ডার্টি গেম – ৩৬

কাজী আনোয়ার হোসেন

ছত্রিশ

শ্যাননের ক্ষত-বিক্ষত বুকের এবড়োখেবড়ো গর্ত থেকে ওপরে উঠে যাচ্ছে ধূসর ধোঁয়া।

পরস্পরের দিকে চেয়ে আছে রিটা ও রানা।

রিটা ভাল করেই বুঝে গেছে, এই লোক মোটেই সাধারণ কেউ নয়। বোধহয় আগে ছিল মিলিটারিতে বড় কোন অফিসার। রিটার চোখে প্রায় দেবতার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে রানা। ও এমন একজন মানুষ, যে মৃতপ্রায় হয়ে গেলেও ফিরে এসেছে রিটাকে বাঁচাতে। দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়েছে ভয়ানক এক নৃশংস খুনিকে। সাধারণ মানুষকে স্বার্থহীনভাবে ভালবাসে এই যুবক।

কীভাবে মাসুদ রানাকে ধন্যবাদ দেবে সেটা ভেবে পেল না রিটা। ও কিছু বলার আগেই শোনা গেল নীরবতা ভেঙে পাহাড়ে চালু হয়েছে হেলিকপ্টারের ইঞ্জিন।

ওরা বুঝে গেল, কর্মীদের পাশে যখন থাকার কথা, সে- সময়ে সবাইকে ত্যাগ করে তাদেরকে বিপদে ফেলে লেজ তুলে পালাচ্ছে ভীতু, কাপুরুষ ব্র্যাড স্টিল।

এক গার্ডের পিস্তল মেঝে থেকে তুলে নিল রানা। বাড়তি একটা ম্যাগাজিন সংগ্রহ করে দুটো লাশ টপকে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল।

পেছন থেকে অবাক চোখে ওকে দেখছে রিটা। হঠাৎ করেই বুঝে গেল, এখন নিজের জীবনের কথা ভেবে কোন লাভ নেই। স্টিলের জন্যেই মারা গেছে অনেকে, সুতরাং সে যাতে পালিয়ে যেতে না পারে, সেটা যেভাবে হোক ঠেকাতে হবে।

.

প্রতিশোধ স্পৃহায় দাউ-দাউ করে জ্বলছে রানার বুক। কম্পাউণ্ডে এখনও রয়ে গেছে একটা জিপ। কিন্তু ওটার কোন চাবি নেই। জিপে চেপে ইগনিশনের তারগুলো ছিঁড়ে মুচড়ে নিল রানা। ইঞ্জিন গর্জে উঠতেই গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে গেল। তীরবেগে পেছনে ফেলল মেইন গেট। একদিকের কাঁচা রাস্তা সোজা গেছে পাহাড়ের দিকে। রওনা হয়ে রানা শুনতে পেল গতি বাড়ছে হেলিকপ্টারের ইঞ্জিনের। তবে আওয়াজ থেকে ওর মনে হচ্ছে, এখনও মাটি ছেড়ে উঠে যায়নি যান্ত্রিক ফড়িঙ।

দু’পাশের জঙ্গল ঝড়ের বেগে ফুরিয়ে যেতেই রানা দেখল, জিপ উঠে এসেছে খাড়া এক টিলার ওপরে। দূরে টিলা সরাসরি নেমে গেছে এক শ’ ফুট নিচের পাথুরে উপকূলে। ওখানে আছড়ে পড়ছে সাগরের উত্তাল ঢেউ। শেষবার জায়গাটা হেলিকপ্টার থেকে ওকে ফেলে দেয়ার সময় দেখেছে রানা।

পথের শেষে আছে স্টিলের জিপ। টিলার ওপরে পঞ্চাশ গজ দূরে হেলিকপ্টারের ইঞ্জিন গরম করছে পাইলট। সরু এক পথে ওপরে উঠে যাচ্ছে স্টিল, হাতে সরু ব্রিফকেস।

কড়া ব্রেক কষে জিপ থামিয়ে নেমে পড়ল রানা। আহত শরীরে দৌড়াতে শুরু করে ভাবল, আগে কখনও এত ব্যথা ছিল না ওর শরীরে।

একবার কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল স্টিল। সে ভেবেছিল পিছু নিয়ে আসছে সিম্পসন। কিন্তু রানাকে তেড়ে আসতে দেখে আত্মা খাঁচাছাড়া হয়ে গেল তার। সোজা দৌড় দিল হেলিকপ্টারের দিকে। কয়েক সেকেণ্ড পর আবারও তাকাল কাঁধের ওপর দিয়ে। ভয়ে অস্থির লাগছে তার। মাত্র বিশ ফুটের ভেতরে পৌঁছে গেছে ছুটন্ত মাসুদ রানা!

ঘুরেই পকেট থেকে পিস্তল বের করে নিল স্টিল। পর পর চারবার গুলি করল রানাকে লক্ষ্য করে। তিনটে গুলি ফস্কে গেলেও চতুর্থ গুলি লাগল রানার কাঁধে। জোর ধাক্কা খেয়ে আধপাক ঘুরে গেল রানা। ওর মনে হলো যে-কোন সময়ে পড়ে যাবে মাটিতে। জোর করে নিজেকে সামলে নিয়ে ঘুরে তাকাল। পঁচিশ ফুট দূরে মোটা এক গাছের ওদিকে চলে যাচ্ছে স্টিল। একবার আড়াল নিলে গুলি করে পাখির মত মারবে রানাকে।

ব্র্যাড স্টিলকে লক্ষ্য করে পিস্তল থেকে দুটো গুলি পাঠাল রানা। একই সময়ে ঘুরে চেয়েছে লোকটা। ফলে দুটো গুলির একটা গেঁথে গেল তার পেটে। পড়ে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে রইল সে। পিস্তলের শেষ চার গুলি খরচ করল রানাকে লক্ষ্য করে। ওগুলোর একটা লাগল রানার বুকে। প্রচণ্ড ব্যথায় বসে পড়ল রানা।

ওদিকে হেলিকপ্টার থেকে বারবার হাতের ইশারা করছে পাইলট। এরই ভেতরে মাটি ছেড়ে শূন্যে উঠে গেছে সে। টলতে টলতে ওদিকে চলল স্টিল। তাকে গুলি করার জন্যে ট্রিগারে চাপ দিল রানা। কিন্তু ম্যাগাজিনে এখন আর কোন গুলি নেই!

যান্ত্রিক ফড়িঙে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল ব্র্যাড। ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে পাইলট। পিস্তলে নতুন ম্যাগাজিন ভরে হেলিকপ্টারের নিচের দিক তাক করে অস্ত্রটা থেকে পর পর কয়েকবার গুলি পাঠাল রানা। ঠাস করে ফেটে গেল চপারের জানালার প্লেক্সিগ্লাস। পরের দুটো গুলি লাগল পাইলটের কন্সোলে।

ইঞ্জিনের ভেতরে বড় কী যেন গোলমাল হয়ে গেছে, বুঝে গেল পাইলট। এখন আর আগের মত উঠে যাচ্ছে না হেলিকপ্টার। একই জায়গায় ঘুরছে মাতালের মত। স্টিলকে কী যেন বলছে পাইলট। দরজা খুলে যেতে দেখল রানা। দশ ফুট ওপর থেকে পাহাড়ের কিনারায় লাফিয়ে নামল স্টিল। খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড় দিল একটু দূরের বড় আরেক গাছ লক্ষ্য করে। উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে ছুটে গেল রানা। চোখের কোণে দেখতে পেল জিপের কাছে পৌঁছে গেছে রিটা, হাতে কী যেন।

এদিকে হেলিকপ্টারের ভেতরে জ্বলে উঠেছে লকলকে নীল আগুন। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ হলো ইঞ্জিনের ভেতরে। পরক্ষণে ভীষণ কাত হয়ে সোজা সাগরের দিকে নেমে গেল জ্বলন্ত উড়োজাহাজ। কয়েক সেকেণ্ড পর নিচ থেকে এল সবকিছু ভেঙেচুরে যাওয়ার বিকট আওয়াজ।

স্টিল যে গাছের আড়ালে আছে, সেদিকে এবার ধীর পায়ে এগোল রানা। ওর কানে এল কারও ফুঁপিয়ে ওঠার আওয়াজ। পরের পাঁচ ফুট পার করে গাছের ওদিকে গেল রানা। মাটিতে শুয়ে আছে স্টিল। ওর দিকে করুণ চোখে তাকাল সে। এখন আর তার হাতে কোন পিস্তল নেই। দুই হাতে চেপে ধরেছে পেট। গলগল করে দশ আঙুলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত। বেসুরো সুরে বলল লোকটা, ‘তো তুমিই তা হলে জিতলে! আমার একদম উচিত হয়নি তোমাকে জেলখানা থেকে বের করা!’

পেছনে পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল রানা।

পৌঁছে গেছে রিটা।

স্টিলের বুকে পিস্তল তাক করল রানা, নিজেও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। বসে পড়ল মাটিতে। ক্লান্ত স্বরে বলল ও, ‘তুমি কি কষ্ট পেয়ে মরতে চাও, স্টিল, নাকি তোমার বুকে গুলি করব?’

‘জানি, আমি আসলে মানুষ নই, তবু এই দয়াটা আমাকে করো, রানা,’ ব্যথায় বিকৃত হয়ে যাওয়া মুখে বলল ব্র্যাড স্টিল।

তার হৃৎপিণ্ড লক্ষ্য করে পিস্তল তাক করল রানা। পরক্ষণে টিপে দিল ট্রিগার। গুলির আওয়াজটা ফাঁকা জায়গায় পটকার মত হালকা শোনাল ওর কানে। মাত্র দু’বার শরীর মুচড়ে স্থির হয়ে গেল ব্র্যাড স্টিল

নিজেও মাথা ঘুরছে বলে শুয়ে পড়ল রানা। বুঝে গেছে গোড়ালির বোমার কারণে একটু পর মরতে হবে ওকে।

ওর পাশে এসে বসে পড়ল রিটা, হাতে এখন সিম্পসনের গলার চেইন। ওটার সঙ্গে ঝুলছে রুপালি ছোট এক চাবি। হাত বাড়িয়ে রানার ব্রেসলেটের তালায় ওটা ভরল রিটা। চাবিতে মোচড় দিতেই টিট আওয়াজ তুলে থেমে গেল টাইমার। রানার গোড়ালি থেকে ব্রেসলেট খুলে নিল রিটা। টাইমারের দিকে একবার তাকাল রানা। ওখানে জ্বলতে জ্বলতে নিভে গেল লাল কিছু সংখ্যা : 00:00:0१।

‘তোমার আসলে অনেক সাহস,’ বিড়বিড় করে বলল রানা।

‘তোমার মত মোটেও নয়,’ আপত্তি তুলল রিটা। ‘তা ছাড়া, আমি তোমার মত অকাতরে মানুষকে সাহায্য করতে শিখিনি। আর সেটা আমার চরম একটা অন্যায়।’ হঠাৎ বুটজুতোর আওয়াজ পেয়ে ঘুরে পাহাড়ের নিচের দিকে তাকাল মেয়েটা। নেভির সাদা পোশাকে একদল লোক ছুটে আসছে ওদের দিকে। তাদের দু’জনের হাতে একটা স্ট্রেচার।

বিস্মিত চোখে রানাকে দেখল রিটা। এরা জানল কী করে যে আমরা এখানে আছি?’

মাথা নাড়ল প্রায় অচেতন রানা। কিছুই জানা নেই ওর।

ক্রমে চলে যাচ্ছে কোমার ভেতরে।

দু’মিনিট পর রানা ও রিটার পাশে পৌঁছে গেল নেভির যুবকেরা। তাদের একজন অফিসার। নরম সুরে জানতে চাইল সে, ‘স্যর, আপনিই কি মেজর রানা?’

‘মেজর নই,’ বিড়বিড় করল রানা। ‘তবে আমিই মাসুদ রানা।

‘স্যর, আমরা জানি আপনি আসলে আমাদের কে। আমি লেফটেন্যান্ট কমাণ্ডার আজিজুর জুয়েল। বিসিআই চিফের অনুরোধে নেভির চিফ আমাদেরকে পাঠিয়ে দিয়েছেন এই দ্বীপে, যাতে আপনাকে সরিয়ে নিতে পারি। আমরা এখন আমাদের শিপে আপনাকে নিয়ে যাব। দুশ্চিন্তা করবেন না, স্যর। আমাদের ডাক্তার ও নার্স আন্তর্জাতিক মানের।’ রিটার দিকে তাকাল তরুণ অফিসার। ‘আপনি কি আমাদের সঙ্গে যেতে চান? সেক্ষেত্রে পৌঁছে দেব পাপুয়া নিউ গিনির রাজধানীতে।’

মাথা দোলাল রিটা। ‘তা হলে খুব ভাল হয়।’

রানার দিকে তাকাল নেভির অফিসার। তবে রক্তশূন্যতার কারণে জ্ঞান হারিয়ে গেছে বিসিআই-এর সেরা এজেন্টের।

অফিসারের নির্দেশে রানাকে খুব সাবধানে স্ট্রেচারে তুলল নেভির দুর্ধর্ষ ক’জন জোয়ান। ফিরতি পথে রওনা হলো ওরা।

সকল অধ্যায়

১. ডার্টি গেম – ১
২. ডার্টি গেম – ২
৩. ডার্টি গেম – ৩
৪. ডার্টি গেম – ৪
৫. ডার্টি গেম – ৫
৬. ডার্টি গেম – ৬
৭. ডার্টি গেম – ৭
৮. ডার্টি গেম – ৮
৯. ডার্টি গেম – ৯
১০. ডার্টি গেম – ১০
১১. ডার্টি গেম – ১১
১২. ডার্টি গেম – ১২
১৩. ডার্টি গেম – ১৩
১৪. ডার্টি গেম – ১৪
১৫. ডার্টি গেম – ১৫
১৬. ডার্টি গেম – ১৬
১৭. ডার্টি গেম – ১৭
১৮. ডার্টি গেম – ১৮
১৯. ডার্টি গেম – ১৯
২০. ডার্টি গেম – ২০
২১. ডার্টি গেম – ২১
২২. ডার্টি গেম – ২২
২৩. ডার্টি গেম – ২৩
২৪. ডার্টি গেম – ২৪
২৫. ডার্টি গেম – ২৫
২৬. ডার্টি গেম – ২৬
২৭. ডার্টি গেম – ২৭
২৮. ডার্টি গেম – ২৮
২৯. ডার্টি গেম – ২৯
৩০. ডার্টি গেম – ৩০
৩১. ডার্টি গেম – ৩১
৩২. ডার্টি গেম – ৩২
৩৩. ডার্টি গেম – ৩৩
৩৪. ডার্টি গেম – ৩৪
৩৫. ডার্টি গেম – ৩৫
৩৬. ডার্টি গেম – ৩৬
৩৭. ডার্টি গেম – ৩৭

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন