কাজী আনোয়ার হোসেন
আর্টিলারি বাঙ্কারের বিস্ফোরণে ছিটকে পড়ে প্রায় অচেতন হয়ে গেছে শ্যানন ও তানাকা। বুক, পেট ও পায়ে এসে লেগেছে শত শত পাথরের টুকরো ও শাপনেল। আগে কখনও সার্চ করতে যায়নি বলে তারা জানত না, বাঙ্কারে আছে আর্টিলারি শেল।
পাক্কা দুই মিনিট পর সচেতন হলো তারা। মাথার ভেতরে আওয়াজ হচ্ছে ভনভন করে। কানের ভেতরে চিঁইইই শব্দ। হালকা হয়ে গেছে চারপাশের কটুগন্ধী ধোঁয়া। প্রায় একই সময়ে চোখ মেলল শ্যানন ও তানাকা। আর তখনই চট্ করে বুঝে গেল, দশ প্রতিযোগীর ভেতরে তারা রয়ে গেছে মাত্র দু’জন।
সকালের কুয়াশা ভেদ করে পরস্পরকে দেখল তারা। দুই খুনির মাঝে এখন ব্যবধান বড়জোর ত্রিশ ফুট। দুই ছোরা রয়ে গেছে তানাকার হাতে। ওদিকে শ্যাননের কাছ থেকে মাত্র একফুট দূরেই পড়ে আছে ধনুক। তবে তীরের তৃণ আছে কয়েক ফুট ব্যবধানে।
দর্শকেরা এখন নিশ্চয়ই ভাবছে: তূণ থেকে নিয়ে ধনুকে তীর জুড়ে তানাকাকে গেঁথে ফেলতে পারবে শ্যানন, নাকি তার আগেই ছুটে এসে ছোরার ঘায়ে তাকে খুন করবে জাপানি খুনি!
পরস্পরের দিকে চেয়ে পাথুরে মূর্তি হয়ে গেছে শ্যানন ও তানাকা। অপেক্ষা করছে প্রতিপক্ষ কী করবে সেটা দেখার জন্যে।
‘ঠিক আছে, হারামজাদা বেঁটে শালা, এবার দেখি তোর মুরোদ কত,’ পাগলের মত হো-হো করে হেসে উঠল শ্যানন। এই দুর্গ তারই দেশের, তাই এখানেই আচমকা শ্যাননের ওপরে হামলা করবে বলে ভেবেছে তানাকা। কিন্তু সরাসরি আক্রমণে গেলে তার ফলাফল ভাল না-ও হতে পারে। কালো আমেরিকান লোকটার সঙ্গে লড়তে গেলে প্যারাশ্যুট দিয়ে তার মাথা মুড়িয়ে পালিয়ে গিয়েছিল শয়তানটা। আর তার অন্তত দ্বিগুণ বিপজ্জনক এই ইংরেজ শুয়োর। এরই ভেতরে নিজেদের মধ্যে একদফা লড়াই করে দেখেছে তারা, ফলে দু’জনই জানে কেমন হবে শত্রুর প্রতিআক্রমণ। হয়তো স্রেফ গায়ের জোরে তানাকাকে পিটিয়ে মারবে সাদা ইবলিশটা।
এদিকে তীর সংগ্রহ করার ভাবনা আপাতত বাদ করে দিয়েছে শ্যানন, নইলে হয়তো ছুটে এসে ওকে খুন করতে চাইবে জাপানি বাঁদরটা।
আসলে দু’জনই ভাবছে, আগে হামলা করুক প্রতিপক্ষ। শ্যাননের মনের কথা যেন পড়ে নিয়েছে জাপানি খুনি। আগে নড়ে উঠল সে। একই সময়ে হাতে তীর পাওয়ার জন্যে একদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল শ্যানন। কিন্তু সে যথেষ্ট দ্রুত নয়। মাত্র ছয় সেকেণ্ডে একছুটে জঙ্গলে হারিয়ে গেল তানাকা।
‘মর্, শালা, শুয়োরের বাচ্চা কোথাকার!’ তিক্ত সুরে বলল শ্যানন। চট্ করে দেখল গোড়ালির টাইমার–০২:০০:০৪।
জাপানি বাঁদরটাকে খুঁজে নিতে এখনও দুই ঘণ্টা হাতে পাবে শ্যানন। তানাকাকে খুন করতে পারলে সেক্ষেত্রে বিজয়ীর মুকুট উঠবে তার মাথায়।
তূণের ভেতরে সবমিলিয়ে মাত্র তিনটে তীর দেখতে পেল শ্যানন। সাপ্লাই ব্যাগ হাতড়ে বের করে নিল ম্যাচেটি। ওটা দেবে বাড়তি নিরাপত্তা।
.
পচা কাঠের বিমের সেতু পাশ কাটিয়ে গিরিখাদ ধরে তীরবেগে ছুটে চলেছে তানাকা। মনে মনে চাইছে শ্যাননের কাছ থেকে বহু দূরে সরে যেতে। এরই ভেতরে ভেবে দেখেছে, ইংরেজ হারামজাদাকে অ্যাম্বুশ করতে হলে চাই ভাল কোন জায়গা। একবার তার মনে হলো লাফিয়ে নেমে যাবে কি না নদীতে। কিন্তু পাহাড়ি তীর থেকে ওটা প্রায় এক শ’ ফুট নিচে। ওখানে ডাইভ দিলে হয়তো জলমগ্ন কোন পাথরে পড়ে মড়াৎ করে ভেঙে যাবে ঘাড় ও মাথা। সুতরাং ঝুঁকিপূর্ণ কাজটা না করে ছুটে চলল তানাকা
একটু পর দেখতে পেল গিরিখাদের পাশে নদীর তিন ফুট ওপরে নেমে গেছে প্রাচীন এক মোটা ড্রেনেজ পাইপ। ওটার মুখ থেকে রাতের বৃষ্টির জল ঝরঝর করে পড়ছে নদীতে। গতিহাস না করে জায়গাটা পেরিয়ে গেল তানাকা।
এর ঠিক পাঁচ সেকেণ্ড পর মোটা পাইপের অন্ধকার গহ্বর থেকে বেরিয়ে এল কাদামাখা কালো খয়েরি রঙের এক ভূত।
ট্র্যাপডোর খুলে নিচের অন্ধকার চেম্বারে নেমে গিয়েছিল রানা। ক্রল শুরু করে পাঁচ সেকেণ্ডে পৌঁছে গেছে এক ড্রেনেজ পাইপের ভেতরে। এর মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পর বিস্ফোরিত হলো আর্টিলারি বাঙ্কার। গোলা ফেটে যাওয়ায় ভূমিকম্পের মত থরথর করে কাঁপল ভূগর্ভস্থ পাইপ। রানার পায়ের ওপরে এসে পড়ল মাটির বড় সব চাকা ও ভাঙা কংক্রিটের চাপড়া। ধুপ করে পেছনে ধসে গেল পাইপ। পা ছুটিয়ে নিয়ে প্রাণপণে ক্রল করে এগোল রানা। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার, তার ওপরে ধুলো ও ভেজা কাদায় ভরে গেছে ওর দু’চোখ। ক্রল করে এগিয়ে চলল অন্ধের মত। নাকে ভক করে এসে লাগল ইঁদুরের মল ও ছোট সব জানোয়ারের লাশের দুর্গন্ধ। এ-ছাড়া পাইপে আছে পচা শেকড়, শেওলা ও বহু বছরের বদ্ধ বাতাসের কুবাস। চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না বলে খুশিই হলো রানা। ওর দেহের চাপে ভচ করে পিষে গেল মৃত ইঁদুরের দেহ। কুড়মুড় আওয়াজে ভাঙল হাড়। চাপা পড়ে কিচকিচ শব্দ করে উঠছে জীবন্ত গাছ-ইঁদুর। হাতের বাড়ি মেরে কয়েকটাকে সরাল রানা। তার একটা পালিয়ে যাওয়ার আগে কামড়ে দিল ওর কড়ে আঙুলের ডগা।
দূরে শুনতে পেল পানি ঝরে যাওয়ার শব্দ। আরও দশ গজ ক্রল করার পর পৌঁছে গেল পাইপের এক জটিল জংশনে। অন্যান্য পাইপ থেকে এখানে এসে পড়েছে কাদাভরা পানি
জলধারা অনুসরণ করে আরও কিছুক্ষণ ক্রল করার পর পাইপের মুখে সাদা আলো দেখতে পেল রানা। মিনিট দুয়েক পর পাইপের শেষ মাথা থেকে খসে পড়ল নদীতে। প্রথমেই ধুয়ে নিল কাদাভরা চোখদুটো। ওপরে চেয়ে দেখতে পেল গিরিখাদের কিনারা ধরে ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে তানাকা। বারবার ঘাড় কাত করে দেখছে পেছনে। রানার মনে হলো, তাকে ধাওয়া করেছে কেউ না কেউ।
আর সেই লোক রুপার্ট শ্যানন। আর এর অর্থ হচ্ছে ভেঙে গেছে দুই খুনির তৈরি জোট। এটা ভাল সংবাদ রানার জন্যে। শ্যানন আর তানাকা ভাবছে মারা গেছে ও। আর এর ফলে পরবর্তী সময়ে হয়তো পাবে কোন সুবিধে।
পরের আধঘণ্টা তানাকা ও শ্যাননকে এড়িয়ে এগিয়ে চলল রানা। সিলভির অসংখ্য লেন্সের কোন কোনটায় ধরা পড়লেও কন্সোলের স্ক্রিনের দিকে খেয়াল নেই স্টিলের কর্মচারীদের। শেষ দুই প্রতিযোগীকে নিয়ে মেতে আছে তারা। তা ছাড়া, ব্যাটারির সীসা দিয়ে জিপিএস ইউনিট ঘিরে দেয়ায় গ্রিডে ধরা পড়ছে না রানার কোন উপস্থিতি।
.
কেমন এক ঘোরের ভেতরে পড়ে বিশাল তাঁবুর ভেতরে রয়ে গেছে রিটা। সিলভির মতই মনে কষ্ট পেয়েছে সুদর্শন বাঙালি যুবকের মৃত্যু হয়েছে জেনে। রানার সত্যিকার ইতিহাস জানা নেই রিটার, তবে গত আটাশ ঘণ্টায় ওর মনে হয়েছে, মিথ্যা কোন মামলায় ফাঁসিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল রানাকে। অন্য খুনিদের সঙ্গে কোনভাবে মেলানো যায় না মানুষটাকে। তার ছিল আন্তরিক এক সুন্দর নরম হৃদয়। রিটা মনে মনে বারবার চেয়েছে, ওয়েদার টাওয়ারে উঠে ব্র্যাড স্টিলের উন্মাদনাময় শো-র প্রচার যেন বন্ধ করে দেয় সে।
.
হাজারো মাইল দূরে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বিসিআই হেডকোয়ার্টারে কমপিউটার ডিপার্টমেন্টে চুপ করে ডার্টি গেম শো দেখছে ক’জন যুবক ও যুবতী। চরম ক্রোধে থমথম করছে তাদের চেহারা।
প্রাণপ্রিয় মাসুদ ভাইয়ের অকাল মৃত্যুর পর শো-র সাউণ্ড মিউট করে দিয়েছে রায়হান রশিদ। স্ক্রিনে চেয়ে থাকলেও কারও মনে এখন আর কোন উৎসাহ নেই। ঘরে শুধু রয়ে গেছে মাত্র একটা কারণে-প্রতিযোগিতার শেষ দু’জনের মধ্যে যে প্রথম হবে, তাকে খুঁজে বের করে খুন করবে ওরা। এবং দুনিয়ার কোথাও গিয়ে বাঁচতে পারবে না ব্র্যাড স্টিল।
এখন জঙ্গলের ভেতরে তীরবেগে ছুটছে তানাকা। আগের চেয়ে আত্মবিশ্বাসী সে। ভাল করেই জানে, মাত্র কয়েকটা তীর আছে ইংরেজ সাইকোর কাছে। ওগুলো খরচ হয়ে গেলে দূর থেকে আর হামলা করতে পারবে না লোকটা। আর তখন শুরু হবে জাপানি কুং-ফু মাস্টারের দুই ছোরার দুর্দান্ত খেলা।
পরের দৃশ্যে দেখা গেল শ্যাননকে। সে ধরে নিয়েছে তার হাত থেকে বাঁচতে পারবে না তানাকা। তীর মেরে খুন করতে না পারলেও শ্যাননের বেল্টে আছে ম্যাচেটি। কয়েক কোপে নামিয়ে দিতে পারবে সে জাপানি খুনির গর্দান। তা ছাড়া, তার পেশিবহুল দেহে যে প্রচণ্ড শক্তি, সেটা বাড়তি সুবিধা। ছুঁচোর সমান তানাকা হাতাহাতি লড়াইয়ে জিতে যেতে পারবে না।
জঙ্গলে তানাকার পিছু নিয়েছে শ্যানন। এইমাত্র বড় এক বোল্ডার টপকে ঝোপের ভেতরে গিয়ে ঢুকেছে তানাকা। আর সেটা দেখেও ফেলেছে শ্যানন। দৌড়ের গতিহ্রাস করে তৃণ থেকে তীর নিয়ে ধনুকে জুড়ল সে।
এদিকে ছোটার গতি কমাল তানাকা। আশা করছে তীর ছুঁড়ে তৃণ খালি করবে ইংরেজ সাইকো।
ছিলা কানের কাছে টেনে গ্রাফাইটের তীর ছেড়ে দিল শ্যানন। তবে একেবারে শেষ সময়ে একটা গাছের আড়ালে সরে গেল জাপানি দস্যু। গাছের গায়ে ঠক্ করে লেগেছে তীর। আবারও দৌড় শুরু করল তানাকা। বোধহয় ভাবছে আরও তীর খরচ করুক ইংরেজ খুনি। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে. দেখল পেছনে। আবারও তীর ছুঁড়েছে শ্যানন। এবার বড় এক বোল্ডারের ওদিকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল তানাকা। পাথরে লেগে ঠনাৎ আওয়াজে ঠিকরে গেল তীর।
বোল্ডারের ওদিক থেকে উঁকি দিল তানাকা। তৃণের শেষ তীর ধনুকে জুড়ে নিয়েছে শ্যানন। আবারও দৌড় দিল তানাকা। বোধহয় ভাবছে লোভ দেখিয়ে নষ্ট করাবে শেষ তীর। যদিও এবার ঝুঁকির মধ্যে আছে বলে একদম নিখুঁত হতে হবে তার টাইমিং।
জঙ্গলের খোলা এক অংশে বেরিয়ে এল তানাকা। আর তখনই হড়কে গেল তার দু’পা। তাই দেখে ধেয়ে এল ইংরেজ সাইকোপ্যাথ। আবারও উঠে ঝেড়ে দৌড় দিল জাপানি দস্যু। শ্যাননকে দিয়ে বসেছে সহজ টার্গেট।
প্রথম তীর ছুঁড়ে টের পেয়ে গেছে শ্যানন, তাকে নিয়ে ইঁদুর-বিড়াল খেলায় মেতে উঠেছে তানাকা। আত্মবিশ্বাসী হয়ে দ্বিতীয় তীর ছুঁড়েছে শ্যানন। তবে সেটাও যখন লক্ষ্যভেদ করল না, খুব হতাশ হয়েছে সে। বুঝে গেছে, এবার কোনভাবেই নষ্ট করা যাবে না তৃতীয় তীর। এদিকে হঠাৎ করেই ব্রেক কষে থমকে গেছে তানাকা। এখন তার পিঠ শ্যাননের দিকে। কী যেন দেখছে দূরে। এখন তার পিঠে লক্ষ্যভেদ করতে পারবে সাধারণ যে-কোন তীরন্দাজ। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে শেষ তীর ছুঁড়ে দিল শ্যানন।
একই সময়ে মস্ত এক লাফে কয়েকটা ডালের ওদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল তানাকা। অবশ্য এবার তার পাছার আধ ছটাক মাংস ছিঁড়ে নিয়ে দূরের এক গাছে গিয়ে লেগেছে তীর। ক্যামেরা যুম হতেই দেখা গেল, শেষ তীরটা ব্যয় করাতে গিয়ে নিজের রক্ত ঝরাতে হয়েছে তানাকার।
ইংরেজ সাইকোর কাছে এখন আর কোন তীর নেই। মোটা এক ডালে দুলে প্যারালাল বারের জিমন্যাস্টের মত উঠে এল তানাকা। হতাশ চেহারায় ধনুক দূরে ছুঁড়ে ফেলল শ্যানন। বদলে বেল্ট থেকে হাতে তুলে নিল ভয়ঙ্কর-দর্শন ম্যাচেটি।
ওটা দেখে শুকিয়ে গেল তানাকার মুখ। এই অস্ত্রটার কথা মনে ছিল না তার। ডাল ছেড়ে দিয়ে একছুটে গিয়ে ঢুকল সবুজ জঙ্গলে। গায়ের জোর শ্যাননের বেশি হলেও তার চেয়ে অনেক জোরে ছুটে পালিয়ে যেতে পারে তানাকা। মাত্র একমিনিটে হারিয়ে গেল জঙ্গলের গভীরে। একটা গাছের আড়ালে গিয়ে অপেক্ষা করল শত্রুর ওপরে হামলা করার জন্যে। উদ্যত ম্যাচেটি হাতে ধীরপায়ে এগিয়ে চলেছে শ্যানন। তানাকা যে গাছের ওদিকে লুকিয়ে আছে, সেটা না জেনে গাছটা পার হয়ে গেল সে।
নিখুঁতভাবে শত শত লেন্স রেখেছে সিলভি। নতুন দৃশ্যে দেখা গেল পা টিপে টিপে শ্যাননের পিছু নিয়েছে তানাকা, দু’হাতে দুই ক্ষুরধার বোলো নাইফ।
.
কমপিউটার ডিপার্টমেন্টে বসে বিসিআই-এর এজেন্টরা চাইছে, যেন খুব কষ্ট পেয়ে খুন হয় ওদের প্রিয় রানার হত্যাকারী স্যাডিস্ট ইংরেজ সাইকো। ফলে আপাতত মনে মনে তানাকাকে সমর্থন করছে ওরা।
হঠাৎ করে স্ক্রিনে দেখা গেল আরেক গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল মাসুদ রানা!
বিসিআই এজেন্টের প্রচণ্ড এক ঘুষি চোয়ালে লাগতেই পাশের কাদায় ভরা অগভীর ডোবায় ঝপাৎ করে গিয়ে পড়ল তানাকা!
‘আমাদের রানা! ও বেঁচে আছে! ও বেঁচে আছে!’ খুশিতে চেয়ার ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল সোহেল।
গলা ফাটিয়ে হৈ-হৈ করে উঠেছে অন্যরা।
সোহেল ঘুরে দেখল, সোহানার চোখ বেয়ে নেমে এসেছে অশ্রু।
কাদাভরা ডোবায় বিহ্বল হয়ে পড়ে আছে তানাকা। সচেতন হতেই ওপরে তুলল দুটো হাত। মুঠোয় এখনও রয়ে গেছে দুই বোলো নাইফ।
‘ওগুলো ফেলো,’ অগভীর ডোবায় নেমে এল গম্ভীর রানা।
একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে ছোরা চালাল তানাকা। তবে বাহুর রড দিয়ে তার হামলা অনায়াসে ঠেকিয়ে দিল রানা।
এদিকে তানাকা ডোবার ভেতরে পড়তেই থমকে গেছে শ্যানন। ভাবছে, জাপানি শালা খুন হলে তো মহাবিপদ! শত্রু হিসেবে তার চেয়ে ঢের বিপজ্জনক বাঙালি হারামি রানা। তাকে খুন করতে হলে কাজে লাগবে জাপানি বাঁদরের সাহায্য। তা ছাড়া, যেভাবে বেদম মার খাচ্ছে তানাকা, সে-ও বোধহয় মনে মনে চাইছে প্রাক্তন মিত্র এসে সাহায্য করুক।
রানা ও তানাকার দিকে এগোল শ্যানন। মনস্থির করেছে পেছন থেকে ম্যাচেটির কোপে নামিয়ে দেবে রানার গর্দান।
তবে শ্যাননকে চোখের কোণে আগেই দেখেছে রানা। তানাকার মুখে ঘুষি মেরেই চরকির মত ঘুরে গেল ও। রডে ঘেরা দু’বাহু তুলে খটাং শব্দে ঠেকিয়ে দিল শ্যাননের ম্যাচেটির কোপ। একদিকে সরে গিয়ে তৈরি হলো পরের আক্রমণ ঠেকাতে।
এখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে প্রাক্তন মিত্র- তানাকা ও শ্যানন। এদের যে-কোন একজনকে খুন করতে পারবে আশা করছে রানা, তবে তারা একযোগে হামলা করলে নির্ঘাৎ মরতে হবে ওকে।
তানাকা বোধহয় ভাবছে, একটু আগে ওকে তাড়া করেছে শ্যানন। কিন্তু এখন রানার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে হাতের ইশারা করছে লোকটা। তাতে সায় দিয়ে মাথা দোলাল তানাকা। ওদের জানা নেই বিস্ফোরণের পরেও কীভাবে বেঁচে আছে বাঙালি যুবক। জঙ্গলে যেন ভূতের মত এসে হাজির হয়েছে। আর তাতে অন্তরাত্মা কেঁপে গেছে তানাকার। রানা যে একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, তাতে মনে কোন সন্দেহ নেই আর। সুতরাং যত দ্রুত মরবে বাঙালি লোকটা, তানাকার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা তত বেশি বাড়বে।
আবারও তানাকাকে হাতের ইশারা করল শ্যানন।
এবার একই সঙ্গে বোলো নাইফ ও ম্যাচেটি হাতে রানার ওপরে হামলে পড়ল দুই খুনি। নিজে আক্রমণে যেতে না পারলেও তাদের মারাত্মক কয়েকটা আক্রমণ দু’বাহুর রড দিয়ে ঠেকিয়ে দিল রানা। ক্রমেই বাধ্য হচ্ছে পিছিয়ে যেতে। তিক্ত চোখে অন্যায় লড়াই দেখছে বিসিআই এজেন্টরা।
‘রানা, তুই হাল ছাড়িস না,’ দু’মুঠো পাকিয়ে ফিসফিস করে বলল সলীল। ‘কুত্তাগুলোকে হারিয়ে তোকে জিততেই হবে! তুই পারবি!’
চট্ করে একবার বামে তাকাল সোহেল। চুপ করে বসে আছে সোহানা, শুকিয়ে গেছে মুখ।
একটু পর দম নেয়ার জন্যে লড়াইয়ে বিরতি দিল শ্যানন ও তানাকা। তাদের কাছ থেকে দশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে রানা। ধারালো ছোরার পোঁচে কেটে-ছিঁড়ে গেছে দু’বাহু। বাম হাঁটুর নিচে হাড়ে বসে গেছে ম্যাচেটির ফলা। ঝরঝর করে ক্ষত থেকে ঝরছে রক্ত।
‘রানা, আত্মরক্ষা করতে গেলে তুই বাঁচবি না,’ বিড়বিড় করে বলল সোহেল। ছলছল করছে দু’চোখ। ‘তুই আক্রমণে যা!’
নিজেও যেন তারই প্রস্তুতি নিচ্ছে রানা।
শ্যানন ও তানাকা একযোগে এগোতেই দু’দিকে দু’হাত প্রসারিত করে পাল্টা আক্রমণে গেল রানা। ওর ডান বাহুর আঘাতে চিরে গেল শ্যাননের গালের মাংস। তীব্র ব্যথা পেয়ে টলমল করে পিছিয়ে গেল সে। পেছনে উপড়ে পড়া মরা এক গুঁড়িতে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ল। এই সুযোগে রানার বুক-পেটে ছোরা গাঁথতে চেয়েছে তানাকা। তবে রানা পিছিয়ে যাওয়ায় হালকাভাবে ওর পেটে আঁচড় কেটেছে ছোরার ডগা। একই সময়ে বাম বাহুর রড দিয়ে তানাকার ঘাড়ে জোর এক চাপড় বসিয়ে দিয়েছে রানা। ফলে হুড়মুড় করে মাটিতে পড়েছে জাপানি দস্যু।
এদিকে বেকায়দাভাবে পড়ে হতভম্ব হয়ে গেছে শ্যানন। তার সাহায্য পাবে না বুঝেও উঠে দাঁড়িয়ে রানার ওপরে হামলে পড়ল তানাকা। বাহুর রড দিয়ে তার আক্রমণ রানা ঠেকিয়ে দিতেই ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল জাপানি দস্যুর বামহাতের ছোরা। তাতে না পিছিয়ে ডানহাতের ছোরা সরাসরি রানার হৃৎপিণ্ডে ঢোকাতে চাইল সে। তবে খপ্ করে তার বাহু ধরে কবজি মুচড়ে দিয়ে তারই বুকে বোলো নাইফের দীর্ঘ ফলা গেঁথে দিল রানা।
বিস্মিত চোখে ওকে দেখল তানাকা। মুখ দিয়ে ভলকে ভলকে বেরিয়ে এল তাজা লাল রক্ত। হৃৎপিণ্ড ভেদ করে সরাসরি ফুসফুসে ঢুকে গেছে বোলো নাইফের ফলা। ঘড়ঘড় করে শ্বাস নিল তানাকা, তারপর মৃত্যু হওয়ায় টলে পড়ে গেল রানার প্রসারিত দুই হাতের ওপরে।
লাশটা মাটিতে ফেলে শ্যাননের দিকে তাকাল রানা। এখনও উঠে দাঁড়াতে পারেনি ব্রিটিশ দানব। মাটি থেকে একটা বোলো নাইফ তুলে ইংরেজ সাইকোর দিকে চলল রানা।
এই প্রতিযোগিতায় নিজের সত্যিকারের পরিচয় এবার দিল রুপার্ট শ্যানন, উঠে দাঁড়িয়েই ঘুরে ঝেড়ে দৌড় দিল সে।
হৈ-হৈ করে উঠল বিসিআই কমপিউটার ডিপার্টমেন্টের সবাই। এবার বাদ পড়েনি সোহানাও।
.
‘আমি জানি মাসুদ রানাই এই লড়াইয়ে জিতবে!’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সিলভি। ‘ওরই উচিত এই শো-তে, প্ৰথম হওয়া!’
অবাক হয়ে সবাই দেখছে, জঙ্গলে তানাকাকে খতম করে দিয়ে শ্যাননের পিছে ছুটে চলেছে দুর্ধর্ষ বাঙালি যুবক।
পরিস্থিতির পরিবর্তনে বোকা বনে গেছে স্টিল। নিজেকে বলল, আমার তো কখনও ভুল হয় না! তো মাসুদ রানাকে আগে কেন চিনলাম না?
দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষের মতই বিস্মিত হতে ভালবাসে স্টিল, সেটা যদি যায় তার পক্ষে।
শো অদ্ভুত মোড় নেয়ায় জমে উঠেছে ডার্টি গেম শো। মৃত্যুর পরেও রানা দুর্দান্তভাবে প্রতিযোগিতায় ফিরে আসায় চেয়ারে পিঠ সোজা করে বসেছে দর্শকেরা।
ভয়ঙ্কর নৃশংস এক খুনিকে খতম করে আরও বড় এক হত্যাকারীর পিছে ছুটছে রানা।
বাহ্, এ তো দারুণ শো!
রানার যে বায়োগ্রাফি তৈরি করে দিয়েছে স্টিল, তাতে দর্শকেরা ভাববে-প্রতিযোগিতায় প্রথম হতে এবার লড়বে দুর্দান্ত দুই নৃশংস যোদ্ধা। এরচেয়ে উত্তেজনাময় শো দর্শকেরা পেত কোথায়?
‘সাড়ে তিন কোটি দর্শক,’ জানাল সিওয়ার্স।
তার দিকে চেয়ে হাসল স্টিল। আবার চোখ রাখল মস্ত স্ক্রিনে। লেজ তুলে ভাগছে শ্যানন। পিছনে মাসুদ রানা।
‘দেখা যাক আমরা চার কোটি দর্শক পাই কি না,’ খুশিমনে বলল ব্র্যাড স্টিল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন