কাজী আনোয়ার হোসেন
আমেরিকার কানেকটিকাট-এ নিউ হ্যাভেন শহরে এফবিআই ভবনে ফেডারেল ব্যুরো অভ ইনভেস্টিগেশনের কমপিউটার ক্রাইম টাস্ক অফিস। ধারণা করা হয় ওটা দেশের সেরা ল্যাবোরেটরি। চব্বিশ ঘণ্টা দেশ-বিদেশের নানান অপরাধের বিরুদ্ধে লড়ছে এই সংগঠন।
কমপিউটারের ইন্টারনেট অপরাধ তদন্ত করতে দু’হাজার তিন সালে গড়ে তোলা হয় সিসিসিটিএফ। কমপিউটার ইনট্রুশন, চাইল্ড অ্যাবিউশন, কপিরাইট ভায়োলেশন্স, ইন্টারনেট ফ্রড, ইন্টারনেট থ্রেট ও হ্যারাসমেন্ট নিয়ে কাজ করছে এই অফিস। ওয়েব যখন হয়ে উঠল নতুন যুদ্ধক্ষেত্র, তখন থেকে পরিচয়-চোর, ব্লুফিল্ম, ভাড়াটে খুনি ও টেরোরিস্টদের বিরুদ্ধে লড়ছে। ওখানে ইন্টারনেট আইনরক্ষা করতে কাজ করছে কয়েক শ’ অফিসার।
ইউএস সিক্রেট সার্ভিস, ইউএস পোস্টাল ইন্সপেকশন সার্ভিস, ডিপার্টমেন্ট অভ ডিফেন্স ইন্সপেকশন জেনারেল ও ইন্টারনাল রেভ্যুনিউ অফিসের সঙ্গে তাল রেখে ইন্টারনেট অপরাধীদের গ্রেফতার করে তারা। গোটা দেশে আছে এমন আরও বিরানব্বুইটি অফিস। তবে ধারণা করা হয় ওগুলোর চেয়ে অনেক দক্ষ সিসিসিটিএফ। সেখানে এলে কমপিউটার জিনিয়াসেরা বুঝে যায়, অফিসটা আধুনিক এক টেকনিকাল স্বর্গ।
কাটিং এজ ইলেকট্রনিক্সসহ এজেন্টদের জন্যে চারদিকে আছে অসংখ্য কিউবিকল। তারই একটায় বয়স্কা এক মহিলার অভিযোগ রেকর্ড করছে একজন এজেন্ট। বাড়ি বিক্রি করবে বলে লোভ দেখিয়ে মহিলার তিন লাখ ডলার হাতিয়ে নিয়ে ভেগে গেছে নাইজেরিয়ান এক বাটপার। অন্য কিউবিকলে তরুণী মেয়ে সেজে চ্যাট-রুমে নারীলোভী এক লোককে হানি ট্র্যাপে ফেলেছে আরেক এজেন্ট। পাশের কিউবিকলে সন্দেহজনক হ্যাকারের পাসওয়ার্ড ভেদ করে প্রমাণ সংগ্রহ করছে এক ফরেনসিক একযামিনার।
ল্যাবোরেটরির হাই-ডেফিনিশন স্ক্রিনে চোখ রেখে চেয়ে আছে স্পেশাল এজেন্ট এডওয়ার্ড সিমন্স। স্ক্রিনের নিচে একের পর এক অ্যাড ব্যানার। ওগুলোর ভেতরে আছে অ্যালকোহল, সিগারেট, পর্নো ও ফায়ারআর্ম-এর বিজ্ঞাপন। কিন্তু সেদিকে মন না দিয়ে বিশেষ এক সাইটে আটকে গেছে সিমন্সের চোখ। সেখানে প্রচার করা হচ্ছে, মাত্র এক শত নিরানব্বুই ডলার পঁচানব্বুই সেণ্ট ব্যয় করে লগ-ইন করা যাবে দুনিয়ার সেরা শো ডার্টি গেম-এর সাইট-এ।
বিজ্ঞাপনে দশবার দেখানো হলো পাহাড় থেকে পড়ে বিস্ফোরিত হয়েছে বিশালদেহী এক রাশান।
প্রচুর গুঞ্জন নিয়ে ব্লগটি চালু হতে এই শো ট্র্যাক করেছে সিমন্স। এ-বিষয়ে তাকে চোখ রাখতে বিশেষ নির্দেশ দিয়েছে তার বস্ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর রবার্ট রাইডার। এই শো কপট না হলে দুনিয়ার প্রতিটি আইন ভাঙছে ওটার প্রযোজক। প্রথমে সিমন্সের ধারণা ছিল: টাকা লুটপাট করার জন্যে মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে কোন হ্যাকার। দেখানো হচ্ছে মানুষের বানোয়াট মৃত্যু।
এডওয়ার্ড সিমন্সের বয়স ত্রিশ। হাই-স্কুলের ছেলেদের মত বৃথা স্বপ্ন দেখে না যে কমপিউটার দিয়ে জয় করে নেবে দুনিয়া। দেখতে সুদর্শন সে। মাথায় ঝাঁকড়া বাদামি চুল। পরনে ইস্ত্রি করা দামি ধূসর সুট, গলায় নীল টাই ও পায়ে টম ফোর্ড শ্যু।
রাশানের মৃত্যু দেখার আগেই সিমন্স বুঝে গেছে, এই শো নকল কিছু নয়। একটু আগে খোঁজ নিয়ে জেনেছে, এই প্রোগ্রামে যারা অংশ নিচ্ছে, তারা সবাই বাস্তব জগতের মানুষ। শো-র প্রযোজক ব্র্যাড স্টিল এমনই এক লোক, যে বিকৃত মানসিকতার প্রোগ্রাম তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত। আর যেখানে ঘটছে এসব, সেই দ্বীপে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে খুন হয়ে যাচ্ছে একদল অপরাধী।
‘এক্ষুণি আপনাকে দেখা করতে বলেছেন রাইডার, কিউবিকলের দরজা খুলে বলল সিমন্সের সহকর্মী স্টেলা। কিছু দিন আগে চাকরি নিয়েছে এই অফিসে।
নিজের বস্ রবার্ট রাইডারকে ঘৃণা না করলেও শ্রদ্ধা করে না সিমন্স। মানুষ হিসেবে খারাপ নয় রাইডার, তবে কোন ঝুঁকি নিতে প্রবল আপত্তি আছে তার। অফিসে দিনের বেশিরভাগ সময় কাটায় উচ্চপদস্থ অফিসারের মন জুগিয়ে চলতে গিয়ে।
নিজের কিউবিকল থেকে বেরিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর রাইডারের অফিসে গিয়ে ঢুকল সিমন্স। নিজের চেয়ারে বসে মাথার তালু ডলছে রাইডার। সিমন্সকে দেখে চেয়ারে সোজা হয়ে বসল সে। নাকের ওপরে সিধে করে নিল কালো ফ্রেমের চশমা। হাত বুলিয়ে চুল গুছিয়ে নিয়ে বলল, ‘সিমন্স, এখন পর্যন্ত কী জানলে ব্র্যাড স্টিল সম্পর্কে?’
‘কোথা থেকে ডেটা স্ট্রিমিং করছে সেটা এখনও জানতে পারিনি,’ বলল সিমন্স, ‘বেশ ক’টা দেশের কাছ থেকে ডেটা নিচ্ছে বলে আমরা কথা বলেছি ইন্টারপোলের অফিসারের সঙ্গে। বোঝা যাচ্ছে, এসব ছবি আসছে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের কোন দ্বীপ থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর সেদিকের এলাকার ওপরে বিশেষজ্ঞ একজন এখন ইমেজ দেখছে ওয়েব সাইটে। তবে এসব দেখে চট্ করে বোঝা খুব কঠিন, কোন্ দ্বীপে আপলোড করা হচ্ছে ভিডিয়ো। ইন্দোনেশিয়া বা পাপুয়া নিউ গিনির মাঝে আছে ছোট দু’ শ’র বেশি দ্বীপ। তাই স্টিল আর তার টিমকে খুঁজে বের করে গ্রেফতার করা প্রায় অসম্ভব।’
আনমনে কথাগুলো শুনে মাথা দোলাল রাইডার। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ। ডার্টি গেম শো-র বিষয়টা ছেড়ে দিয়েছে সিমন্সের ওপরে। যদিও তাকে একফোঁটা বিশ্বাস করে না সে। সিমন্স অফিসের সেরা এজেন্ট হলেও তার ব্যাপারে ভীষণ ভয় আছে রাইডারের-একদিন ষড়যন্ত্র করে তার চেয়ারটা দখল করে নেবে যুবক।
‘এই শো-তে আছে দশজন অপরাধী,’ বলল রাইডার।
‘যাদের তিনজন এরই ভেতরে মারা গেছে,’ বসের মুখের কথা কেড়ে নিল সিমন্স। উচ্চপদস্থ অফিসারকে তেল দিতে পারবে না বলে রাইডারের চেয়ারে বসার কোন আগ্রহ নেই ওর। ‘ওরা এখন আছে সবমিলিয়ে সাতজন।’
‘তাদের একজন আমেরিকান। …সে কি বেঁচে আছে?’
মাথা দোলাল সিমন্স। ‘সে একজন ড্রাগ ডিলার। নাম জনি এস. ক্লার্ক। দেশে থাকলে মরত ইলেকট্রিক চেয়ারে বসে। পালিয়ে যাওয়ার আগে থাকত লস এঞ্জেলেসে। বয়স বত্রিশ বছর। ড্রাগ পাচার, মানুষের ওপরে হামলা ও খুনের আসামী। বছরখানেক আগে তার ফাঁসির রায় হয়েছে মালোয়েশিয়ায়।’
‘ওখানে গিয়ে কী করছিল?’
‘ড্রাগ ডিলিং। গাঁজা। মালোয়েশিয়ার কর্মকর্তারা জানিয়ে দিয়েছে, ক্লার্কের বিষয়ে আমাদেরকে কোন তথ্য দেবে না তারা।’
রিসার্চ করে বড়ধরনের ঝামেলার খোঁজ পেয়েছে সিমন্স। প্রচুর ঘুষের বিনিময়ে নানান দেশের জেল ওয়ার্ডেনের কাছ থেকে অপরাধী সংগ্রহ করে সেই দ্বীপে নিয়ে গেছে ব্র্যাড স্টিল। অবশ্য এটা সিসিসিটিএফ-এর এক্তিয়ারের বাইরে।
সিমন্সের কথা শুনে ব্যথা শুরু হয়েছে রবার্ট রাইডারের কপালে। বিরাট এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।
বসের অফিস থেকে বেরিয়ে নিজের কিউবিকলে গিয়ে ঢুকল স্পেশাল এজেন্ট সিমন্স। ডার্টি গেম-এর প্রতিযোগীদের খোঁজ নিতে ডেকে এনে কাজ দিল পাঁচজন এজেন্টকে।
একঘণ্টা পর ওর অফিসে ঢুকল তাদের একজন।
‘নতুন কিছু পেলে?’ জানতে চাইল সিমন্স।
‘একজন আছে, যাকে আমরা খুঁজে পেয়েছি।’
‘নাম কী?’ বলল সিমন্স। ‘সে কি আমেরিকার নাগরিক?’
মাথা নাড়ল এজেন্ট। ‘আমি যার ছবি সনাক্ত করেছি, তাকে আমাদের ডিআইএ ধার হিসেবে নিয়েছিল বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স থেকে। সেই এজেন্টের নাম মাসুদ রানা।’
‘আর কিছু?’
মাথা নাড়ল এজেণ্ট।
নিচু গলায় বলল সিমন্স, ‘আরও খোঁজ-খবর নাও। কিছু পেলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবে।’
অধীনস্থ এজেণ্ট কিউবিকল থেকে চলে যেতেই টেবিল থেকে মোবাইল ফোন তুলে নিল সিমন্স। মনস্থির করেছে, কথা বলবে বিসিআই-এর কমপিউটার ডিপার্টমেন্টের চিফ রায়হান রশিদের সঙ্গে। বছর দুয়েক আগে যৌথ এক ট্রেনিঙে পরিচয় হয়েছিল তার সঙ্গে। হাসিখুশি রশিদকে দায়িত্বশীল মানুষ বলেই মনে হয়েছে সিমন্সের।
দেরি না করে তাকে ফোন দিল সে। ওদিক থেকে রায়হান রশিদ ফোন ধরতেই কুশল বিনিময় করল। মাত্র তিন মিনিটের ভেতরে জেনে গেল বেশ কিছু জরুরি তথ্য।
সংক্ষেপে বলল রায়হান রশিদ, ‘বিসিআই চিফকে কথা দিয়েছিলেন ডিআইএর চিফ, এল সালভেদরের মিশনে গেলে মাসুদ ভাইকে সব ধরনের সহায়তা দেবেন তাঁরা। কিন্তু এরপর তিনি বিপদে পড়লে দেখা গেল মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তাঁরা।’
রাইডারের মত দুর্বল চিত্তের মানুষ নয় সিমন্স। বাংলাদেশি এজেন্টকে এল সালভেদরে পাঠিয়ে থাকলে সে- দায় এড়াতে পারবে না ডিআইএ, সেটা বুঝতে অসুবিধে হলো না তার। রায়হান রশিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেখে দিল ফোন। আবারও চোখ বোলাল কমপিউটার স্ক্রিনে। কুঁচকে গেছে দুই ভুরু।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন