কাজী আনোয়ার হোসেন
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে খাড়া এক টিলার সামনে পৌঁছে গেছে রানা। ভাবছে, একবার ওপরে উঠলে বোধহয় দেখতে পাবে কাছেই ওয়েদার টাওয়ার।
শুকনো মাটিতে জুতোর কুড়মুড় শব্দ তুলে টিলা বেয়ে উঠতে লাগল রানা। ওপরদিকের মাটি কালচে ও পাথুরে। একটু পর ও বুঝে গেল, সাগরতলের অগ্ন্যুৎপাত ও ভূমিকম্পে তৈরি হয়েছে এই দ্বীপ। নানাদিকে ছোটবড় পাহাড় ও টিলা গভীর অরণ্যের সবুজ ও সাগরের সুনীলে এই দ্বীপ যেন মর্ত্যে তৈরি এক স্বর্গ। আবার একই সঙ্গে এখানে আছে নানান ধরনের ভয়ঙ্কর মৃত্যুফাঁদ। ওগুলো মানবসৃষ্ট নয়। বিশেষ করে খাড়া টিলা বেয়ে উঠতে গিয়ে নিচের ধারাল ঝামাপাথরে আছড়ে পড়লে হবে নিশ্চিত মৃত্যু। এ-ছাড়া, আছে লাভার গোপন সুড়ঙ্গ। একবার ওপরের মাটি ধসে গেলে সরাসরি পড়তে হবে বহু নিচে।
সাবধানে টিলা বেয়ে উঠছে রানা। কিছুক্ষণ পর পাহাড় বেয়ে উঠে এল এক অধিত্যকায়। দূরে দেখতে পেল পশ্চিমে উপকূল। এরই ভেতরে দিগন্তের দিকে নেমে গেছে সূর্য। ফলে দিক নির্ধারণ করা এখন কোন সমস্যা নয়। দক্ষিণে ওদের সবাইকে হেলিকপ্টার থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল। ওদিক এখন রানার বামে। দ্বীপের চারদিকের দৃশ্য অনায়াসে দেখতে পেল ও। বিশেষ করে ওর চোখ কেড়ে নিল দক্ষিণে গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়নের মত এক এলাকা ও কিছু জলপ্রপাত। বড়সব ঝর্না হয়ে ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে জলপ্রপাতের পানি। এক পর্যায়ে বড় ধরনের নদী তৈরি করে নেমে গেছে সাগরে।
রানা যেতে চাইছে দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমে। উঁচু পাহাড়ের জন্যে ওদিকে দেখা যাচ্ছে না ওয়েদার টাওয়ার। ওর বুঝতে দেরি হলো না যে ঠিক দিকেই চলেছে।
অধিত্যকার শেষে খাড়া জমিন। তবে এত দূর থেকে বোঝা গেল না ওদিক দিয়ে নেমে যেতে পারবে কি না। শেষ বাঁশের ক্যান্টিনের পানিটুকু গিলে নিয়ে ওদিকে চলল রানা।
বামে দুই কলাগাছের মাঝ দিয়ে এল ন্যাড়া-মাথা, বিশাল এক দানব। সে-ও চলেছে অধিত্যকার খাড়া জমির দিকে।
রাশান এই লোকই ম্যানইয়া লোপাতিন। নানান শুকনো গাছপালা সরিয়ে হেঁটে আসছে রানার দিকে। লোকটা যেন সাক্ষাৎ এক মৃত্যুদূত। অক্সিজেনের অভাবে মানুষ যেভাবে মারা যায়, কাউকে খুন করতে না পেরে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে গেছে তার পক্ষে।
‘একটু ভেবে দেখো, আমি কিন্তু মোটেও তোমার শত্রু নই,’ তাকে বলল রানা।
জবাবে মাটিতে বুট দিয়ে আঁচড় কেটে নিয়ে ওর দিকে বাইসনের মত তেড়ে এল লোপাতিন।
কুঁজো হয়ে আক্রমণ ঠেকাতে তৈরি হলো রানা।
ষাঁড়টা ওকে উড়িয়ে নেয়ার আগে সরে গিয়ে কাঁধ দিয়ে তার গাছের গুঁড়ির মত উরুতে প্রচণ্ড গুঁতো দিল রানা। ওকে টপকে হুড়মুড় করে চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ল লোপাতিন।
‘তুমি হামলা না করলে তোমার সঙ্গে আমার কোন শত্রুতা নেই,’ বোঝানোর সুরে বলল রানা।
সাড়ে সাত ফুটি দেহ নিয়ে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল লোপাতিন। ঢালু নিচু জমিতে তাকে সাত ফুটি দানব বলে মনে হচ্ছে রানার। সে এখনও ওর চেয়ে অন্তত একফুট বেশি উঁচু।
‘বড় ধরনের বিপদে পড়ে গেছি!’ বিড়বিড় করল রানা।
.
একই সময়ে স্ক্রিনে লোপাতিন ও রানাকে দেখছে সিওয়ার্স। বুঝে গেছে, এবার তুমুল লড়াই হবে দুই প্রতিযোগীর ভেতরে।
‘মিস্টার স্টিল,’ গলা ফাটাল সে। ‘নতুন করে কিছু ঘটতে শুরু করেছে!’
দ্রুত এসে সিওয়ার্সের স্ক্রিনে চোখ বোলাল পরিচালক। সিলভারম্যানের উদ্দেশে বলল, ‘এবার লড়ছে বাঙালি মাসুদ রানা আর রাশান ম্যানইয়া লোপাতিন!’
স্ক্রিনের দিকে হাতের ইশারা করল স্টিল। ‘সিলভি! তুমি কি কানা হয়ে গেলে? জলদি ছোট স্ক্রিনের দৃশ্য লাইভে দাও!’
এরই মধ্যে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে সিলভারম্যান। মেইন স্ক্রিনে ফুটল রানা ও লোপাতিনের লড়াইয়ের দৃশ্য।
কয়েকটা অ্যাঙ্গেল কাট করল সিলভি। অধিত্যকার ওপরে চালু করে দিয়েছে তিনটে ক্যামেরা। এ-ছাড়া আছে আরও অন্তত দশটা লেন্স। রানা আর লোপাতিনের প্রাণান্তকর লড়াই পরিষ্কার দেখতে পাবে দর্শকেরা।
‘দারুণ!’ খুশিমনে চেঁচাল স্টিল, ‘ভাল করে লড়ক ওরা!’
.
অধিত্যকার ওপরে পরস্পরের বুকে প্রচণ্ড ঘুষি বসাচ্ছে রানা ও লোপাতিন। দুই প্রতিযোগী যেন লড়ছে কোন খাঁচার ভেতরে, আর শ্বাস আটকে সেটা দেখছে দর্শকেরা।
এই যুদ্ধের অস্বাভাবিক বিষয় হচ্ছে, পুরনো আমলের মত লড়াকুদের চারপাশে কোন চেইন লিঙ্ক নেই। উড়ে গিয়ে বাইরে পড়লে প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়বে না কেউ। তার বদলে আছে খাড়া ক্লিফ। একবার ওদিক দিয়ে শত শত ফুট নিচে পাথরের ঝামার স্তূপে পড়ে গেলে মরতে হবে নিশ্চিতভাবে। অন্যদিকে আছে রহস্যময় ঢালু জমি। ওখানে হঠাৎ করে থেমে গেছে অধিত্যকা। ওদিকে হয়তো বহু নিচে উপকূলে আছড়ে পড়ছে অতল প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল সব ঢেউ। একবার ওখানে পড়লে বাঁচবে না দুই প্রতিযোগীর কেউ।
রানার মাথার পাশে লেগেছে রাশানের মুগুরের মত হাতের মারাত্মক ঘুষি। বাধ্য হয়ে পিছিয়ে গেছে ও। পরের ঘুষি আসার আগেই কীভাবে যেন তাল সামলে ওর সেরা ঘুষি লোপাতিনের চোয়ালে ও ঘাড়ে মারল রানা। যদিও এর ফলে থামল না দানবের এগিয়ে আসার গতি। গরিলার মত রানাকে জড়িয়ে ধরে বুকে তুলে অধিত্যকার কিনারায় চলে গেল সে।
গায়ের জোরে কয়েকবার লোপাতিনের পাঁজরে কনুইয়ের গুঁতো মারল রানা। ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। তারই মধ্যে ঘুষি মেরে ফাটিয়ে দিয়েছে দৈত্যের নাক। তবুও কমল না ওর ওপরে রাশানের হামলার বেগ।
অধিত্যকার কিনারায় দাঁড়িয়ে একবার নিচে চোখ বোলাল রানা। প্রথম পঞ্চাশ গজ প্রায় খাড়াভাবে নেমে গেছে পাহাড়। কোথাও জন্মায়নি কোন গাছপালা। এখানে-ওখানে পাথরের বোল্ডার। যেদিক দিয়ে উঠে এসেছে ওরা, এদিকটা তার চেয়েও অনেক বেশি দুর্গম।
বুকে প্রচণ্ড এক ঘুষি লাগতেই মাটিতে পড়ে গেল রানা। ঢালু জমি বেয়ে গড়িয়ে নেমে যেতে লাগল ও। আরও নিচে কী আছে সেটা আর দেখতে পেল না। আগেই বুঝে গেছে, লড়াইয়ে জিতে গেলেও নতুন কোন পথে যেতে হবে ওয়েদার টাওয়ারে।
একের পর এক ঘুষি ও লাথি মেরে অধিত্যকার কিনারায় রানাকে নিয়ে গেল লোপাতিন। পরের লাথি আসার আগেই ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে দানবের দু’ফুটের ভেতরে পৌঁছে গেল রানা। গায়ের জোরে কয়েকটা ঘুষি মারল রাশানের বুক ও মুখে। তাতে ভয়ঙ্কর রেগে প্রচণ্ড এক গর্জন ছেড়ে রানাকে ট্যাকল করল রাশান দৈত্য। হাত-পা পেঁচিয়ে অধিত্যকা থেকে নিচে হুড়মুড় করে নেমে গেল ওরা।
ঢালু জমিতে গড়িয়ে পঁচিশ গজ নামার পর বড় এক ফার্নের ঝোপে থেমে গেল ওরা দু’জন। দু’হাতে গলা পেঁচিয়ে ধরে রানার শ্বাস আটকে দিল লোপাতিন।
জবাবে হাতের তালু দিয়ে তার দু’কানের তালি ফাটিয়ে দিতে চাইল রানা। নাক থেকে ঝরঝর করে ওর মুখে রক্ত ঝরাচ্ছে দানব। ফুরিয়ে গেছে তার সব ধৈর্য। একহাত সরিয়ে নিয়ে রানার গোড়ালির লাল ট্যাব টেনে খুলে নিতে চাইল সে।
একই সময়ে ডানপায়ে দৈত্যের চোয়ালে লাথি দিল রানা। ওর গোড়ালির ব্রেসলেটে লেগে পিছলে গেল লোপাতিনের সাগর কলার মত আঙুল। আর সে-সুযোগে দৈত্যের বামহাত গলা থেকে ছুটিয়ে নিল রানা। প্রচণ্ড এক ঘুষি মারল রাশানের মুখে। তাতে আবারও গড়ান খেয়ে শুরু হলো ওদের পতন। কয়েকটা ঝোপের ভেতর দিয়ে নেমে চলেছে ওরা। পৌঁছে গেল একটা কার্নিশের ওপরে। এরপর পাহাড় সরাসরি নেমে গেছে অতল গভীরে। আবারও রানার বুকে চেপে বসেছে লোপাতিন। এবার এক ঘুষিতে নিভিয়ে দেবে রানার জীবনের বাতি। কিন্তু তখনই জোর এক ‘বিইইইপ!’ আওয়াজ শুনে থমকে গেল সে।
একই সময়ে রানা বুঝল, গড়িয়ে নেমে আসার সময় কোন এক ঝোপে লেগে খুলে গেছে ওদের একজনের লাল ট্যাব!
চট্ করে নিজের গোড়ালির দিকে তাকাল রানা। এখনও রয়ে গেছে ওর ব্রেসলেটের লাল ট্যাব।
নিজের গোড়ালির দিকে বোকা চোখে তাকাল লোপাতিন। এবার কী হবে সেটা ভালভাবে বুঝে গেছে। একেক সেকেণ্ডে কমে যাচ্ছে তার জীবনের ক্ষণ! মাত্র তিন সেকেণ্ডে বুঝে গেল সে, বড়জোর আর বাঁচবে সে পাঁচ সেকেণ্ড!
মরতেই যদি হয়, তো একা কেন!
তাতে আপত্তি আছে দানবের।
নতুন করে রানার গলা পেঁচিয়ে ধরতে দু’হাত তুলল সে।
আর তখনই সরাসরি তার কণ্ঠনালীতে ঘুষি মারল রানা। চুরমার করে দিল অ্যাডাম্স্ অ্যাপল। তাতেও তোয়াক্কা করল না দানব। এদিকে বিপ বিপ শব্দ তুলছে টাইম বম!
রাশান দৈত্যের মাথা প্রকাণ্ড আর বিকৃত। দাড়িতে মেখে আছে রক্ত। মুখে একরাশ লালা। চোখ হাঁসের ডিমের মত। দৈত্যটার জন্যে মরতে হবে ভাবতে গিয়ে মনে প্রবল আপত্তি এল রানার। আর তখনই হাতড়াতে গিয়ে পেয়ে গেল যা খুঁজছে।
লাভা পাথরের অংশ ওটা। মাথার পাশে পাথরের টুকরোর প্রচণ্ড তিনটে বাড়ি খেয়ে গলা থেকে হাত সরিয়ে নিল লোপাতিন। দু’হাঁটু তুলে গায়ের জোরে তার বুকে লাথি দিল রানা। ওর ওপর থেকে পিছলে প্যারাশ্যুটহীন প্যারাট্রুপারের মত কিনারা থেকে নিচে খসে গেল রাশান দৈত্য।
দুই সেকেণ্ড পর ক্যানিয়নের ভেতর থেকে এল বিকট বিস্ফোরণের আওয়াজ। বিশ্ব যেন কেঁপে গেল থরথর করে। মায়া জাদুর মত মাত্র একসেকেণ্ডে উবে গেছে দৈত্য!
ওখানে রয়ে গেল শুধু লালচে মেঘ ও একরাশ কালো ধোঁয়া। ভুস্ করে উঠে এল ওটা ওপরদিকে।
লোপাতিনের মাংস ও হাড়ের টুকরো রয়ে গেলে সেটা সাঁই করে নেমে গেছে আড়াই শ’ ফুট নিচে কালো নারকীয় কোন গহ্বরে।
বড় করে শ্বাস নিল রানা। পাহাড়ের কিনারা থেকে নিচে তাকাল। এখনও ওর দিকে উঠে আসছে বিশ্রী গন্ধের ধোঁয়া।
‘আগেই বলেছি মারামারি করতে নেই,’ বিড়বিড় করে লোপাতিনের উদ্দেশে বলল রানা। চট্ করে দেখে নিল নিজের গোড়ালির টাইমার। ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে সময়।
ঘড়িতে বাজে ২৩:১৫:১৭!
হাঁচড়েপাঁচড়ে ঢালু জমি বেয়ে ওপরে চলল রানা।
.
যে তাঁবুতে স্টিলের সঙ্গে বাস করছে, ওখানে বসে ল্যাপটপে রানা ও লোপাতিনের লড়াইয়ের শুরুর দিক দেখেছে রিটা। দুনিয়ার লাখো দর্শক ওর মত করেই চোখ রেখেছে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মরণপণ লড়াইয়ের ওপরে।
এরপর ব্যক্তিগত তাঁবু থেকে বেরিয়ে মেইন তাঁবুতে ঢুকে সবাইকে হাসিখুশি দেখে খুব বিস্মিত হয়েছে রিটা। ওর মনে হয়েছে, মানুষ খুন হওয়া যেন এদের কাছে ম্যাডেলিন স্কয়্যারের কোন সভার মত সাধারণ কিছু! লড়াইয়ে অংশ নিয়ে সবমিলিয়ে দশজনের ভেতরে শেষমেশ বাঁচবে মাত্র একজন!
বিশাল তাঁবুর কেউ যেন বুঝতে চাইছে না, নিজেদের ভেতরে লড়াই করে মরছে একদল মানুষ!
এরই ভেতরে রিটা দেখেছে, কীভাবেই না মারা গেছে দু’জন লোক!
বিশাল তাঁবুর দিকে আসার সময় বোধহয় অধিত্যকার নিচের ঢালে খুন হয়ে গেছে রানা বা লোপাতিন। ডার্টি গেম শো এখনও কেন দেখছে, নিজেও জানে না রিটা। এটা ঠিক, অদ্ভুত এক উত্তেজনা আছে এই প্রোগ্রামের। আজ রানার চোখে অন্যকিছু দেখতে পেয়েছে রিটা। ওটা মানবিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তার নকল ব্যাকগ্রাউণ্ড তৈরি করে দিয়ে এখন নিজেকে দোষী বলে মনে হচ্ছে ওর। বড় রহস্যময় মানুষ এই মাসুদ রানা। দুর্গম জঙ্গলে একা উড়িয়ে দিয়েছে হেরোইনের মত ভয়ঙ্কর সব ড্রাগসের কারখানা। তার হাতে খুন হয়ে গেছে পশুর চেয়েও ঘৃণ্য একদল লোক। কিন্তু একজন সন্ত্রাসী হিসেবে এই কাজ রানা করেছে বলে ভাবছে না রিটা। নিশ্চয়ই কোন না কোন দেশের হয়ে কাজ করে সে। আরও বড় কথা, মানবতার পক্ষে একা লড়ছে মানুষটা।
কোনভাবেই মাসুদ রানাকে একজন অপরাধী হিসেবে ভাবতে পারছে না রিটা। রাশান খুনি-ধর্ষক লোপাতিন ভয়ঙ্কর একজন অপরাধী। আগ বাড়িয়ে খুন করতে চেয়েছে রানাকে। তার মত নিচু পর্যায়ের মানুষ হিসেবে বাঙালি যুবককে ভাবছে ‘না রিটা।
মরুভূমির ঝড়ে বালির নিচে মুখ ডুবিয়ে দেয়া উটপাখির মত নিজেকে মনে হচ্ছে ওর। স্বীকার করুক বা না করুক, এরই ভেতরে বেছে নিয়েছে পক্ষ। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ভেবেছে অপরাধীদের চরম শাস্তি দেয়ার পূর্ণ অধিকার আছে স্টিলের। কিন্তু এখন ভাবছে, সত্যিই কি সেটা আছে তার? কারও মৃত্যু নিশ্চিত করার ন্যায্যতা কোথায় পেল স্টিল? যতই সে বলুক শো-র কোটি টাকা পরে ব্যয় করবে নানান দেশের জেলের উন্নয়নে, সেটা সত্য বলে মোটেও মনে হয়নি রিটার।
শো-র শুরু থেকে স্টিলকে চরম স্বার্থপর এক লোক বলেই মনে হয়েছে ওর। অপরাধীদের ভাল-মন্দ নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা আসলে ছিল না তার। অথচ আগে এটা ভাবতে আপত্তি ছিল রিটার।
বিশাল শরীরের রাশান অপরাধী খুনি এবং ধর্ষক। কিন্তু সেজন্যে কর্তৃপক্ষের বদলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার কে আসলে ব্র্যাড স্টিল? মৃত্যু-দৃশ্য দেখাতে দর্শকদের কাছ থেকে নিচ্ছে কোটি কোটি ডলার। যারা এমন শো দেখতে টাকা দিচ্ছে, তারাই বা কেমন ধরনের বিকৃত মানসিকতার মানুষ!
খুশিতে হৈ-চৈ করছে স্টিল আর তার কর্মচারীরা।
তাদের সঙ্গে নিজের মানসিকতার তফাৎটা এখন ভাল করে বুঝতে পারছে রিটা।
.
‘এক কোটি বিশ লাখ,’ উঁচু গলায় বলল সিওয়ার্স, ‘আমাদের দর্শক এখন এক কোটি বিশ লাখ!’ হাসিমুখে স্ক্রিনের দিকে চেয়ে আছে সে। এইমাত্র দেখা গেল মেইন স্ক্রিনে ধোঁয়ার মধ্যে ভুস্ করে উবে গেছে রাশান দানব।
সামনে বেড়ে সিলভারম্যানের কাঁধে প্রশংসার চাপড় দিল স্টিল। হাসছে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। চট করে তাকাল মেইন স্ক্রিনে-ওখানে লোপাতিনের ছবির ওপরে ফুটে উঠেছে লাল একটা ক্রস।
‘কী বুঝলে, সিলভি? এখন আমাদের শো দেখছে এক কোটি বিশ লাখের বেশি দর্শক!’
‘এক কোটি বিশ লাখ তো আর চার কোটি নয়,’ জবাবে বলল সিলভারম্যান।
‘চিন্তা কোরো না, ঠিকই ওখানে পৌঁছে যাব আমরা,’ বলল স্টিল।
বন্ধুকে সন্দেহ নিয়ে দেখল সিলভারম্যান।
দর্শক-সংখ্যা জেনে হতবাক হয়ে গেছে রিটা।
প্রতি সেকেণ্ডে হুড়মুড় করে বাড়ছে দর্শক।
এমিলি ও সিওয়ার্সের দিকে তাকাল রিটা।
খুশিতে উরুতে চাপড় দিচ্ছে ওরা।
‘এমিলি, সিওয়ার্স, নতুন কিছু ঘটার আগে স্লো মোশনে দেখাতে থাকো রাশানের মৃত্যু। একে একে দেখাবে প্রতিটা ফ্রেম। কাজটা করতে দেরি কোরো না!’
‘আগেই মেইন স্ক্রিনে দেখাচ্ছি,’ লোপাতিনের অদ্ভুত মৃত্যু বিস্মিত করেছে এমিলিকে। ওর মনে হচ্ছে, দেখতে পেয়েছে কোন স্পেশাল এফেক্ট সিকিউয়েন্স। মনেই হয়নি সত্যি সত্যি মারা গেছে লোকটা। লোপাতিন যেন ছিল দক্ষ স্টান্টম্যান, যার কপট মৃত্যু দেখানো হয়েছে বোমা বিস্ফোরণ ও কালো ধোঁয়ার মাধ্যমে।
এমিলি ভাবছে, অপরাধীদের গোড়ালিতে বোমা রেখে দুর্দান্তভাবে শো জমিয়ে তুলেছেন ওদের বস্!
চট্ করে স্টিলের দিকে তাকাল সে। অন্তর থেকে মেনে নিয়েছে, এই দুনিয়ায় ওদের বসের মত জিনিয়াস আর কেউ নেই।
বারবার বন্ধুকে দেখছে সিলভারম্যান। তার ক্যারিয়ারে এত জনপ্রিয় শো আগে কখনও তৈরি করতে পারেনি স্টিল। ভয়ঙ্কর দৃশ্য প্রচারের জন্যে বাকি জীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে সে। রক্তপিশাচের মত জঘন্য কাজ করে লুটে নিচ্ছে শত শত কোটি ডলার। এরই ভেতরে বিনোদন জগতে নিজের নাম লিখে নিয়েছে ইগোম্যানিয়াক হিসেবে। তার শো দেখতে গিয়ে নিষ্ঠুরতার চরম প্রকাশ ঘটাচ্ছে কোটি মানুষ।
দীর্ঘ দিনের সম্পর্কে প্রথমবারের মত সিলভারম্যান টের পেল, স্টিল আসলে খুব অরুচিকর মানসিকতার এক লোক। অথচ বাধ্য হয়ে তার সঙ্গে এই শো-তে কাজ করতে হবে। এবং সেজন্যে বাকি জীবন ওকে কুরে কুরে খাবে ওর বিবেক।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন