কাজী আনোয়ার হোসেন
রুপার্ট শ্যানন আর কাইতো তানাকা যেন পিছু নিতে না পারে, সেজন্যে আলেক্যান্দ্রো আলকারাযকে নিয়ে পর পর দু’বার অগভীর এক নদী পার হয়েছে মাসুদ রানা। একটা গাছের ডাল ভেঙে যুবকের হাতে দিয়েছে, যাতে লাঠি হিসেবে ওটা ব্যবহার করে হাঁটতে পারে সে। আহত সৈনিকের মত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে চলেছে মেক্সিকান লোকটা। রানা জানে, পিছু নিয়েছে ব্রিটিশ প্রাক্তন মেজর ও জাপানি খুনি। দ্রুত হেঁটে আসছে তারা। তাদের কাছ থেকে বাঁচাতে হলে ‘গোপন কোন নিরাপদ জায়গায় আলকারাযকে রেখে যেতে হবে। তারপর আবার রওনা হতে হবে ওয়েদার টাওয়ারের দিকে। তখন ইচ্ছে করে রেখে যাবে নিজের ট্র্যাক। সেক্ষেত্রে হয়তো দুই নৃশংস খুনির কবল থেকে প্রাণে বেঁচে যাবে আলকারায। মেক্সিকান লোকটা যে শেষমেশ মারা পড়বে, মনে কোন সন্দেহ নেই রানার। ভাবছে, ইংরেজ পিশাচ ও তার নরপশু সঙ্গীর হাতে প্রচণ্ড নির্যাতনে খুন হওয়ার চেয়ে বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু আলকারাযের জন্যে ঢের আনন্দের।
ওরা এখন কোথায় আছে সেটা জানে না, শ্যানন ও তানাকা। আলকারাযকে নিয়ে ছোট এক টিলায় উঠল রানা। ওপর থেকে তাকাল চারপাশে। মাত্র একমাইল দূরে বড় এক গিরিখাদের ওদিকে দেখতে পেল ওয়েদার টাওয়ার। চাঁদের রুপালি স্নিগ্ধ আলোয় চকচক করছে ওটার টিনের ছাত। এত কাছে পৌঁছে গেছে বুঝতে পেরে মনে স্বস্তি বোধ করল রানা। কিন্তু ঠিক তখনই মনে পড়ল জরুরি একটা বিষয়। কালো মেঘে ছেয়ে গেল ওর অন্তর। যেটা নিয়ে ভাবছে, ওটার জন্যে হয়তো বানচাল হয়ে যাবে ওর প্ল্যান। গোড়ালির ব্রেসলেটের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল রানা। আগেই ওটার কথা ওর ভাবা উচিত ছিল।
ডিভাইসটার সঙ্গে আছে জিপিএস। শত্রুপক্ষ জানে দ্বীপের কোথায় আছে ও। রাত বা দিনে যেখানেই থাকুক, তারা জেনে নিতে পারবে কোনদিকে চলেছে ও। সুতরাং নিজের পরিকল্পনা মত কাজ করতে হলে আগে বিকল করতে হবে জিপিএস। এর আগে লুকিয়ে থাকার মত জায়গা খুঁজে বের করতে হবে আলকারাযের জন্যে।
অন্ধকারে চারপাশে তাকাল রানা। উঁচু-নিচু টপোগ্রাফি ছাড়া তেমন কিছুই বুঝতে পারল না। বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে ঘন জঙ্গল। ওখানে রয়ে গেলে আগে হোক বা পরে ওদেরকে খুঁজে বের করবে শ্যানন ও তানাকা।
গিরিখাদের দিকে চেয়ে রইল রানা। দূরে ঝোপঝাড়ের ভেতরে দেখতে পেল পুরনো এক কাঠের সেতু। ওর মনে হলো সরু সেতু দিয়ে যেতে পারবে কোন জিপ। গিরিখাদ একবার পেরোলে ওদিকে অপেক্ষাকৃত ঘন ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে পড়তে পারবে আলকারায।
মেক্সিকান ডাকাতকে সঙ্গে নিয়ে টিলা থেকে নেমে সেতুর দিকে চলল রানা। চেষ্টা করছে ট্র্যাক আড়াল করে এগোতে। সেতুর কাছে গিয়ে দেখতে পেল, মর্টারের শেল মেরে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে ওটার মাঝের অংশ। ওদিকের স্ট্রাকচার ও এদিকের অংশের মাঝে ঝুলছে জং-ভরা কিছু সাপোর্ট কেব্ল্। যদিও ওগুলো বেয়ে ওদিকের তীরে আলকারাযকে নেয়া যাবে না।
সতর্ক চোখে চারদিকে আবারও তাকাল রানা। ভাবছে, এখানে কেন তৈরি করা হয়েছে এই সেতু? নিশ্চয়ই কাছে ছিল কোন সামরিক স্থাপনা। আর ওটা দখল করতে সেতুর ওপরে বোমা ফেলেছে মিত্রপক্ষ।
আরও পঞ্চাশ গজ যাওয়ার পর রানা দেখতে পেল, জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহের এক ডকের কাছে কংক্রিটের দালান। ওটার পেছন অংশ গিরিখাদের দিকে। ডকের কাছে উঁচু করে রাখা আছে কাঠের অসংখ্য ক্রেট। জায়গাটা আলকারাযকে লুকিয়ে রাখার জন্যে উপযুক্ত বলে মনে হলো ওর। হয়তো দালানের ভেতরে এখনও রয়ে গেছে কোন অস্ত্র।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে কমাণ্ড পোস্টের কাছে চলে গেল রানা। আলকারাযকে সাহায্য করল লোডিং ডকের পাশে বসতে। ঢোলের মত ফুলে গেছে যুবকের ভাঙা হাঁটু। বোধহয় সহ্য করছে প্রচণ্ড ব্যথা।
‘ভাঙা হাঁটুর কী অবস্থা?’ জানতে চাইল রানা।
‘হাঁটতে পারছি না, লড়তেও পারব না,’ মুখ বিকৃত করে বলল আলকারায। চোখ তুলে তাকাল রানার চোখে। ‘লাঠিতে ভর করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আমার হয়ে ওদেরকে খুন কোরো তুমি। এটা আমার একান্ত অনুরোধ।’
স্ত্রী-হত্যার প্রতিশোধ নেবে ভাবছে যুবক। তবে তাকে কোন ধরনের প্রতিশ্রুতি বা সান্ত্বনা দিল না রানা। শ্যানন ও তানাকাকে খুন করতে গিয়ে সময় নষ্ট করা ওর উদ্দেশ্য নয়। যেভাবে ‘হোক ওয়েদার টাওয়ারে গিয়ে যোগাযোগ করতে হবে বিসিআই-এ। ‘আপাতত তোমার অনুরোধ রাখতে পারছি না,’ আলকারাযকে বলল রানা, ‘আরও জরুরি একটা কাজ আমাকে করতে হবে।’
‘সেটা কী?’
‘দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমে ওয়েদার টাওয়ার দেখেছি। ওখানে রেডিয়ো থাকার কথা। ওটা ব্যবহার করব।’
ক্ষণিকের জন্যে উজ্জ্বল হলো আলকারাযের মুখ। ‘তুমি রেডিয়োর মাধ্যমে কারও কাছে সাহায্য চাইবে?’ বুঝে গেছে যে বেঁচে থাকার আরেকটা কারণ তৈরি করেছে বাঙালি যুবক।
‘অন্তত চেষ্টা তো করবই,’ বলল রানা।
মাথা দোলাল আলকারায। ইসাবেলাকে ছাড়া অর্থহীন হয়ে গেছে তার জীবন, তাই কখনও সুযোগ পেলে শ্যাননকে নিজের হাতে হত্যা করবে সে।
‘কাকে রেডিয়ো করবে তুমি?’
চুপ করে থাকল রানা।
‘তোমার বউ আছে? তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে?’
আলকারাযের দিকে তাকাল রানা। একটু আগে নিজের চোখে যুবক দেখেছে তার স্ত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে এক নরপশু। নরম সুরে বলল রানা, ‘আমার আত্মীয় বলতে আর কেউ নেই। তবে কিছু বন্ধু-বান্ধব আছে। আমার কিছু হলে খুঁজে বের করে ব্র্যাড স্টিলকে খুন করবে ওরা। এখন যদি সম্ভব হয়, তা হলে আমার বসের সঙ্গে যোগাযোগ করব।’
‘তোমার কপাল ভাল, জীবনে বিশ্বাস করার মত কিছু বন্ধু পেয়েছ,’ দূরে তাকাল আলকারায, ‘আমার তো আর কেউই রইল না। ডাকাতির দায়ে খুঁজছে পুলিশ, এমন সময় আকাপুলকোর এক পতিতালয়ে পরিচয় হয়েছিল ইসাবেলার সঙ্গে। নিজের অসুস্থ মা আর ছোট বোনের জন্যে দেহ দান করতে বাধ্য হতো ও। ওখান থেকে ওকে সরিয়ে নিয়ে বিয়ে করেছিলাম। কয়েক মাস পর ওকে বললাম, তুমি যদি রিভলভার চালাতে পারো, তো দু’জন মিলে আমরা অনেক টাকার মালিক হতে পারব। খুব দ্রুত সব শিখে নিল ও।’
নিজের মনে ডুব দিল আলকারায। একটু পর ঠোঁটে ফুটে উঠল তিক্ত এক চিলতে হাসি। ‘একের পর এক ডাকাতি করেছি আমরা। কিন্তু ইসাবেলা যখন আর দুনিয়ায় নেই, তাই আমি আসলেই জানি না এরপর কী করব।’
.
অন্ধকারে লোডিং ডকের পাশে এক ভিডিয়ো ক্যামেরা আছে, যেটা দেখতে পায়নি রানা ও আলকারায।
বিশাল তাঁবুর মস্ত এলইডি স্ক্রিনে ওদেরকে দেখছে ব্র্যাড স্টিল। কুঁচকে গেছে তার ভুরু। চট্ করে বদলে গেল দৃশ্যটা। এখন দেখা যাচ্ছে শ্যানন ও তানাকাকে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মত জঙ্গলে হেঁটে চলেছে তারা।
স্ক্রিনে এল তৃতীয় দৃশ্য। পরস্পরের হাত ধরে বিধ্বস্ত বি- ২৫ বিমানের দিকে চলেছে ক্লার্ক ও ইয়াসিমান।
সত্যি কথা বলতে শো-তে নতুন আর কিছুই ঘটছে না।
বাইরে থেকে ঘুরে এসে আবার কন্সোলে বসেছে সিলভি। আগের চেয়ে সুস্থ। ভাবছে, কপাল ভাল যে কারও হাতে খুন হতে হচ্ছে না কাউকে। ‘আসলে এই দ্বীপে ঘটছেটা কী?’ আনমনে বলল সে।
‘কিছুই ঘটছে না,’ বলল সিওয়ার্স। ‘লড়ছে না কেউ।’
‘বাজে অবস্থা,’ বলল বিরক্ত স্টিল। ‘সিওয়ার্স, দেখো তো এরা পরস্পরের কতটা কাছে?’
সিওয়ার্স দেখল গ্রিড ম্যাপ। ওটার ভেতরে আছে + চিহ্ন দেয়া সবার অবস্থান।
‘এইমাত্র ভাঙা বিমানে গিয়ে ঢুকেছে ক্লার্ক আর কেলে সুন্দরী। এদিকে জাপানি ধ্বংসস্তূপের কাছে রানা আর আলকারায।’
‘সেটা তো দেখতে পেয়েছি,’ প্রায় খেঁকিয়ে উঠল স্টিল। ‘কিন্তু শ্যানন আর তার সঙ্গী এখন কোথায়? ওদের কাছ থেকে কতটা দূরে অন্যরা?’
উত্তেজনা তৈরি করার জন্যে ইংরেজ সাইকোর ওপরে নির্ভর করছে স্টিল। খুনি লোকটা বোঝে কীভাবে ক্যামেরা নিজের দিকে টেনে নিতে হয়। সে সাধারণ কোন খুনি নয়, সত্যিকারের এক পাকা অভিনেতা।
রানা ও আলকারাযের কাছ থেকে সামান্য দূরে এক জোড়া + চিহ্ন ব্র্যাডকে দেখাল সিওয়ার্স। ‘এই যে ওরা। রানা আর আলকারায থেকে সামান্য পুবে।’
পঞ্চম কফির মগ খালি করেছে সিকিউরিটি চিফ সিম্পসন। তার সামনে গিয়ে থামল স্টিল। মনস্থির করেছে, এবার নতুন করে প্রতিযোগীদের ভেতরে বাধিয়ে দেবে লড়াই।
‘আমাদের তরফ থেকে শ্যাননের কাছে আরেকটা ক্রিসমাস ব্যাগ পৌঁছে দাও,’ নিচু গলায় বললেও ব্র্যাডের কথা শুনতে পেল সিলভি। ‘দরকারি সব মালপত্র পৌঁছে দেবে, যাতে জাপানি ধ্বংসস্তূপে গিয়ে হামলা করতে কোন ধরনের অসুবিধে না হয় ওদের।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন