ডার্টি গেম – ৩১

কাজী আনোয়ার হোসেন

একত্রিশ

ডার্টি গেম শো-র শেষ দুই প্রতিযোগীর ভেতরে মরণপণ যুদ্ধ শুরু হলে সেটা ইন্টারনেটে দেখবে চার কোটির বেশি মানুষ।

প্রথমেই ঘুষি ও লাথির কম্বো অ্যাটাকের মাধ্যমে রানাকে কুপোকাৎ করতে চাইল প্রাক্তন ইংরেজ মেজর। সেটার ভেতরে আছে মিলিটারিতে শেখা মার্শাল আর্টের ছোঁয়া। তবে ব্লক করে ঝড়ের বেগে শ্যাননের মুখে, কিডনিতে ও পেটে তিনটে ঘুষি গেঁথে দিল রানা। পিছিয়ে গিয়ে আবারও আক্রমণে এল শ্যানন। রানার চোয়ালে ঘুষি মারল সে। কিন্তু কবজিটা সরিয়ে দিয়ে তার মুখে শক্তিশালী একটা জ্যাব করল রানা। হুড়মুড় করে পিছিয়ে গেল লোকটা

রানার জানা নেই, একই সময়ে বিসিআই হেডকোয়ার্টারে ওদের দু’জনের লড়াই দেখছে অনেকে। প্রত্যেকে উত্তেজিত রানার প্রতিটা ঘুষি ও লাথি মনোযোগ দিয়ে দেখছে সবাই।

ওদিকে নিজেদের অফিসে বসে লড়াই দেখছে স্পেশাল এজেন্ট এডওয়ার্ড সিমন্স ও তার টিমের সদস্যরা। এমন কী নিজের অফিসে ডার্টি গেম শো গিলছে তাদের বস্ রাইডার। ভুরু কুঁচকে ভাবছে, ইংরেজ মেজরকে লাথিয়ে ও ঘুষিয়ে যেভাবে নাজেহাল করছে মাসুদ রানা, সেটা সত্যিই দেখার মত। এদিকে দ্বীপ লক্ষ্য করে রওনা হয়ে গেছে নেভির বিমান, সুতরাং এখন আর ডিআইএ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর খেয়ে নেবে না তার চাকরি। তথ্য দিয়েছে বলে পদোন্নতিও হতে পারে রাইডারের।

হাতাহাতি লড়াইয়ে কে জিতবে সেটা অনিশ্চিত।

হেলিকপ্টার থেকে ব্যাগ ফেলা হলে ওটার ভেতরে ছিল শটগান ও খাপে ভরা কমব্যাট নাইফ। এখন ইংরেজ মেজরের গোড়ালিতে আছে ছোরাটা। ওটা হয়তো এনে দেবে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

রানার ঘুষি খেয়ে ফুলে গেছে শ্যাননের মুখ। মার খেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে সে। যে-কেউ ভাববে কাহিল হয়ে গেছে।

রানার আরেক ঘুষি মাথার পাশে নিয়ে কার্নিশের মত এক জায়গায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল শ্যানন। ভঙ্গি করছে যে লড়াই করার আর কোন শক্তি নেই। ওদিকে গোড়ালির কাছে হাত নিয়ে খাপ থেকে বের করেছে ছোরা। সামনে বেড়ে ঝুঁকে তার মুখে ঘুষি দিতে চাইল রানা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসে একপাশ থেকে ওর বুক লক্ষ্য করে ছোরা চালাল শ্যানন।

বুকের পেশি চিরে যাওয়ায় হোঁচট খেয়ে পিছিয়ে মাটিতে পড়ল রানা। ব্যথা এতই বেশি, ওর মনে হলো যেন দাউ-দাউ করে মগজে জ্বলে উঠেছে আগুন। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে টকটকে লাল রক্তে ভরে গেল ওর শার্ট।

খাপে ছোরা রেখে উঠে দাঁড়াল শ্যানন। এবার হাসতে হাসতে খুন করতে পারবে রানাকে। একটু দূরেই কোথাও আছে গুলি ভরা বন্দুক।

ক্লান্ত রানা কোথাও সরে যাবে, সেটা আর হওয়ার নয়। লড়াই এবার সত্যিই শেষ। আর সেটা ভাল করে জানে শ্যানন। পাথুরে এলাকায় বন্দুকটা খুঁজছে সে।

নিচের দিকে জলে ভরা সব ডোবা দেখতে পাচ্ছে রানা। কার্নিশ থেকে ওদিকে গড়ান দিয়ে নেমে গেলে আহত হবে। তবে এখানে রয়ে গেলেও মরতেই হবে ওকে।

এদিকে বন্দুক হাতে তুলে নিয়েছে শ্যানন।

কার্নিশে শরীরটা গড়িয়ে দিয়ে ঢালু জমি বেয়ে নেমে চলল রানা। তীক্ষ্ণ পাথরে লেগে কেটে যাচ্ছে ওর হাত-পা ও শরীর। শ্যাননের হাতে বিকট শব্দে গর্জে উঠল বন্দুক। একরাশ ছররা লাগতেই রানার মনে হলো নরকের আগুন জ্বলে উঠেছে ওর পিঠে। তীব্র ব্যথা সহ্য করে গড়িয়ে নেমে গেল ও। এবার গুলি লাগল ওর ডান বাহুতে। ঠনাৎ শব্দে ভেঙে গেল কয়েকটা রড। ছররা গুলি ফুটো করে দিয়েছে ওর বাহু। গুলির চেয়ে কম ব্যথা দিচ্ছে না পাথরের খোঁচা। কার্নিশে দাঁড়িয়ে আবারও ওকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ল শ্যানন। আর তখনই ছোট এক জলপ্রপাত পেরিয়ে গেল রানা। কিছুই ভাবতে পারছে না তীব্র যন্ত্রণায়। শরীরে বইছে ব্যথার একের পর এক ঢেউ। বরাবরের মত হাল ছাড়ল না ওর নার্ভাস সিস্টেম। ফলে জ্ঞান হারাল না ও। গুলি এসে লাগল ওর শরীরে। পরের গড়ান দিয়ে ঝপাস্ করে নেমে গেল রানা নিচের ডোবায়। ঘোলা চোখে দেখতে পেল ধূসর পানি। কানের ভেতরে এখন আছে অদ্ভুত এক নীরবতা।

কার্নিশে ঝুঁকে ওকে দেখছে ইংরেজ সাইকো। আবার পাম্প করে গুলি ছুঁড়ল। রানার চারপাশের পানিতে লাগল অসংখ্য পেলেট। পানিতে ডোবা পুরুষ লাশের মত উপুড় হয়ে ভেসে থাকল রানার দেহ। ওর মাথা ও অণ্ডকোষে গুলি করবে বলে ভেবেছে শ্যানন। কিন্তু সেটা করতে হলে নেমে যেতে হবে বহু নিচে। হাত ভরে দেখল পকেটে আর কোন গুলি নেই। চারপাশে তাকাল লেন্স দেখার জন্যে। ভাবছে, কোন না কোন ক্যামেরায় দেখানো হচ্ছে ডার্টি গেমের প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে গেছে সে।

.

ফ্যাকাসে মুখে মস্ত স্ক্রিনের দিকে চেয়ে আছে সোহানা। অনেক কষ্টে সামলে রেখেছে অদম্য কান্না। রানার চারপাশের পানিতে ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে লাল রক্ত। কিছুক্ষণের জন্যে ওর দেহের ওপরে স্থির হলো ক্যামেরা। তারপর দেখানো হলো হাসিমুখে রুপার্ট শ্যাননকে।

থমথমে নীরবতা নেমেছে বিসিআই-এর কমপিউটার ডিপার্টমেন্টে। অবিশ্বাস নিয়ে দৃশ্যটা দেখছে সবাই। কেউ মেনে নিতে পারছে না যে ওদের প্রিয় রানা আর বেঁচে নেই।

‘এই দুনিয়াটা সত্যিই খুব নিষ্ঠুর, আর স্রষ্টা আসলে চরম অবিবেচক,’ বিড়বিড় করল সলীল।

ঘরের কারও সাহস নেই যে তাকাবে সোহানার দিকে।

.

মস্ত তাঁবুতে বসে আত্মতৃপ্তি নিয়ে স্ক্রিনের দিকে চেয়ে আছে ব্র্যাড স্টিল, খুশিতে ফুরফুর করছে তার মন। এটা ঠিক, অন্য অপরাধীদের মত রানাকে নির্যাতন করতে পারেনি শ্যানন, আর সেটা বোধহয় ভালই হয়েছে। দারুণভাবে শেষ হয়ে গেছে ডার্টি গেম শো। এভাবে অনুষ্ঠানটা শেষ হবে সেটা নিজেও কখনও ভাবেনি ব্র্যাড। যেমন ধরনের মানুষই হোক শ্যানন, সে একজন শ্বেতাঙ্গ, তাই পশ্চিমা দুনিয়া খুশি হবে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়নি বাদামি চামড়ার এক লোক।

তারকা হিসেবে শ্যাননের ক্লোয-আপ ছবি স্ক্রিনে দিল এমিলি। ইংরেজ প্রতিযোগী ভাল করে জানে কোথায় আছে ক্যামেরা, তাই লেন্সের দিকে চেয়ে চোখ টিপে হাসল সে। শেষ দৃশ্যের জন্যে আগেই বিজয়ের একটা সুর বেছে দিয়েছে স্টিল। এবার বেজে উঠল সেই মিউযিক।

নিজেকে নিয়ে গর্ব বোধ করছে স্টিল। সিওয়ার্সের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল সাবস্ক্রিপশন নাম্বারের ওপরে। যা চেয়েছিল সেটাই পেয়ে গেছে সে। বুক ফুলিয়ে বলল স্টিল, ‘পুরো চার কোটি পাঁচ লাখ চার হাজার বায়ান্ন জন দর্শক।’

.

এখন তিনটে লেন্স সরাসরি তাক করা আছে শ্যাননের ওপরে।

পেখম মেলা ময়ূরের মত যেন নেচে চলেছে ইংরেজ সাইকো। বারবার তার মনে হচ্ছে, সে যেন হয়ে গেছে দুনিয়ার রাজা। আরও বড় একটা কারণে ভাল লাগছে তার, চিরকালের জন্যে মুক্ত হয়ে গেছে প্রযোজক স্টিলের কল্যাণে। বাকি জীবন আর অভাব হবে না টাকার।

চাপা গর্জন শুনে আকাশে চোখ তুলল শ্যানন।

তার মাথার ওপর দিয়ে গেল নেভির জেট বিমান।

দ্বীপ পেরিয়ে কোথায় যেন চলেছে ওটা।

.

শ্যানন যখন বিমান উড়ে যেতে দেখল, তার মাত্র দুই সেকেণ্ড পর জেট ইঞ্জিনের গর্জন শুনতে পেল সিম্পসন। চমকে গেছে সে। দ্রুত বিশাল তাঁবু থেকে বেরিয়ে চোখ রাখল নীল আকাশে। শুকিয়ে গেছে তার মুখ।

.

হাজার হাজার মাইল দূরে তীব্র হতাশা নিয়ে স্ক্রিনে চেয়ে আছে বিসিআই-এর এজেন্টরা। কারও বুঝতে দেরি হয়নি, প্রথম থেকেই চরম প্রহসন করে গেছে ব্র্যাড স্টিল। আগেই স্থির ছিল আসলে কে জিতবে।

নতুন দৃশ্যে দেখা গেল ডোবার ভেতরে উপুড় হয়ে ভাসছে রানার লাশ। পানিতে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে লাল রক্ত।

হঠাৎ ফোন বেজে উঠতেই পকেট থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে স্ক্রিন দেখল রায়হান রশিদ। বাটন টিপে কানে ঠেকাল যন্ত্রটা। ‘হ্যাঁ, বলুন, এডওয়ার্ড।’

‘দ্বীপটা পাওয়া গেছে,’ জানাল স্পেশাল এজেন্ট সিমন্স। .’আগামী কয়েক ঘণ্টার ভেতরে ওখানে পৌঁছে যাবে নেভি সিল।’

স্ক্রিনে রানার ভাসমান লাশ দেখে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রায়হান। ক্লো-আপ করা দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে হাস্যরত শ্যাননের মুখ। হঠাৎ রানার ছবির ওপরে এল লাল এক বড় ক্রস-চিহ্ন। দপদপ করে উজ্জ্বল আলো ছড়াল শ্যাননের ছবি।

‘আমাদের আর কিছু করার ছিল না,’ বলল সিমন্স। ‘বিসিআই এজেণ্ট মাসুদ রানাকে সাহায্য করতে গিয়ে অনেক দেরি করে ফেলেছে ডিআইএ।’

‘আপনি আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, সেজন্যে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ,’ শুকনো গলায় বলল রায়হান। ‘ভাল থাকুন!

স্পেশাল এজেন্ট এডওয়ার্ড সিমন্সের কল কেটে দিল ও।

ইন্টারনাল স্পিকারে ওরা শুনল বিসিআই চিফের গুরুগম্ভীর কণ্ঠ: ‘কোঅর্ডিনেট্স্ অনুযায়ী সেই দ্বীপের খুব কাছে আছে বাংলাদেশ নেভির ব্যাটল শিপ। আগামী আধঘণ্টার ভেতরে ওখানে পৌঁছে যাবে আমাদের অফিসার ও জোয়ানেরা। ওরা ধরে আনবে ব্র্যাড স্টিল এবং তার দলের লোকগুলোকে। রানার প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে, সেজন্যে আমাদের তরফ থেকে চরম শাস্তি দেয়া হবে তাদেরকে।’ আরামদায়ক চেয়ারে বসে বিশাল স্ক্রিন দেখছে ব্র্যাড স্টিল। গর্বে আরও দশ ইঞ্চি ফুলে গেছে তার বুক। এ-ধরনের কোন অনুষ্ঠান আগে কখনও দেখেনি কেউ। চিরকালের জন্যে ইতিহাসে লেখা থাকবে তার নাম।

‘এমিলি, হাইলাইট করা রিল কাট করে নিয়েছ?’ স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়ে বলল সে।

‘আমার কাজ শেষ,’ জবাবে জানাল মেয়েটা। তর্কে যেতে রাজি নয়, তবে তারও মনে হচ্ছে প্রতিযোগিতায় কোন ন্যায্যতা ছিল না। চরম অন্যায় করেছে ওদের বস্।

‘আমাদের বিজয়ীকে এনে অনুষ্ঠান শেষ করার আগে রিল দেখাও,’ ক্লান্ত স্বরে বলল স্টিল। তার চেহারা দেখলে যে- কেউ এখন ভাববে, এইমাত্র যৌন-মিলন শেষে বিশ্রাম করছে লোকটা।

মাথা দোলাল এমিলি। ‘তো শেষ হয়ে গেল এই শো।’

তার দিকে চেয়ে খুশির হাসি হাসল স্টিল। এমিলি যেহেতু বেইমানি করেনি, তাই অন্য কোন শো-তে ওকে নেবে সে। রিটার কথা ভেবে মনে মনে বলল স্টিল, ‘তোমার এতক্ষণে বোঝার কথা, আমি সত্যিই একজন জিনিয়াস।’ ঘুরে তাকাল যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটা।

কিন্তু কখন যেন বিশাল তাঁবু ছেড়ে চলে গেছে রিটা।

মেয়েটা নেই বলে খুব বিরক্তি বোধ করল স্টিল। রিটাকে খুঁজে নেবে বলে চেয়ার ছেড়ে রওনা হবে, এমন সময় তাঁবুর ভেতরে এসে ঢুকল রিভ সিম্পসন। শুকিয়ে গেছে তার মুখ। ‘আবার কী হয়েছে?’ বিরক্তি আরও বাড়ল স্টিলের।

অন্যরা যেন শুনতে না পায়, তাই তার কানের কাছে মুখ নিয়ে সিম্পসন বলল, ‘এইমাত্র ইউএস নেভির একটা এফ/এ-১৮ বিমান দ্বীপের ওপর দিয়ে গেছে। ওরা এখন জানে আমরা কোথায় আছি।’

কথাটা অ্যাটম বোমার মত আঘাত করল স্টিলের মগজে। এতদিন এই দ্বীপের অবস্থান গোপন করে রেখেছিল সে। দ্বিগুণ বেতন দিয়েছে পাইলটদেরকে, যাতে মুখ বন্ধ রাখে তারা। সবাই মুখ বুজে থাকলেও আজ ভোরে কম্পাউণ্ডে ঢুকে ওয়েদার টাওয়ার থেকে কোঅর্ডিনেট্স্ ফাঁস করে দিয়েছে মাসুদ রানা। এরই ভেতরে মারা গেছে লোকটা, নইলে নিজের হাতে তাকে গুলি করে মারত স্টিল।

‘এবার?’ নিচু গলায় বলল সিম্পসন। চট্ করে তাকাল এমিলি, সিওয়ার্স ও অন্যদের দিকে।

তার দৃষ্টি অনুসরণ করল ব্র্যাড। আগে কখনও ভাবেনি দলের সবাইকে হঠাৎ করে অন্য কোথাও সরাতে হলে কী করতে হবে। কয়েক সেকেণ্ড ভেবে বুঝে গেল সে, আইনী ঝামেলা থেকে বাঁচতে চাইলে অন্যদেরকে ফেলে পালিয়ে চলে যেতে হবে দ্বীপ ছেড়ে।

‘বড় হেলিকপ্টারটা কি ফিরেছে?’

‘না,’ মাথা নাড়ল সিম্পসন। ‘সেট-আপ ক্রুদের পৌঁছে দিতে মেইন ল্যাণ্ডে গেছে।’

পাইলটকে বাদ দিলে মাত্র কয়েকজন উঠতে পারবে বেল জেটরেঞ্জার হেলিকপ্টারে। আর সেক্ষেত্রে দ্বীপ ত্যাগ করতে পারবে শুধুমাত্র ব্র্যাড, সিম্পসন, রিটা আর অন্য একজন। বিশাল তাঁবুর ভেতরে চোখ বোলাল স্টিল। সন্দেহ নিয়ে ওকে দেখছে সিলভি। গত কয়েক ঘণ্টা ধরে বেয়াড়াপনা করলেও এতকাল ভাল বন্ধুর মত নিজের দায়িত্ব পালন করেছে সে। একবার বিশ্বাসী কর্মী সিওয়ার্স ও এমিলিকে দেখল স্টিল। কাজে দক্ষ না হলেও এই শো-র জন্যে প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছে তারা।

এমিলি ও সিওয়ার্সের মধ্যে কাকে সঙ্গে নেবে ভেবে পেল না স্টিল। ফিসফিস করে বলল সিম্পসনের কানে, ‘সব গুছিয়ে নেব। দশ মিনিটের ভেতরে চলে এসো জিপের কাছে।’

স্টিলের দিকে এল সিলভি, চোখে অভিযোগের দৃষ্টি।

‘অন্যদের কী হবে?’ নিচু গলায় বলল সিম্পসন।

‘মিলিটারি হানা দিলে আগে ধরতে চাইবে আমাদের ক’জনকে, ওদেরকে নয়।’

কথাটা যে আসলে মিথ্যা, সেটা ভাল করে জানে সিম্পসন ও স্টিল। ডার্টি গেমের মত চরম অন্যায় শো-তে যারা জড়িত, তাদের কাউকে ছাড় দেবে না দুনিয়ার কোন আদালত।

‘হঠাৎ তোমার এত তাড়া কিসের?’ বলল সিলভারম্যান।

জবাব না দিয়ে তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে গেল সিম্পসন। পেছন থেকে তাকে দেখছে সিলভি। প্রথম থেকে সিকিউরিটি চিফকে বিপজ্জনক, অসৎ লোক বলে মনে হয়েছে ওর। সিম্পসন যখন পুলিশের চাকরি করত, তখনও নানা অপরাধে জড়িত ছিল। তার ভেতরে ছিল ডাকাতি ও খুনের অভিযোগ। ডার্টি গেমের · শো-র জন্যে ভাল লোক চেয়েছিল সিলভারম্যান, কিন্তু তার কথা কানেই তোলেনি স্টিল। উল্টে বলেছে, ‘সিম্পসন ভাল একজন মানুষ। নিজের কাজও খুব ভাল করে বোঝে।’

দ্বীপের ওপর দিয়ে বিমান যেতেই সেই আওয়াজ শুনেছে সিলভি। এ-ও বুঝে গেছে, গোপনে কী যেন করছে স্টিল ও সিম্পসন।

‘আমি এখন ব্যস্ত, সিলভি,’ নিজের তাঁবুতে যাওয়ার জন্যে রওনা হলো ব্র্যাড।

‘দূরে কোথাও যাচ্ছ, স্টিল?’ তার পিছু নিল সিলভারম্যান।

জবাব না দিয়ে হনহন করে হাঁটছে স্টিল।

‘আসলে যাচ্ছ কোথায়? ভেবেছ আমি কিছুই বুঝিনি? এইমাত্র দ্বীপের ওপর দিয়ে গেছে বিমান। আমার তো মনে হচ্ছে আমাদেরকে ফেলে পালিয়ে যাচ্ছ তোমরা!’

একটু দূরে আছে সিম্পসন। সিলভির কথা শুনতে পেয়েছে সে। এটা বুঝে গেছে, ঝামেলা করবে টেকনিকাল ডিরেক্টর।

বহুকালের বন্ধু হলেও সিলভি যে ঝগড়া করেছে, সেটা মনে পড়তেই তিক্ত হলো স্টিলের মন। ব্যক্তিগত তাঁবুতে ঢুকে ভাবল সে, সিলভির অন্তত সত্যি কথাটা জানার অধিকার আছে।

‘একটু আগে নেভির বিমান আমাদের ক্যাম্প দেখে গেছে। নেভি যে-কোন সময়ে এই দ্বীপে রেইড দেবে।’

‘নেভি?’ চমকে গেল সিলভি। ‘আর তুমি ভাবছ সবাইকে ফেলে পালিয়ে যাবে?’

‘গলা নিচু করে কথা বলো, সিলভি।’

‘তুমি তো সবাইকে আশ্বস্ত করেছিলে, আইনী কোন বিপদ হলে সেটা সামলে নেবে তুমি,’ গলা আরও চড়ল সিলভির। ‘এখন চোখ উল্টে নিচ্ছ কেন! অন্যরা বিপদে থাকবে আর তুমি কাপুরুষের মত সটকে পড়বে?’

‘পরিস্থিতি এখন একদম বদলে গেছে,’ দ্রুত হাতে ব্যক্তিগত কিছু জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছে স্টিল।

‘তুমি যা খুশি করতে চাইলেই হবে? অন্যদের কোন অধিকার নেই নিরাপদে চলে যাওয়ার? আমি সবাইকে বলে দেব! এমিলি, সিওয়ার্স, রিটা… সবাইকে!’

চট্ করে প্রেমিকার কথা মনে পড়ল স্টিলের। মেয়েটা কোথায় গেল? সে ভেবেছিল তাঁবুতে থাকবে রিটা।

‘আমরা গেলে একসঙ্গে যাব, নইলে কেউ নয়!’ চেঁচিয়ে উঠল সিলভারম্যান।

তাঁবুর দরজার কাছে সিম্পসনকে দেখতে পেল স্টিল। লোকটার চোখে সিলভির প্রতি চরম বিদ্বেষ। যে-কোন সময়ে টেকনিকাল ডিরেক্টরের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে সে।

সিলভিকে শেষবার সুযোগ দিল স্টিল। ‘হেলিকপ্টারে আর মাত্র একজন উঠতে পারবে। তুমি আমার সঙ্গে যেতে পারো। শো-তে কাজ করেছ বলে তোমাকে দেব পুরো এক মিলিয়ন ডলার।’

স্টিলের কথায় আরও রেগে গেল সিলভি। অন্যদের কী হবে সেটা ভাবতে গিয়ে ভয়ে শুকিয়ে গেছে তার গলা। বুঝে গেল, ডার্টি গেম শো-তে কাজ করে নিজের আত্মা শয়তানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে সে। ‘তুমি এক মিলিয়ন ডলার দিতে চাইছ? অন্যদের কী হবে? তোমার সঙ্গে যে মৌখিক চুক্তি আমার হয়েছে, তাতে আমাকে দেয়ার কথা অন্তত পাঁচ মিলিয়ন ডলার!’

টাকার অঙ্ক শুনে সিলভির প্রতি শেষ ফোঁটা বন্ধুত্বও উবে গেল স্টিলের মন থেকে। শীতল কণ্ঠে বলল সে, ‘তুমি কিন্তু একজন টেকনিশিয়ান, এর বেশি কিছু নও। চাকরি করেছ, তাই বেতন পাবে। শো থেকে যে টাকা এসেছে, সেসবে কিন্তু তোমার কোন অধিকার নেই।’

‘শালা, কুত্তার বাচ্চা কোথাকার…’ মারমুখী হয়ে স্টিলের দিকে এগোল সিলভি। কিন্তু পরক্ষণে তার সামনে পৌঁছে গেল সিম্পসন। হ্যাঁচকা টানে স্টিলের কাছ থেকে সিলভিকে সরিয়ে নিল সে। প্রচণ্ড ঘুষি বসাল টেকনিশিয়ানের পেটে। বুক থেকে বাতাস বেরোতেই প্রায় দুই ভাঁজ হয়ে গেছে সিলভি।

পরস্পরের চোখে তাকাল স্টিল আর সিম্পসন। তাদের ভেতরে কোন কথা হলো না। দু’জনই জানে এবার কী করতে হবে। প্রাক্তন বন্ধুকে দেখল ব্র্যাড। একসময় অনেক কাজে এসেছে সিলভি, আর সেজন্যে পেয়েছে মেলা টাকা বেইমানি না করলে হয়তো আরও বহু কিছু পেত। মনিবের ওপরে চড়াও হতে গিয়েছিল বলে এখন চরম শাস্তি পাবে সে।

সিম্পসনের দিকে চেয়ে মৃদু মাথা দোলাল স্টিল। গোছাতে লাগল নিজের মালপত্র। সিলভারম্যানকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে তাঁবুর পেছনে ফাঁকা জায়গায় গেল সিম্পসন। এদিকে আসে না কেউ। মাত্র দম ফিরে পেয়েছে সিলভি, এমন সময় দেখতে পেল সিম্পসনের হাতে আর্মির ছোরা।

‘আমাকে মেরো না,’ করুণ সুরে বলল সিলভি।

অসহায় যুবকের গলায় ছোরার ফলা ঠেকাল সিম্পসন। গত ত্রিশ ঘণ্টায় বারবার করে দেখেছে মানুষ খুন হতে। ভেবেছে, সে-ও যদি পেত এই সুযোগ! হেলিকপ্টারের ভেতরে রানা কনুইয়ের গুঁতো মারার পর বহুবার মনে হয়েছে, নিজের হাতে ব্যাটাকে খুন করতে পারলে খুব ভাল লাগত তার। তবে সেটা যখন হলো না, বেইমান সিলভিকে খতম করে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে নিতে দোষ কোথায়!

সিলভির পেটে ডান হাঁটু গেঁথে দিল সিম্পসন। ভুস্ করে ফুসফুস থেকে বাতাস বেরিয়ে যেতেই কুঁজো হয়ে গেল যুবক। আর এই সুযোগে গরু জবাইয়ের মত করে তার গলায় ছোরা চালাল সিকিউরিটি চিফ। ক্ষত থেকে ফিনকি দিয়ে বেরোল টকটকে রক্ত। মাটিতে ধুপ করে পড়ে দু’পা ছুঁড়ছে সিলভি। একটু সরে তার ওপরে চোখ রাখল সিম্পসন।

একমিনিটের ভেতরে থেমে গেল সিলভির দেহের সব নড়াচড়া আর গলার ভেতরে ঘড়ঘড় আওয়াজ। আকাশে অস্বচ্ছ চোখে চেয়ে রইল টেকনিকাল ডিরেক্টর।

মনে অদ্ভুত এক তৃপ্তি নিয়ে জিপের দিকে চলল সিম্পসন। নিজেকে বলল, এভাবে খুন করতে যে এত মজা, আগে তো বুঝিনি! আমি চাই এমন করে আরও অনেকের জান নিতে!

সকল অধ্যায়

১. ডার্টি গেম – ১
২. ডার্টি গেম – ২
৩. ডার্টি গেম – ৩
৪. ডার্টি গেম – ৪
৫. ডার্টি গেম – ৫
৬. ডার্টি গেম – ৬
৭. ডার্টি গেম – ৭
৮. ডার্টি গেম – ৮
৯. ডার্টি গেম – ৯
১০. ডার্টি গেম – ১০
১১. ডার্টি গেম – ১১
১২. ডার্টি গেম – ১২
১৩. ডার্টি গেম – ১৩
১৪. ডার্টি গেম – ১৪
১৫. ডার্টি গেম – ১৫
১৬. ডার্টি গেম – ১৬
১৭. ডার্টি গেম – ১৭
১৮. ডার্টি গেম – ১৮
১৯. ডার্টি গেম – ১৯
২০. ডার্টি গেম – ২০
২১. ডার্টি গেম – ২১
২২. ডার্টি গেম – ২২
২৩. ডার্টি গেম – ২৩
২৪. ডার্টি গেম – ২৪
২৫. ডার্টি গেম – ২৫
২৬. ডার্টি গেম – ২৬
২৭. ডার্টি গেম – ২৭
২৮. ডার্টি গেম – ২৮
২৯. ডার্টি গেম – ২৯
৩০. ডার্টি গেম – ৩০
৩১. ডার্টি গেম – ৩১
৩২. ডার্টি গেম – ৩২
৩৩. ডার্টি গেম – ৩৩
৩৪. ডার্টি গেম – ৩৪
৩৫. ডার্টি গেম – ৩৫
৩৬. ডার্টি গেম – ৩৬
৩৭. ডার্টি গেম – ৩৭

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন