ডার্টি গেম – ৯

কাজী আনোয়ার হোসেন

নয়

চপার থেকে পড়ে যেতেই দুনিয়াটাকে বনবন করে ঘুরতে দেখছে রানা। চারদিকে নীল, সবুজ, তামাটে ও সাদা রঙের খেলা। বিশ্বের চারভাগের একভাগ নীল আকাশ। পরের ভাগ সবুজ জঙ্গল। তৃতীয় অংশ তামার তৈরি। আর শেষে আছে ঝলমলে সাদা সৈকত। বহু ওপর থেকে বালির ঢিবিতে পড়লে হাড়গোড় বোধহয় একটাও আস্ত থাকবে না, ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল রানার। তারপর হঠাৎ করেই ভুস্ করে বুক থেকে বেরোল সব দম। বালির ঢিবিতে পতন হতেই গড়াতে গড়াতে ফুটবলের মত নেমে চলল ও। হাত-পা বেড়ি ও হ্যাণ্ডকাফে আটকানো বলে গড়িয়ে যাওয়ার গতি হ্রাস করতে পারছে না। শক্ত করে বুজে রেখেছে চোখ-মুখ। জানে না শেষমেশ কোথায় গিয়ে থামবে।

আরও দশ সেকেণ্ড পর ঢিবি থেকে নেমে সমতল জমিতে এসে থামল রানা। মুখের ভেতরে ঢুকে গেছে কর্কশ বালি। থুথু করে ওগুলো ফেলতে চাইল। চোখ মেলে দেখল মাত্র দশ ফুট দূরে সৈকতে প্রায় ডুবে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জং-ধরা এক উইলি জিপ। ওটা মিত্র বাহিনী ও অক্ষ বাহিনীর যুদ্ধের সাক্ষী। গায়ে জোয়ারের দাগ। জিপটার কারণে রানার মনে পড়ে গেল দ্বীপের সেই ওয়েদার টাওয়ারের কথা। একবার ওখানে গেলে হয়তো যোগাযোগ করতে পারবে বিসিআই হেডকোয়ার্টারে।

পায়ের শেকলের দিকে তাকাল রানা। চাবি ছাড়া কোনভাবেই খুলবে না বেড়ির তালা বা হ্যাণ্ডকাফ। বুঝে গেল, হেলিকপ্টারে সিম্পসনের থুতনিতে কনুইয়ের গুঁতো দেয়া বুদ্ধির কাজ হয়নি। গোড়ালির ব্রেসলেটের ওপরে থামল ওর চোখ। টাইম বমের ডিজিটাল ক্লক বলছে: আজ সোমবার, ২৬:৩২:০৫ মিনিট।

আশপাশে এখন কেউ নেই। উঠে বসে বোমার ওয়াএয়ার ও প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভের হাউসিং পরখ করে দেখল রানা। যেহেতু অভিজ্ঞ বোমা বিশারদ, তাই সহজেই বুঝে গেল মিথ্যা বলেনি সিম্পসন। ঠিক যন্ত্রপাতি থাকলেও ডিযআর্ম হবে না এই বোমা। ওয়াওয়ারলেস হোস্ট প্রোগ্রাম বা বিশেষ কোন চাবিও ওর কাছে নেই।

মনে পড়ল শ্যাননের কথা। ইংরেজ সাইকোপ্যাথ বোধহয় ভেবেছে সবাইকে খুন করলে মুক্তি পাবে সে। চালাক লোক, সাগরে নেমে সহজেই খুলে নেবে নিজের হাত-পায়ের তালা। খুশিমনে নেমে পড়বে মানব-হত্যার খেলায়। এদিকে হাতে-পায়ে বেড়ি ও হ্যাণ্ডকাফ নিয়ে তার সঙ্গে দেখা হলে একমিনিটে খুন হবে রানা!

.

বিশাল তাঁবুর মেইন স্ক্রিনে রুপার্ট শ্যাননকে দেখছে সবাই। ব্রডকাস্ট করা হচ্ছে দৃশ্যটা। শুধু তাই নয়, রানা ছাড়া অন্য আটজনকে দেখানো হচ্ছে ক্যামেরার ফিডব্যাক থেকে। মেইন স্ক্রিনে অন্যদের দেখলেও রানাকে খুঁজে পাচ্ছে না পরিচালক ও প্রযোজক স্টিল। ভুরু কুঁচকে মস্ত স্ক্রিন দেখল সে, তারপর সিলভির দিকে চেয়ে বলল, ‘বাঙালিটা কোথায়?’

সব ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল দেখা যাচ্ছে বিশেষ এক স্ক্রিনে। ওখান থেকে বালির ঢিবির একটা দৃশ্য বেছে নিল সিলভি।

ক্যামেরাটা দেখাচ্ছে জং-ধরা জিপের পাশে রানা।

‘বালির ঢিবি টপকে ওদিকে গিয়ে পড়েছে সে।’

কন্সোলের একটা বাটন টিপে মস্ত স্ক্রিনে রানাকে আনল সিলভি। দুই সেকেণ্ড পর শর্ট কাট করে বেছে নিল কাছের এক অ্যাঙ্গেল। লেন্সটা আছে জিপের ভেতরে।

ভুরু কুঁচকে গেল স্টিলের। ‘ওর হ্যাণ্ডকাফ আর বেড়ি খুলে দেয়া হয়নি কেন?’

‘পড়বার সময় বোধহয় হারিয়ে গেছে এর চাবি,’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল সিলভি।

বন্ধুর সঙ্গে একমত নয় ব্র্যাড। ভাবল, সময় মত এ- বিষয়ে জানতে চাইবে সিম্পসনের কাছে। এটা বুঝে গেছে, বড় ধরনের বিপদে আছে মাসুদ রানা। অবশ্য তার মানে এমন নয় যে, খেলা থেকে বাদ পড়ে গেছে সে। চিরকাল নিজের শো-র জন্যে সেরা লোক বেছে নিয়েছে স্টিল। প্রতিভা চেনার অদ্ভুত এক গুণ আছে তার। ভাল করেই জানে, বিপদে লড়াই করতে দ্বিধা করবে না রানা।

স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে সিওয়ার্সের দিকে তাকাল স্টিল। ‘সিওয়ার্স?’

নিজের প্যানেলে দ্বীপের কমপিউটার গ্রাফিক ইমেজ নিয়ে ব্যস্ত যুবক। দক্ষিণে আছে নয়টা + চিহ্ন। সেগুলো নড়েচড়ে বলে দিচ্ছে কারা আছে ওখানে।

‘ওরা আছে দক্ষিণে, সময় মত যে-যার মত খুঁজে নেবে নিজেদের।’

‘গুড। সিলভি, আমাদের কৃষ্ণ-সুন্দরী আর নাৎসির বেলায় কী ঘটছে?’

‘মিলা, দেরি না করে স্প্লিট স্ক্রিনে যাও,’ টেকনিশিয়ানকে বলল সিলভি।

স্ক্রিন দুই ভাগ হয়ে দেখা দিল দুটো দৃশ্য।

ডানের ছবিতে রোযি ইয়াসিমান, বামেরটায় নাৎসি।

দু’জনের চেহারা ও দৈহিক আচরণ থেকে যে-কেউ বুঝবে, কে আসলে শিকারি আর কে হচ্ছে শিকার।

এদিকে-ওদিকে চেয়ে হনহন করে হেঁটে চলেছে মেয়েটা। ঝোপের ভেতর দিয়ে সরাসরি ওদিকেই চলেছে স্লাইডার।

ওদিকে দিকহীনভাবে হাঁটছে রোযি। সাগর বা নদীর বানে ভেসে আসা বিশাল এক গাছের ডালপালা সরিয়ে এগোল সে। পাঁচ সেকেণ্ড পর একই গাছের শাখার কাছে পৌঁছে গেল নাৎসি স্লাইডার। সাপের মত নিঃশব্দে চলেছে। বুঝে গেছে, সামান্য দূরেই আছে মেয়েটা।

একটু দূরের সাদা সৈকত একদম নির্জন। উপকূলে মৃদু চুমু দিচ্ছে ছোট সব ঢেউ। সাগরের হাওয়া এসে বারবার দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে পাম গাছগুলোকে। আপাত শান্ত এই পরিবেশে নিজেকে একা আর নিরাপদ বলে ভাবছে রোযি। মাথার ওপরে কী যেন গুনগুন করে উঠতেই মুখ তুলে চেয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল সে। একটু দূরের দুই গাছের মাঝ দিয়ে উপসাগরের দিকে গেছে একটা কেব্‌ল্। ওটা থেকে ঝুলছে চারটে গুচ্ছ ক্যামেরা। সরসর করে এসে থামল রোযির মাথার ওপরে। ওর মনে হলো, অস্বাভাবিক কী যেন এবার ঘটবে!

ক্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে সৈকতে তাকাল রোযি। এইমাত্র এক শ’ গজ দূরে বড় এক পাথরের ওদিকে লুকিয়ে পড়েছে জাপানি খুনি কাইতো তানাকা। ভয়ে শুকিয়ে গেল রোযির গলা। লোকটা আবার ওকে দেখে ফেলেনি তো? আর ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না, ওর উচিত এখান থেকে সরে যাওয়া।

ঘুরে দৌড় দেবে ভেবেছে রোযি, এমন সময় ধক্ করে উঠল ওর হৃৎপিণ্ড। মাত্র ছয় ফুট দূরে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে হাসছে নাৎসি স্নাইডার!

শ্বাস আটকে ফেলে ঘুরেই অন্যদিকে ছুটল রোযি।

.

‘অ্যাকশন! শুরু হয়ে গেছে ওদের লড়াই!’ খুশি হয়ে মস্ত তাঁবুর ভেতরে চেঁচিয়ে উঠল ব্র্যাড স্টিল। ‘এবার জমবে খেলা!’

উধাও হলো স্প্লিট স্ক্রিন। এখন একই পর্দায় দেখা যাচ্ছে দুই অসম প্রতিযোগীকে। সৈকতের দিকে ছুটছে রোযি, আর তার পিছনে ধেয়ে যাচ্ছে স্লাইডার। ওদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরসর করে এগোচ্ছে সিলভির কেবলের ক্যামেরা।

‘আরও ভাল করে দেখাও!’ চিৎকার করে উঠল স্টিল। ‘ওদিকে তোমার আর কোন ক্যামেরা নেই?’

‘এইটিন, টোয়েন্টি, থার্টি-ওয়ান, ‘থার্টি-ওয়ান,’ টেকনিশিয়ানকে জানাল সিলভি, ‘প্রতিটি ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল ঠিক আছে। আমরা আছি টোয়েন্টির সঙ্গে।’

রোমি ও স্নাইডারের সঙ্গে কেব্‌ল্ বেয়ে চলেছে ক্যামেরা। মেয়েটা হরিণীর বেগে ছুটলেও দৌড়ে নাৎসি যথেষ্ট পারদর্শী। মরিয়া হয়ে উঠেছে সুন্দরী মেয়েটাকে ধর্ষণ করতে। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পর মাটিতে রোযিকে পেড়ে ফেলল সে। ওর বাম গালে বসাল ডানহাতি জোরালো এক ঘুষি।

ক্যামেরার নানা অ্যাঙ্গেল ইন্টারকাট করছে সিলভি। একই সময়ে ডিসপ্লেতে মাউসের ক্লিক দিয়ে উপজাতিদের প্রার্থনার সুরেলা এক মন্ত্র বাজিয়ে দিল এমিলি।

‘দারুণ!’ চেয়ারে সোজা হয়ে বসল স্টিল। ‘আরও কাছ থেকে ছবি নাও, সিলভি! কিছু যেন বাদ না পড়ে!’

দৃশ্য ধারণে মন রাখতে গিয়ে ভুরু কুঁচকাল সিলভারম্যান। ‘একটা কথা, ব্র্যাড, তুমি ষাঁড়ের মত চেঁচালে মনোযোগ আমার বাড়বে না। মনে হবে সব ছেড়ে পালিয়ে যাই!’

‘এমিলি, মন্ত্রের সঙ্গে চলুক জাঙ্গল মিউযিক!’ নির্দেশ দিল স্টিল। ‘তাতে আরও বাড়বে উত্তেজনা!’

.

সৈকতে মরা এক গাছের ডাল ধরে স্লাইডারের তলা থেকে হাঁচড়েপাঁচড়ে বেরিয়ে আসছে রোযি। ভয়ে গলার কাছে এসে লাফ দিচ্ছে ওর হৃৎপিণ্ড। মনে পড়েছে ছোটবেলায় ধর্ষিত হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা। চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছে খুন করে ফেলা লোকগুলোর বিকৃত চেহারা। প্রথমবার যখন ধর্ষিত হলো, তার আগে লুকিয়ে পড়েছিল বিছানার নিচে। এখনও মরা গাছের ডালপালার নিচে আছে সে। দুই গোড়ালি ধরে হিড়হিড় করে টেনে বের করা হচ্ছে ওকে। বারো বছর বয়সে যে-লোক ধর্ষণ করেছিল, সে ছিল ওরই মায়ের গোপন প্রেমিক। পাপোশ খামচে ধরেও বিছানার নিচে লুকিয়ে থাকতে পারেনি রোযি। এখন দু’হাতের দশ আঙুলে খামচে ধরেছে বালি। মায়ের প্রেমিক বিছানার তলা থেকে টেনে বের করে ওকে চিত করে শুইয়ে একের এক এক চড় দিয়েছিল গালে। কাঁদতে শুরু করলে ছিঁড়ে নিয়েছিল ওর ব্লাউয। এখন তার চেয়েও অনেক বড় বিপদে আছে রোযি। নাৎসি লোকটা ভোগ করার পর হাসতে হাসতে খুন করবে ওকে!

ডেরেকের বয়স পঞ্চাশ হলেও শরীরে অসুরের শক্তি। বারবার ঘুষি মারছে রোযির তলপেট ও ঊরুর ওপরে। ওকে গাছের তলা থেকে বের করে এনে উঠে দাঁড়াল লোকটা। শুরু হলো একের পর এক লাথি রোযির পাঁজরে। আত্মরক্ষা করার জন্যে লোকটার পায়ে খামচি মেরে পিছিয়ে যেতে চাইছে ও।

নিরীহ দেখালেও শরীরে বেশ শক্তি আছে রোযির। অবশ্য সেটা কিছুই নয় স্লাইডারের তুলনায়। লোকটার প্রচণ্ড এক ঘুষি বুকে লাগতেই প্রায় উড়ে গিয়ে ঝোপের ভেতরে পড়ল রোযি। ব্যথা পেয়েছে ভীষণ। ওর মনে হলো অচেতন হয়ে গেলেই বুঝি ভাল ছিল। তাতে শেষ হতো কষ্টের এই জীবন। এসব ভাবলেও মনের জোরে নিজেকে সামলে নিতে চাইল মেয়েটা।

ক্ষুধার্ত নেকড়ে যেমন দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে আহত খরগোশের দিকে তাকায়, সেভাবে রোযিকে দেখছে ডেরেক। প্রচণ্ড যৌন-লালসায় ঠোঁটের কশ বেয়ে নামছে লালা। মেয়েটাকে ভোগ করার পর খুশিমনে খুন করবে। অন্য জাতির কোন মেয়েকে বাগে পেলে মিলিটারি জীবনে ধর্ষণের পর খুন করত। তাদের বিকৃত লাশ দেখে কেউ বুঝত না দেখতে আগে কেমন ছিল বেচারি। ছোরা দিয়ে জবাই করার শখ ছিল স্লাইডারের। আর তাই ধরা পড়ার পর নাম হয়ে গিয়েছিল ‘কসাই’।

ইস্পাত নীল চোখে এখন রোযিকে দেখছে সে। ভাবছে, যৌন-মিলনের পর মেয়েটাকে গলা টিপে মারলে কেমন হয়!

.

বিশাল তাঁবুর ভেতরে মস্ত স্ক্রিনের দিকে চেয়ে আছে সবাই। কারও মুখে কোন রা নেই। বুঝে গেছে, চোখের সামনে দেখতে হবে মেয়েটাকে ধর্ষণের পর খুন করছে স্নাইডার। হাঁ হয়ে গেছে ক’জন। অন্যদের মনে কাজ করছে অপরাধবোধ।

‘এসব মারাত্মক ফুটেজ,’ ঢোক গিলল সিওয়ার্স।

‘সত্যিই খুব ভীতিকর,’ সায় দিল এমিলি।

এসব দৃশ্য এতই আপত্তিজনক ও অসুস্থকর, স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছে রিটা। তিক্ত মনে ভাবছে, আর কতক্ষণ এই ভয়াবহ দৃশ্য দর্শকদের দেখাবে ব্র্যাড!

স্ক্রিনের দৃশ্য যেন গপগপ করে গিলছে স্টিল। হঠাৎ করে ঘুরে দেখল, চরম আপত্তি ফুটে উঠেছে রিটার মুখে।

অনুষ্ঠান শেষ হলে নানান দেশে হাজার হাজার সাংবাদিক বলবে, সত্যিকারের জঘন্য এক জানোয়ার এই ব্র্যাড স্টিল। কেউ কেউ হয়তো নেবে আইনের আশ্রয়। কিছু দেশের সরকার চাইবে, যাতে ভবিষ্যতে এ-ধরনের কোন শো কেউ আর তৈরি করতে না পারে। মনে মনে হাসল ব্র্যাড, রাজনীতিবিদ, বিচারক, জুরি বা সমালোচকেরা যা-ই বলুক, দেখার মত শো তৈরি করছে ও। এরপর আর কখনও বক্স অফিস নিয়ে ভাবতে হবে না। ধর্ষণ-দৃশ্য দেখে কোটি কোটি দর্শক বলতে বাধ্য হবে, আর কখনও এমন শো দেখিনি।

সুতরাং কোনভাবেই এখন বন্ধ করা যাবে না এই শো।

.

সাপের মত পিছলে এসে রোযির বুকে উঠে পড়েছে স্নাইডার। দু’হাতে খামচে ধরেছে সুন্দরী মেয়েটার ট্যাঙ্ক টপ। এবার ফড়ফড় করে ছিঁড়ে নেবে সংক্ষিপ্ত পোশাক।

কৈশোরের সেই ধর্ষকের মুখ যেন চোখের পাতায় দেখছে রোযি। ছোটবেলায় খুব ভয় পেয়েছিল। কিছু করার ছিল না তখন। পরে বড় হয়ে শিখে নিয়েছে শুয়োরগুলোকে কীভাবে ঠেকাতে হবে। রাগ ও ক্ষোভ ঝাড়তে গিয়ে দু’হাতে ডেরেকের অণ্ডকোষ ধরে হ্যাঁচকা টান দিল রোযি।

তাতে বিকট এক আর্তচিৎকার ছেড়ে প্রায় অবশ হয়ে গেল জার্মান খুনি। আর এ-সুযোগে হাঁচড়েপাঁচড়ে তার তলা থেকে বেরিয়ে এল রোযি। ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড় দেবে, কিন্তু তার আগেই আবারও খপ্ করে ওর কবজি ধরল ডেরেক। ডানহাতি জোর এক ঘুষি মারল রোযির বুকে। ধর্ষণ করার কথা ভুলে গিয়ে এখন ভাবছে: কত বেশি কষ্ট দিয়ে খুন করতে পারবে বেটিকে।

উঠে বসে রোযির কণ্ঠনালী চেপে ধরল সে। গলায় তীব্র ব্যথা পেয়ে দু’হাতে ডেরেকের দুই কনুই সরাতে চাইল রোযি। লাথি ছুঁড়লেও লাগাতে পারল না লোকটার তলপেটে। বাড়ছে শ্বাসনালীর ওপরে চাপ। দমের অভাবে রোয়ির মনে হলো ডুবে মরে যাচ্ছে সে। জার্মান খুনির নীল চোখে চেয়ে তাকে সাক্ষাৎ ইবলিশ বলে মনে হচ্ছে ওর। এতকাল যারা শরীর ভোগ করে গেছে, তাদেরই যেন প্রতিভূ এই নাৎসি লোকটা। তাদের সবাইকে খুন করতে পারলেও এখন মনে হচ্ছে রোযির, নরক থেকে উঠে এসে ওকে শেষ করে দিচ্ছে এই হারামজাদা।

রোষির হাত খসে গেল স্লাইডারের বাহু থেকে। ঝাপসা দেখছে চোখে। জগৎ হয়ে গেল ধূসর। একটু পর ঢলে পড়বে মৃত্যু-মুখে। অথচ, ভেবেছিল কোন না কোনভাবে প্রাণে বেঁচে যাবে। কেন যেন ওর ভীষণ অভিমান হলো স্রষ্টার ওপরে।

নিজেকে বলল রোযি, নাহ্! আমি একে জিতে যেতে দেব না! কাত হয়ে মরা এক শুকনো ডাল তুলে নিল ও। একদিকে চাপ দিতেই মড়াৎ করে ভাঙল ওটা। শরীরের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে ডালের চোখা দিক ডেরেকের ঘাড়ে গেঁথে দিল রোযি।

বেসুরো আর্তনাদ করে উঠল স্নাইডার। রোযির গলা ছেড়ে পিছিয়ে গেল সে। এই সুযোগে বড় করে দম নিল রোযি। বাতাস যে এত মিষ্টি সেটা আগে কখনও ভাবেনি। দুই সেকেণ্ড পর চোখ মেলল ও।

রক্তে ভাসছে ডেরেকের ঘাড়ের একদিক। গভীর ক্ষতটার ভেতরে গেঁথে আছে চোখা ডাল।

জার্মান ভাষায় কী যেন বলল লোকটা। ঘাড়ের গর্ত থেকে বের করতে চাইল তর্জনীর মত পুরু ডাল।

এক পা ছুটিয়ে নিয়ে গায়ের জোরে তার মুখে লাথি মারল রোযি। ছিটকে মাটিতে গিয়ে চিত হয়ে পড়ল স্নাইডার।

.

রোযির দুর্দান্ত সাহসিক কাণ্ড দেখে বিশাল তাঁবুর ভেতরে প্রশংসা করছে কয়েকজন মিলে। চোখ তুলে মস্ত স্ক্রিনের দৃশ্য দেখে নিল রিটা। গোপনে ফেলল স্বস্তির শ্বাস। পরক্ষণে নিজেকে সামলাতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘পালাও! এবার পালিয়ে যাও!’

চোখে খুশি নিয়ে ওকে দেখল স্টিল। তার তৈরি শো মুগ্ধ করছে প্রেমিকাকে। আর এমন হবে সেটা আগেই জানত সে।

.

একদল মানুষ যে শো দেখে হাততালি দিচ্ছে বা প্রশংসা করছে, তার কিছুই মাথায় নেই রোযি ইয়াসিমানের। ছুটে পালিয়ে যাওয়ার কথাও মনে নেই। অথচ সেটা উচিত ছিল ওর। রোযি এটা বুঝেছে, এখন আর হামলা করতে পারবে না জার্মান খুনি। রক্তক্ষরণে না মরলেও দ্বীপে যারা আছে, তাদের হাতে মরবে লোকটা।

অবশ্য তাতে তো আর কমে যাচ্ছে না রোযির রাগ। সাবধানে সামনে বেড়ে স্লাইডারের ব্রেসলেটের লাল ট্যাব এক টানে খুলে নিল সে।

টাইমারে দেখা দিল নতুন সংখ্যা – ০০:০০:১০।

পরের সেকেণ্ডে ঘড়িটা বিপবিপ আওয়াজে জানান দিল, মাত্র নয় সেকেণ্ড পর ফাটবে শক্তিশালী বোমা!

জীবনে প্রথমবারের মত বুঝে গেল স্লাইডার, সত্যিকারের ইবলিশ আসলে হচ্ছে এই রোযি ইয়াসিমান!

রক্তাক্ত ঘাড়ের ব্যথা ভুলে গেল স্নাইডার। দু’হাতে গোড়ালি থেকে খুলতে চাইল ব্রেসলেট।

ওদিকে ঝড়ের বেগে দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে কালো মেয়েটা। তার উদ্দেশে জার্মান ভাষায় বিশ্রী সব গালি দিল স্লাইডার। বদ্ধ উন্মাদের মত চাইল টাইম বমের ব্রেসলেট খুলে ফেলতে।

আর মাত্র তিন সেকেণ্ড পর ফাটবে বোমা!

মৃত্যুক্ষণে গলা ফাটিয়ে ঈশ্বরের বাপ তুলে গালি দিল সে।

আস্ত কোন কেবিন উড়িয়ে দেয়ার জন্যে বিশ আউন্স সি- ৪ মোটেই কম নয়। টাইম বম ফেটে যেতেই আগুনের বিশাল ফুটবলটা হলো দেখার মত। একসেকেণ্ডে বাষ্প হয়ে উবে গেল স্লাইডার। বালির বুকে শুধু রয়ে গেল লালচে কিছু দাগ।

.

বিশাল তাঁবুর ভেতরে ফোঁস করে শ্বাস ফেলল সবাই।

‘কঠিন শো,’ চট্‌ করে কমপিউটারের ডিসপ্লে দেখল সিওয়ার্স। স্ক্রিনে এখন দেখাচ্ছে কমে গেছে একটা + চিহ্ন।

বিশাল স্ক্রিনে ফুটল স্নাইডারের পাসপোর্ট ছবি। ওটার ওপরে দেখা গেল লাল এক্স অক্ষর।

খুশিমনে ওদিকে চেয়ে আছে স্টিল।

দ্বীপে প্রতিযোগী রয়েছে এখন মাত্র আটজন।

মাত্র একঘণ্টায় ভালভাবে জমে গেছে শো।

প্রথম থেকে দেখানো হচ্ছে বিস্ময়কর সব ঘটনা।

যদিও এখনই খুব খুশি হওয়ার কিছু নেই।

যখন-তখন গুবলেট হয়ে যেতে পারে সব।

সাত প্রতিযোগীকে শেষ করে বিজয়ী হতে হলে একজনের লাগবে অনেক ঘণ্টার শ্রম। আর এ-সময়ে দর্শক- সংখ্যা বাড়িয়ে নিতে হবে স্টিলের। যতক্ষণ ধরে চলবে এই শো, ততই লাভ হবে তার। শুধু মনে রাখতে হবে ডার্টি গেম যেন না হয়ে ওঠে বিরক্তিকর।

স্টিলের কোন শো কখনও বিরক্তিকর বলে মনে করেনি দর্শকেরা। আর এবারের শো হবে আগেরগুলোর চেয়ে ভাল।

সকল অধ্যায়

১. ডার্টি গেম – ১
২. ডার্টি গেম – ২
৩. ডার্টি গেম – ৩
৪. ডার্টি গেম – ৪
৫. ডার্টি গেম – ৫
৬. ডার্টি গেম – ৬
৭. ডার্টি গেম – ৭
৮. ডার্টি গেম – ৮
৯. ডার্টি গেম – ৯
১০. ডার্টি গেম – ১০
১১. ডার্টি গেম – ১১
১২. ডার্টি গেম – ১২
১৩. ডার্টি গেম – ১৩
১৪. ডার্টি গেম – ১৪
১৫. ডার্টি গেম – ১৫
১৬. ডার্টি গেম – ১৬
১৭. ডার্টি গেম – ১৭
১৮. ডার্টি গেম – ১৮
১৯. ডার্টি গেম – ১৯
২০. ডার্টি গেম – ২০
২১. ডার্টি গেম – ২১
২২. ডার্টি গেম – ২২
২৩. ডার্টি গেম – ২৩
২৪. ডার্টি গেম – ২৪
২৫. ডার্টি গেম – ২৫
২৬. ডার্টি গেম – ২৬
২৭. ডার্টি গেম – ২৭
২৮. ডার্টি গেম – ২৮
২৯. ডার্টি গেম – ২৯
৩০. ডার্টি গেম – ৩০
৩১. ডার্টি গেম – ৩১
৩২. ডার্টি গেম – ৩২
৩৩. ডার্টি গেম – ৩৩
৩৪. ডার্টি গেম – ৩৪
৩৫. ডার্টি গেম – ৩৫
৩৬. ডার্টি গেম – ৩৬
৩৭. ডার্টি গেম – ৩৭

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন