কাজী আনোয়ার হোসেন
আর্টিলারি বাঙ্কারে ভারী শেল ফাটার প্রচণ্ড বিস্ফোরণ দেখে হতবাক হয়ে গেছে বিসিআই-এর কমপিউটার ডিপার্টমেন্টে জড় হওয়া সবাই। শকওয়েভের জোর ধাক্কায় পিছিয়ে হুড়মুড় করে মাটিতে চিত হয়ে পড়েছে রুপার্ট শ্যানন ও কাইতো তানাকা।
সোহানা, সোহেল, সলীল, জাহেদ ও অন্যরা দেখেছে বাঙ্কারে গিয়ে ঢুকেছে রানা। তারপর কালো মেয়েটার সঙ্গে লড়তে হলো ওকে। এরপর আর বের হয়নি রানা। একটু পর বিস্ফোরিত হয়েছে বাঙ্কার।
কারও মনে কোন সন্দেহ নেই যে, মারা গেছে মাসুদ রানা। সোহানার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না সোহেল, জাহেদ ও সলীল।
‘রানা… রানা…’ মুখে হাত চেপে ফিসফিস করে বলল সোহানা। রক্তশূন্য হয়ে গেছে ওর চেহারা। মায়া ভরা দুই চোখ থেকে দরদর করে গালে নেমে এল অঝোর অশ্রুধারা।
নীরব হয়ে গেছে বিশাল ঘর।
পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে ওরা। কারও মুখে রা নেই।
টেলিভিশনের স্পিকারে শোনা গেল এক নারীকণ্ঠ: ‘গোটা দুনিয়া জুড়ে কমবয়সী ছেলেমেয়েরা দেখবে কী করুণভাবেই না মারা পড়বে একের পর এক মানুষ!’
মুখ তুলে টিভি দেখল সোহানা। দুনিয়াজোড়া নামকরা মহিলা সাংবাদিক ডায়ানা এরেনো ইন্টারভিউ নিচ্ছে প্রযোজক ব্র্যাড স্টিলের। এই লোকই তৈরি করেছে ডার্টি গেম শো। আর তার জন্যেই মারা গেছে সোহানার ভালবাসার মানুষটা।
স্টিলের পরনে দামি প্যান্ট ও শার্ট, চোখে হাসির ছাপ। ‘ওরা অবশ্যই দেখবে, দেখবে না কেন! আর সেজন্যে চাই মাত্র একটা ক্রেডিট কার্ড। ছোটদের এই শো দেখা থেকে আমরা বিরত রাখতে পারব না। ওদের বাবা-মার উচিত তাদের বাচ্চাদের সামলে রাখা। এর দায় তাদেরই, আমাদের নয়।’
আগে কাউকে এতটা ঘৃণা করেনি সোহানা, যেটা এখন করছে ব্র্যাড স্টিলকে। অন্তর থেকে বুঝে গেছে, দুনিয়ার যেখানেই লুকিয়ে থাকুক লোকটা, তাকে খুঁজে বের করে নিজের হাতে খুন করবে ও।
.
সোহানার মতই ডায়ানা এরেনোর ব্রডকাস্ট নিজেদের বিশাল তাঁবুর ছোট এক এলইডি স্ক্রিনে দেখছে স্টিল। এদিকে বিশাল স্ক্রিনে বারবার দেখানো হচ্ছে বাঙ্কার বিস্ফোরণের দৃশ্য। একই সঙ্গে দুই প্রতিযোগী শেষ হয়ে যাওয়ায় খুব খুশি হয়েছে স্টিল। শো শেষ হতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি, এরপর কে বিজয়ী সেটা ঘোষণা দেবে সে। এখন বেঁচে আছে শ্যানন ও তানাকা। গোটা শো-তে দুর্দান্ত অভিনয় করেছে ইংরেজ সাইকোপ্যাথ। সে যে জয়ী হবে, সেটা বুঝে গেছে স্টিল।
বিস্ফোরণের শকওয়েভে ছিটকে পড়েছে শ্যানন ও তানাকা। ওদেরকে ঘিরে নিয়েছে ঘন কালো ধোঁয়া। তবে যেহেতু বেঁচে আছে, তাই এবার উত্তেজনার চরমে উঠবে ডার্টি গেম শো। প্রথম থেকে শ্যানন ছিল স্টিলের সেরা প্রতিযোগী। তাই তাকে নানান ধরনের অন্যায় সুবিধা করে দিয়েছে সে। এই একই কাজ করেছে আগের সব রিয়েলিটি শো-তে। ডার্টি গেমের শো-র জটিল কাহিনী রচনা করেছে বলে নিজেকে বারবার বাহবা দিচ্ছে সে।
নিজেকে আবারও দেখল ছোট্ট স্ক্রিনে।
গত ক’বছরে বহুবার ইন্টারভিউ দিয়েছে বলে ওর জানা আছে কীভাবে ক্যামেরার সামনে নিজেকে তুলে ধরতে হবে। এবারের ইন্টারভিউয়ের সময় তার চেহারা ও বডি ল্যাংগুয়েজে প্রকাশ পেয়েছে অমিত আত্মবিশ্বাস। ছোটবেলায় সাইকেল থেকে পড়ে কেটে গিয়েছিল থুতনি, আর সেই দাগ আড়াল করতে এবার ক্যামেরা নিচু থেকে ফোকাস করতে দেয়নি। এদিকে বাম থেকে ভাল দেখায় তার নাক, তাই ডায়ানা এরেনোর ডানে ক্যামেরা রাখতে বাধ্য করেছে সে। স্টিলের ধারণা দুনিয়ার সেরা সব শো-র মতই নিখুঁত হতে হবে তার জীবন, যেখানে কখনও কোন দুর্ঘটনা ঘটবে না।
‘ভুলেও ধরে নেবেন না যে এসবে আপনার কোন দায় নেই,’ টিভিতে বলছে ডায়ানা। ‘এই শো তৈরি করা কতবড় অন্যায়, সেটা আপনি কিন্তু নিজেই ভাল করে জানেন।’
টিভির স্ক্রিনে নিজেকে দেখে হাসল স্টিল। কী উজবুকের মত কথা বলছে মহিলা! যেন জানে না, ওকে ভিলেন হিসেবে দেখালে উল্টে হুড়মুড় করে বাড়বে শো-র দর্শক-সংখ্যা।
‘ডায়ানা, আমি তো কাউকে বাধ্য করছি না লগ ইন করতে,’ আরাম করে চেয়ারে বসে স্বাভাবিক চেহারায় বলেছে স্টিল। ‘আমি এ-ধরনের শো-র চাহিদা তৈরি করিনি। হাজার বছর আগে সেটা করেছে রোমানরা তাদের কোসিলিয়ামে। প্যারিসে ফ্রেঞ্চরা গিলোটিনের মাধ্যমে। সালেমে করা হয়েছে ডাইনী গণহত্যার সময়। প্রাচীনকাল থেকে সবসময় সহিংসতা দেখতে চেয়ে অধীর হয়ে অপেক্ষা করেছে বিশ্বের মানুষ। সেটা অতীত বলুন বা বর্তমান যুগ-আগামীতেও শত কোটি মানুষ চাইবে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা দেখতে। কারণ বেশিরভাগ মানুষ আসলে এমনই।’
আমার আসলে কোন তুলনা নেই, মনে মনে বলল স্টিল।
ডায়ানার পেছনের স্ক্রিনে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সবুজ দ্বীপ। দৃশ্যটা উধাও হতেই দর্শকের উদ্দেশে বলল মহিলা সাংবাদিক, ‘এই সাক্ষাৎকার শেষ হলে প্রযোজক ব্র্যাড স্টিলের ওপরে ভীষণ রেগে গিয়েছিলাম। আমার প্রতিক্রিয়া ছিল খুব স্বাভাবিক। তবে গত চব্বিশ ঘণ্টায় কোটি কোটি মানুষ লগ ইন করেছে তার ওয়েব সাইটে। মিস্টার স্টিলের সাফল্যে আমি এখন রেগে নেই। আমি আসলে হতাশ ও দুঃখিত যে, এমন এক নোংরা ও নৃশংস পৃথিবীতে বাস করি আমরা।’
‘ভাল বলেছে,’ স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়ে বিড়বিড় করে বলল স্টিল। সে নিজেও হয়তো এত ভালভাবে সাক্ষাৎকার নিতে পারত না। ডায়ানা এরেনোর কথা শুনে নতুন করে অন্তত আরও দশ মিলিয়ন মানুষ সাবস্ক্রাইব করবে ডার্টি গেম শো-তে।
‘আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, আমরা আসলে ব্র্যাড স্টিলের মত মানুষদেরকে থামাতে চাই কি না। আমরা কি আসলে মানুষ হতে পেরেছি? আমরা আসলে কারা বা কী?’ আবেগ- প্রবণ হয়ে বলে চলেছে ডায়ানা এরেনো, ‘আমরা যারা ব্র্যাড স্টিলের শো দেখে তার পকেটে কোটি কোটি ডলার তুলে দিচ্ছি, আমরা নিজেরা কি আসলে অপরাধী নই?’
স্টিলের পেছনে থেমে টিভি স্ক্রিন দেখছে রিটা। নিজের সাক্ষাৎকারে আকণ্ঠ ডুবে আছে প্রযোজক, খেয়াল করেনি বিশাল তাঁবুতে ফিরে এসেছে তার প্রেমিকা। ডায়ানা এরেনোর মত চট করে রেগে যায়নি রিটা। ওর আসলে খারাপ লাগছে স্টিল, সিলভারম্যান, নিষ্ঠুর এই পৃথিবী আর নিজের জন্যে।
সিলভির দিকে তাকাল রিটা। সিওয়ার্সকে কন্সোল দেখতে বলে স্টিলের সাক্ষাৎকার মন দিয়ে দেখছে সে। একবার চোখ তুলে রিটাকে দেখে নিচু করে নিল দৃষ্টি। ভাল করে জানে, প্রতিবাদ করে কোন লাভ হবে না। তাই চেহারায় ফুটে উঠেছে অপরাধবোধের ছাপ।
সিলভির মত একই কথা ভাবছে রিটা। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা দাঁতে দাঁত চেপে পার করতে পারলে চিরকালের জন্যে বিদায় নেবে অভিশপ্ত এই দ্বীপ থেকে। এরপর ওদের দু’জনের জীবন থেকে চিরকালের জন্যে বিদায় নেবে ব্র্যাড স্টিল। কিন্তু গত কয়েক ঘণ্টায় ভয়াবহ যেসব ঘটনা দেখতে হলো, বাকি জীবনেও ওদের মন থেকে মুছে যাবে না সেটার রেশ।
‘প্রিয় দর্শক, তা হলে আগামীকাল আবারও দেখা হবে…’
সন্তুষ্ট হয়ে রিমোট কন্ট্রোলের বাটন টিপে টিভি বন্ধ করল স্টিল। ধারণা করেছিল শো-র বাকি সময়ে আর ফিরে আসবে না রিটা। অথচ পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সে।
ব্র্যাড বুঝতে পারছে, ওকে অপছন্দ করছে রিটা। বিশেষ করে কষে চড় খাওয়ার পর। কিন্তু সুপুরুষ হিসেবে ওর যে আকর্ষণ শক্তি, সেটা এড়াতে পারবে না রিটা। বেশিরভাগ মেয়ে অর্থশালী ও ক্ষমতাবান লোকের পূজারিণী হয়। কখনও কখনও পুরুষ চরম দুর্ব্যবহার করে বসলেও সেটা গোনায় ধরে না তারা। তা ছাড়া, স্টিল একজন নামকরা, বিত্তবান মানুষ, যে কি না রিয়েলিটি শো-র জগতে মস্ত বিশাল এক তারকা।
রিটার সঙ্গে সম্পর্ক সহজ করে নেয়ার সুযোগ এলেও সেটা নিল না স্টিল। চেয়ার ছেড়ে রিটাকে পাশ কাটিয়ে চলল অন্যদিকে। মনে মনে বলল, ‘পরে দেখব যাতে আমার পা চেপে ধরতে হয় তোমার।’
বিশাল স্ক্রিনে চোখ রাখল স্টিল।
এবার মরণপণ লড়তে শুরু করবে শেষ দুই প্রতিযোগী শ্যানন ও তানাকা। ওদের মধ্যে কে বিজয়ী হবে, সেটাও জানে সে।
এখন জরুরি হচ্ছে চমৎকারভাবে এই শো শেষ করা।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন