ডার্টি গেম – ৬

কাজী আনোয়ার হোসেন

ছয়

দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমে খাড়া এক টিলার ওপরে ল্যাণ্ড করেছে স্টিলের ব্যক্তিগত হেলিকপ্টার। ল্যাণ্ডিং প্যাডের দু’দিকে দুর্গম ক্লিফ। অন্যদিকে এক শ’ ফুট নিচে বোল্ডারের ওপরে আছড়ে পড়ছে প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল ঢেউ। সাগরের দিক দিয়ে দ্বীপে ওঠা প্রায় অসম্ভব। আর সেটা সম্ভব হলেও সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে ঘন জঙ্গল। ওটার মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে গেছে চওড়া নদী। স্টিল ভেবেছে, দ্বীপের দক্ষিণে নামিয়ে দেবে খুনিদেরকে। সেক্ষেত্রে গিরিখাদের কারণে ওর গ্রামে সহজে পৌঁছুতে পারবে না কেউ।

হেলিপ্যাড থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে জঙ্গলের ভেতরে টেক গ্রাম। উঁচু টিলা থেকে পঞ্চাশ ফুট নেমে জিপের কাছে পৌঁছল রিটা ও স্টিল। জিপের ড্রাইভার সিম্পসনের একজন গার্ড। জঙ্গলের এবড়োখেবড়ো পথে গাড়ি চালিয়ে গ্রামে পৌঁছে দেবে সে।

হেলিকপ্টারে ওঠার পর থেকে কোন কথা বলেনি রিটা। উষ্ণ পরিবেশে তিরিক্ষি হয়ে গেছে ওর মন। নিজেকে বোঝাতে চাইছে, মানুষগুলো মৃত্যুদণ্ড-প্রাপ্ত খুনি। এমনিতেই হত্যা করা হতো তাদেরকে। কিন্তু এ-কথা ভাবতে গেলেই মনে খোঁচা দিচ্ছে অন্য চিন্তা। ব্র্যাড আসলে কে ওদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার? আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার অধিকার কোথায় পেল সে? দর্শকেরা যা দেখতে চাইছে, সেটাই দেখাবে। কিন্তু মানুষগুলোর মৃত্যু নিশ্চিত করে কোটি কোটি ডলার আয় করার ভাবনাটা কি অমানবিক নয়?

মৃত্যুপথযাত্রীদের নতুন পোশাক আর তাদের নকল জীবন বৃত্তান্ত তৈরি করতে গিয়ে নিজেও বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে গেছে রিটা। স্টিল যদিও বলেছে, আইনের পথ বাঁকা করে নিলেও ডার্টি গেম শো-র জন্যে কোন ধরনের অপরাধ করবে না। কিন্তু তাই যদি হয়, সেক্ষেত্রে কেন কোটি কোটি মানুষের কাছে এই শো-র টিকেট বিক্রি করছে সে? প্রথম থেকেই ভাল পরিচালক স্টিল। আর সে যোগ্যতার কারণে কেড়ে নিয়েছে বহু মানুষের মনোযোগ। প্রেমিক হিসেবেও তুলনা নেই ওর। সবসময় স্টিলকে বিশ্বাস করেছে রিটা, নইলে কখনও তার কথা শুনে নিজের ক্যারিয়ার ফেলে এখানে আসত না। স্টিলের হঠাৎ এই পরিবর্তন নতুন করে ভাবাচ্ছে ওকে।

দ্বীপে ফেরার সময় নিজেও চুপ করে থেকেছে স্টিল। বুঝে গেছে, খুব অস্বস্তির ভেতরে পড়েছে রিটা। তবে সেটা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। মানুষ খুনের মাধ্যমে টাকা উপার্জনের বিষয়টা মানতে কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার। ভাল বিক্রেতা সবসময় বোঝে কখন কঠিন হবে তার মাল বিক্রি করা, আর কখন একেবারেই পারবে না। স্টিল জানে, আগে হোক বা পরে ওর মত করে ভাবতে শুরু করবে রিটা। বিশেষ করে বিশাল স্ক্রিনে শো শুরু হলে ডার্টি গেমের এডিটিং, গ্রাফিক্স ও মিউযিকের গুণে উত্তেজনার স্রোতে না ভেসে উপায় থাকবে না। ওর কাজ এখনও ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখছে না রিটা। সেটা যদি করত, অনেক আগেই মানা করে দিত এখানে আসতে। মেয়েটা গত কয়েক মাসে জেনে গেছে, সুদর্শন, প্রতিভাবান কোটিপতি স্টিলের অমোঘ আকর্ষণ এড়ানো যায় না।

গ্রামে পৌঁছে জিপ থেকে নেমে সিম্পসনের গার্ডকে বলল স্টিল, ‘এবার গেট আটকে দাও। শুরু হচ্ছে শো-টাইম।’

রেযর ওয়াএয়ার গেট আটকে শেকল জড়িয়ে তালা মারল গার্ড। বিশাল তাঁবুতে ঢুকতেই শিরায় অ্যাড্রেনালিনের স্রোত টের পেল স্টিল। বুঝে গেল, এবার শো শুরু হচ্ছে বলে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে তাঁবুর সবাই।

‘ওরা রওনা হয়ে গেছে,’ সবার ওপরে চোখ বোলাল স্টিল। ‘তোমরা তৈরি তো? তোমার কী খবর, সিলভি?’

‘খবর ভাল না, দুর্বল স্বরে বলল সিলভারম্যান, ‘তুমি আসলে আমাকে কী করতে বলো? এখানে তো টেকনিকাল কোন কিছুই আসলে ঠিকঠাক নেই!’

অসংখ্য স্ক্রিনের দিকে চেয়ে ঘামছে টেকনিকাল ডিরেক্টর। কিছু স্ক্রিনে একাধিক দৃশ্য। বক্সের মত সব অংশে লাইভ ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল-স্বর্গের মত সুন্দর সৈকত, উঁচু জলপ্রপাত, বিধ্বস্ত মিলিটারি ট্র্যান্সপোর্ট বিমান, এমন কী সাগরের নিচেও আছে চমৎকার সব দৃশ্য। প্রতিটি দৃশ্যের নিচে টেপ লাগিয়ে ক্যামেরার নম্বর ও এলাকার নাম লিখছে সিলভির অ্যাসিস্ট্যান্টরা।

এতদিন সিলভির সঙ্গে কাজ করে স্টিল বুঝেছে, তার বন্ধুর মন যত খারাপ হবে, তত ভালভাবে চলবে শো।

‘এমিলি? তুমি কি রেডি?’

‘আমার জন্মই তো হয়েছে রেডি থাকার জন্যে, খুশিমনে বলল এমিলি।

‘সিওয়ার্স?’

কিবোর্ড থেকে তুলে বুড়ো আঙুল দেখাল সিওয়ার্স। ‘সব ঠিক আছে।’

অন্য কোন শো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আগে এত ভাল লাগেনি স্টিলের। উত্থিত হলো তার পুরুষাঙ্গ। রিটার সঙ্গে সঙ্গমের সময়েও এত উত্তেজিত হয় না সে।

‘এমিলি! পুরনো কিছু রক অ্যাণ্ড রোল চালু করো।’

মুচকি হেসে ডিভিডি নিয়ে পাশের মেশিনে ভরল এমিলি।

ব্রডকাস্ট শুরু করার আগে তিক্ত মুখে স্ক্রিনগুলো দেখছে সিলভারম্যান। তার মানে, সবকিছুই ঠিকভাবে চলছে।

‘মিলা, এক শ’ তেতাল্লিশ নম্বর ক্যামেরা।’ বছর বিশেকের এক মেয়ের দিকে তাকাল সিলভি। মিলাকে দেখলে মনে হবে ওর বয়স বড়জোর পনেরো। ‘তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? এমন হলে তো ডুবে যাবে এই শো! পাম গাছের পাতা থেকে সরিয়ে সরাসরি ক্যামেরা তাক করো সাগরে।’

মেইন স্ক্রিনে শুভ্র তুষারের দৃশ্য দেখে ঘুরে তাকাল স্টিল। ‘সিলভি, আমাদের স্যাটেলাইট কি কাজ করছে?’

‘না, করছে না।’

পরের সেকেণ্ডে তুষারের মত দৃশ্যের বদলে এল সবুজ দ্বীপের দক্ষিণ দিক ও নীল সাগর। সমুদ্র-সমতল থেকে মাত্র পঞ্চাশ ফুট ওপর দিয়ে গর্জন ছাড়তে ছাড়তে আসছে দুটো মিলিটারি হেলিকপ্টার। প্রতিটির ভেতরে আছে পাঁচজন করে অপরাধী।

মস্ত স্ক্রিনে তাকাল স্টিল। ক্রমে ক্রমে বড় হয়ে উঠছে হেলিকপ্টার দুটো। যেন সোজা আছড়ে পড়বে তাঁবুর ওপরে।

‘মিউযিক, এমিলি!’

মেয়েটা প্লে-বাটন টিপে দিতেই চালু হলো গাল্স্ অ্যান’ রোযেসের বিখ্যাত গান—’ওয়েলকাম টু দ্য জাঙ্গল’।

বিশাল তাঁবুর স্পিকার ছড়িয়ে দিল বিকট আওয়াজ।

‘সিওয়ার্স, এবার আমাদেরকে নেবে ওয়েব-এ!’

সকল অধ্যায়

১. ডার্টি গেম – ১
২. ডার্টি গেম – ২
৩. ডার্টি গেম – ৩
৪. ডার্টি গেম – ৪
৫. ডার্টি গেম – ৫
৬. ডার্টি গেম – ৬
৭. ডার্টি গেম – ৭
৮. ডার্টি গেম – ৮
৯. ডার্টি গেম – ৯
১০. ডার্টি গেম – ১০
১১. ডার্টি গেম – ১১
১২. ডার্টি গেম – ১২
১৩. ডার্টি গেম – ১৩
১৪. ডার্টি গেম – ১৪
১৫. ডার্টি গেম – ১৫
১৬. ডার্টি গেম – ১৬
১৭. ডার্টি গেম – ১৭
১৮. ডার্টি গেম – ১৮
১৯. ডার্টি গেম – ১৯
২০. ডার্টি গেম – ২০
২১. ডার্টি গেম – ২১
২২. ডার্টি গেম – ২২
২৩. ডার্টি গেম – ২৩
২৪. ডার্টি গেম – ২৪
২৫. ডার্টি গেম – ২৫
২৬. ডার্টি গেম – ২৬
২৭. ডার্টি গেম – ২৭
২৮. ডার্টি গেম – ২৮
২৯. ডার্টি গেম – ২৯
৩০. ডার্টি গেম – ৩০
৩১. ডার্টি গেম – ৩১
৩২. ডার্টি গেম – ৩২
৩৩. ডার্টি গেম – ৩৩
৩৪. ডার্টি গেম – ৩৪
৩৫. ডার্টি গেম – ৩৫
৩৬. ডার্টি গেম – ৩৬
৩৭. ডার্টি গেম – ৩৭

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন