলভি। গোটা ক্যাম্পে শুধু সে আর রিটা মাত্র দু’জন মানুষ, যারা এই শো-র নৈতিকতা নিয়ে ভাবছে।
.
ল্যাপটপে চোখ রেখে গিরিখাদের ওপরে কেবলে ঝুলতে ঝুলতে রানাকে এগোতে দেখছে স্পেশাল এজেন্ট এডওয়ার্ড সিমন্স। এরই ভেতরে বিসিআই থেকে রানার বিষয়ে কিছু ডেটা জোগান দিয়েছে রায়হান রশিদ। এখন বাঙালি এজেন্টের ব্যাপারে আমেরিকান ইন্টেলিজেন্স অফিস থেকে আরও তথ্য পাবে বলে অপেক্ষা করছে সিমন্স।
একটু পর তার কিউবিকলের দরজায় টোকা দিল কেউ। পরক্ষণে দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘরে ঢুকল জুনিয়র এজেন্ট স্টেলা। ‘এক্ষুণি আপনাকে নিজের অফিসে ডেকেছেন রাইডার।’
‘কী কারণে ডাকছে, সেটা জানো?’
‘বস্কে খুব নার্ভাস বলে মনে হলো।’
চেয়ার ছেড়ে কিউবিকল থেকে বেরিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের অফিসে গিয়ে ঢুকল সিমন্স। নিজের ডেস্কে বসে আছে রাইডার। তার পেছনের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে নিউ হ্যাভেন আর কানেক্টিকাটের গ্রাম্য দৃশ্য।
‘আমাকে ডেকেছেন?’ দরজার কাছে থেমে বলল সিমন্স।
‘মাসুদ রানার ব্যাপারে সবধরনের তদন্ত বন্ধ করো।’
এক পা সামনে বাড়ল সিমন্স। ‘তদন্ত বন্ধ করে দেব?’ এবার ঘরের কোণে এক লোককে বসে থাকতে দেখল সে। তার পরনে দামি কালো সুট, পায়ে মুচির তৈরি চামড়ার জুতো। বয়স হবে কমপক্ষে পঁয়তাল্লিশ। কলপ করেছে মাথার চুল। সিমন্সকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল না রাইডার।
‘তোমার আর তদন্ত করতে হবে না,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর।
রহস্যময় লোকটার দিকে চেয়ে নিচু গলায় বলল সিমন্স, ‘ওই দ্বীপে আটকা পড়েছে আমেরিকার একজন নাগরিক। আর আমাদের দেশের জন্যে মস্তবড় ঝুঁকি নিয়েছে মাসুদ রানা। আমরা চাইলেই তো তাদেরকে…’
‘সিমন্স… তোমার আর নতুন করে কোন তর্কের সুযোগ নেই।’
রবার্ট রাইডার ঘাবড়ে গেছে, সেটা টের পেল সিমন্স। লোকটা চাইছে অন্য কোন অফিসে যেন তাকে বদলি করে দেয়া না হয়।
‘মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে আপনিই আমাকে বলেছেন, আমরা যেন ভালভাবে তদন্ত করি,’ বসের চোখে আপত্তি দেখেও বলল সিমন্স। ‘আমেরিকার নানান উপকার করেছে মাসুদ রানা। আর আপনি এখন আমাকে বলছেন তদন্ত বন্ধ করে দিতে?’
চেয়ার থেকে না উঠে পা বাড়িয়ে আধখোলা দরজা বন্ধ করল অতিথি। শুকনো গলায় বলল, ‘আপনি যখন তদন্ত শুরু করলেন, তখন থেকেই আমার অফিসের অনেকে বিব্রত বোধ করছে।’ ওয়াশিংটনের প্রভাবশালী আমলাদের সুরে কথা বলেছে লোকটা।
‘তো আপনার অফিসটা যেন কোথায়?’ তোয়াক্কা না করে তেড়া সুরে জানতে চাইল সিমন্স।
খুকখুক করে কেশে নিয়ে লোকটার হয়ে জবাব দিল রাইডার, ‘ইনি কাজ করেন পেন্টাগনের ডিআইএ অফিসে। তাঁর নাম ডোমেনিক উসবার্টি। ডিআইএর অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর।’
কথাগুলো শুনে তিক্ত হয়ে গেল সিমন্সের মন। ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির কথা কে না জানে! এই অফিসের মোটো: সর্বশক্তি দিয়ে দেশের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বজায় রাখতে হবে।
সারাবছরে সিআইএ ও এফবিআই গোটা দুনিয়ায় গোপন যে অপারেশনগুলো চালায়, তার কয়েক গুণ মিশন পরিচালনা করে ডিআইএ। অত্যন্ত দক্ষ একদল অপারেটরকে দিয়ে টপ কোয়ালিটি টেকনোলজি ব্যবহার করে চালানো হয় সেসব অপারেশন। একদল তুখোড় মগজের ডিফেন্স প্ল্যানার দেশের প্রয়োজনে নিরাপত্তার জন্যে ধার নেয় হাইলি ট্রেইণ্ড মিলিটারি অপারেটিভদেরকে। তাদের কথার ওপর দিয়ে কিছু করতে গেলে চাকরি থাকে না কারও।
‘আপনার এই তদন্ত এখানেই শেষ,’ আবেগহীন সুরে বললেন ডোমেনিক উসবার্টি। ‘মাসুদ রানা সম্পর্কে সবই আমরা জানি। এবং জনি এস. ক্লার্কের মত অপরাধীকে নিয়েও আপনার কিছু ভাবার দরকার নেই। ‘
আমি বসের মত পদোন্নতির জন্যে লালায়িত নই, ভাবল সিমন্স। ডিআইএ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর দাবড়ি দিলেই তদন্ত বন্ধ করে দুই পায়ের ফাঁকে লেজ গুটিয়ে নেব না।
‘মাসুদ রানা কি আমাদের দেশের জন্যে এল সালভেদরে গিয়ে ড্রাগসের ফ্যাক্টরি ধ্বংস করে দেয়নি?’ বলল সিমন্স।
সর্বজ্ঞানী সাধুর মত মুচকি একটা হাসি দিলেন উসবার্টি। ‘হ্যাঁ, সেটা সে করেছে।’
‘তা হলে বিপদে আমরা তাকে সাহায্য করব না কেন?’
‘যথেষ্ট হয়েছে, সিমন্স!’ রাইডারের কপালে জমে গেছে বিন্দু-বিন্দু ঘাম।
‘না, বলুক না,’ দাদাগিরির ভঙ্গিতে বললেন উসবার্টি। ‘অনেক কিছুই জানে না স্পেশাল এজেন্ট সিমন্স। তার জানার অধিকার আছে। নানান ধরনের জ্ঞান পরবর্তী জীবনে কাজে আসবে। আপনি বলুন, সিমন্স।’
‘আপনাদের এজেন্সি চিফ নিজে মাসুদ রানাকে বিসিআই থেকে ধার নিয়েছেন,’ বলল সিমন্স। ‘বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সকে বলা হয়েছিল, মাসুদ রানা এল সালভেদরে বন্দি হলে আমেরিকান সরকার থেকে যথাসাধ্য সহায়তা করা হবে। তারপর তিন মাস আগে নিজের কাজ শেষ করেছে সে। কিন্তু গ্রেফতার হওয়ার পর ডিআইএ তাকে একদম ভুলে গেছে। বলুন, এটা কেন হবে? আপনারা কি চান অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করুক লোকটা?’
‘সে মারা গেলেই বা আমাদের কী, আর বেঁচে থাকলেই বা কী,’ হালকা সুরে বললেন উসবার্টি। ‘মাসুদ রানা আমাদের হয়ে কাজ করেছে বলে তার বদলে নানান ধরনের সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ সরকার। বিসিআই চিফ সেটা জানেন বলেই ডিআইএ চিফের সঙ্গে আর যোগাযোগ করেননি।’ নিষ্পলক চোখে সিমন্সকে দেখলেন তিনি। ‘ধরে নিন, যে দরজা বন্ধ করে রাখা খুব জরুরি, জোর করে সেটা খুলতে যাওয়া হবে খুব অনুচিত।’
‘এটাই আসলে উচ্চ পর্যায়ের অফিসারদের সিদ্ধান্ত, ‘ বলল অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর রাইডার।
‘আমি বুঝতে পারছি, সিমন্স, আপনি চান মাসুদ রানার বিষয়ে আমরা যেন হস্তক্ষেপ করি,’ বললেন উসবার্টি। ‘কিন্তু সেটা করতে গেলে আমরা যেমন ফেঁসে যাব, তেমনি জন্ম নেবে নানান ধরনের প্রশ্ন।’ ডিআইএ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর বুঝে গেছেন, নীতিবান মাথাগরম ধরনের লোক সিমন্স।
চুপ করে থাকল এফবিআই স্পেশাল এজেন্ট।
রাইডারের চোখে চোখ রেখে শীতল কণ্ঠে বললেন উসবার্টি, ‘কোন ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করা হোক, সেটা আমরা চাইছি না।’
ঘাড় বেয়ে ঘামের স্রোত নামল সিমন্সের পিঠে। যা বলার বলে দিয়েছেন উসবার্টি। নতুন করে কিছু করতে গেলে টান পড়বে ওর চাকরি নিয়ে। ডিআইএর খাতা থেকে আলগোছে মুছে দেয়া হয়েছে মাসুদ রানার নাম।
‘তবুও ডার্টি গেমের ওপরে আমি চোখ রাখব,’ মনে মনে নিজেকে শোনাল সিমন্স। ‘যোগাযোগ থাকবে বিসিআই এজেণ্ট রায়হান রশিদের সঙ্গে। আর সম্ভব হলে দেরি করব না মাসুদ রানাকে সাহায্য করতে।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন