ডার্টি গেম – ২৫

কাজী আনোয়ার হোসেন

পঁচিশ

ভোরের নরম আলো পড়েছে জাপানি কমাণ্ড পোস্টের ওপরে। দামি রে-ব্যান সানগ্লাস পরে ডকের ওপরে পায়চারি করছে কাইতো তানাকা। অধৈর্য হয়ে দু’হাতে ঘোরাচ্ছে বোলো নাইফ। আলকারাযের কয়লা হওয়া দেহের সামনে গিয়ে থামল সে। এখনও সামান্য ধোঁয়া উঠছে দেহভস্ম থেকে। যে-কোন সময়ে মাসুদ রানা হামলা করবে ভেবে চারপাশে চোখ রেখেছে জাপানি খুনি। তার ধারণা, হাসতে হাসতে বাঙালি লোকটাকে লড়াইয়ে হারিয়ে দিতে পারবে সে।

ধনুক আর তীরে ভরা তৃণ নিয়ে কমাণ্ড পোস্টের ছাতে গিয়ে উঠেছে রুপার্ট শ্যানন। তারও চোখ চারদিকে। ছাত থেকে নিচের দিকে চেয়ে নিজেকে দ্বীপের রাজা মনে হচ্ছে তার। ভাবছে, কমাণ্ড পোস্ট আসলে রাজ-সিংহাসনের মত। কিন্তু তার রাজ্যে গোপনে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর এক লোক-নাম তার মাসুদ রানা। কোনভাবেই বাঁচতে দেয়া যাবে না তাকে। লোকটাকে কী কায়দায় খুন করবে সেটা ভাবতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠছে শ্যানন। হারামজাদা বাঙালি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে তার দিকে। তাতে অবশ্য কোন সমস্যা নেই। চিরকালই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে ভালবাসে শ্যানন। এই দ্বীপে এখন পর্যন্ত যাদের সঙ্গে লড়াই করেছে, সবাই ছিল মাছির মত ফালতু। এখন আশা করছে মাসুদ রানার কারণে অন্য পর্যায়ে চলে যাবে এরপরের লড়াইটা।

কমাণ্ড পোস্টের ছাত থেকে নিচে চেয়ে তানাকাকে দেখতে পেল শ্যানন। জাপানি যুবক আকারে তার অর্ধেক হলেও সত্যিকারের এক লড়াকু যোদ্ধা। তাকে বলা চলে এই দ্বীপের রাজার একমাত্র বিশ্বস্ত সেনাপতি। কিন্তু অন্য সবাই খুন হলে তানাকার জন্যে তখন একটা তীর’ খরচ করবে শ্যানন। এ-ছাড়া আসলে কোন উপায়ও নেই।

‘আশপাশে এখন না থাকলেও হারামজাদা আবারও হাজির হবে,’ ছাত থেকে জানাল শ্যানন, ‘তানাকা, তুমি কি ওকে নিজের হাতে খতম করতে চাও, নাকি আমার জন্যে রাখবে?’

ইংরেজি ভাল করেই বোঝে তানাকা। তবে মুখে কিছু না বলে বোলো ছুরি ঘুরিয়ে ক’বার বাতাস চিরে দিল সে। সামনে পেলে ফালি ফালি করে দেবে মাসুদ রানাকে।

‘আমিও তা-ই ভেবেছি,’ দাঁত বিকশিত হাসি দিল সাইকো শ্যানন।

.

ফিরতি পথ ধরে গিরিখাদের নিচের দিকে নেমে চলেছে রানা। এখন মাথার ওপরে কাঠের ভাঙা সেতু। শুকনো এক গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে নদী তীরে দুটো পাথরের মাঝে বারবার ঘষে চোখা করে নিয়েছে ওটার একমাথা। লাঠিটা দেখতে হয়েছে ছয় ফুটি কাঠের বর্শার মত। ওর ধারণা গ্রাম থেকে পিছু নেয়নি কেউ, তবুও পায়ের চিহ্ন আড়াল করতে অগভীর নদী পেরিয়ে গেল রানা।

ওর ভুল না হলে বোমা বিস্ফোরণে যারা মারা গেছে, আর মৃত আলকারাযকে হিসেবে নিলে দ্বীপে প্রতিযোগী আছে সবমিলিয়ে বড়জোর চার বা পাঁচজন।

সবচেয়ে সহজে শত্রুকে নিকেশ করতে হলে বুদ্ধিমানের কাজ হবে লাল ট্যাব ধরে টান দেয়া। মরার আগে আরেকটু হলে ওর লাল ট্যাব টেনে বের করত রাশান দৈত্য। আবারও কাউকে এ-সুযোগ দিতে চাইছে না রানা। ভাবছে, জিপিএস সিগনাল যেভাবে ঠেকিয়ে দিয়েছে, শত্রুর কাছ থেকে সেভাবেই নিরাপদ রাখবে গোড়ালির ব্রেসলেটের লাল ট্যাব।

নদীর উজানে হেঁটে সেতুর কংক্রিটের ভিত্তির দিকে এগিয়ে গেল রানা। ভাঙা ব্রিজের মাঝে বিশাল সিমেন্টের স্তম্ভের ওপরে একসময় ছিল কাঠের বিম। কিন্তু বোমার আঘাতে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে ওটা। শক্তিশালী বিস্ফোরণে স্তম্ভের এখানে-ওখানে খসে গেছে চাপড়া চাপড়া সিমেন্ট। সেখানে বেরিয়ে এসেছে জং-ধরা লোহার রডের কঙ্কাল।

রাতে হেলিকপ্টারটা তীরধনুক, দাহ্য তেল ও ছোরা পৌঁছে দিয়েছে শ্যাননের হাতে। তাতে রানা বুঝে গেছে প্রতিযোগীদের কাউকে কাউকে বিশেষ সুবিধে দিচ্ছে ব্র্যাড স্টিল। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর জীবনে থাকে অন্যায্য সব ঘটনা। কেউ পাবে তো কেউ পাবে না। সুতরাং এটা নিয়ে আর ভাবছে না রানা।

মানসিকভাবে তৈরি হতে হবে সামনের লড়াইয়ের জন্যে। খপ্ করে একটা রড ধরে একদিকে ঠেলে দিল ও। পরক্ষণে নিল অন্যদিকে। বারবার এদিক-ওদিকে নেয়ায় একমিনিটের ভেতরে ভেঙে গেল রড। পরের পনেরোটা ভাঙতে লাগল দশ মিনিট। প্রতি রডের দৈর্ঘ্য বড়জোর একফুট। ওগুলো মাটিতে রেখে ওয়েদার টাওয়ার থেকে সংগ্রহ করা ডাক্ট টেপ বের করল রানা। কিছুক্ষণের মধ্যে কনুই থেকে কবজি আর হাঁটু থেকে গোড়ালিতে ডাক্ট টেপ দিয়ে আটকে নিল রড। আশা করছে এই বর্মের জন্যে তীর মেরে সহজে ওকে খুন করতে পারবে না শ্যানন।

এবার নামল পরের কাজে। গোড়ালির বোমা ও লাল ট্যাব ভাল মত টেপ দিয়ে মুড়িয়ে নিল। এখন চট্ করে লাল ট্যাব টান দিয়ে খুলে নিতে পারবে না কেউ। এমনভাবে টেপ আটকে নিয়েছে, যাতে পরিষ্কার দেখা যায় টাইমার।

এখন ঘড়িতে বাজে ০৪:৪৩:২৫।

রানার মনে হলো না এখনও জাপানি কমাণ্ড পোস্টে রয়ে গেছে শ্যানন আর তানাকা। তবে তাদের পিছু নিতে হলে ওটা হবে সেরা জায়গা।

কথাটা মাত্র ভেবেছে রানা, এমন সময় মাথার ওপরে সেতুর পাটাতনে শুনতে পেল পদশব্দ। দেরি না করে চট্‌ করে কংক্রিটের পিলারের ওদিকে সরে গেল ও। ভাঙা বিমের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে তানাকাকে। দু’হাতে বোলো নাইফ ঘোরাচ্ছে সে। রানার বুঝতে অসুবিধে হলো না, এই ব্যাটা যখন এখানে রয়ে গেছে, তো খুব কাছেই কোথাও আছে শ্যানন।

দুই খুনি ভাবছে তাদেরকে মোকাবিলা করতে আবারও হাজির হবে রানা। আর এর আরেক অর্থ হচ্ছে: কষ্ট করে এদেরকে অনুসরণ করতে হবে না ওর। তানাকার আচরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে কোন ধরনের দুশ্চিন্তায় নেই, সঙ্গীর মতই আত্মবিশ্বাসী সে।

দ্রুত নিজের পরিকল্পনা গুছিয়ে নিল রানা।

.

সেতুর ওপরে অধৈর্য হয়ে উঠছে জাপানি খুনি। ভাবছে, বাঙালি লোকটা হাজির হলেই সঙ্গে সঙ্গে তাকে খতম করে দেবে। এরপর প্রথম সুযোগে দুনিয়া থেকে বিদায় করবে রুপার্ট শ্যাননকে। যাই ভাবুক, ইংরেজ সাইকোপ্যাথ আসলে দলনেতা নয়। সঠিক সময়ে তার ভুল ভাঙিয়ে দেবে কুং-ফু মাস্টার। বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ গুনে সে জানে, রানাকে খুন করার পর শুধু শ্যানন আর বড়জোর একজনকে খতম করে দিতে হবে। অথবা হয়তো এরই ভেতরে লোকটা বা মেয়েটা মারা গেছে। সেক্ষেত্রে শ্যাননকে পৃথিবী থেকে সরালে হিসাব অনুযায়ী দশজনের মধ্যে শুধু বেঁচে থাকবে সে। অর্থাৎ, তখন ডার্টি গেমের বিজয়ী বলে তাকেই ঘোষণা দেবে ব্র্যাড স্টিল। শ্যানন নিশ্চয়ই ভাবছে, রানাকে খুন করে তারপর মুখোমুখি হবে তানাকার। ধরে নিয়েছে, অন্যান্য প্রতিযোগীকে শেষ করে দিতে কোন ঝামেলায় পড়বে না সে।

ভবিষ্যতে কীভাবে হামলা করবে সেটা নিয়ে ভাবছে তানাকা। তার জানা নেই, একই সময়ে গিরিখাদের ঢালু জমি বেয়ে উঠে আসছে রানা। ঝোপঝাড়ের ভারী পাতার ওদিক থেকে দেখতে পেল, কমাণ্ড পোস্টের ছাত থেকে চারদিকে চোখ রেখেছে শ্যানন। মনোযোগ বেশি তার সেতুর ওপরে। রানা বুঝে গেল, অন্য কোনদিকে না গিয়ে ওর উচিত কমাণ্ড পোস্টের পেছনদিক দিয়ে ঢোকা। টেপ দিয়ে মোড়া রডের ‘ জন্যে একটু আড়ষ্ট পায়ে ঝোপঝাড় ও গাছপালার মাঝ দিয়ে এগোল রানা।

কম্পাউণ্ডের পেছনে পাথুরে দেয়ালের কাছে এসে বুঝে গেল, ওটা বেয়ে ওঠার সময় খুব সতর্ক হতে হবে ওকে, নইলে রডের সঙ্গে পাথরের আওয়াজে সবই টের পাবে শ্যানন। এ-ও ভাবল রানা, একবার ছাতে উঠলে সরাসরি ওর ওপরে হামলা করবে সে। সেক্ষেত্রে রানার বোধহয় উচিত হবে প্রথমে তানাকাকে শেষ করে দেয়া। পাথুরে দেয়ালে শুয়ে জাপানি খুনির ওপরে চোখ রাখল ও। সেতুর ওপরে অধৈর্য হয়ে পায়চারি করছে তানাকা। এখন নিঃশব্দ পায়ে ওদিকের ঝোপে গিয়ে ঢুকলে হয়তো আচমকা হামলা করা যাবে তার ওপরে।

সেতুর পাশের ঝোপঝাড় আর মাঝের দূরত্ব হিসাব কষল রানা। মনে মনে নিজেকে সতর্ক করল, শ্যাননের কাছে আছে তীরধনুক। নিজে যখন সেতুর ওদিকে ছিল ও, আর ওর দিকে তীর ছুঁড়ল সে, তার চেয়ে অনেক কাছে এদিকের ঝোপঝাড় ও তানাকা। একবার তার সঙ্গে লড়তে গেলে সেটা শেষ করতে হবে খুব দ্রুত। কারণ, বুলেটের মত একের পর এক তীর ছুঁড়তে না পারলেও ছাত থেকে অনায়াসেই ওকে গেঁথে ফেলতে পারবে শ্যানন। অবশ্য তীর ছুঁড়বার মাঝে থাকবে সামান্য বিরতি, আর সেই সুযোগে হয়তো এঁকেবেঁকে দৌড় দিয়ে আড়ালে সরে যেতে পারবে রানা। আর পরে সুযোগ মত মোকাবিলা করবে শ্যাননকে।

এবার এমন একটা সময় রানার বেছে নিতে হবে, যখন পরস্পরের দিকে পিঠ থাকবে দুই খুনির। সেতুর ভাঙা অংশের কাছে গিয়ে থামল তানাকা। চোখ বোলাল নিচের নদীতে। একই সময়ে কম্পাউণ্ডের পেছনে তাকাল শ্যানন। আর এই সুযোগে দেয়াল থেকে নেমে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে তীরবেগে ছুটে চলল রানা। পাতাগুলোর মাঝ দিয়ে দেখতে পেল তানাকাকে। সে আছে মাত্র বিশ ফুট দূরে। ঘুরে আবারও এগিয়ে এল সেতুর এদিকে।

আমাকে সঠিক সময়ের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে, মনে মনে নিজেকে বলল রানা।

সেতুর গোড়ায় এসে থেমে গেল তানাকা। শক্ত হাতে লাঠি ধরে অপেক্ষা করছে রানা। ভাবছে, আরেকটু কাছে আয়!

রানার দিকে আরও এক পা এগোল তানাকা।

এইবার!

চিতার বেগে ঝোপ থেকে ছিটকে বেরিয়ে সেতুতে উঠল রানা। হাতের বর্শার চোখা দিক বিদ্যুদ্বেগে চালাল তানাকার হৃৎপিণ্ড লক্ষ্য করে। ভেবেছিল সঙ্গে সঙ্গে মরবে যুবক। কিন্তু চট্‌ করে বর্শা এড়িয়ে গেল কুং-ফু মাস্টার। শুধু তা-ই নয়, ছোরার কোপে দু’ভাগ করে দিল রানার লাঠি।

এদিকে খটাশ্ শব্দ শুনতে পেয়ে ঘুরে তাকাল শ্যানন। রানাকে মোকাবিলা করতে এগিয়ে এল তানাকা, মুখে জাপানি গালি। সে যেন উন্মাদ কোন সুশি শেফ, ফালি ফালি করে দেবে রানাকে। দৃশ্যটা দেখে এক কান থেকে আরেক কানে গেল শ্যাননের দুই ঠোঁট। বাঙালি গাধাটাকে নিজের হাতে খুন করতে চেয়েছিল, কিন্তু নিজের কাজে কোন খুঁত রাখছে না তানাকা। অবশ্য এমনও হতে পারে যে, এই লড়াইয়ে শেষমেশ জিতে যাবে রানা। তবে ঘটনা যাই হোক, কিছুই যায়-আসে না শ্যাননের। দুই প্রতিযোগীর মধ্যে যে জয়ী হবে, তাকে মরতে হবে বুকে তীর খেয়ে।

তানাকার সঙ্গে লড়তে গিয়ে মস্তবড় বিপদে আছে রানা। জাপানি খুনির ওপরে যেমন চোখ রাখতে হবে, আবার যে- কোন সময়ে ছুটে আসতে পারে শ্যাননের তীর। তানাকা এগিয়ে আসতেই খাটো দুই লাঠির একটা দিয়ে খটাস্ করে তার মাথার পাশে বাড়ি বসিয়ে দিল রানা। তবে সত্যিকারের লড়াকু লোক এই জাপানি খুনি। টলমল করে পিছিয়ে পরক্ষণে পা ঘুরিয়ে কিক-জ্যাব করল রানার বাম কিডনিতে। বেদম ব্যথা পেয়ে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ফেললেও তানাকার দিকে এগোল রানা। ঝড়ের বেগে দু’হাতে দুই ছোরা ঘোরাচ্ছে কুং- ফু মাস্টার। কচকচ করে কাটা পড়ল রানার হাতের খাটো দুই লাঠি। ওর মুঠোয় রয়ে গেছে মাত্র তিন ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের ডাল। সে-দুটো বড়জোর ডাংগুলি খেলার সময় কাজে লাগবে বাচ্চাদের। হতাশ হয়ে ডালের টুকরো দুটো হাত থেকে ফেলে দিল রানা। লাফ দিয়ে এগিয়ে ছোরা ঘোরাতে ঘোরাতে ওর মুখে নকশা কাটতে চাইল জাপানি খুনি। কিন্তু বাহু তুলে তার আক্রমণ ঠেকিয়ে দিল রানা। ছোরার সংঘর্ষে চারদিকে ছিটকে গেল লাল ফুলকি। নিজের কাজ ঠিকভাবেই করছে সেতুর রড।

এ-ধরনের অদ্ভুত বাধার মুখে পড়বে সেটা ভাবতে পারেনি তানাকা। আর সে সুযোগটা পুরোপুরি নিল রানা। ওর ডানহাতি ঘুষি গেঁথে গেল তানাকার পেটে। একই সময়ে বাম বাহু দিয়ে খটাস্ করে বাড়ি দিল জাপানি খুনির মাথায়।

লোকটা এতই বেশি ব্যথা পেয়েছে, তার হাত থেকে সেতুর ওপরে ঠং-ঠং করে পড়ল দুই ছোরা।

এখন আর কোন অস্ত্র নেই তানাকার হাতে। যত ভাল মার্শাল আর্টিস্ট হোক, রানার অভিজ্ঞতা আর দৈহিক শক্তির কাছে সে আসলে কিছুই নয়। তানাকার প্রতিটি কিক আর জ্যাব ঠেকিয়ে দিয়ে পাল্টা বাড়তি কিছু ঘুষি তাকে উপহার দিচ্ছে রানা। ওর দু’হাতের মুঠো যেন কামানের গোলা, ধুপধাপ করে পড়ছে জাপানি যুবকের নাকে-মুখে ও বুকে। তার ওপর লোহার রড দিয়ে ঘেরা পায়ের জোর এক লাথি কোমরে লাগতেই ব্যথায় বাঁকা হয়ে গেল তানাকা। পরক্ষণে তার চোয়ালে নামল রানার ডানহাতি হুক। উড়ে গিয়ে ছিটকে সেতুর মেঝের পাটাতনে পড়ল তানাকা, প্রায় অচেতন।

এদিকে শ্যানন বুঝে গেছে যে হারাতে চলেছে নিজের সঙ্গীকে, তাই তূণ থেকে তীর নিয়ে ধনুকে জুড়ল সে। রানার বুকে ধনুক তাক করে থমকে গেল। এই দূরত্বে লক্ষ্যভেদ করতে পারবে কি না সেটা নিয়ে ভাবছে। তবে আরও অপেক্ষা করলে হয়তো রানার হাতে খুন হবে তানাকা। এরপর তীর এসে বুকে বিঁধবে সেজন্যে বোকার মত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে না রানা। তিন সেকেণ্ডে উধাও হবে ঝোপঝাড়ের ভেতরে।

দৌড়ে গিয়ে ছাতের কিনারায় থামল শ্যানন। ওখানে না থেমে লাফিয়ে নেমে এল নিচের ডকে। আনমনে হাসল নিজের যোগ্যতা দেখে। তীরবেগে ছুটল সেতুর দিকে। তারই ফাঁকে ধনুকে তীর জুড়ে ছিলা টেনে নিল কানের কাছে। দেখতে পেল তানাকার বুকে চেপে বসেছে রানা। এবার মট করে ভেঙে দেবে জাপানির ঘাড়।

এদিকে হঠাৎ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সতর্ক করতেই মুখ তুলে তাকাল রানা। দেখতে পেল কমাণ্ড পোস্টের কাছ থেকে ওকে লক্ষ্য করে ছুটে আসছে প্রায় অদৃশ্য তীর। কাত হয়ে তানাকার ওপর থেকে সেতুর মেঝেতে গড়িয়ে নামল রানা। পরের সেকেণ্ডে ওর শার্টের কলারের অংশ ছিঁড়ে নিয়ে নদীর দিকে গেল তীর। রানা বুঝে গেল, এবার গেঁথে ফেলা হবে ওকে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সেতু থেকে নেমে পড়ল ও। দু’ সেকেণ্ড আগে যেখানে ছিল ওর মাথা, সে জায়গা পেরিয়ে সেতুর বিমে গেঁথে গেল আরেকটা তীর।

কম্পাউণ্ডের বাঙ্কার লক্ষ্য করে ছুটে চলল রানা। একবার বাঙ্কারের কোনা ঘুরতে পারলে তীর মেরে ওকে খুন করতে পারবে না শ্যানন। তখন রানাকে শেষ করতে হলে ঝুঁকি নিয়ে তাকে ঢুকতে হবে অন্ধকার বাঙ্কারে, আর তখন শুরু হবে হ্যাণ্ড-টু-হ্যাণ্ড কমব্যাট।

ছোটার গতিহ্রাস না করেই বাঙ্কারের কোনা ঘুরে ডাইভ দিয়ে সাইড ডোরের ওদিকে গিয়ে পড়ল রানা। পাশের দেয়ালে লেগে ঠিকরে গেল একটা তীর। বাঙ্কারের দেয়ালে ঠাস্ করে লেগেছে রানার মাথা। আঁধারে দেখতে পেল জাপানি আর্মির তৈরি সরু ভিউয়িং স্লট। ওদিক দিয়ে আসছে ভোরের আলো। আর সেই লালচে রশ্মিতে দেখা যাচ্ছে, ওর দিকেই চেয়ে আছে বড় মায়াবী দুটো চোখ!

রানার বুঝতে দেরি হলো না, ও ছাড়াও আরও কেউ আছে বাঙ্কারে!

.

সেতুর ওপরে উঠে দাঁড়াল কাইতো তানাকা, রক্তাক্ত চেহারায় দুই ছোরা হাতে ছুটে গেল বাঙ্কারের দিকে। ডকে পড়ে থাকা সাপ্লাই ব্যাগ হাতের ইশারায় তাকে দেখাল শ্যানন, ঠোঁটে শয়তানির হাসি। মুখে কিছু বলতে হলো না তানাকাকে। ব্যাগে এখনও আছে আরও দুটো অকটেনের বোতল।

.

এদিকে বাঙ্কারের ভেতরে লালচে আলোয় সরে এল অদ্ভুত সুন্দর চোখের মেয়েটা। সে রোযি ইয়াসিমান। বি-২৫ বিমানের ভেতরে জনি এস. ক্লার্ক বোমা বিস্ফোরণে মারা যাওয়ার পর আবারও ফিরে গিয়েছিল ওখানে। কাজে লাগবে বলে ওখান থেকে সংগ্রহ করেছে ধাতব একটা চোখা শাফট।

শ্যানন ও তানাকা আলকারাযকে নির্যাতন করার সময়ে বাঙ্কারের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল সে। এখনও ভাবছে কোন উপায়ে শেষ করে দেবে অন্যান্য প্রতিযোগীদেরকে। আর সেক্ষেত্রে ওকে বিজয়ী ঘোষণা করবে ব্র্যাড স্টিল। ভেবেছিল বাঙ্কারে শ্যানন বা তানাকা ঢুকলে তাদেরকে খুন করবে সে। এখন রানাকে দেখে একই কথাই ভাবছে।

‘তুমি তা হলে এখানে,’ নিচু গলায় বলল রানা। ভেবেছিল অনেক আগেই খুন হয়ে গেছে মেয়েটা। তবে এখন বুঝে গেল, সত্যিকারের লড়াকু মনের মানুষ রোযি ইয়াসিমান।

‘এবার নিশ্চয়ই আমার ওপরে হামলা করবে?’ হিসহিস করে বলল মেয়েটা।

পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল ওরা।

আঁধারে ইয়াসিমানের চোখ সয়ে গেলেও রানা এখনও অভ্যস্ত নয়। তা ছাড়া, মাথায় বাড়ি খেয়ে এখনও সামলে নিতে পারেনি। তবুও ওর যোগ্য প্রতিপক্ষ নয় রোযি। হঠাৎ করে মেয়েটা এগোতেই তার কবজি খপ্ করে ধরে ফেলল রানা। ধাক্কা মেরে ঠেলে দিল সরু স্লটের দেয়ালের গায়ে। মেয়েটার দেহের পেছনে আটকা পড়েছে হাতের চোখা শাফট। সেঁটে আছে ওদের পরস্পরের দেহ। দুই নাকের মাঝে মাত্র এক ইঞ্চি ব্যবধান। হঠাৎ করেই শরীরে ঢিল দিল রোযি। মুখ থেকে বিদায় নিল কঠোরতা। চোখে-মুখে কাতর ভাব। একই অভিনয় করে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে আমেরিকান ড্রাগ ডিলারের।

‘প্লিয, আমাকে ছেড়ে দাও,’ কাঁপা গলায় বলল রোযি। ‘রেপ কোরো না। আমি ভেবেছিলাম তুমি হামলা করবে।

চুপ করে থাকল রানা।

ছলছলে চোখে মায়াবী দৃষ্টি এনে ওকে দেখছে রোযি। ‘তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। আমি কখনও তোমার কোন ক্ষতি করব না।’

‘এই দ্বীপের কাউকে আমি বিশ্বাস করি না,’ বলল রানা।

ইয়াসিমান কিছু বলার আগেই হুস্ করে একটা আওয়াজ শুনতে পেল ওরা।

ভীষণ ঝটকা খেল মেয়েটার দেহ। বিস্ফারিত চোখে রানার দিকে তাকাল সে। কী যেন বলতে মুখ হাঁ করলেও গলা চিরে বেরোল না কোন শব্দ।

কারোযিকে সরিয়ে এনে রানা দেখতে পেল তীর গেঁথে আছে তার পিঠে। জিনিসটা ঢুকেছে সরু স্লট দিয়ে।

এক্কেবারে বুল’স্‌ আই!’ বাইরে হো-হো করে হেসে উঠল শ্যানন। ‘বেরিয়ে আয়, বাঙালি হারামজাদা! এবার তোর পালা!’

সাবধানে এগিয়ে আসছে ইংরেজ সাইকো। ওদিকে বাঙ্কারের সাইড ডোর লক্ষ্য করে এল তানাকা, হাতে মলোটভ ককটেল। এরই ভেতরে আগুন জ্বেলে নিয়েছে সলতের ডগায়। এসএএস ফোর্সে থাকার সময়ে দুর্ধর্ষ যোদ্ধা মাসুদ রানা সম্পর্কে বহু কিছুই শুনেছে শ্যানন, তাই কোন ঝুঁকি নিচ্ছে না।

আস্তে করে বাঙ্কারের মেঝেতে ইয়াসিমানকে শুইয়ে দিল রানা। কাতর সুরে গোঙাচ্ছে মেয়েটা। নিজেও বুঝে গেছে, মরতেই হবে ওকে। পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল রানা ও ইয়াসিমান। আর তখনই ভেতরের একটা দেয়ালে লেগে ঠাস্ করে ভাঙল অকটেনের কাঁচের বোতল। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে চারদিকে ছড়িয়ে গেল নীল আগুনের হলকা। লেলিহান শিখা চলে গেছে আর্টিলারি শেলগুলোর খুব কাছে। যে-কোন সময়ে বাঙ্কারের ভেতরে তৈরি হবে আস্ত নরক।

.

‘বাঙ্কারের দৃশ্য দেখাও! বাঙ্কার! জলদি!’ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল ব্র্যাড স্টিল।

সিলভারম্যানের বেছে নেয়া লো-লাক্স নাইট-ভিশন লেন্সের কল্যাণে সবাই দেখতে পাচ্ছে বাঙ্কারের ভেতরে মাসুদ রানার ওপরে হামলা করেছে দক্ষিণ আফ্রিকার সুন্দরী রোযি ইয়াসিমান। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পর মলোটভ ককটেল ফাটতেই ঘরের ভেতরে দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। পরক্ষণে লেলিহান শিখায় পুড়ে গেল লেন্সের সার্কিট

‘ভেতরের দুই ক্যামেরার সার্কিট পুড়ে গেছে, আমাদের আর কিছু করার নেই,’ হতাশ সুরে বলল সিলভি। কী ভয়াবহভাবে মেক্সিকান দম্পতিকে হত্যা করেছে শ্যানন ও তানাকা, নিজের চোখে দেখেছে সে। এ-ও জানে, খুন না করে উল্টে আলকারাযকে সাহায্য করেছে মাসুদ রানা। বাঙালি মানুষটাকে বাঙ্কারে দেখে সিলভির মনে হয়নি সে রোযি ইয়াসিমানকে খুন করবে। আর তারপর দেখল মেয়েটাকে তীর মেরেছে শ্যানন।

এই অন্যায় লড়াইয়ে কে বিজয়ী হবে, সেটা নিয়ে একটু আগেও আগ্রহ ছিল না সিলভির। কিন্তু এখন বুঝে গেছে, কার উচিত এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়া, আর কাদের উচিত খুন হওয়া। রুপার্ট শ্যানন ও কাইতো তানাকা অশুভ মানুষ, বিশেষ করে ইংরেজ সাইকোপ্যাথ-আর তাকে শেষ করতে হলে চাই মাসুদ রানার মত যোগ্য কাউকে। অথচ শেষ দৃশ্য দেখে সিলভির মনে হয়েছে, আগুনে পুড়ে মরতে হবে রানার। তাই এখন সিলভি ভাবছে, হয়তো এটাই ভাল হলো, নিজের চোখে তার মৃত্যু দেখতে হলো না ওকে।

.

বাঙ্কারে আগুনে পুড়ে বা শেল ফাটার মাধ্যমে ওর মৃত্যু হবে সেটা জেনেও ঘাবড়ে যায়নি রানা। নানান সিনারিয়ো নিয়ে গবেষণা করেছে আর্মি জীবনে। তাই জানে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানি মিলিটারি ছিল দুর্ধর্ষ এক ফোর্স। কোনভাবেই তাদেরকে কোণঠাসা করা যেত না। বিশেষ করে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্টিলারি বাঙ্কারে। শক্তিশালী শত্রুপক্ষ হামলা করবে অথচ নিজেরা নিরাপদে সরে যাওয়ার পথ জাপানি যোদ্ধারা রাখবে না, এটা অসম্ভব।

এখান থেকে বেরোবার অবশ্যই অন্য কোন পথ আছে।

চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে লকলকে আগুন। বাঙ্কার থেকে বেরোবার দ্বিতীয় পথ খুঁজতে লাগল রানা। খাড়া একটা পাথুরে টিলা ঘেঁষে এই বাঙ্কার, তাই ধরে নেয়া যায় টিলা ভেদ করে তৈরি করা হয়নি কোন সুড়ঙ্গ। ঘন ধোঁয়া থেকে বাঁচতে মেঝেতে বসে পড়েছে রানা। দু’হাতে মেঝেতে কিল দিতে দিতে হামাগুড়ি দিয়ে এগোল সামনে। প্রথম পাঁচ ফুট শক্ত মাটির হলেও এরপর মেঝেতে কিল দিতেই ওদিক থেকে এল ফাঁপা একটা আওয়াজ। দ্রুত হাতে মেঝে থেকে ধুলোবালি সরিয়ে কাঠের এক ট্র্যাপডোর দেখতে পেল রানা। হ্যাঁচকা টানে ওটা ওপরে তুলতেই পেয়ে গেল নিচে গোপন এক ছোট চেম্বার। ধোঁয়ার ভেতরে হাত বাড়িয়ে রোযির হাত ধরল রানা।

‘এসো! এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে!’

কথাটা শুনেও নড়ল না মেয়েটা। আবছা আলোয় রানা দেখতে পেল ইয়াসিমানের আরেক হাত চলে গেছে গোড়ালির লাল ট্যাবের কাছে।

‘কাজটা কোরো না, এখনও হয়তো বাঁচার সুযোগ আছে,’ নরম সুরে তাকে বলল রানা।

পিঠে গেঁথে থাকা তীরের জন্যে অসহ্য ব্যথা সইতে হচ্ছে মেয়েটার। বুঝে গেছে যে, আর বাঁচতে পারবে না। মুখের কাছে দুলছে নীল আগুনের শিখা। চোখ মেলে ফিসফিস করে বলল সে, ‘প্লিয, আমাকে কোথাও সরিয়ো না। তাতে ব্যথা বেড়ে যাবে।’

চুপ করে থাকল রানা। দু’জনই বুঝে গেছে, কোন উপায় নেই রোযি ইয়াসিমানের বেঁচে থাকার। মারাত্মক যে ব্যথা সহ্য করছে, তার চেয়ে দ্রুত মৃত্যু অনেক বেশি সুখের।

আস্তে করে মেয়েটার হাত ছেড়ে দিল রানা।

হ্যাঁচকা টানে লাল ট্যাব খুলে নিল রোযি ইয়াসিমান।

শেষবারের মত তাকে দেখে নিয়ে নিচের চেম্বারে নেমে গেল রানা।

সকল অধ্যায়

১. ডার্টি গেম – ১
২. ডার্টি গেম – ২
৩. ডার্টি গেম – ৩
৪. ডার্টি গেম – ৪
৫. ডার্টি গেম – ৫
৬. ডার্টি গেম – ৬
৭. ডার্টি গেম – ৭
৮. ডার্টি গেম – ৮
৯. ডার্টি গেম – ৯
১০. ডার্টি গেম – ১০
১১. ডার্টি গেম – ১১
১২. ডার্টি গেম – ১২
১৩. ডার্টি গেম – ১৩
১৪. ডার্টি গেম – ১৪
১৫. ডার্টি গেম – ১৫
১৬. ডার্টি গেম – ১৬
১৭. ডার্টি গেম – ১৭
১৮. ডার্টি গেম – ১৮
১৯. ডার্টি গেম – ১৯
২০. ডার্টি গেম – ২০
২১. ডার্টি গেম – ২১
২২. ডার্টি গেম – ২২
২৩. ডার্টি গেম – ২৩
২৪. ডার্টি গেম – ২৪
২৫. ডার্টি গেম – ২৫
২৬. ডার্টি গেম – ২৬
২৭. ডার্টি গেম – ২৭
২৮. ডার্টি গেম – ২৮
২৯. ডার্টি গেম – ২৯
৩০. ডার্টি গেম – ৩০
৩১. ডার্টি গেম – ৩১
৩২. ডার্টি গেম – ৩২
৩৩. ডার্টি গেম – ৩৩
৩৪. ডার্টি গেম – ৩৪
৩৫. ডার্টি গেম – ৩৫
৩৬. ডার্টি গেম – ৩৬
৩৭. ডার্টি গেম – ৩৭

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন