কাজী আনোয়ার হোসেন
প্রতি হেলিকপ্টারে আছে পাঁচজন করে ক্রিমিনাল, দু’জন করে সশস্ত্র গার্ড এবং একজন করে পাইলট। আলফা হেলিকপ্টারে প্রতিযোগী হিসেবে আছে রানা, রাশান খুনি, দুই মেক্সিকান অপরাধী আর সাইকোপ্যাথ রুপার্ট শ্যানন। কার্গো বেতে একই শেকলে বেঁধে নেয়া হয়েছে ওদের হ্যাণ্ডকাফের চেইন। বড় ধরনের কোন ঝামেলা হোক সেটা চাইছে না স্টিল, তাই তার অনুরোধে এদের সঙ্গে এসেছে রিভ সিম্পসন।
হেলিকপ্টারে সবাইকে তোলা হয়েছে বহু হিসেব-নিকেশ কষে। স্টিল চেয়েছে প্রতিটি যান্ত্রিক ফড়িঙে থাকবে একজন করে মেয়ে। আর ওর জন্যে কামুক হয়ে উঠবে পুরুষেরা। যাদেরকে আনা হচ্ছে এ-দ্বীপে, রানা ছাড়া অন্যরা সবাই খুনি ও ধর্ষক। আলেক্যান্দ্রো ও তার স্ত্রীর সঙ্গে ভেবেচিন্তে জুটিয়ে দেয়া হয়েছে ইংরেজ সাইকো শ্যাননকে। লোকটা নিষ্ঠুর এক ধর্ষণকারী বলে আতঙ্কে থাকবে ইসাবেলা। আর তাতে ওকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্যে উত্তেজিত থাকবে তার স্বামী। এদিকে হেলিকপ্টার থেকে কাছাকাছি জায়গায় নামানো হবে তাদের তিনজনকে। ফলে মেক্সিকান দুই খুনি জোট তৈরি করলে জমে উঠবে শ্যাননের সঙ্গে তাদের বিরোধ।
লোপাতিন হয়তো কারও সঙ্গে দল গড়বে না।
হ্যাঙারের ভেতরে স্টিল দেখেছে, পরস্পরকে মেপে নিচ্ছে মাসুদ রানা আর রুপার্ট শ্যানন। ওদের লড়াই নিজের চোখে দেখেছে সে। দু’জনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে সেটা হবে খুব আকর্ষণীয় কিছু।
সাগরের ওপর দিয়ে হেলিকপ্টারে করে আসার সময় কারও দিকে খুব একটা মনোযোগ দেয়নি রানা। চল্লিশ মিনিট পর পাইলটের উইগুস্ক্রিনের ওদিকে দেখতে পেল দ্বীপটাকে। হেলিকপ্টার এত নিচু দিয়ে চলেছে যে বুঝতে পারল না দ্বীপটা আসলে বড় না ছোট। আন্দাজ করল, ওটা প্রশস্তে বড়জোর আট বা দশ মাইল। দৈর্ঘ্যে বিশ মাইল। চারপাশে ঘন জঙ্গল। এদিকে-ওদিকে উঁচু টিলা ও গভীর সব উপত্যকা। সূর্যের যে অ্যাঙ্গেল দেখা যাচ্ছে, তাতে রানার ধারণা ওরা এসেছে পশ্চিম দিক থেকে। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে ওরা চলেছে পুবদিকে।
পুবদিকে দ্বীপ বা রিফ নেই যে ছোট হবে সাগরের ঢেউ। দ্বীপের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসে ঢেউয়ের বুকে তৈরি হচ্ছে সফেদ ফেনা-ওগুলো বলে দিচ্ছে পুবে চলেছে বাতাসের তোড়। রানা তাতে বুঝে গেল, দ্বীপের পুবে ভিড়তে পারবে না কোন ধরনের বোট। একই কারণে সাগরে নেমে পালিয়ে যেতে পারবে না কেউ।
চোখ সরিয়ে শ্যাননকে দেখে নিয়ে ভাবল রানা, ওর মত একই হিসাব কষছে সে। কিন্তু পরের সেকেণ্ডে বুঝল, মেক্সিকান খুনি ইসাবেলার ওপরে তার লোভী দৃষ্টি। মেয়েটার ঊরু বেয়ে স্তনে থামল শ্যাননের চোখ। তারপর দৃষ্টি আবার নেমে গেল ঊরু-সন্ধিস্থলে। রানার মনে হলো, মানসিকভাবে মেয়েটাকে ধর্ষণ করছে ইংরেজ সাইকোপ্যাথ।
সচেতন হয়ে উঠেছে ইসাবেলা। আড়ষ্ট কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘অ্যাই, তোমার আসলে সমস্যাটা কী?’
জবাবে বড় বড় সাদা দাঁত বের করে হাসল শ্যানন। আলেক্যান্দ্রোর দিকে তাকাল। নিরাপত্তা দেয়ার জন্যে স্ত্রীর পাশে আছে লোকটা। ‘তোমার বউ খুবই সুন্দরী,’ প্রশংসার সুরে বলল শ্যানন।
‘আমি তোর পুটকি মারি, শালা!’ চোখ পাকিয়ে তাকে দেখল আলকারায।
ভাষা অচেনা হলেও সবই বুঝে গেছে রাশান দানব। সে-ও চেয়ে আছে ইসাবেলার বুকের দিকে। হাসতেই দুই সারি ক্ষয়ে যাওয়া দাঁতের মাঝ দিয়ে গিরগিটির মত বেরোল কাটা লাল জিভ। ভয় পেয়ে দূরে সরে যেতে চাইল ইসাবেলা।
হঠাৎ উচ্চতা হ্রাস করে বামে বাঁক নিল হেলিকপ্টার। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে ডানে দ্বিতীয় হেলিকপ্টারটা দেখতে পেল রানা। পুব সাগর বিক্ষুব্ধ বলে দ্বীপের অন্যদিকে চলেছে দুই যান্ত্রিক ফড়িঙ। এরা আলাদা জায়গায় আমাদের নামিয়ে দেবে, ভাবল রানা। তবে খুব বেশি ব্যবধান থাকবে না পরস্পরের ভেতরে।
আবারও শ্যাননকে দেখল ও। স্টিলের পরিকল্পনা বুঝে তিক্ত হলো ওর মন। লোকটা চাইছে মেয়েদুটোকে দখলে নেয়ার জন্যে লড়তে শুরু করবে অপরাধীরা। আর তাতে জমে উঠবে ডার্টি গেম শো।
হেলিকপ্টারের সাইড ডোর সিম্পসন খুলে দিতেই হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকল দমকা হাওয়া। দ্বীপের কোনা ঘুরল চপার। পলকের জন্যে জঙ্গলে পুরনো এক ওয়েদার টাওয়ার দেখতে পেল রানা। ওটার ছাতে বিশাল এক আধুনিক অ্যান্টেনা। ঘন জঙ্গলে আরও কী আছে বুঝতে ঝুঁকে তাকাল ও। গাছপালার মাঝে চলাচলের সরু পথ। এ-ছাড়া, ওদিকে আছে বিশাল এক তাঁবু আর আকাশের দিকে তাক করা স্যাটেলাইট ডিশ। মাত্র একসেকেণ্ডে পেছনে হারিয়ে গেল সব।
পাইলটের কাঁধের ওপর দিয়ে কম্পাসে চোখ রাখল রানা। ছোট যন্ত্রটার কাঁটা উত্তরদিকে।
আরও নিচে নেমে এল হেলিকপ্টার।
খোলা দরজা দিয়ে ঢুকল সোনালি রোদ।
নিচে জনশূন্য সৈকত ও এবড়োখেবড়ো উপকূল।
বুঝতে দেরি হলো না রানার, ওদেরকে নেয়া হচ্ছে দ্বীপের দক্ষিণ তীরে। ওখানেই শুরু হবে সবার ভয়ঙ্কর লড়াই।
আর সেটা এড়াতে হলে নিখুঁত কোন প্ল্যান চাই ওর।
.
ব্রাভো হেলিকপ্টারের বিকট আওয়াজ ছাপিয়ে সিসিলিয়ান ও ইংরেজিতে মেশা চিৎকার জুড়েছে ইতালিয়ান খুনি বিয়াঞ্চি। গত আধঘণ্টায় তার গালাগালির তোড়ে আধপাগল হয়ে গেছে অন্যরা।
‘ওরে, আমার দয়ালু যিশুর বাপ! এরা আমার কথা একদম শুনছে না! হারামজাদা কুত্তাগুলো কোন মানুষই না! শুয়োরের বাচ্চাগুলোকে চরম শাস্তি দিন, আমার দয়ালু মালিক!’ কথার ফাঁকে কাইতো তানাকার দিকে তাকাল এনযো।
কোনকিছু তোয়াক্কা না করে শেকলে ভর দিয়ে বুকডন দিচ্ছে জাপানি খুনি।
‘তুই আসলে আমার ভাই! আমার কথা মন দিয়ে শোন! আমরা নিজেরা নিজেরা মারামারি করব না! না হলে সবাই মিলে খুন হতে হবে!’
‘অ্যাই, শালা, চুপ!’ দাঁত খিঁচিয়ে ধমক দিল ড্রাগ ডিলার ক্লার্ক, ‘একদম চুপ!’
কৃষ্ণাঙ্গ লোকটাকে দেখছে নাৎসি স্লাইডার, চোখে তীব্র ঘৃণা। একবার ঘুরে তাকাল বিয়াঞ্চির দিকে। ‘অ্যাই, শালা, তুই চুপ কর, নইলে তোর লালচে পাছা দিয়ে সাদা স্প্যাগেটি ভরে দেব!’
ক্লার্ককে দেখল রোযি ইয়াসিমান। কতবড় বিপদে পড়েছে সেটা বুঝে চোখ রাখল চপারের মেঝেতে। যেন পণ করেছে চোখ তুলে দেখবে না জার্মান খুনিকে। কৃষ্ণকায় সুন্দরীর ওপর চোখ পড়ার পর থেকে জিভের লালা ঝরছে স্লাইডারের। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিল রোযি, যেন একই চপারে না থাকে লোকটা। কিন্তু ওর প্রার্থনায় বরাবরের মত এবারও সাড়া দেননি স্রষ্টা।
এটা ঠিক যে অনেকের জীবন কেড়ে নিয়েছে রোযি, কিন্তু তারাই তো আগে খুন করতে চেয়েছিল ওকে। সেই কিশোরী বয়সে ধর্ষণ করা হয়েছে, আর সেসময়ে রোযি বুঝে গেছে, পুরুষমানুষ আসলে খুব হিংস্র জানোয়ার। শুধু সুন্দরী বলে ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ত তারা। খাবারের অভাবে একসময় হতে হলো পতিতা। ভোগ করে টাকা দিত কেউ কেউ আবার কেউ চাইত ঠকাতে। আর যারা ঠকাতে চাইত, তাদেরকেই ছুরি মেরে খুন করত ও। ক’জনকে খুন করার পর ধরা পড়ে গেল পুলিশের হাতে। বিচারে মৃত্যুদণ্ড হলো ওর।
রোযির নিটোল ঊরু লোভী চোখে দেখছে স্লাইডার। তার দৃষ্টি গিয়ে থামল পাতলা ব্লাউযের ওপরে ফুটে থাকা স্তনবৃন্তের ওপর। এখানে ধরে এনেছে বলে স্টিলকে খুন করতে চাইছে স্লাইডার। আবার এ-ও ভাবছে: চকোলেটের মত লোভনীয় সুন্দরীকে এই চপারে তুলে খুব ভাল কাজ করেছে ব্যাটা। একবার দ্বীপে নামলে প্রথম সুযোগে রোযিকে ধর্ষণ করবে সে, তারপর হাসতে হাসতে গলা টিপে খুন করবে।
এখনও একনাগাড়ে বকবক করছে বিয়াঞ্চি। ‘শালারা, সব ক’টা তোরা কিন্তু মরবি!’ আঙুল তুলল নাৎসির দিকে। ‘আগে আমার হাতে মরবি তুই, শুয়োরের বাচ্চা! স্রেফ চিবিয়ে খেয়ে নেব তোকে!’
নাৎসি জবাব না দিলেও ইতালিয়ান গাধার কথা শুনে ফিক করে হাসল আমেরিকান ড্রাগ ডিলার ক্লার্ক।
‘হারামির বাচ্চা কেলে শয়তান, তুই ভেবেছিস তোর পেটের কথা আমি বুঝিনি?’ সাপের মত ফোঁস তুলল বিয়াঞ্চি। ‘কুচ করে কেটে নেব তোর কালো নেংটি। তারপর ওটা ভচ করে ভরে দেব তোর কালো পোঁদে! কুত্তার বাচ্চা কোথাকার, শালা, ‘তুই চিনিস আমি আসলে কে?’
‘বুঝলাম, তুই, শালা, সত্যিকারের এক ধলা পোঁদ, ‘ বলল ক্লার্ক, ‘তবে এবার মুখ না বুজলে এক ঘুষিতে তোর নাক ভচকে দেব।’
খপ্ করে মুখ বন্ধ করল বিয়াঞ্চি। সেটা ক্লার্কের কথায় নয়। হঠাৎ করে ডানে বাঁক নিয়ে দক্ষিণ-পুবে চলেছে চপার।
.
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল সিলভি। ‘ধীরে ধীরে যুম করো!’
কন্সোলের সামনে বসে জয়স্টিক ঠেলে দিল টেকনিশিয়ান মিলা। পাম গাছের ইমেজ যুম হতেই দূরে দেখা গেল উড়ে আসছে দুই হেলিকপ্টার। বেজে উঠল ওয়েলকাম টু দ্য জাঙ্গল গানটির কোরাস। দেখিয়ে দেয়া হলো দুই চপারের গ্রাফিক সুপারইমপোজ্ড ইমেজ। এর মাধ্যমে দর্শকদের বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে, শুরু হয়ে গেছে ডার্টি গেম শো। দুই চপার দু’দিকে বাঁক নিয়ে চলে যাওয়ার আগেই স্ক্রিনে বিস্ফোরিত হলো শো-র টাইটেল নেম: ডার্টি গেম শো!
‘ক্যামেরা ফিফটিন আর টোয়েন্টি-টু, আমার চাই স্প্লিট স্ক্রিন,’ নির্দেশ দিল সিলভারম্যান।
এলইডি স্ক্রিনে ফুটল উড়ন্ত দুই চপারের দৃশ্য। লেন্সের ওপর দিয়ে গেল আলফা চপার। ক্যামেরা সেট করা আছে ওয়েদার টাওয়ারের ওপরে। পাম গাছে সেট করা এক ক্যামেরা দেখাল সাদা সৈকতের ওপর দিয়ে উড়ে গেল ব্রাভো চপার।
শ্বাস আটকে দৃশ্য দুটো মন দিয়ে দেখল স্টিল। চলচ্চিত্র ধারণে কোথাও কোন ত্রুটি নেই। ভাল পরিচালক জানে, প্রথম সেকেণ্ড থেকে খপ্ করে ধরতে হবে দর্শকদেরকে। এ- ধরনের শো তৈরির সময় চোখ থাকতে হয় টেকনিশিয়ানদের ওপরে, যাতে সঠিক ক্লিক দেয়া হয় কমপিউটার মাউসে। শুধু তা-ই নয়, যেন ডুবে না যায় শো, সেজন্যে চোখ থাকতে হয় নতুন ব্লগ ও মেসেজের ওপরে। সেজন্যেই বাধ্য না হলে টেকনিকাল ডিরেক্টরের কাজে নাক গলাতে হয় না পরিচালকের। সিলভির ওপর ভরসা ছিল না বলে পণ্ডিতি করতে গিয়ে ফ্লপ করে দিয়েছিল স্টিল তার প্রথম শো। সিলভি ভাল করে জানে কোথায় রাখতে হবে তার ক্যামেরা।
‘দক্ষিণ উপকূলে পৌঁছে গেছে চপার ব্রাভো…
অর্কেস্ট্রার পরিচালকের ভঙ্গিতে আঙুল তুলে স্ক্রিনের বাঁকা এক চাঁদের আকৃতির সৈকত দেখাল সিলভি। পরের সেকেণ্ডে ক্যামেরার ওপর দিয়ে গেল ব্রাভো চপার।
দৃশ্য ধারণে কোথাও কোন ভুল নেই সিলভির।
.
ব্রাভো চপারে বিকট চিৎকার জুড়েছে ইতালিয়ান খুনি বিয়াঞ্চি। কেবলে আটকানো আছে ইয়াসিমানের হ্যাণ্ডকাফ। তাকে চপারের খোলা দরজার দিকে ঠেলে দিল একজন গার্ড। মেয়েটার উরুতে হাত রেখেছে সে। আপত্তি থাকলেও কিছু বলছে না ইয়াসিমান। ইঞ্জিনের আওয়াজের ওপর দিয়ে বলল গার্ড, ‘মুখ খোলো!’
ভয় পেয়ে পেছাতে চাইছে বুঝতে পেরে মেয়েটাকে সামনে ঠেলে দিল দ্বিতীয় গার্ড। ছোট এক চাবি দেখিয়ে চিৎকার করল প্রথম গার্ড, ‘মুখের ভেতরে চাবি নাও!’
হ্যাণ্ডকাফের দিকে চেয়ে সবই বুঝে গেল রোযি। হাঁ মেলতেই মুখের ভেতরে চাবি গুঁজে দিল গার্ড। দু’সারি দাঁতের ফাঁকে চাবিটা ধরল মেয়েটা। দু’হাতে হ্যাণ্ডকাফ। ওভারহেড কেল্ থেকে তাকে খুলে দিল দ্বিতীয় গার্ড। এদিকে রোযির উদ্দেশে ফ্লাইয়িং কিস দিয়ে চপারের দরজা থেকে তাকে নিচে ফেলে দিল প্রথম গার্ড। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে চল্লিশ ফুট নিচে নীল সাগরে পড়ে টুপ করে তলিয়ে গেল রোযি ইয়াসিমান।
.
দৃশ্য ধারণে ব্যস্ত টেকনিকাল ডিরেক্টর সিলভি। মেয়েটা সাগরে ডুবে যাওয়ার আগে তর্জনী ওপরে তুলল সে। ‘ওয়ান সেভেণ্টি-ওয়ান বি!’
মস্ত স্ক্রিনে এল সাগরতলের দৃশ্য। পানির নিচে সরাসরি নেমে চলেছে মেয়েটা। বিশাল তাঁবুর ভেতরে চুপ করে তাকে দেখছে ওরা। আহত সাপের মত শরীর মুচড়ে ওপরে উঠতে চাইছে রোযি। দু’হাত তুলে মুখ থেকে নিতে গিয়ে আরেকটু হলে চাবি ফেলে দিত। ফুরিয়ে এসেছে ওর দম। কাছে এসেও অন্যদিকে গেল তেরো ফুটি এক টাইগার শার্ক।
তাতে খুশি হয়ে হাসল স্টিল। স্রেফ কপালের জোরে ক্যামেরায় ধরা পড়েছে হাঙরের আগমন। তার মনে হলো, এটা স্রষ্টার তরফ থেকে বিশেষ এক উপহার। হয়তো আরও ভাল হতো হাঙরটা হামলা করে বসলে। তবে দুনিয়ায় তো আর সবকিছু পাওয়া যায় না। তা ছাড়া, খেলার শুরুতে সুন্দরী মেয়েটাকে মরতে দেখলে হতাশ হতো দর্শকেরা। রোযিকে যখন ধর্ষণের পর খুন করবে কোন খুনি, তখন সবার মনেই তৈরি হবে চরম রোমাঞ্চ।
ঘুরে এসে রোযিকে দেখে নিয়ে আরেক দিকে গেল টাইগার শার্ক। চাবি দিয়ে গোড়ালির বেড়ির তালা খুলল মেয়েটা। প্রাণপণে পা ছুঁড়ল সাগর-সমতলে উঠে আসতে। স্টিলের মনে হলো, হ্যাণ্ডকাফের তালার ফুটো খুঁজে পায়নি রোযি। দুশ্চিন্তায় গলা শুকিয়ে গেল তার। দুই মেয়ের মধ্যে রোযি বেশি সুন্দরী, এখন খেলা শুরু হওয়ার আগেই সে ডুবে মারা গেলে মস্ত ক্ষতি হবে শো-র!
মেয়েটার দিকে আবারও ঘুরে এল টাইগার শার্ক।
হ্যাণ্ডকাফে আটকে বন্দিদের সাগরে ফেলতে বুদ্ধি দিয়েছে সিম্পসন। এখন সেজন্যে আফসোস হচ্ছে স্টিলের। অবশ্য হাঙরের আক্রমণে মেয়েটার মৃত্যুদৃশ্য দেখতে পেলে অন্যরকম এক অনুভূতি হবে দর্শকদের।
কয়েক সেকেণ্ড পর হ্যাণ্ডকাফের তালা খুলল রোযি। ভারী হাতকড়া নেমে গেল সাগরতলের সাদা বালির ওপরে। বুকের শেষ বাতাসটুকু খরচ করে ভুস্ করে উঠে এল মেয়েটা।
‘ওয়ান সেভেণ্টি-টু এ,’ বলল সিলভি। রোযির কাছ থেকে মাত্র বিশ ফুট দূরে বয়া রেখেছে সে। নিজেই কন্সোলে ঝুঁকে খপ্ করে ধরল জয়স্টিক। ক্যামেরা যুম করে দেখাল রোযির আতঙ্কিত মুখ। বড় করে দম নিচ্ছে মেয়েটা।
দুর্দান্ত দৃশ্য দেখে বড় করে শ্বাস ফেলল সবাই। হাততালি দিল স্টিল। ‘ব্রাভো! সিলভি, তোমার কোন তুলনা নেই!’
স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়ে বলল সিলভারম্যান, ‘কী বললে? আরেকবার বলো তো!’
‘তুমি আসলে দুনিয়ার সেরা!’
‘কথাটা বলার জন্যে অনেক ধন্যবাদ।’ বন্ধুর দিকে চেয়ে হাসল সিলভি। সবসময় নিজের পাতে দই তুলে নেয় স্টিল, মূল্যায়ন করে না অন্যের অবদানের-তাই তার কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া মানেই সেটা বিরাট এক পুরস্কার।
সাঁতরে তীরে উঠল রোযি। তার জানা নেই, অন্তত তিনটে ক্যামেরা ট্র্যাক করছে ওর প্রতিটি নড়াচড়া। তিন ক্যামেরার একটা আছে উঁচু গাছে। আরেকটা আছে বালিতে ডেবে যাওয়া মরা গাছের গুঁড়ির ওপর। তৃতীয়টা আছে সৈকতের কাছে কলাগাছের বনে। রোদে ঝিকমিক করছে সাদা সৈকত। দৃশ্যটা ট্রপিকাল ট্র্যাভেল ব্রাউচার থেকে যেন তুলে আনা। সাগরের নীল-সবুজ ঢেউ এসে মাথা কুটে মরছে সৈকতে। কোথাও নেই কারও পদচিহ্ন। সবুজ কলাগাছের বনে অসংখ্য নারকেল গাছ। এই স্বর্গে এখন শুধু চাই বিলাসী কাউকে, যে কি না হ্যামকে শুয়ে চুমুক দেবে মাই টাই-এর গ্লাসে।
ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে সৈকত পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকল রোযি, খুশি যে এখনও প্রাণে বেঁচে আছে। একবার থেমে চোখ বুজে টানটান করল পিঠ। বুক ভরে টেনে নিল বাতাসের বুনো গুল্মের সুবাস। রওনা হলো আবারও। জঙ্গলে ওকে অনুসরণ করছে ক্যামেরা। মেয়েটার দোদুল্যমান কোমর থেকে ঝাপসা হলো ওয়াইড শট। যে-কেউ ভাববে এটা জ্যামাইকা বা ভার্জিন আইল্যাণ্ডের ট্যুরিযম এজেন্সির বিজ্ঞাপন। রোযির ভেজা ট্যাঙ্ক টপ সেঁটে আছে বুকে। অপরূপ মুখে ক্যামেরা ক্লোযআপ করল সিলভি। রোযি চোখ মেলতেই তাতে প্রতিফলিত হলো সাগরের নীল-সবুজ বিস্তৃতি।
‘দুর্দান্ত সুন্দরী এক মেয়ে,’ স্ক্রিন থেকে চোখ সরাল না রন সিওয়ার্স। তার কথায় মনে মনে সায় দিল তাঁবুর পুরুষেরা। অবশ্য ব্যতিক্রম হচ্ছে সিলভি। টেকনিকাল দিক নিয়ে ভাবছে সে এবার তাকে যেতে হবে নতুন কোন দৃশ্যে।
‘আলফা চপারের কী খবর?’ স্ক্রিনের অসংখ্য ইমেজের দিকে তাকাল সে। সময় নিল না জরুরি দৃশ্য খুঁজে নিতে। দক্ষিণ উপকূলে এক খাঁড়ির ওপরে ভাসছে হেলিকপ্টার।
‘কাট টু টু থার্টি-ফোর।’
মেইন স্ক্রিন থেকে রোযির ক্লোযআপ মুখ বিদায় হতেই সেখানে ফুটল নতুন দৃশ্য। এবারও নিখুঁত হয়েছে সিলভির টাইমিং।। একসেকেণ্ড পর হেলিকপ্টারের দরজা থেকে নিচে পড়ল ভারী একটা দেহ। লোকটা রাশান খুনি-ধর্ষক ম্যানইয়া লোপাতিন। সাগরে পড়ে আলোড়ন তৈরি করল সে। দ্রুত বেড়ি ও হ্যাণ্ডকাফ খুলে উঠে এল সাগর-সমতলে। তিন মিনিট পর পৌঁছে গেল সৈকতে। ওদিকটাতে বোল্ডার থাকলেও ছোট্ট উপসাগর ও সৈকত সত্যিই দেখার মত সুন্দর। সৈকতের এখানে-ওখানে ছোট ছোট ঝোপ।
জার্মান নাৎসির মতই ইংরেজি জানে না লোপাতিন। আলাদাভাবে তাকে ব্রিফ করার সময় সঙ্গে ছিল এক দ্বিভাষী। লোপাতিন এখন জানে কী করতে হবে ওকে। পুব ইউরোপের কনকনে শীত আর বেদম নির্যাতন থেকে উষ্ণ এই দ্বীপে এসে তার মনে হচ্ছে, সে পৌঁছে গেছে চমৎকার এক স্বর্গে।
তারুণ্যে ম্যানইয়া লোপাতিন ছিল দক্ষ কিকবক্সার। বাবা-মা ছিল পরিশ্রমী সৎ মানুষ। তারা কখনও বোঝেনি নিজের ছোট ভাইকে কেন খুন করল লোপাতিন, আর কেনই বা তার মনে জন্মাল না কোন অনুশোচনা। সারা উঠনে খেলে বেড়াত ওরা দু’ভাই। খুন করার পর বাবা-মাকে লোপাতিন বলেছিল, ছোট ভাই ভিকিকে আসলে ব্যথা দিতে চায়নি। যদিও কথাটা ছিল ডাহা মিথ্যা। আবারও কারও ঘাড় ভাঙার তীব্র ইচ্ছে ছিল তার মনে। তাই নিজেও জানে না কবে হয়ে উঠল পাকা এক খুনি ও ধর্ষক। বিশেষ করে মেয়েদের ওপরে হামলা করতে খুব ভাল লাগত তার। মনে হতো যে কাজের কাজ করেছে।
সৈকত পেরিয়ে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল লোপাতিন। লুকিয়ে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। মন চাইছে কাউকে খুন করতে।
খাড়ি ঘুরে সৈকতের দূরে এগিয়ে চলেছে আলফা চপার।
এবার নামবে মেক্সিকান খুনে-ডাকাত আলকারায। চট্ করে দেখল স্ত্রীকে। তার পাশে খোলা দরজার কাছে চেঁচিয়ে উঠল সিম্পসন, ‘তুমি রেডি?’ ছোট্ট প্লাস্টিকের বালতি থেকে নিয়ে চাবি বাড়িয়ে দিল আলকারাযের দিকে।
চাবি নিজের মুখে পুরল মেক্সিকান দস্যু। শেষবারের মত দেখছে ইসাবেলাকে। তার চোখ বলে দিচ্ছে বহু কথা।
‘দেখো, আবারও আমাদের দেখা হবে,’ চোখে অশ্রু নিয়ে বলল ইসাবেলা।
মৃত্যুমুখে পড়ে স্বামীর প্রতি সত্যিকারের ভালবাসা অনুভব করছে মেয়েটা। এই পৃথিবী চরম নিষ্ঠুরতা করেছে ওর প্রতি। তারপর আলকারাযের সঙ্গে পরিচয় হলে বদলে গেল জীবন। অভাব ও নির্যাতন থেকে ওকে রক্ষা করল ওর স্বামী।
অতীতে চেয়ে ইসাবেলা বুঝল, যে ছয় মাস ডাকাতি করতে গিয়ে মানুষ খুন করেছে ওরা, সেই গ্লানি যেন মুছে যাচ্ছে ওদের এই বিচ্ছেদে। মৃতদের মুখ ঝাপসা হয়ে গেছে ওর মন থেকে। আর সেটা খুব স্বস্তিকর। ডাকাতি করার সেই সময়টা ছিল প্রায় ছুটি কাটাবার মত। খারাপটা মুছে গেলেও মনে রয়ে গেছে ভাল লাগার সময়টুকু।
ইসাবেলার কষ্টকর জীবনে যা ভাল, তার মস্ত অংশ জুড়ে আছে স্বামীর সঙ্গে মধুর স্মৃতি। এখন হেলিকপ্টার থেকে ফেলে দিলে হয়তো আর কখনও ফিরে পাবে না মানুষটাকে।
স্মৃতিচারণ করছে আলকারাযও।
মুছে দিতে পারেনি মনের খাতায় লেখা স্মৃতি। ইসাবেলা তার জীবনের প্রথম নারী নয়। যদিও এই প্রতিযোগিতা থেকে রেহাই পেলে ওকেই জীবনের শেষ নারী হিসেবে চাইবে সে। বহু মেয়ের সঙ্গে শুয়ে অন্তত এটা বুঝেছে আলকারায, ওর জীবনে ইসাবেলা আসলে ম্যারি ম্যাগডালেন। যেমন অনুগত, তেমনি কোন খাদ নেই ওর ভালবাসায়।
মানবিক ত্রুটি থাকলেও পরস্পরকে ভালবেসেছে ওরা। ইসাবেলার হাতে যখন রিভলভার তুলে দিল, তখনও কাজটা করতে গিয়ে খারাপ লেগেছিল ওর। তবুও নিজের হাতে শিখিয়ে দিয়েছে কীভাবে গুলি করতে হবে। ইসাবেলা একবারও জানতে চায়নি, কেন শিখতে হবে আগ্নেয়াস্ত্রের চালনা। মানব-হত্যা কখনও ভাল লাগেনি আলকারাযের। দোকানি আর সাক্ষীদের বাধ্য হয়ে খুন করত। ওর মত করেই ভাবত ইসাবেলা। কিন্তু খেয়ে পরে বাঁচার জন্যে ডাকাতি না করে উপায় ছিল না ওদের। অন্তত সেটা নিজের মনকে বোঝাতে চেয়েছে আলকারায, নইলে উধাও হতো রাতে ঘুম।
আর এখন ত্রিশ ঘণ্টার ভেতরে বিস্ফোরিত হবে গোড়ালির শক্তিশালী বোমা। ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে ওর দেহ। এসবে ইসাবেলাকে টেনে এনেছে বলে এখন অনুশোচনা হচ্ছে ওর। বারবার ভাবছে, ক্যাথোলিক ধর্ম অনুযায়ী সত্যিই যদি একবার ওদের দু’জনকে মাফ করে দিতেন মহান ঈশ্বর!
নিজেকে ভুলে বুক ভরে ইসাবেলাকে দেখছে আলকারায। জানে, স্ত্রীকে বাঁচাবার জন্যে জান দিতেও দ্বিধা করবে না সে। ইসাবেলার কোন ক্ষতি হবে, সেটা ভাবতে গেলে…
‘এত ভেবো না, তোমার বউয়ের দেখভাল আমিই করব,’ বাঁকা হাসল প্রাক্তন মেজর শ্যানন।
ইংরেজ সাইকোর দিকে তাকাল আলকারায। ধক করে উঠেছে ওর অন্তর। বুঝে গেছে, কতবড় বিপদেই না ফেলে দিয়েছে ওর ইসাবেলাকে! এই মৃত্যু-খেলার নিয়ম অনুযায়ী একবার দ্বীপে উঠলে শেষ করতে হবে অন্যদেরকে। তাদের ভেতরে আছে এই হারামজাদা ইংরেজ। শেষে যদি বেঁচে থাকে ইসাবেলা আর সে, তখন কী হবে? নিজে তো আলকারায় টোকাও দিতে পারবে না ইসাবেলার গায়ে।
ওর মুখের ওপরে টিটকারির হাসি হাসছে শ্যানন। কিছু বলবে ভেবে মুখ থেকে চাবি বের করবে আলকারায, কিন্তু তার আগেই হেলিকপ্টারের দরজা দিয়ে তাকে সাগরে ফেলে দিল সিম্পসন।
বিবাহিত দু’জনের ওপরে চোখ ছিল রানার। দেখেছে ওদেরকে বিরক্ত করছে শ্যানন। সহজেই বুঝে গেছে ও, স্ত্রীর কথা ভেবে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে গেছে আলকারায। ফলে বিপদ এলে নিজেকে রক্ষা করা কঠিন হবে তার পক্ষে।
নিজে রানা শারীরিক ও মানসিকভাবে ফিট।
ডার্টি গেম শো-তে ওর কঠিন প্রতিপক্ষ হবে শ্যানন।
এ-ছাড়া আছে রাশান দানব ও জার্মান খুনি। প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কম যাবে না তারা।
.
তাঁবুর ভেতরে মস্ত স্ক্রিনে দেখা গেল ব্রাভো চপার থেকে এইমাত্র ফেলে দেয়া হয়েছে স্নাইডারকে। ঝকঝকে সাদা সৈকতের একটু দূরের সাগরে পড়ল সে।
ওখান থেকে সামান্য ব্যবধানে নেমেছে রোযি ইয়াসিমান। এটা যে ভুলবশত করা হয়নি, স্টিলের চেয়ে ভাল আর কেউ জানে না। সৈকতে উঠে মেয়েটাকে খুঁজে নিয়ে ধর্ষণ করার পর খুন করবে নাৎসি। তাতে প্রথম লাশ হবে সুন্দরী মেয়েটা। আর সেটা হলে সঠিকভাবে চলবে ডার্টি গেম শো।
‘এবার মেয়েটাকে খুঁজে নেবে স্নাইডার,’ বলল স্টিল, ‘এরপর পিঠ টানটান করে চেয়ারে বসবে দর্শকেরা।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন