কাজী আনোয়ার হোসেন
রাশান দানব ম্যানইয়া লোপাতিন ক্লিফ থেকে পড়ার পর হেঁটে চলেছে রানা। বিকেলের সোনালি আকাশ একসময় হয়ে গেল কালো আঁধার। বিরামহীনভাবে কমছে গোড়ালির ব্রেসলেটের ঘড়ির ডিজিট, সুতরাং বিশ্রাম নেয়া বা ঘুমাবার কোন উপায় নেই ওর।
আরেকটু হলে গভীর যে বিশাল ক্যানিয়নে পড়ত রানা, ওটা একসময় রুদ্ধ করল ওর চলার পথ। লাভার তৈরি যে খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠে এসেছে, বাধ্য হয়ে আবার ওটা বেয়ে নেমে এল রানা। নতুন করে এগোল গ্রীষ্মকালীন বনের ভেতর দিয়ে। রাত নামার পর পৌঁছে গেল কালো এক ক্যানিয়নের মুখে। প্রকাণ্ড ফাটলের মাঝ দিয়ে গেছে অগভীর নদী। ওটাতে নেমে পেট পুরে পানি খেল রানা। মনে পড়ল ওর বাঁশের ক্যান্টিনগুলোর কথা। লোপাতিনের সঙ্গে লড়তে গিয়ে কোথায় যেন পড়ে গেছে ওগুলো।
হাঁটতে হাঁটতে দ্বীপের অভ্যন্তরে নানান ধরনের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে রানা। মাঝে মাঝে দূর থেকে আসছে সাগরের শোঁ-শোঁ গর্জন। কখনও ওটা চাপা পড়ছে অসংখ্য পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে। একসময় কানে এল বড় কোন জলপ্রপাতের বিকট শব্দ। অবশ্য একটা টিলায় ওঠার পর আর থাকল না সেই আওয়াজ। ইসাবেলা বা তার স্বামীর প্রতিবাদ বা আর্তচিৎকার না শুনলেও মেয়েটার টাইম বম ফাটার শব্দ পেয়েছে রানা। কে মারা গেল সেটা জানতে গিয়ে সময় নষ্ট করেনি। এটা বুঝে গেছে, কমে গেল আরও এক প্রতিদ্বন্দ্বী।
একটু পর আকাশে মুখ তুলল মস্তবড় এক চাঁদ। তবে ওটা পূর্ণিমার নয়, ঝাপসা আলোয় চিতাবাঘের মত নিঃশব্দে এগিয়ে চলল রানা। লোপাতিনের সঙ্গে মোকাবিলা করার পর থেকে এখনও আর কারও সঙ্গে দেখা হয়নি। মাটিতে কারও পদচিহ্ন নেই। ভাঙা হয়নি কোন গাছের ডাল। আশপাশে নেই মানুষের প্রস্রাবের কটু গন্ধ।
একসময় ঘনিয়ে এল মাঝরাত। যে গিরিখাদে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরভাবে ইসাবেলাকে খুন করে গেছে শ্যানন, ওটা থেকে দু’মাইল উজানে পৌঁছে গেল রানা। ওর ধারণা, চওড়ায় এই দ্বীপ বড়জোর চার মাইল। রানা আছে মাঝের ঘন জঙ্গলে। বিরতি না দিলে সূর্যোদয়ের আগে পৌছুতে পারবে ওয়েদার টাওয়ারের কাছে। যেহেতু দিনের আলোয় স্টিলের কম্পাউণ্ডে ঢুকতে পারবে না, তাই ভোরের আগে ওখানে হাজির হওয়া রানার জন্যে খুব জরুরি।
আরও কিছুক্ষণ হাঁটার পর বুটজুতোর ভেজা দাগ দেখতে পেল রানা। চিহ্নগুলো কোন মেয়ের তৈরি নয়। এক পা টেনে এগিয়ে গেছে লোকটা। জঙ্গলে থমকে গেল রানা। কান পেতে অপেক্ষা করতেই শুনতে পেল একটু দূরেই ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে কে যেন।
অন্ধকারে চারপাশে চোখ বোলাল ও। একটু সামনে বড় এক গাছের গুঁড়ি ছেয়ে ফেলেছে লতাগাছে। কাণ্ডের ওপাশ থেকে বেরিয়ে আছে একটা বুটজুতোর ডগা।
বড় করে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল কেউ।
সাবধানে এগোল রানা। উঁকি দিল গুঁড়ির ওদিকে।
যুবক মেক্সিকান দস্যু আলকারায। কবজিতে হ্যাণ্ডকাফ। খুব কাছে কেউ পৌঁছে গেলেও হুঁশ নেই তার। তাকে দেখে রানার মনে হলো, মরতে পারলে যেন প্রাণে বেঁচে যাবে সে।
চারপাশে আরেকবার চোখ বোলাল রানা। ওর মনে হলো না এখানে অ্যাম্বুশ করবে কেউ। নিচু গলায় বলল, ‘তোমার আসলে কী হয়েছে?’
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল আলকারায। বুকের কাছে নেমে গেছে থুতনি।
‘কী হয়েছে তোমার?’ আবারও জানতে চাইল রানা।
একবার মাথা নেড়ে মুখ তুলে ওকে দেখল আলকারায। রানা বুঝে গেল, প্রচণ্ড মারধর করা হয়েছে তাকে।
‘আমি ওদেরকে খুন করতে চাই,’ ঢোক গিলে বলল মেক্সিকান দস্যু।
‘কাদেরকে খুন করবে?’
বিকৃত হলো আলকারাযের মুখ। হঠাৎ করে খপ্ করে চেপে ধরল রানার ঊরু। ‘আমাকে সাহায্য করো ওদেরকে খুন করতে। আমরা দু’জন মিলে খতম করে দেব ওদেরকে।’
‘তুমি আসলে কী বলতে চাইছ?’ আলকারায যাদেরকে খুন করতে চাইছে, তারা হয়তো আশপাশে কোথাও আছে। তাই আবারও চারপাশে চোখ বোলাল সতর্ক রানা।
‘আমার ইসাবেলা… ওরা ওকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে! তার আগে ইংরেজ কুকুরটা ছোরা দিয়ে ফালি ফালি করে দিয়েছে ওর শরীর। তারপর টাইম বম দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে ওকে। আমার চোখের সামনে সব ঘটে গেল।’ রাগে ও ঘৃণায় থরথর করে কাঁপছে ‘যুবক আলকারায। ‘তুমি আমাকে সাহায্য করলে আমরা ওদেরকে খুন করব।’
আলকারাযের মানসিক যন্ত্রণার মাত্রা বুঝে তিক্ত হয়ে গেল রানার অন্তর। মনে পড়ল সোহানার মিষ্টি মুখ। ওকে কেউ এভাবে খুন করলে আলকারাযের মতই প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে পাগল হয়ে যেত রানা।
আলকারায বলছে শ্যাননের সঙ্গে আরও কেউ আছে। দু’জন মিলে দল তৈরি করেছে তারা।
‘ওদেরকে খুন করতে সাহায্য করো, প্লিয,’ আগের চেয়ে জোরে বলল আলকারায।
দূরে মট করে একটা ডাল ভাঙার আওয়াজ শুনতে পেল রানা। নিচু গলায় বলল, ‘লুকিয়ে পড়ো। কারা যেন আসছে।’
কান পেতে রইল ওরা। একটু পর পঞ্চাশ গজ দূরে ঘন ঝোপের ভেতরে কারও নড়াচড়া দেখতে পেল রানা। পাশাপাশি আসছে দু’জন লোক। একজন লম্বায় ছয় ফুটের মত, অন্যজন বেশ বেঁটে। জাপানি খুনি তানাকার সঙ্গে জোট বেঁধে খুন করে চলেছে প্রাক্তন এসএএস মেজর। ইংরেজ লোকটার হাতে ছোরা। রানা বুঝে গেল, আহত আলকারাযকে নিয়ে সরে যেতে হবে ওর।
‘আমি তোমাকে সাহায্য করব,’ ফিসফিস করে বলল রানা। ‘মন শক্ত করো। ওঠো, এখান থেকে সরে যেতে হবে।’
‘আমি আর হাঁটতে পারব না। ভেঙে দিয়েছে হাঁটুর বাটি।’
চাপা শ্বাস ফেলল রানা। বুঝে গেল জঙ্গলের ভেতরে কেন ছেঁচড়ে চলার দাগ ছিল। আর সে-চিহ্ন অনুসরণ করে এগিয়ে আসছে শ্যানন ও তানাকা।
বাঁচার জন্যে লড়াই চলছে এই দ্বীপে।
আলকারাযকে এখন কোথাও লুকিয়ে রাখবে, সেটা আর সম্ভব নয় রানার পক্ষে। এদিকে পেরিয়ে গেছে মাঝরাত। ভোরের আগে পৌছুতে হবে ওয়েদার টাওয়ারের কাছে। তাই বলে আহত কাউকে ফেলে চলে যাবে, তেমন মানুষ নয় রানা। দু’হাতে পাঁজাকোলা করে আলকারাযকে তুলে নিল ও, দ্রুত পায়ে সরে যেতে লাগল এই এলাকা থেকে।
.
সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসতেই আবার বিধ্বস্ত বি-২৫ বিমানের কাছে ফিরে এসেছে জনি এস. ক্লার্ক। তানাকার ওপরে চাদরের মত করে প্যারাশ্যুট ফেলে ছুটে গিয়ে ঢুকেছিল জঙ্গলে। তখন নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছে, নিশ্চয়ই হেলিকপ্টার থেকে আবারও পড়বে রিলিফের ব্যাগ। আর সে- সময়ে কেউ বাধা দিলে দ্বিধা করবে না তাকে খুন করতে। তবে এরপর আর এল না কোন হেলিকপ্টার। ফলে ব্যাগও আর মিলল না। কাউকে খুনও করতে হলো না।
মাঠে ফিরে ক্লার্ক দেখল এখন আর ব্যাগের ভেতরে কিছু নেই। তবে বিমানের ফিউজেলাজে হয়তো কাজে লাগবে এমন কিছু থাকতে পারে।
ছোরা পেয়ে ওর তৈরি বর্শা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল ক্লার্ক। ফিউজেলাজে ঢোকার আগে আবার সংগ্রহ করল ওটা।
আকাশে এখনও চাঁদ ওঠেনি।
চারপাশে ঘুটঘুটে আঁধার রাত। ভুতুড়ে দেখাচ্ছে ভাঙা বিমান।
‘শালার মারাত্মক কোন ভূত আছে ওটার ভেতরে,’ বিড়বিড় করল ক্লার্ক। ভয় লাগতেই পিছিয়ে গেল কয়েক পা।
পরের পাঁচ মিনিট কান পেতেও কোথাও কোন অস্বাভাবিক আওয়াজ শুনতে পেল না।
বিমানে হয়তো দরকারি কিছু পাব, নিজেকে বোঝাল ক্লার্ক। তা ছাড়া, সারারাত এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে কোন ফায়দা নেই। আরও বড় কথা, কোন্ শালা বলেছে যে আসলে আমার সাহস নেই!
দ্রুত পায়ে ফিউজেলাজে গিয়ে ঢুকল ক্লার্ক। ডালের বর্শা দিয়ে খোঁচা দিল চারদিকে। বিমানের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানান জিনিস। ভেতরে কেউ নেই। ফিউজেলাজে সে একা আছে ভেবে মনের ভেতরে বেশ স্বস্তি পেল ক্লার্ক।
বেশ কয়েক সেকেণ্ড ওর লাগল অন্ধকারে চোখ সয়ে যেতে। মেঝেতে পড়ে আছে সার্ডিন মাছের ক্যান। একটা কুড়িয়ে নিল ক্লার্ক। রুক্ষ হয়ে গেছে কৌটার ধাতব দেহ। এক জায়গায় লেখা: ১৯৪২। সার্ডিন মাছ একদম পছন্দ করে না সে। কিন্তু এখন পেটের তীব্র জ্বালায় অস্থির লাগছে তার। মাছ খেতে পাবে ভেবে গলা দিয়ে বেরোল গুনগুনে গান। কি-র ভেতরে তর্জনী ভরে চড়চড় করে খুলল পাতলা ঢাকনি। তবে কৌটার ভেতর থেকে যে ভয়াবহ দুর্গন্ধ বেরিয়ে এল, তাতে আরেকটু হলে চিত হয়ে ধপাস্ করে মেঝেতে পড়ে যেত ক্লার্ক। তাড়াতাড়ি বাইরে ছুঁড়ে ফেলল ভয়ঙ্কর কৌটা। নতুন উদ্যমে খুঁজতে লাগল অন্যকিছু। মেঝেতে পেল আরেকটা কৌটা। আগেরটার মতই জং ধরে গেছে এটার গায়ে। আবার লেবেলও নেই। ভেতরের জিনিসটাও বোধহয় বহু বছর আগে নষ্ট হয়ে গেছে।
তাতে কী! অন্তত একবার তো দেখা উচিত ভেতরে কী!
কৌটার ঢাকনি খুলে মারাত্মক দুর্গন্ধের জন্যে তৈরি হলো ক্লার্ক। গন্ধের আওতার বাইরে সরিয়ে নিল নাক। তবে ওটার ভেতর থেকে বাজে কোন কুবাস এল না।
কৌটার কাছে নাক নিল সে।
নাহ্, গন্ধটা তো বাজে লাগছে না!
কৌটার মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে ভেতরের জিনিসটা বের করে জিভে ঠেকাল। তাতে মায়ের কথা মনে পড়ে গেল ক্লার্কের।
ছোটবেলায় ওদের বাবার তেমন টাকা ছিল না বলে ভাল মাংস বাড়িতে আসত না। ওর মা তখন এ-ধরনের টিনবন্দি রান্না করা মাংস কিনে সেটা পাউরুটি, নুডল্স্ আর বাঁধাকপির সঙ্গে মিশিয়ে ওদেরকে খেতে দিত। তাতে কখনও কোন ক্ষতি হয়নি কারও।
কৌটার মাংস আশি বছর আগের হলেও এই মৃত্যুদ্বীপে ওটাই বা কে দিচ্ছে ক্লার্ককে!
সেই আগের মতই স্বাদ। মাংস খেতে পেয়ে ভাল লাগলেও মায়ের কথা ভাবতেই মন খারাপ হয়ে গেল ক্লার্কের। মার সামনে গিয়ে দাঁড়াবার সাহস আর নেই ওর। শেষবার যখন জেলখানায় গেল ক্লার্ক, দেখা করতে এসেছিল মা। আর তখন শপথ করে ও বলেছিল, নিয়মিত গির্জায় গিয়ে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে ওকে, আসলে কোন অপরাধই করেনি। কবে মানুষের মত মানুষ হয়ে গেছে সে সেটা আইনের লোকেরা জানেও না। সমাজের কল্যাণের জন্যে এখন হু-হু করে কেঁদে ওঠে ওর অন্তর। কিন্তু ক’দিন পর প্রমাণ হয়ে গেল, ড্রাগসের ব্যবসায় ওরই এক প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে খুন করেছে ক্লার্ক।
মায়ের সঙ্গে কথা বলার পরের সপ্তাহে সোলেড্যাড কারাগার থেকে ওকে ফোলসম জেলখানায় নেয়ার সময় দু’জন পুলিশকে আহত করে পালিয়ে গেল ও। একমাস আগে থেকেই জানত, সোলেড্যাড কারাগার বর্ণবাদীদের আস্তানা বলে ওকে সরিয়ে দেয়া হবে অন্য কোথাও। একই কুঠরিতে তখন ছিল বয়স্ক এক পাকা অপরাধী। সে ঠিক করে দিয়েছিল আমেরিকা থেকে মেক্সিকোতে গিয়ে তারপর কীভাবে মালোয়েশিয়া পালিয়ে যাবে ক্লার্ক। জাহাজে চেপে এশিয়ার দেশটাতে গিয়ে বুঝে গেল, সরকারের খুব কড়াকড়ি আছে ড্রাগের ব্যাপারে। তার কিছু দিনের ভেতরে ড্রাগের চালানসহ ধরা পড়ে গেল ক্লার্ক। আর তাতে আবার আদালত থেকে রায় দেয়া হলো ওর মৃত্যুদণ্ডের। আসলে কোন্ দেশে আছে, কখনও ভুলেও মাকে বলেনি ক্লার্ক, নইলে ভেঙে যেত মহিলার বুক। এমনিতেই বেচারি জেনে গেছে, সোলেড্যাড প্রিযন থেকে ভেগে গেছে তার ছেলে। আর এর মানেই নিজের মাকে একগাদা মিথ্যা বললেও অপরাধ-জগৎ থেকে কখনও বেরিয়ে আসেনি সে।
আর এখন এই দ্বীপে যে একদল খুনির সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হবে, সেটা জানলে তো মা হয়তো হার্ট অ্যাটাক করে মরেই যেত!
প্রাচীন মাংস চিবুতে চিবুতে দূর হলো ক্লার্কের সব চিন্তা। কিছুক্ষণ পর কৌটা খালি করে এনেছে, এমন সময় বিমানের পাশের ফাটল দিয়ে বাইরে চোখ গেল তার। ফিউজেলাজের সঙ্গে শরীর মিশিয়ে সাবধানে তাকাল। ভেতরের অন্ধকারে ভাল করেই সয়ে গেছে চোখ। চাঁদের ম্লান আলোয় বাইরে সব দেখা যাচ্ছে।
ভীত হরিণীর মত পা টিপে টিপে এগিয়ে চলেছে দক্ষিণ আফ্রিকান সুন্দরী রোযি ইয়াসিমান। চট্ করে একবার ঘুরে তাকাল বিমানের দিকে। মেয়েটার চেহারায় কোন ধরনের অনুভূতি দেখতে পেল না ক্লার্ক।
বাইরে থেকে তো আমাকে দেখার কথা নয়, ভাবল সে। ভুল করে একবার কাছে আসুক, খতম করে দেবে শালীকে।
বিমানের দিকেই এল রোযি। তারপর থমকে গিয়ে দ্বিধা করল। চাঁদের আবছা আলোয় দেখে মনে হচ্ছে ভয় পেয়েছে সে। যদিও ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে না। একটু পর ধীর পায়ে এল বিমানের দরজার দিকে।
ফিউজেলাজের দরজার কাছে চলে গেল ক্লার্ক। এখনও নিশ্চিত নয় মেয়েটাকে ধরতে পারলে কী করবে। তবে এটা ঠিক, সুযোগ পেয়ে পশুর মত ধরে ফেলে ধর্ষণ করবে না। হয়তো উচিত হবে সুন্দরীকে দলে টেনে নেয়া। ওরা একসঙ্গে লড়াই করলে হয়তো জিতে যাওয়া সহজ হবে অন্যদের বিরুদ্ধে। খাপ পেতে বিমানের ভেতরে অপেক্ষা করল ক্লার্ক।
.
বিমানে আশ্রয় নেবে বলে ভাবছে রোযি ইয়াসিমান। তাতে হয়তো কিছুক্ষণের জন্যে বুজতে পারবে দু’চোখ। তবে ক্লার্ক জানে না, ফিউজেলাজের ভেতরে কারও নড়াচড়া দেখে ফেলেছে সে। আর তখনই বুঝে গেছে, এখন ছুট দিলে নির্ঘাৎ বিমানের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে লোকটা ধেয়ে আসবে খুন করতে। ছোটবেলা থেকে পুরুষমানুষকে বোকা বানিয়ে বাঁচতে হয়েছে ওকে, তাই সহজেই বুঝে গেছে এখন বুদ্ধির কাজ ওর হবে লোকটাকে বুঝতে দেয়া, আসলে কিছুই জানে না ও।
আজ ভীতিকর যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, তাতে বিমানের ভেতরে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারত না, সেটা বুঝে গেছে রোযি ইয়াসিমান। হেলিকপ্টার থেকে ফেলে দেয়ার পর আরেকটু হলে দম আটকে মরত পানির নিচে। তারপর খুব কাছে চলে এল জার্মান হারামজাদা। আরেকটু হলে ধর্ষণের পর ওকে খুন করত শুয়োরটা। তাকে বোমা ফাটিয়ে খুন করার পর আর কোথাও ভুলেও থামেনি রোযি। একবারও ভাবেনি, জিতে যাবে এই অন্যায় প্রতিযোগিতায়। অবশ্য তাতে কী, ওর চেষ্টা করতে হবে বেঁচে থাকার জন্যে।
কান খাড়া করে রেখেছে সে। বুঝে গেছে, অলক্ষে কেউ না কেউ দেখছে ওকে। হরিণের মত এখন দৌড় দিলে বিমান থেকে বেরিয়ে ধাওয়া করবে লোকটা। তাতে মরতে হবে ওর।
পেছনে ঝোপঝাড় ও ঘাস সরে যাওয়ার খস খস শব্দ শুনতে পেল রোযি। পাঁজরে ধুপধাপ করে লাগছে ওর উত্তেজিত হৃৎপিণ্ড। ওটার অস্বাভাবিক আওয়াজ প্রায় তলিয়ে দিচ্ছে লোকটার পদশব্দ।
আমি ভুলেও দৌড়ে পালিয়ে যাব না, মনে মনে নিজেকে বলল মেয়েটা। কয়েক পা দূরে শুকনো একটা গাছ। এখনই ঘুরে দৌড় দিতে হবে, নইলে পরে আর নয়!
গাছ ঘুরে সামনে এগোল রোযি। আপাতত ওকে দেখতে পাচ্ছে না লোকটা। গাছের একটা ডাল দেখতে ওয়াকিং স্টিকের মত। মড়াৎ করে ওটা ভেঙে নিল রোযি। ভাবছে, কপাল ভাল হলে লোকটা ভাববে, শুকনো কোন ডালের ওপরে পা পড়তেই ভেঙে গেছে ওটা।
আবারও পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল রোযি।
এইমাত্র মরা গাছটা ঘুরে ওর দিকেই আসছে সে।
লোকটার দিকে নিজের পিঠ রেখে এগোচ্ছে রোযি। ধীর পায়ে চলেছে বিমানের দরজার দিকে। সামনের দিকে ধরে রেখেছে হাতের লাঠি। ওর মন বলে দিল, ঠিক কখন হামলা করতে হবে। মচমচ আওয়াজ তুলছে লোকটার বুট। এল শ্বাস ফেলার ফোঁস আওয়াজ। আততায়ী এত বেশি কাছে, তার গায়ের গন্ধ পেল রোযি। ঝড়ের বেগে ঘুরেই মাথার ওপরে লাঠি তুলে নামিয়ে আনল ক্লার্কের মাথার ওপরে।
ডালের বাড়ি সরাসরি লেগেছে যুবকের কাঁধের হাড়ের ওপরে। ঝটকা দিয়ে পিছিয়ে যেতে গিয়ে হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ে গেল সে। চিতার মত তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল রোযি। ডালের ডগা দিয়ে খোঁচা দিতে চাইল শত্রুর গলায়। কিন্তু এক হাতে লাঠিটা ধরে আরেক দিকে সরিয়ে দিল ক্লার্ক। ওর পাশে মাটিতে গেঁথে গেল লাঠির ডগা। ল্যাং মেরে নিজের পাশে মেয়েটাকে ফেলে দিল সে। লাফ দিয়ে উঠে বসে লাঠি তুলে তলোয়ারের মত ঠেকিয়ে দিল রোযির বুকে। তানাকার সঙ্গে লড়ার পর তার শিরায় বইছে অ্যাড্রেনালিনের স্রোত। দরকার হলে ভেঙে দেবে রোযির ঘাড়। হ্যাঙার বা হেলিকপ্টারের সেই মেয়ে এখন অন্য কেউ- যে কি না আসলে তার জন্মের শত্রু!
.
‘জলদি!’ উত্তেজিত হয়ে বলল স্টিল, ‘মেয়েটার দিকে ক্যামেরা তাক করো!’
মস্ত স্ক্রিনে চেয়ে আছে সিওয়ার্স ও এমিলি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে ক্লান্ত। কিন্তু এখনও আরও বহু ঘণ্টার শ্যুটিং বাকি।
ওদের কাছে গিয়ে থামল ব্র্যাড। প্রতিযোগিতায় কেউ বিজয়ী না হওয়া পর্যন্ত ঘুমাতে পারবে না সে। আপাতত বিশাল তাঁবুতে নেই রিটা। তবে এক সময়ে যে তার প্রতি ভালবাসায় আবারও ভরে উঠবে মেয়েটার বুক, তাতে মনে কোন সন্দেহ নেই স্টিলের। দুশ্চিন্তায় পড়েছে অন্য কারণে। তাই নিজে থেকে বলে দিয়েছে, যাতে বিশ্রাম করে সিলভি। এ-ছাড়া কোন উপায়ও ছিল না। ধর্ষণ করার পর যখন মেক্সিকান মেয়েটাকে খুন করল শ্যানন, তখন নাক-মুখ কুঁচকে আপত্তির চোখে ওকে দেখেছে সিলভি। যে-কোন সময়ে প্রতিবাদ করে উঠত।
ক্লার্ক ও রোযিকে বিমানের কাছে দেখে সিলভির ক্যামেরা বসাবার দক্ষতার প্রশংসা মনে মনে না করে পারছে না স্টিল। ব্যবহার করা হয়েছে সুপার ব্রাইট লেন্স ও নাইট-ভিশন সফটওয়্যার। সেজন্যে রাতের আঁধারেও দেখা যাচ্ছে কালো দু’জন মানুষের লড়াই। অবশ্য ডার্টি গেমের প্রতিযোগীরা নিজেদের ভেতরে লড়াই না করলে কোন কাজে আসবে না দামি টেকনোলজি।
মেক্সিকান মেয়েটাকে শ্যানন খুন করার পর বিকেলে মন্থর হয়ে গেছে শো। মারা পড়েনি আর কেউ। আগ্রহ তৈরি হবে এমন কোন ঘটনাও ঘটেনি। তবে ইংরেজ সাইকোর গুণে এখনও ওদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি দর্শকেরা। স্টিল এখন আশা করছে, নতুন করে শো-টা আবারও জমিয়ে দেবে ক্লার্ক ও ইয়াসিমান।
‘এবার বোধহয় কিছু ঘটবে,’ ক্লার্কের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বলল স্টিল। ‘সুন্দরী মেয়েটাকে খুন করলেই ভাল।’
.
ধস্তাধস্তি করে উঠে বসতে চাইছে ইয়াসিমান, তবে ক্লার্কের গায়ের জোর তার চেয়ে অনেক বেশি। মেয়েটা জানে, নাৎসির কাছ থেকে বেঁচে গেছে স্রেফ ভাগ্যের জোরে। আর এবার প্রাণে বাঁচতে হলে অলৌকিক কিছু ঘটতে হবে।
‘মাথা ঠাণ্ডা রাখো, তোমার ভয়ের কিছু নেই,’ লোকটাকে নরম সুরে বলতে শুনল ইয়াসিমান। ‘আমি তোমাকে খুন করব না।’
বুক থেকে চাপ কমে যেতেই বড় করে শ্বাস নিল মেয়েটা। এখনও ওকে মাটিতে ঠেসে ধরে রেখেছে ক্লার্ক।
‘আমি খুব ভয় পেয়েছি,’ কাঁপা গলায় বলল রোযি।
‘তোমার কোন ক্ষতি করব না। আমি শুধু চাই গোড়ালির এই বোমা খুলে ফেলতে।
‘আমাকে খুন করে ফেললে কি ওটা খুলে যাবে,’ ভয়ে ভয়ে বলল ইয়াসিমান।
দীর্ঘ দশ সেকেণ্ড ভেবে বলল ক্লার্ক, ‘তা নয়।’ মেয়েটাকে খুন করবে কি না ভাবতে গিয়ে সময় নিচ্ছে সে। একজন প্রতিযোগী কমে গেলে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। আর শেষমেশ যে মেয়েটা মরবে, সে-ও সত্যি। অন্যরা বেঁচে থাকলে কোনভাবেই প্রথম হতে পারবে না ক্লার্ক। আগেও দু’জন ড্রাগ ডিলারকে খুন করেছে সে। তবে কখনও কোন মেয়েকে হত্যা করেনি। অবশ্য পুরুষের চেয়ে মেয়েরা কম হিংস্র হলেও এমন নয় যে তারা কম ক্ষতিকর। ওর বোধহয় উচিত ঝুঁকি না নিয়ে এই সুন্দরীকে খতম করে দেয়া।
এই মেয়ে রীতিমত মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মত রূপসী হলেও খুনই করত ক্লার্ক, কিন্তু মনের ভেতরে বাধা হয়ে দাঁড়াল ওর মা। ওকে এখন দেখলে মা কী বলত-আত্মরক্ষা করার জন্যে পুরুষদের খুন করলেও দুর্বল ও অসহায় এক মেয়েকে কীভাবে তুই খুন করলি, ক্লার্ক?
এমনিতেই জীবনে নানান ধরনের পাপ করেছে সে।
আজ এই মেয়েকে অন্য কেউ শেষ করে দিলে সেই দায় এসে পড়বে না ওর ঘাড়ে।
সুতরাং অন্যের হাতেই মরুক মেয়েটা!
আবারও রোযির দিকে তাকাল ক্লার্ক।
মেয়েটার চোখদুটো মায়া হরিণীর মত। নাক বাঁশির মত খাড়া। কমলার টসটসে কোয়ার মত নিখুঁত ঠোঁট। চিবুক খুব সুন্দর।
‘হায়, যিশু, এত সুন্দরী মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি!’ মনে মনে বলল ক্লার্ক। আরও বড় কথা, কী যেন গোপনে ঘটে যাচ্ছে ওদের দু’জনের ভেতরে।
এটাই কি তা হলে মানব-মানবীর সত্যিকারের ভালবাসা?
এখন আর ভয়ে থরথর করে কাঁপছে না রোযি। শুয়ে আছে শরীর শিথিল করে। দেখছে ক্লার্কের চোখ। সুরেলা গলায় বলল সে, ‘তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো।’
‘এর আগে যে মেয়েকে বিশ্বাস করেছি, তার জন্যে আদালত থেকে আমার ফাঁসির রায় হয়েছিল,’ ভুরু কুঁচকে বলল ক্লার্ক।
একফোঁটা মিথ্যা কথা বলেনি। মালোয়েশিয়ায় প্রতিযোগী এক ড্রাগ ডিলারকে খুন করে সেটা বলে ফেলেছিল গার্লফ্রেণ্ডের কাছে। একটা স্ট্রিপ ক্লাবে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ওর। পরে জানা গেল ক্লার্কের ব্যবসা আরও বড় হচ্ছে দেখে অন্য দলের ডিলার টাকার বিনিময়ে ওর সঙ্গে ভিড়িয়ে দিয়েছিল মেয়েটাকে। প্রেমের দুর্দান্ত অভিনয় করত বেটি। বোকার মত কুত্তীটার প্রতিটা কথা বিশ্বাস করে বসেছিল ক্লার্ক। এরপর আর কখনও একই ভুল করবে না। সবসময় খুলে রাখবে চোখ।
অপরূপ সুন্দরী রোযির দিকে সতর্ক চোখে চেয়ে আছে ক্লার্ক। হালকা শরীরটা থেকে সরে যেতেই উঠে বসল রোযি ইয়াসিমান।
.
‘হায় হায়, মেয়েটাকে তো দেখি ছেড়ে দিচ্ছে!’ আপত্তির দৃষ্টিতে স্ক্রিনের দিকে চেয়ে আছে সিওয়ার্স।
বারকয়েক মাথা নাড়ল এমিলি। ‘আমাদের কপাল বোধহয় আসলেই মন্দ।’
রাগে গরম হয়ে উঠেছে স্টিলের মাথা। ‘কী হলো, কালো কুত্তাগুলোর সমস্যাটা আসলে কী? ওরা কি দ্বীপটাকে ফ্রেণ্ডশিপ রিসোর্ট বলে ভাবতে শুরু করেছে? এদের কি বাঁচার কোন আগ্রহ নেই?’
বস্ খেপে গেছে সেটা বুঝতে পেরেছে সিওয়ার্স। যে- কোন সময়ে বাজে গালি বেরোবে স্টিলের মুখ থেকে। আগেও মেজাজ খাট্টা হওয়ায় ঘাড় ধরে দলের এক লোককে তাঁবু থেকে বের করে দিয়েছিল। দেরি করেনি চাকরি নট করতে। আপাতত স্টিলের গুড বুকে সিওয়ার্স থাকলেও পাঁচ মিনিট পর সেটা না-ও থাকতে পারে। সাবস্ক্রিপশন পেজ বের করে ভাল সংবাদ দিতে পারে কি না, সেটা দেখল সে।
এরই ভেতরে দিন হয়ে গেছে দুনিয়ার নানান জায়গায়। আর তার মানেই বাড়ছে অনলাইনের গ্রাহক।
‘এত ভাববেন না, বস্। এরই ভেতরে শো দেখার জন্যে টাকা দিয়ে লগ ইন করেছে বিশ মিলিয়ন ভিউয়ার।’
তথ্যটা একটু শান্ত করল স্টিলকে। শুকনো গলায় বলল সে, ‘এখন পর্যন্ত মাত্র অর্ধেক লোক আমাদের শো দেখছে। আমার আরও অনেক দর্শক চাই।’ স্ক্রিনে চেয়ে ভাবল, একঘণ্টার ভেতরে কেউ খুন না হলে ডার্টি গেম বাঁচাতে কারও না কারও জান নিতে হবে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন