ডার্টি গেম – ৩০

কাজী আনোয়ার হোসেন

ত্রিশ

ওয়াশিংটন ডিসিতে ফিরে ভাবছেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ডোমেনিক উসবার্টি—অনুমতি না নিয়ে যে নেভিকে কাজে নামিয়ে দিয়েছেন, সেটা নিশ্চয়ই এরই ভেতরে জেনে গেছেন ডিরেক্টর লুকাস ম্যাকগিল। সেক্ষেত্রে তাঁর কি এখনও চাকরি আছে?

নানান ধরনের প্রাইমারি ডিরেক্টরেট-এর অধীনে ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিতে চাকরি করে আট হাজার পুরুষ-নারী অফিসার ও কর্মচারী। এতকাল তাদের ওপরে ছিল উসবার্টির কর্তৃত্ব। দুর্ব্যবহার করেন না বলে সবাই পছন্দ করে তাঁকে। স্ট্র্যাটেজিক সাপোর্ট ব্রাঞ্চের হিউম্যান ডিরেক্টরেটের দায়িত্বে আছেন। এসএসবি ডিভিশনের ফিল্ড অ্যানালিস্ট, টেকনিকাল স্পেশালিস্ট, ইন্টারোগেশন এক্সপার্ট, স্পেশাল ফোর্স ও ব্ল্যাক অপারেশনের মাধ্যমে গোটা বিশ্বে চালান জটিল সব মিশন। সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির নানান অপারগতার জন্যে নাইন/ইলেভেনের পর এসএসবি তৈরি করেন প্রাক্তন ডিফেন্স সেক্রেটারি ডোনাল্ড রাফিল্ড। এরপর কয়েক বছর প্রায় কেউ জানত না, সত্যিই অস্তিত্ব আছে কি না এই সংগঠনের।

নিউ হ্যাভেনের সিসিসিটিএফ ত্যাগ করে দু’বার ফোনে কথা বলেছেন উসবার্টি। তাঁর মনে হয়েছে খামোকা সময় নষ্ট করেছেন তিনি। মাত্র একজন মানুষ, যে আবার আমেরিকার নাগরিক নয়, এমন কারও জন্যে আমেরিকান নেভিকে কোঅর্ডিনেট্স্ দিয়ে পাপুয়া নিউ গিনিতে এয়ার সার্চ করার নির্দেশ দেয়ায় হয়তো এবার চাকরিটা যাবে তাঁর।

দ্বিতীয় ফোন ছিল অফিস থেকে, তাঁকে নাকি তিনবার কল করেছে এফবিআই স্পেশাল এজেন্ট সিমন্স। এটা জেনেও যুবকের সঙ্গে আর যোগাযোগ করেননি তিনি।

ডিআইএর অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের ক্ষমতা আসলে এতই বেশি, নেভির অধিকার নেই প্রশ্ন তুলবার। নির্দেশ পেতেই দক্ষিণ সাগরে ইউএস নিমিট্য থেকে আকাশে উড়াল দিয়েছে দুটো এফ/এ-১৮সি হর্নেট। পেন্টাগনে যখন পা রাখছেন উসবার্টি, একই সময়ে কোঅর্ডিনেট্স্ অনুযায়ী নির্দিষ্ট দ্বীপের ওপরে এয়ার সার্চ করতে শুরু করেছে বিমানদুটো।

উসবার্টি অফিসের চেয়ারে বসতে না বসতেই বেজে উঠল ইন্টারকম। রিসিভার তুলতেই শুনতে পেলেন ডিরেক্টর লুকাস ম্যাকগিলের গম্ভীর কণ্ঠ, ‘আপনি আসলে কী করছেন? আমার সঙ্গে আলাপ না করেই নেভিকে নির্দেশ দিলেন কেন?’

ফ্যাকাসে হলো উসবার্টির মুখ। কী জবাব দেবেন সেটা ভাবতে শুরু করেছেন, তবে তার আগেই বললেন ম্যাকগিল, ‘আমি তো আপনাকে বলেছি ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে। অথচ আপনি আরও গোলমেলে করে দিলেন পরিস্থিতি।’

চুপ করে থাকলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর উসবার্টি। বুঝে গেছেন রণতরী থেকে আকাশে যুদ্ধবিমান উঠতেই ডিরেক্টর ম্যাকগিলের সঙ্গে দেরি না করে যোগাযোগ করেছেন নিমিট- এর ক্যাপ্টেন।

‘সিসিসিটিএফ থেকে জানানো হয়েছে, একটা দ্বীপ থেকে আংশিক কোঅর্ডিনেন্স ট্র্যান্সমিট করেছে মাসুদ রানা। সে এখন এল সালভেদরের জেলখানায় নেই।’ কয়েক সেকেণ্ড বিরতি নিয়ে বললেন উসবার্টি, ‘আপনাকে জানানোর জন্যে দু’বার ফোন করেছি, তবে আপনি ব্যস্ত ছিলেন। হাতে বেশি সময় নেই বলে আমি নিজেই নির্দেশ দিয়েছি।’

পুরো মিথ্যা কথা বলেননি। সত্যি দু’বার ভেবেছেন কথা বলবেন ডিরেক্টরের সঙ্গে, তবে ডায়াল আর করেননি।

‘আপনি বোধহয় জানেন, এ-ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে হয়তো আপনার চাকরিতে সমস্যা হবে,’ বললেন লুকাস ম্যাকগিল।

‘জী, সেটা আমি জানি, স্যর। আমি জেনে-বুঝেই ঝুঁকিটা নিয়েছি। মাসুদ রানা বহুবার নানানভাবে আমাদেরকে সাহায্য করেছে। মানুষ হিসেবেও সে ভাল। আমরা যদি তাকে জীবিত উদ্ধার করতে পারি, সেজন্যে প্রশংসা পাবে এসএসবি।’

‘আর আমরা যদি তাকে জীবিত না পাই?’

‘আমরা অন্তত বলতে পারব, তাকে উদ্ধার করার কাজে এসএসবি কোন ত্রুটি করেনি। স্যর, যেহেতু এ-মিশনের পুরো অথোরাইযেশন দিয়েছি, কাজেই এর সমস্ত দায় আমিই নেব।’

মনে মনে তিক্ত হাসলেন উসবার্টি। যা হবে সেটার জন্যে তাঁর বসের কোন ধরনের বিপদ হবে না। তবে মিশন সফল হলে সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ঢুকবে ম্যাকগিলের পকেটে। আর ব্যর্থতা এলে সেজন্যে পূর্ণ দায় বহন করবেন উসবার্টি।

কিছুক্ষণ ভেবে ইন্টারকমে বললেন ডিরেক্টর ম্যাকগিল, ‘তো ধরে নিন আমাদের ভেতরে কোন কথাই হয়নি।’

‘তা তো বটেই, স্যর।’

লুকাস ম্যাকগিল ইন্টারকমের রিসিভার রেখে দিতেই বড় করে শ্বাস নিলেন ডোমেনিক উসবার্টি। বহু বছর পর নিজেকে মানুষ বলে মনে হচ্ছে তাঁর। যদিও বুঝতে পারছেন, গোটা ক্যারিয়ারে আগে কখনও এত বড় ঝুঁকি নেননি। তাঁর মিশন সফল না অসফল হবে, সেটা এখন নির্ভর করছে মাসুদ রানার বেঁচে থাকার ওপরে।

.

রাগে থমথম করছে বিসিআই-এর সবার মুখ। কথা বলছে না কেউ। এইমাত্র চকচকে নতুন বারো গেজের পাম্প অ্যাকশন শটগানের চেম্বারে কার্তুজ ভরে নিয়েছে রুপার্ট শ্যানন। এখন আর মুখোমুখি লড়াইয়ে জিতে যাওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই রানার।

অসৎ বিনোদন প্রচারের জন্যে নিজের ইচ্ছা রানার ওপরে চাপিয়ে দিয়েছে ব্র্যাড স্টিল। শ্যানন যেমন চরম অপরাধী, একইভাবে মানব-হত্যার দায় কখনও এড়াতে পারবে না সে।

স্ক্রিনে দেখা গেল নানান আকারের বোল্ডারের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে রানা।

পরের দৃশ্যে দেখানো হলো শটগান হাতে শ্যাননকে।

‘রানা, দোস্ত! হারামজাদার হাতে গুলি ভরা শটগান!’ বিড়বিড় করে বলল সোহেল। দুশ্চিন্তায় কালচে হয়ে গেছে ওর মুখ।

.

ক্যানিয়নে নিজের বুটের শব্দ ছাড়া কিছুই শুনছে না রানা। জানা নেই শ্যাননের হাতে কী ধরনের অস্ত্র আছে। অবশ্য এটা বুঝে গেছে, তার কাছে বোধহয় দেয়া হয়েছে খাবার, ছোরা ও মলোটভ ককটেল। এটা এখন পরিষ্কার, লড়াইয়ের এই পর্যায়ে কী করবে সেটা আগেই জানত স্টিল। রানা আর শ্যানন মুখোমুখি লড়াই না করলে হতাশ হবে দর্শকেরা। তাই স্টিল চাইবে না যে বোমার বিস্ফোরণে মরুক ডার্টি গেমের শেষ দুই প্রতিযোগী।

নিজেও বোমার আঘাতে মরতে চাইছে না রানা। পাশ কাটিয়ে গেল কয়েকটা বোল্ডার, তারপর হঠাৎ শুনতে পেল শ্যাননের কণ্ঠ: ‘অ্যাই, শালা, তুই নাকি আমাকে খুঁজছিস?’

মুখ তুলে বড় এক বোল্ডারের ওপরে তাকে দেখতে পেল রানা। ইংরেজ সাইকোপ্যাথের হাতে এখন নলকাটা বন্দুক

এবার তোর নাচ দেখব, বুঝলি?’ কাঁধে কুঁদো তুলে রানার দিকে বন্দুক তাক করল শ্যানন।

শটগান গর্জে উঠতেই একই সময়ে ডানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রানা। পরক্ষণে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে টপকে গেল বড় এক বোল্ডার। রানার হাঁটুর নিচে ঝড়াৎ শব্দে লেগেছে ছোট পাখি মারার নয় নম্বর কার্তুজের পেলেট। সেতু থেকে ভেঙে নেয়া রডে লেগে আরেক দিকে ছিটকে গেছে বেশিরভাগ গুলি।

খুশিতে হো-হো করে হেসে উঠল শ্যানন। বোল্ডার থেকে লাফিয়ে নেমে ছুটে গেল রানার দিকে। পাম্প করে বের করে দিল খরচ করা শেল। পরক্ষণে চেম্বারে ভরে নিল তাজা বুলেট।

.

তাঁবুর ভেতরে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে সিলভির মুখ। মনোযোগ দিয়ে দেখছে ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল। স্টিল খুশিতে হাত তালি দিতেই তিক্ত হলো তার মন।

‘একেই বলে মজা! হেসে উঠল স্টিল।

স্টিল। ‘এবার দারুণভাবে শেষ হবে ডার্টি গেম শো!’

তার কথা শুনে চোখ বুজল সিলভারম্যান। এমনিতেই দিনের পর দিন ঘুম নেই তার, এর ওপরে মুখে কিছু দিতে পারছে না; মনে কাজ করছে অপরাধবোধ-সবমিলিয়ে নিজেকে একজন মানুষ বলে মনে হচ্ছে না ওর। জোর করে চোখ মেলে স্টিল ও সিম্পসনকে দেখল সে। বিশাল তাঁবুর কোণে দাঁড়িয়ে আছে স্টিল ও সিম্পসন। প্রতিযোগিতাটাকে খুব নোংরা করে তুলেছে তারা। যার চরম শাস্তি হওয়া উচিত, তাকে এরা দিচ্ছে অন্যায় সব সুযোগ। ওদিকে পুরস্কার প্রাপ্য যার, তাকে ঠেলে দিচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। আর এজন্যে সিলভির মনে হচ্ছে, মৃত্যুদণ্ড দেয়া উচিত ব্র্যাড স্টিল আর রিভ সিম্পসনকে। ‘আমার আসলে আর কিছু করার নেই,’ ভাবল সে। কখন যেন উঠে পড়েছে চেয়ার ছেড়ে। নিজেকে বলল, ‘অনেক তো সহ্য করেছি, আর নয়!’

স্টিলের সামনে গিয়ে সিলভি দাঁড়াতেই কন্সোলের দায়িত্ব নিল সিওয়ার্স।

‘তুমি গোটা প্রতিযোগিতায় ম্যানিয়াকটাকে অন্যায় সব সুযোগ করে দিয়েছ,’ অভিযোগের সুরে স্টিলকে বলল সিলভারম্যান।

‘গোটা শো জমিয়ে রেখেছে সে, তাই মাঝে মাঝে তাকে একটা-দুটো হাড় জুগিয়ে দিয়েছি,’ মেইন স্ক্রিনের ওপরে চোখ রেখে হাসিমুখে বলল স্টিল।

একের পর এক গুলি করছে শ্যানন।

বোল্ডারের আড়ালে সরে গিয়ে কাভার নিতে চাইছে রানা।

৩০২

গম্ভীর মুখে বিশাল স্ক্রিন দেখছে রিটা। গত ছত্রিশ ঘণ্টা ঘুমাতে না পেরে শুকিয়ে গেছে মুখ। এখন যা ঘটছে, সেটা মেনে নিতে পারছে না। সেটা বলেও ফেলল, ‘ওরা ন্যায্যভাবে লড়াই করলে সেটা অনেক ভাল হতো!’

‘ন্যায্য বলে এই দুনিয়ায় কিছু নেই,’ ধমকের সুরে বলল স্টিল। এত জোরে বলেছে যে এমিলি আর আশপাশের সবাই চমকে গেছে। ‘বাঙালি লোকটা এখন যেভাবে বিপদে পড়েছে, সেটা তারিয়ে তারিয়ে দেখছে দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ। এমন কাউকে খুঁজে পাবে না, যে কি না এখন উঠে পড়বে ডার্টি গেমের শো বাদ দিয়ে। একেই বলে যোগ্য লেখকের নিখুঁত ম্যান্যুস্ক্রিপ্ট।’

কথাটা শুনে আরও তিক্ত হলো সিলভির মন। বুঝে গেল, মাসুদ রানা বা অন্য যে ক’জন প্রতিযোগী ছিল, তাদেরকে মানুষ বলেই গণ্য করেনি স্টিল। নিজের হাতে লেখা চরিত্রগুলো চাপিয়ে দিয়েছে এদের ওপরে। যেমন মাসুদ রানা। তার ভাল গুণ গোপন করে তাকে পচিয়ে দেয়ার জন্যে মিথ্যার পর মিথ্যা গিলিয়ে দিয়েছে দর্শকদেরকে। প্রথম থেকেই স্থির করে রেখেছিল, এই প্রতিযোগিতায় প্রথম হবে রুপার্ট শ্যানন।

কত নোংরামিতে নাক গুঁজে দিয়েছে, সেটা ভাবতে গিয়ে মন দমে গেল টেকনিকাল ডিরেক্টরের। ডার্টি গেম তৈরি করার জন্যে স্টিলের প্রতি তার মনে জন্মে গেল একরাশ ঘৃণা। অন্তর থেকে বুঝে গেল, বহু আগে উচিত ছিল এসব থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া। অথচ এখন অনেক বেশি দেরি করে ফেলেছে।

তার দিকে নিষ্পলক চোখে চেয়ে বুঝে গেল রিটা, চাইলেও তাঁবু ছেড়ে এখন চলে যেতে পারবে না লোকটা। আর তার এই অপারগতার জন্যে তাকে অক্ষম লোক বলে মনে হলো ওর। পরক্ষণে ভাবল, আমিই বা কেন প্রতিবাদ করিনি? নিজেকেও তো ঘৃণা করা উচিত। আমি নিজে কি বিক্রি হইনি শয়তানের কাছে?

ভয়ঙ্কর দানব ব্র্যাড স্টিলের দিকে চেয়ে রইল ও।

রিটাকে পাত্তা দিচ্ছে না স্টিল। আবারও তাকাল এমিলির দিকে। সিলভির কথায় অস্বস্তিতে পড়ে গেছে মেয়েটা। সিওয়ার্সের দিকে ঘুরে গেল স্টিল। ‘দর্শক-সংখ্যা এখন কত?’

‘আগুন ধরে গেছে ওয়েব সাইটে,’ জানাল যুবক। ‘আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি চার কোটির কাছে।’

কথাটা শুনে হেসে ফেলল স্টিল। ‘ঠিক আছে, চার কোটি ক্রস করলে আমাকে সেটা জানাবে।

আবারও দর্শক-সংখ্যা দেখল সিওয়ার্স। মনে মনে বলল, স্টিলের সঙ্গে থাকলে কখনও টাকার অভাব হবে না আমার।

সবাই চেয়ে আছে বিশাল স্ক্রিনের দিকে।

.

‘শুয়োরের বাচ্চা, সাহস থাকলে মোকাবিলা কর্ পুরুষমানুষের মত!’ চিৎকার ছাড়ল কাপুরুষ শ্যানন। রানার পিছু নিয়েছে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে, কারণ হাতে গুলিতে ভরা বন্দুক। অসংখ্য বোল্ডারের ভেতরে কোথায় যেন লুকিয়ে পড়েছে রানা। অবশ্য তাতে ওর কোন লাভ হবে না। রেহাই পাবে না শ্যাননের হাত থেকে। বারো গেজের বন্দুকের গুলি খেয়ে মরতে হবে রানার।

ওকে কীভাবে খুন করবে সেটা ভাবতে গিয়ে খুশি হয়ে উঠেছে শ্যানন। প্রথমে গুলি করবে ডান ঊরুতে। হামাগুড়ি দিয়ে পালিয়ে যেতে চাইবে রানা। তখন গুলি করে তার বাম ঊরু ফুটো করে দেবে শ্যানন। মাটিতে পড়ে থাকবে রানা। কোমরে লাথি মেরে ওকে চিত করবে শ্যানন। এরপর সরাসরি গুলি গেঁথে দেবে তলপেটে। ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে লোকটার। প্রায় যায় যায় অবস্থা হলে তখন তার মুখে পুরে দেবে বন্দুকের নল। দুই ব্যারেলের দুই গুলিতে উড়িয়ে দেবে হারামজাদার মাথা।

আর মজার ব্যাপার হচ্ছে, খুনের গোটা দৃশ্য ক্যামেরার কল্যাণে দেখতে পাবে দর্শকেরা। শ্যানন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার পর বারবার খুনের দৃশ্যটা দেখাবে ব্র্যাড স্টিল। চুক্তি অনুযায়ী, ওর হাতে তুলে দেবে সুটকেস ভরা ডলার। ওকে পৌঁছে দেয়া হবে নিরাপদ কোন দেশে। লোকারণ্যে হারিয়ে যাবে সে। এরচেয়ে ভাল কিছু আর কী ঘটতে পারে ওর মত একজন মানুষের জীবনে!

.

শ্যাননকে কীভাবে ঘায়েল করবে সেটা নিয়ে ভাবছে রানা। অস্ত্র বলতে আছে শুধু ছোরা। ওটার জোরে বন্দুকের বিরুদ্ধে জিতে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তানাকার মতই শ্যাননকে লোভ দেখাতে চাইছে রানা। এগিয়ে চলেছে ক্যানিয়নের দূর থেকে দূরে। বুঝে গেছে, যেভাবে হোক খরচ করাতে হবে ইংরেজ সাইকোর গুলি।

রানার পরিকল্পনায় নিজেও সহায়তা করছে শ্যানন। তার জানা আছে আগামী চুয়াল্লিশ মিনিটের ভেতরে রানাকে খুন করতে না পারলে নিজেই মরবে গোড়ালির বোমা বিস্ফোরণে।

অস্বাভাবিক রঙের এক ঝোপের দিকে ছুটে চলেছে রানা। ওটার পাতা সবজেটে-নীল। অবশ্য এখন কিছু ভাবার সময় নেই ওর। পেছনে ‘বুম্‌!’ শব্দে গর্জে উঠল বন্দুক। একরাশ ছররা গুলি লাগতেই আগুন জ্বলে উঠল রানার পিঠে। ঝাঁপিয়ে পড়ল বামের এক ঝোপে। উঠে বসে ডানহাত পেছনে নিয়ে স্পর্শ করল আহত জায়গা। হাত ফিরিয়ে এনে দেখতে পেল তাজা রক্তে ভিজে গেছে ওর তালু।

বন্দুকের চেম্বারে গুলি ভরছে শ্যানন। বিড়বিড় করে গালি দিচ্ছে স্টিলের বাপ-মা তুলে। শুয়োরের বাচ্চা এলজি শেল না পাঠিয়ে ওকে গছিয়ে দিয়েছে ছোট পাখি মারার কার্তুজ। আবার খুব যে মন্দ লোক ওই শালা, তেমনটাও নয়। বাক্সের ভেতরে অভাব নেই গুলির। সুতরাং সমস্যা হবে না তার। শেয়ালের মত তাড়া খেয়ে ভাগছে এসএএস ফোর্স থেকে প্রশিক্ষিত মাসুদ রানা। শেয়ালের মতই গুলি খেয়ে মরবে সে। শ্যাননের শুধু সতর্ক হতে হবে, যাতে দূর থেকে ছুঁড়ে ছোরা দিয়ে ওকে আহত করতে না পারে সে।

বন্দুকে গুলি ভরে ঝড়ের বেগে ছুটে চলল শ্যানন। খেয়াল করল না, সামনের ঝোপ কেমন যেন অস্বাভাবিক।

.

রুপার্ট শ্যানন পেরিয়ে যেতেই নড়ে উঠে এগোল একটা ঝোপ। বেলারুশের জেলখানায় রাশান অপরাধী লোপাতিনের লড়াইয়ের যোগ্যতা দেখতে যাদের পাঠিয়ে দিয়েছিল স্টিল, তাদেরই একজন অস্ট্রেলিয়ান ক্যামেরাম্যান জোহানসন। এখন ক্যামোফ্লেজ্‌জ্ ঝোপ নিয়ে এগোচ্ছে সে। ঘুমাতে পারেনি প্রায় তিরিশ ঘণ্টা। তার ওপরে নিজের চোখে ভয়ঙ্কর খুনোখুনি দেখে দমে গেছে তার মন। রানার সঙ্গে লোপাতিনের লড়াই দেখার পর থেকে শুরু হয়েছে তার মানসিক যন্ত্রণা। এটা বুঝে গেছে, দেশে ফিরে গেলে দেরি না করে দেখাতে হবে ভাল কোন সাইকিয়াট্রিস্ট। থেরাপি নিলেও বোধহয় বহু দিন লাগবে সুস্থ হতে।

ভিউফাইণ্ডারে চোখ রেখে যে দৃশ্য ধারণ করেছে, সেজন্যে নিজেকে দোষী বলে ভাবছে সে। ভাল করেই জানে, মানুষ খুনকে কখনও বিনোদন বলে চালিয়ে দেয়া যায় না। এই যে এখন ধীরে ধীরে ঝোপ নিয়ে এগোচ্ছে, সে-ও তো মানুষের খুনের ভিডিয়ো তুলতে। প্রিয় স্ত্রী জেনি আর লক্ষ্মী বাচ্চাদুটোর কথা ভাবতে গেলেই তার মনে চেপে বসছে অপরাধবোধ। জেনি শুধু জানে প্রশান্ত মহাসাগরে এক দ্বীপে একটি রিয়েলিটি শো-তে ক্যামেরাম্যানের কাজ করছে সে। নিয়মিত চার্চে যায় বেচারি, কখনও যদি জানতে পারে ওর স্বামী একদল পশুর জন্যে মানব-হত্যার ভিডিয়ো তুলে বেড়িয়েছে, তাতে চুরচুর হয়ে ভেঙে যাবে ওর মন। আর জানবে না তেমনও নয়। হয়তো এরই মধ্যে পরিচিতরা বলে দিয়েছে, জোহানসন কাজ করছে ডার্টি গেম শো-তে। নিজেকে বোঝাতে চাইছে সে, সংসারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে এই কাজটা নিতে বাধ্য হয়েছে সে। কিন্তু তাতেও রেহাই পাচ্ছে না বিবেকের দংশন থেকে। বড় হয়ে বাচ্চারা যখন জানবে ডার্টি গেম-এর ক্যামেরাম্যান ছিল ওদের বাবা, হয়তো চরম ঘৃণা করবে ওকে। পর্নো ক্যামেরাম্যানের চেয়ে নিজেকে ভাল মানুষ বলে ভাবতে পারছে না জোহানসন।

‘এগোও,’ নিচু গলায় বলল পাশের ঝোপ।

জোহানসনকে নিরাপত্তা দিতে বিআর ১৮ অ্যাসল্ট রাইফেল হাতে বসে আছে লোকটা।

কী করবে ভাবতে গিয়ে দ্বিধা এল জোহানসনের মনে। সব ছেড়ে-ছুঁড়ে দেশে ফিরলেই হয়তো ভাল হতো। কিন্তু ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রি অদ্ভুত এক জগৎ। একবার বদনাম হয়ে গেলে আর কখনও কোন কাজ পাবে না। তা ছাড়া, এখন চলে গেলে হয়তো আটকে দেয়া হবে ওর চেক। নিজেকে বুঝ দিল জোহানসন, ঊনত্রিশ ঘণ্টা তো কষ্টেসৃষ্টে পেরিয়ে গেছে, কোনমতে বাকি সময়টুকু পার করতে পারলে হাতে পাব মোটা অঙ্কের টাকা। এরপর আর কখনও যাব না ব্র্যাড স্টিলের ধারে-কাছে। বাকি জীবন খুঁজে নেব ভাল সব শো।

শ্যাননের ওপরে লেন্স তাক করে এগোল জোহানসন। বড় এক বোল্ডারের ওদিকে গুলি করল ইংরেজ সাইকোপ্যাথ। ডান বাহুতে ছররা লাগতেই রানার হাত থেকে উড়াল দিয়ে দূরে গিয়ে পড়েছে বোলো নাইফ। পেছনে বারো গেজের বন্দুকের গর্জন শুনতে পেল রানা। বুঝে গেল, খুব দ্রুত সরে না গেলে পরের গুলি শেষ করে দেবে ওকে। পনেরো গজ দূরে পাথুরে এক গভীর গামলার মত জায়গায় জমে আছে নদীর পানি। ওদিকে ছুটে গেল রানা। প্রায় উড়ে গিয়ে ঝাঁপ দিল ডোবার ভেতরে। পানির নিচে তলিয়ে যেতেই ওপরদিকের পানিতে এসে লাগল একরাশ পেলেট।

পাথুরে ডোবার কিনারায় এসে থামল শ্যানন। বন্দুক রিলোড করে পায়চারি শুরু করেছে ডোবা ঘিরে।

ডোবার ভেতরে কোথাও কোন চিহ্ন নেই মাসুদ রানার।

‘আরে উঠে আয়, শুয়োরের বাচ্চা! এত ভয় কিসের তোর!’ পাথুরে ক্যানিয়নে গমগম করছে শ্যাননের কর্কশ কণ্ঠ।

দুই মিনিট পেরিয়ে গেলেও আর ভেসে উঠল না রানা।

লোকটার গায়ে বোধহয় গুলি লাগেনি, ভাবছে শ্যানন। তবে এবার যে-কোন সময়ে ভেসে উঠতে হবে তাকে।

ডোবার বিশ ফুট দূরে নড়ে উঠল একটা ঝোপ

কীভাবে যেন ডোবা ত্যাগ করে ওদিকের ঝোপে লুকিয়ে পড়েছে মাসুদ রানা, বুঝে গেল শ্যানন। নিশ্চয়ই লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে হারামজাদাটা! শেওলা ভরা পাথুরে জমিতে ঘুরেই ওদিকে ছুটল শ্যানন। জানে, এখন রানার হাতে ছোরাও নেই। ঝোপ আবারও নড়ে উঠতেই নলকাটা বন্দুক ওদিকে তাক করল ইংরেজ সাইকো। ‘বেরিয়ে আয়, শুয়োরের বাচ্চা!’

আরও কয়েক পা যেতেই ঝোপের ভেতরে ক্যামেরার লেন্স দেখতে পেল সে। ধরা পড়ে গেছে বুঝে ভিউফাইণ্ডার থেকে চোখ সরিয়ে উঠে দাঁড়াল জোহানসন। তার চোখ সরাসরি খুনির লালচে চোখে।

পরস্পরকে দেখছে জোহানসন ও শ্যানন। তারপর বলে উঠল প্রাক্তন মেজর, ‘তুই ঝোপের ভেতরে কেন?’

চোখের কোণে আরেকটা ঝোপ নড়ে উঠতে দেখল শ্যানন। ওর দিকে অ্যাসল্ট রাইফেল তাক করছে এক লোক। শ্যানন জানে না, গার্ডকে বলা হয়েছে বাধ্য না হলে যেন গুলি না করে। গুলি করবে কি না সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়েছে লোকটা। আর সেজন্যেই প্রাণ হারাতে হলো তাকে।

বন্দুক ঘুরিয়ে তার মুখ লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ল শ্যানন। একগাদা পেলেটের আঘাতে উড়ে গল গার্ডের মুখ। পিছিয়ে ধুপ করে পাথুরে মাটিতে পড়ল সে। পরক্ষণে পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে ক্যামেরাম্যানের বুকে গুলি করল শ্যানন।

হৃৎপিণ্ডে ছররা ঢুকতেই ধড়াস করে পড়ে গেল জোহানসন। শুধু বলতে পারল, ‘আমি তো সামান্য এক ক্যামেরাম্যান!’

‘তো কীভাবে মরলি সেটা ভিডিয়ো কর্!’ খ্যাকখ্যাক করে হেসে উঠল শ্যানন।

মৃত্যুদূত এসে প্রাণটা নিয়ে যাওয়ার আগে পলকের জন্যে প্রিয় স্ত্রী আর বাচ্চাদুটোর হাসিমুখ দেখতে পেল জোহানসন।

.

একই সময়ে ডোবার ভেতরে রানা ভেসে উঠতেই দৃশ্যটা স্ক্রিনে তুলে দিল এমিলি। চোখ এড়িয়ে গেছে গার্ড ও ক্যামেরাম্যানের হত্যাকাণ্ড।

‘এসব দৃশ্য কোথা থেকে এল! লাইভ ইউনিট কী করছে!’ হতাশা নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল ব্র্যাড স্টিল।

‘লাইভ ইউনিট মারা গেছে,’ ঢোক গিলে বলল সিওয়ার্স।

জোহানসনের ক্যামেরার দৃশ্য স্ক্রিনে আনল এমিলি। মাটিতে পড়ে আছে যন্ত্রটা। পাশেই মৃত জোহানসন। সামান্য দূরেই অ্যাসল্ট রাইফেলের পাশে গার্ডের লাশ।

এর অর্থ ভাল করে বুঝে গেছে মেইন তাঁবুর সবাই।

এইমাত্র তাদেরই দলের দু’জনকে খুন করে ফেলেছে শ্যানন।

‘ব্যাটা করছেটা কী!’ বিড়বিড় করল স্টিল। লোকদু’জন মারা গেছে বলে তার মনে কোন দুঃখ নেই। আফসোস করছে যে শো-র দুর্দান্ত কিছু দৃশ্য এখন আর দেখতে পাবে না দর্শকেরা।

ক্যামেরায় দেখা গেল শ্যাননের বুটের অংশ। তারপর লোকটা তুলে নিল অটোমেটিক অস্ত্রটা।

রানা যে ডোবায় ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে, ক্যামেরা সেদিকে আবারও ফিরিয়ে আনল এমিলি। একসেকেণ্ডের জন্যে দেখা গেল একটা ঝোপের ওদিকে চলে গেল বাঙালি যুবক।

স্রেফ কপালের জোরে বেঁচে আছে রানা। মিনিট চারেক পানির নিচে ছিল, তারপর দম ফুরিয়ে যেতেই ভেসে উঠেছে ঘন কিছু নলখাগড়ার ভেতরে। আর তখনই দেখতে পেয়েছে ডোবা পাশ কাটিয়ে আরেক দিকে গেল শ্যানন। এরপর গর্জে উঠল তার হাতের বন্দুক। পরক্ষণে আবারও ‘বুম!’ শব্দ ছাড়ল অস্ত্রটা। কে যেন অসহায় স্বরে বলল, ‘আমি তো সামান্য এক ক্যামেরাম্যান!’

নলখাগড়ার ভেতর দিয়ে শ্যাননের দিকে এগোল রানা। কিন্তু তখনই হাত বাড়িয়ে অটোমেটিক অস্ত্র তুলে নিল সাইকো লোকটা।

এবার নিশ্চিত হয়ে গেছে ওর মৃত্যু, বুঝতে দেরি হলো না রানার। তবুও ভাবল ঝুঁকি নিয়ে আক্রমণ করবে শ্যাননের ওপরে। এ-ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই ওর। ডোবার কাছে ওকে খুঁজছে শ্যানন। আর তখনই ঝোপ থেকে বেরিয়ে তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা।

একেবারে শেষ সময়ে ওকে দেখে বিআর ১৮ অ্যাসল্ট রাইফেলের নল ঘুরিয়ে নিতে চাইল শ্যানন। তবে রানার হাতের ঝটকা খেয়ে ছিটকে পড়ল অস্ত্রটা। তাতে কমে গেল না বিপদের মাত্রা। ডানহাতে নলকাটা বন্দুক ঘুরিয়ে নিল শ্যানন। অবশ্য গুলি বেরোবার আগেই লাথি মেরে তার হাত থেকে বন্দুক ফেলে দিল রানা। দু’জনই বুঝে গেছে, এবার মরণপণ লড়াইয়ে বোঝা যাবে ওদের ভেতরে কে আসলে সত্যিকারের যোগ্য যোদ্ধা।

সকল অধ্যায়

১. ডার্টি গেম – ১
২. ডার্টি গেম – ২
৩. ডার্টি গেম – ৩
৪. ডার্টি গেম – ৪
৫. ডার্টি গেম – ৫
৬. ডার্টি গেম – ৬
৭. ডার্টি গেম – ৭
৮. ডার্টি গেম – ৮
৯. ডার্টি গেম – ৯
১০. ডার্টি গেম – ১০
১১. ডার্টি গেম – ১১
১২. ডার্টি গেম – ১২
১৩. ডার্টি গেম – ১৩
১৪. ডার্টি গেম – ১৪
১৫. ডার্টি গেম – ১৫
১৬. ডার্টি গেম – ১৬
১৭. ডার্টি গেম – ১৭
১৮. ডার্টি গেম – ১৮
১৯. ডার্টি গেম – ১৯
২০. ডার্টি গেম – ২০
২১. ডার্টি গেম – ২১
২২. ডার্টি গেম – ২২
২৩. ডার্টি গেম – ২৩
২৪. ডার্টি গেম – ২৪
২৫. ডার্টি গেম – ২৫
২৬. ডার্টি গেম – ২৬
২৭. ডার্টি গেম – ২৭
২৮. ডার্টি গেম – ২৮
২৯. ডার্টি গেম – ২৯
৩০. ডার্টি গেম – ৩০
৩১. ডার্টি গেম – ৩১
৩২. ডার্টি গেম – ৩২
৩৩. ডার্টি গেম – ৩৩
৩৪. ডার্টি গেম – ৩৪
৩৫. ডার্টি গেম – ৩৫
৩৬. ডার্টি গেম – ৩৬
৩৭. ডার্টি গেম – ৩৭

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন