কাজী আনোয়ার হোসেন
তাঁবুর এডিটিং বে-তে কাজ করছে বারোজন টেকনিশিয়ান। সামনে ছাতের কাছে ঝুলছে মস্ত এলইডি স্ক্রিন। ওটার ভেতরে আছে দশটা বক্স। তার নয়টার ভেতরে অপরাধীদের পাসপোর্ট ছবি। অবশ্য দশ নম্বর বক্সে কারও ছবি নেই। অলিম্পিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের মত অপরাধীদের প্রত্যেকের ছবির নিচে ফুটে উঠেছে তাদের নাম ও জাতীয় পতাকা।
হঠাৎ দশম বক্সে দেখা দিল রাশান অপরাধী লোপাতিনের ছবি। মস্ত স্ক্রিনের প্রথম বক্সে আছে মা-বোন ও স্ত্রীকে হত্যাকারী এক সিরিয়ান মুসলিম আরবের ছবি। এরপর মধ্যবয়সী এক জার্মান নাৎসি। তারপর কোঁকড়ানো চুলের আফ্রিকান-আমেরিকান এক যুবক। তার পাশের দুই বক্সে দুই মেক্সিকান লুঠেরার ছবি। তাদের একজন পুরুষ। অন্যজন মহিলা। ষষ্ঠ অপরাধী মার্শাল আর্টে দক্ষ জাপানি এক খুনি। সপ্তম হত্যাকারী অদ্ভুত সুন্দরী আফ্রিকান এক কালো মেয়ে। অষ্টম ছবি পনি টেইল করা এক ইতালিয়ান খুনির। নয় নম্বর অপরাধী সাইকোপ্যাথের মত চোখের এক ইংলিশ যুবক।
নানান কারাগার থেকে আনা হয়েছে এদের দশজনকে। প্রত্যেকে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর খুনি। তাদেরকে যার যার দেশে দেয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। নিজের বেছে নেয়া অপরাধীদের দিকে চেয়ে খুশিতে ভরে গেল স্টিলের অন্তর। আর তখনই ওর পাশে এসে থামল ফ্যাশান ডিযাইনার রূপসী রিটা জোসেফ।
‘আমার অনুষ্ঠানের প্রতিযোগীদেরকে দেখে কী মনে হচ্ছে তোমার?’ জানতে চাইল স্টিল।
‘তোমার তুলনা নেই,’ প্রেমিকের কাঁধে হাত রাখল রিটা। ‘ভাবতে পারিনি এত কঠিন কাজ তুমি করে দেখাবে।’
মেয়েটার ব্রিটিশ উচ্চারণের জন্যে ওকে আরও সেক্সি বলে মনে হচ্ছে স্টিলের। হেসে বলল, ‘ও, তা হলে আমার যোগ্যতা নিয়ে তোমার মনে কোন সন্দেহ ছিল?’
‘ভাবতেই পারিনি কেউ এ-কাজ পারবে,’ বলল রিটা।
‘অসম্ভবকে সম্ভব করার কাজটাই আমার পছন্দ।’
‘আর সেজন্যেই তোমাকে আমার এত ভাল লাগে,’ হাসল রিটা। ওর কাঁধে ঝিলমিল করছে একরাশ সোনালি চুল।
সাত মাস হলো মেয়েটা স্টিলের নতুন প্রেমিকা। আগে কখনও কোন মেয়ে এত দিন তার সঙ্গে টিকতে পারেনি। এ- থেকে স্টিল বুঝে গেছে, তার মেজাজ বুঝে চলে রিটা। যেমন দারুণ সুন্দরী, শরীরটাও তেমন নিখুঁত। তুলনা নেই বিছানায়। আরও বড় কথা—রিটা বুদ্ধিমতী। চেপে বসে না কারও ঘাড়ে।
চামড়ার লাউঞ্জ চেয়ার ছেড়ে নেমে পড়ে রিটার ঠোঁটে চুমু দিল স্টিল। নতুন শো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে টেস্টোস্টেরন বেড়ে গেছে তার শরীরে, অথচ উপায় নেই রিটাকে বিছানায় তোলার। চারপাশের কর্মীদেরকে দেখে তার মনে হলো, শো তৈরি করে মানুষের মন কেড়ে নেয়ার চেয়ে ফূর্তির আর কিছু নেই। নানান আকারের ডিসপ্লেতে দেখা যাচ্ছে অনেক রকমের গ্রাফিক। অন্যগুলোতে বিজ্ঞাপন, ব্লগ ও ওয়েব প্রচারণা।
‘দুই ও তিন নম্বর স্ক্রিনে কিসের প্রোমো?’ জানতে চাইল এডিটিং অ্যাণ্ড গ্রাফিক্স টিমের চিফ এমিলি। ওর বয়স মাত্র তেইশ। মাথার খাটো করে ছাঁটা চুল কালো রঙের। পরনে ঢিলা গেঞ্জি ও জিন্সের প্যান্ট। চোখে পুরু কাঁচের চশমা।
‘এইমাত্র দিতে শুরু করেছি,’ জবাবে বলল টিমের তরুণ এক টেকনিশিয়ান।
কোথাও কোন ত্রুটি আছে কি না, সেটা বোঝার জন্যে মস্তবড় তাঁবুর ভেতরে চক্কর কাটল ব্র্যাড স্টিল। ‘এমিলি, আমাকে জানাও প্রোমোর কী অবস্থা।’
‘এইমাত্র তিরিশ সেকেণ্ডের প্রোমো রেডি করে ছেড়েছি, ‘ অতিরিক্ত ক্যাফেইনে ভরা কর্কশ স্বরে বলল এমিলি। ‘একই সঙ্গে ইউটিউব আর ফেসবুকে প্রোমো যাচ্ছে।’
‘গুড,’ রাশান দানবের ছবি আরেকবার দেখল স্টিল। ‘আমাদের নতুন আকর্ষণ ম্যানইয়া লোপাতিনের ছবি শেয়ার করো। ওর চেহারা পয়সার মাল! মানুষ গপগপ করে গিলবে!’
‘ঠিকই বলেছেন, বস্।’
আরেক টিমের কাছে গিয়ে থামল স্টিল। তারা ব্যস্ত হয়ে কাজ করছে ইণ্টারনেটে।
‘সিওয়ার্স, ওরা কেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে আমাদের প্রতি?’
‘খবর আগুনের মত ছড়িয়ে গেছে,’ বলল লাল চুলের যুবক রন সিওয়ার্স। একমাস হলো থুতনিতে রেখেছে দাড়ি।
‘আগুনের তাপ কতটা ভাবছ?’
‘সূর্যের চেয়েও বেশি। আমার টিম খবর দিচ্ছে নানান ব্লগ আর চ্যাট-রুমে। বিক্রি করছে বিজ্ঞাপনের জন্যে স্পেস। প্রতি মিনিটে সাইটগুলো থেকে সাড়া পাচ্ছি নয় শ’র বেশি। পর্নো ও ফাইট ব্লগ আগ্রহ দেখাচ্ছে বিরানব্বুই পার্সেন্ট।’ বিশ বছরের তরুণের মত উৎসাহ নিয়ে কাজ করছে রন সিওয়ার্স।
এই যুবক স্টিলের ওয়েব গুরু। আগে ছিল পাকা হ্যাকার। ধরা পড়ে জেলে যেত, কিন্তু তখন সে ছিল নাবালক। সেজন্যে আদালত থেকে মাফ করা হয় তাকে। পোর্শে গাড়ির কোম্পানি যেমন হাতের তালুর মত চেনে অটোবাহন, তার চেয়ে বেশি ভালভাবে ইন্টারনেটের জগৎ চেনে সিওয়ার্স।
‘এমিলির কাছে আধমিনিটের ম্যাটার আছে,’ বলল স্টিল। ‘দেখো, ওটা যেন পরের একঘণ্টা দেখানো হয় সেক্স, ফাইট আর গেম্স্ সাইটে।’
‘তথাস্তু!’ ঘুরে কমপিউটারের কিবোর্ডে ঝড়ের বেগে দশ আঙুল চালাল সিওয়ার্স। তাকে পাশ কাটিয়ে অন্যদিকে চলল স্টিল। নিজেকে দক্ষ এক জেনারেল বলে মনে হচ্ছে তার। নিজের সৈনিকদেরকে প্রস্তুত করছে পরবর্তী যুদ্ধের জন্যে।
‘জলদি! কোথাও যেন কোন ত্রুটি না থাকে! আমাদের বিজ্ঞাপন থেকে যেন বাদ না পড়ে কোন ইন্টারনেট সার্ফার। এই শো যেন এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, দুই আমেরিকা, ওশেনিয়া এমন কী অ্যান্টার্কটিকার ভয়ঙ্কর ঝড়ের মাঝেও ইগলুর ভেতরে বসে দেখতে পায় এস্কিমোরা। আগামী ক’দিন চব্বিশ ঘণ্টা চালাও বিজ্ঞাপন।’
চরকির মত ঘুরে সিওয়ার্সের দিকে তাকাল সে। ‘সিওয়ার্স, মাত্র বিরানব্বুই পার্সেন্ট কেন? আমি চাই পুরো হান্ড্রেড পার্সেন্ট! ইন্টারনেটের সবাই যেন এই শো-র কথা জানতে পারে! আমার কথা বুঝতে পেরেছ?’
‘গট ইট, বস্!’ একসেকেণ্ড বিরতি না নিয়েই টাইপ করে চলেছে সিওয়ার্স। তাঁবুর ক্যানভাসের ভেতরে উষ্ণ পরিবেশে একুশ ঘণ্টা বিশ্রামহীনভাবে অন্যদের সঙ্গে কাজ করছে সে।
এক টেকনিশিয়ানের সামনে থামল স্টিল। ঘুম ঠেকাতে ফেনা ওঠা কড়া কফিতে চুমুক দিচ্ছে তরুণ। স্টিলের ইচ্ছে হলো কষে তার গালে চড় দিতে। কিন্তু ক্রুদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে তার ফলাফল হবে খুব খারাপ। তাই হাসি-হাসি মুখে বলল সে, ‘জেগে থাকো, আমার দুর্ধর্ষ সৈনিক! যুদ্ধের সময় ঘুমাতে নেই!
বসের বক্তব্য শুনে বুঝে গেল তরুণ, জরুরি কাজে কোন গাফিলতি করা চলবে না।
‘এমিলি, ওদের কাজ বুঝিয়ে দাও,’ তাঁবুর দরজার দিকে চলল স্টিল। ‘ওদের বলো, আমাদের টার্গেটের চেয়ে প্রতি মিলিয়ন ভিউ বেশি হলে সবাই পাবে বাড়তি দশ হাজার ডলার করে।
এ-কথা শুনে নতুন করে মনোযোগী হয়ে উঠল তাঁবুর সবাই। স্টিলের ক্রুরা বয়সে তরুণ। সামনে কোন টার্গেট দেয়া হলে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেকে প্রমাণ করতে। একবার সবার হাসিমুখ দেখে নিয়ে তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে এল স্টিল। সে জানে, মানুষকে শতবার বললে যে ফলাফল হবে, তার বহু গুণ কাজ হবে একহাজার ডলার হাতে ধরিয়ে দিলে।
টাকা সবসময় কথা বলে।
তাঁবুর ভেতরে রয়ে গেছে রিটা। পেছন থেকে প্রশংসার চোখে স্টিলকে দেখছে আর ভাবছে, মানুষটা বড্ড বেশি কাজ পাগল। নিজের দিকে একটুও খেয়াল নেই। মাত্র সাত মাস হলো ওকে চেনে রিটা। এরই ভেতরে মনে মনে ভালবেসে ফেলেছে। মানুষ হিসেবে স্টিল যেমন বুদ্ধিমান, তেমনি টাকা- পয়সাওয়ালা। একবার কোন কিছুতে মন দিলে কাজটা না শেষ করে থামে না। নিজে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ফ্যাশন ডিযাইনিঙে এম.এস. করেছে রিটা, তবে স্টিলের তুলনায় নিজেকে ওর মনে হয় তুচ্ছ মানুষ। ফ্যাশন ডিযাইনার হিসেবে সামনে ছিল ওর চমৎকার ক্যারিয়ার। নিজেই হয়তো একসময় ফ্যাশন শো করে সবাইকে চমকে দিত। কিন্তু সে-পথে যাওয়ার আগেই লণ্ডনের এক ডিযাইন শো-তে ওর সঙ্গে দেখা হলো স্টিলের। সে বলল, চিরকৃতজ্ঞ হয়ে যাবে তার দলের সবার জন্যে ডিযাইনার পোশাক রিটা তৈরি করে দিলে।
পুরুষমানুষের চোখ দেখে অনেক কিছুই বুঝে ফেলে মেয়েরা। মাত্র কয়েক দিনের ভেতরে রিটা বুঝল, মন থেকে ওকে কাছে চাইছে স্টিল। ডিনারে নিয়ে গিয়ে সেরা খাবার অর্ডার করে শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে লাজুক মুখে বলল স্টিল, ‘আমি বোধহয় মস্তবড় ভুল করে বসেছি। রিটা, কখন যেন ভালবেসে ফেলেছি তোমাকে।’
এরপর প্রেমের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারেনি রিটা কিছু দিন আগে ব্র্যাড বলেছে, লঞ্চ করবে অদ্ভুত এক শো। আর ওটা হবে দুর্ধর্ষ দাগী কয়েদীদের নিয়ে। আর তাই চাই তাদের জন্যে ভাল পোশাক। সে-দায়িত্ব রিটা নিজের কাঁধে নিলে খুশি হবে স্টিল। ও আরও বলেছে, শো-তে থাকবে চরম উত্তেজনা ও দুর্দান্ত বিনোদন। প্রথমে এই শো-র কথা শুনে অবাক হয়েছিল রিটা। আগে কখনও কারও মনে এমন ভাবনা এসেছে কি না, জানা নেই ওর। স্টিল জানিয়ে দিয়েছে, দক্ষতার সঙ্গে অনুষ্ঠান পরিচালনা করবে ও। আর তাতেই শাস্তি পেয়ে যাবে ক্রিমিনালেরা। এবং এর মাধ্যমে শেষ হবে ডার্টি গেম শো।
এলইডি স্ক্রিনে খুনিদের দেখে রিটা বুঝে গেছে, এদেরকে প্রতিযোগিতায় নামানোর জন্যেই জড় করেছে ব্র্যাড। ফাঁসির মঞ্চে বা ইলেকট্রিক চেয়ারে এমনিতেই জীবন দিত এরা। ব্র্যাড শুধু চেয়েছে, তাদের ভেতরে যেন শুরু হয় লড়াই। সেই প্রতিযোগিতায় শেষমেশ যে বিজয়ী হবে, মেলা টাকাসহ নিরাপদ কোন দেশে পৌঁছে দেয়া হবে তাকে।
অবশ্য স্টিল এসব নিয়ে কথা বললে কেন যেন ডার্টি গেম শো-র ব্যাপারে মন থেকে একদম সাড়া পাচ্ছে না রিটা। বিশাল তাঁবু থেকে বেরিয়ে চারপাশে তাকাল ব্র্যাড স্টিল। নতুন শো-র জন্যে গড়ে নিয়েছে তাঁবুর তৈরি এই গ্রাম। এখানে-ওখানে ক্যানোপি দেয়া জায়গা, ক্যামোফ্লেজ করা ভেহিকেল ও একাধিক স্যাটেলাইট ডিশ। দশ ফুট উঁচু রেযর ওয়াএয়ার দিয়ে ঘেরা হয়েছে গোটা গ্রাম। এটা যেন ভিডিয়ো প্রোডাকশনের কোন হাউস নয়, যুদ্ধের এক কমাণ্ড সেন্টার।
গ্রামের একদিকে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জঙ্গলের মাঝ থেকে হঠাৎ করেই আকাশে নাক তুলেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নড়বড়ে এক ওয়েদার টাওয়ার। ওটার ওপর থেকে সহজেই দেখা যায়, দ্বীপের চারপাশ। টাওয়ারের ওপরে স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন যন্ত্র ও ট্র্যাকিং ইকুইপমেন্ট নিয়ে আট ঘণ্টার শিডিউলে কাজ করছে যোগ্য ক’জন টেকনিশিয়ান।
শো-র জন্যে টাওয়ারের ওপর ক্যামেরা বসাচ্ছে একদল অডিয়োভিস্যুয়ার টেকনিশিয়ান। তাদের পাশ কাটাল স্টিল। কম্পাউণ্ডের চারপাশে সেট করা হয়েছে এক শ’র বেশি ভিডিয়ো লেন্স। এ-ছাড়া জঙ্গলে আছে ক্যামোফ্লেজ করা তিনগুণ ক্যামেরা। জিপে করে টেক গ্রামে আনা হয়েছে এসব যন্ত্রপাতি। সব দক্ষতার সঙ্গে বসানো হয়েছে সঠিক জায়গায়। গ্রামের রেযর ওয়াএয়ারের ওদিকে দ্বীপের অন্য জায়গাগুলোকে ধরে নেয়া হয়েছে খুনিদের প্লে-গ্রাউণ্ড হিসেবে।
আরেকবার টেকনিশিয়ানদের দেখল ব্র্যাড। ওখানে আছে তার ডানহাত গ্রেগরি সিলভারম্যান। কয়েক বছর ধরে স্টিলের টেকনিকাল ডিরেক্টর ও ক্যামেরা উইয়ার্ড হিসেবে কাজ করছে সে। দুই বিয়েতে দুই স্ত্রী স্টিলের সঙ্গে যেসময় কাটিয়ে গেছে, তার চেয়ে বেশি পাশে থেকেছে সিলভারম্যান। সহজ লোক নয় সে। নিখুঁত দৃশ্যধারণে যেমন দক্ষ, তেমনি প্রতিটি বিষয়ে নালিশ করার বিশ্রী এক অভ্যেস আছে তার।
‘ঠিক আছে, আমার কথা বুঝতে পেরেছ, রবি? বাইশতম ক্যামেরার কী হলো? ওটার দৃশ্য তো ক্যাডিলাকের মত বড় দেখাচ্ছে। অথচ হওয়ার কথা পিঁপড়ের সমান! তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? সামনে কিন্তু বড় ধরনের কাজ। তুমি পাগল হয়ে গেলে তো আমার চলবে না! বিষয়টা কী?’
বরাবরের মতই উত্তেজিত হয়ে নিজের কাজ করছে গ্রেগরি, সিলভারম্যান। তাকে ভাল করে চেনে স্টিল। কোন কাজ না পেলে খেপে ওঠে মানুষটা। বয়স তার বড়জোর আটাশ। অথচ এরই ভেতরে মুখটা হয়ে গেছে বুড়ো বুলডগের মত তিক্ত। চোখের নিচে ফকিরের শত তালি দেয়া নীল-বেগুনি ও লালচে দুটো ব্যাগের মত ঝোলা। কানদুটো কুলোর মত বড়। চুল উঠে ফাঁকা হয়ে গেছে মাথার তালু। গত পাঁচ দিনে স্নান করে পোশাক পাল্টায়নি। জীবনে কখনও ব্যায়াম করেছে এমন কোন ইতিহাস কারও জানা নেই। সারাদিন পড়ে আছে ভিডিয়ো ক্যামেরা ও ভিডিয়ো সুইচ নিয়ে। অদ্ভুত মানুষটার দৃশ্যপটে হাজির হলো স্টিল।
‘কী খবর,’ একটা স্যাটেলাইট ডিশের দিকে পা বাড়িয়ে হাতের ইশারা করল সিলভারম্যান। বাধ্য হয়ে তার পিছু নিল স্টিল। বুঝে গেছে, আপাতত খারাপি আছে ওর কপালে।
‘বুঝলে, আমরা দোষ ছাড়াই পাছামারা খেয়ে গেছি,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল সিলভারম্যান। ‘আমার কথা কি বুঝতে পেরেছ? এই শো আর কোনদিনই সাফল্যের মুখ দেখবে না!’
চুপ করে থাকল স্টিল। বিশাল এক ডিশের পাশে কাজ করছে হোঁৎকা এক তরুণ। সেদিকে চলেছে সিলভারম্যান। সঙ্গে যেতে বাধ্য হচ্ছে স্টিল।
‘হিলি, মিউযিক তো বাদ পড়ে গেল! মিউযিক ছাড়া আবার সেক্স হবে কীভাবে? মেরামত করা হয়েছে স্যাটেলাইট? তুমি তো দেড়ঘণ্টা আগে বলেছিলে কাজটা শেষ করবে!’
পকেট থেকে রুপালি বোতল বের করে ওটা থেকে নিয়ে পানি ছাড়াই মুখে সাদা ট্যাবলেট ফেলল সিলভারম্যান।
‘আমি কি পানি এনে দেব?’ জানতে চাইল স্টিল।
‘তাতে কোন লাভ নেই,’ মাথা নাড়ল সিলভারম্যান।
‘কড়া এক মগ কফি?’ হেসে বলল স্টিল। জানে, এরই ভেতরে অন্তত পাঁচ মগ এসপ্রেসো কফি গিলেছে তার বন্ধু।
‘কফি? জীবনেও আর ওই জিনিস খাব না!’ তিক্ত স্বরে বলল গ্রেগরি। ‘পানি গেলার টাইম পাই না, তো তার আবার কফি! এমন কী প্রস্রাব করারও সময় নেই আমার! ব্র্যাড, মন শক্ত করো, যা বলব সেটা খুব কঠিন বাস্তব। কোনভাবেই আমরা হিট করাতে পারব না এই শো! আমার কথা মাথায় ঢুকিয়ে নাও! গত কয়েক বছর আগে যে ফালতু শো তৈরি করেছিলে, ওটার কথা মনে আছে? ওই যে, যেখানে মহিলাদের সাংসারিক ব্যর্থতা নিয়ে মন্তব্য করেছিল তাদের স্বামীরা? আর আমাদের দিকে পচা ডিম আর ভাঙা তরমুজ ছুঁড়ে মেরেছিল পোলকের বউটা?’
‘আমরা তাতে আহত হইনি,’ আত্মসমর্থন করল স্টিল। ‘তার চেয়ে বড় কথা, ওই শো থেকে এসেছে আড়াই লাখ ডলার।’
‘তা যাই হোক, সেবার বেঁচে গেলেও এবার একটা কিলও বোধহয় মাটিতে পড়বে না!’
নতুন শো ব্র্যাড স্টিলের উচ্চাভিলাষী প্রজেক্ট। সম্ভাবনা আছে হুমড়ি খেয়ে পড়বে ওটা। কিন্তু সেটা না হলে এই এক শো থেকে আসবে শত মিলিয়ন ডলার। নানান শো তৈরি করার সময় বরাবরের মত ব্যর্থ হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে সিলভারম্যান। কিন্তু আগে কখনও এত জোরেশোরে এ-কথা বলেনি। যাই হোক, এখন কোনভাবেই পিছাতে পারবে না স্টিল। তার চাই সিলভির পেশাদারী দক্ষতা। তাই দরকার হলে তেল মেরে তাকে সন্তুষ্ট করবে।
‘এত হতাশ না হয়ে আমার ওপর ভরসা রাখো, সিলভি, ‘ নরম সুরে বলল স্টিল। ‘বলো তো, এখন কাজের ঠিক কোন্ পর্যায়ে আছ তুমি?’
‘জানতে চাইছ তাই বলছি: এরই ভেতরে নানাদিকে সেট করা হয়েছে ঊননব্বুইটা ক্লাস্টার ক্যামেরা। এ-ছাড়া, নানান দিকে মাইকসহ এক শ’ আশিটা সোলো ক্যাম। এরই ভেতরে পাহাড়ে, জঙ্গলে আর সৈকতে কাজ করছে আশিটা লেন্স। সবমিলিয়ে ধরো দ্বীপের ওপরে চোখ রাখছে পাঁচ শ’টা ক্যামেরা। তবে এরপরেও রয়ে গেছে কিছু ডেড স্পট। ওগুলো কাভার করতে পারিনি ইকুইপমেন্টের অভাবে। তা ছাড়া, আমার এত লোকবল নেই যে ভালভাবে কাজ শেষ করব। আর সেজন্যেই বলছি, সফল হবে না ডার্টি গেম-এর এই শো।’ উত্তেজিতভাবে কথা বলতে গিয়ে ঠোঁটের কোনায় সাদা ফেনা জমেছে তার।
স্টিল বুঝে গেল, নিজের দায়িত্ব ভালভাবেই শেষ করবে সিলভি। নানান অ্যাঙ্গেল দিয়ে দ্বীপের ওপরে চোখ রাখছে পাঁচ শ’র বেশি ক্যামেরা। তার ওপর আছে লাইভ ইউনিট। সে-কথা বলতে ভুলে গেছে সিলভি। নিজের হাতে সেট করেছে শত শত ক্যামেরা। এর আগে দুনিয়ার আর কোন শো-তে এত টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়নি।
‘দেখো, আমরা ঠিকই উৎরে যাব,’ বলল স্টিল, ‘বিপদ এলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ব তুমি আর আমি।’
‘এটা যুদ্ধ না, স্টিল, টেলিভিশনের কাজ আরও কঠিন, ‘ তিক্ত সুরে বলল সিলভি। ‘হয়তো খেয়াল করেছ, আমাদের কাছে যথেষ্ট ইকুইপমেন্ট নেই। পড়ে আছি এমন এক দ্বীপে, যেখানে চট করে ওগুলো সভ্য জগৎ থেকে সংগ্রহ করতে পারব না। জানোই তো, ক্যামেরার কাজ করতে ভালবাসি বলে এখনও রয়ে গেছি। কিন্তু শেষমেশ কী হবে সেটা জানি না।’
একটু দূরে দুই টেকনিশিয়ান এক স্যাটেলাইট ডিশে সংযোগ দেয়ায় বিশ্রীভাবে চারপাশে ছড়াল আগুনের কমলা ফুলকি। তাতে চমকে গেছে সিলভারম্যান। তার ভাব দেখে স্টিলের মনে হলো, বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে সিলভির মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে। ‘অ্যাই, অ্যাপেল! ভুলেও ওয়াএয়ার ধরবে না! মনে নেই আগে কী বলেছি? ওগুলো ধরতে যেয়ো না!’
অবাক চোখে ওকে দেখল টেকনিশিয়ানেরা। একটা কথাও বুঝতে পারেনি।
স্টিলের দিকে তাকাল সিলভারম্যান। বাদীর উকিলের ভঙ্গিতে আঙুল তাক করল টেকনিশিয়ানদের দিকে। তারা যেন দাগী আসামী। ‘বারবার স্পার্ক হচ্ছে। আর এরা একদম ইংরেজি জানে না। তো এদেরকে দিয়ে কাজ করাব কীভাবে!’
কারও ভেতরে ইতিবাচক মনোভাব দেখলেই খেপে যায় সিলভি। সবসময় কাজ করে মনে নিরাশা নিয়ে। তবে কাজটা শেষ করে প্রথমশ্রেণীর টেকনিকাল ডিরেক্টরের মতই।
বন্ধুর কথা শেষ হতে স্টিল বলল, ‘একটা কথা, সিলভি, এই শো কিন্তু ঠিকভাবেই শেষ হবে।’
‘কীভাবে?’ বলল সিলভারম্যান। ভাবছে, তুই, শালা, কিছুই বুঝিস না! গাধা কোথাকার!
‘এই শো খুব ভাল হবে, কারণ এটার দায়িত্বে তুমি আছ।’
প্রতিবাদ করতে গিয়েও খপ্ করে মুখ বুজল সিলভি।
প্রিয় বন্ধু বলছে, তার কাজে সে দুনিয়ার সেরা।
আর সেজন্যেই খুব জনপ্রিয় হবে ডার্টি গেম শো।
এরপর আর কোন কথা চলে?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন